ক্রমাগত পুড়তে পুড়তে সিগারেটের ছাই লোকটার আঙুল অবধি পৌঁছেছে, তখনই বৃষ্টিপরবর্তী শহরের আধভেজা হাওয়া শেষ ছাইটুকু পেড়ে নিয়ে গেল। টিনের ছাউনি চুইয়ে চাপচাপ জল তখনো গড়িয়ে পড়ছে, শহরের গায়ে ঠান্ডা আমেজ যেন ডিপফ্রিজের হাওয়া, সদ্য খুলেছে কেউ শহরের বুকে, একই সাথে ট্রাফিক ছাড়েনি, আকাশে ছাপছাপ মেঘও লেগে আছে, রাস্তার ওইপাশে ‘মেম-মেম’ ডাকে কয়েকটা ফুলকিশোর-কিশোরী কারো দিকে দৌড়ে যায়। ততক্ষণে ট্রাফিকের কালোগম্বুজ ছাতার নিচে আধভেজা আস্তিনের ইশারায় রাস্তায় জমে থাকা গাড়িগুলো জড়তা ভাঙার তাগিদে দিয়ে নড়েচড়ে একধাপ এগোয়, থেমে যায় আবার চলে। টিনচালার নিচে কয়েকটা (আপাতত) কয়েক বেওয়ারিশ পোটলা, একটা নেড়ি ভয়েভয়ে একবার বৃষ্টি একবার ছাউনির নিচের লোকদের মুখে তাকাচ্ছে, ফেরিওলার হাতে চিরুনি, স্বচ্ছ মোড়কে সাদাসাদা তুলা জড়ানো বাডস, কয়েকটা লাল-নীল-বাদামি পিঠচুলকানি, সাধাসিধা কিছু গা মাজুনি, উকুননাশক ইংলিশ শ্যাম্পু, হাতআয়না- আরো সবজিনিস। পাশের যে লোকটার সিগারেট থেকে এইমাত্র শহরের ভেজা হাওয়ায় ছাই খসেছিলো, উঠে দাঁড়িয়েছে- তারই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কাঞ্চা; একটা সাদা, ঈষৎ ছেঁড়া, অনেক ময়লা বস্তাটা ঘাড়ে তুলতে তুলতে ‘মেম-মেম’ ডাকের দিকে উৎসুক চেয়ে আছে সে। নাভিঅব্দি অসমাপ্ত টিশার্ট আর শর্টপ্যান্টের মধ্যবর্তী অবসরে যতটুকু পেট বের হয়ে আছে তা আবিল, ফাঁপা, ময়লা, বদহজমের; একজিমা বা অন্যকোনো চুলকানিতে খোস উঠছে।
ডানহাতে বস্তার মুঠি ধরে পিঠে ফেলে আনহাতে পেটের দগদগে জায়গায় অলক্ষ্য ময়লা নখ চালাতে চালাতে সে রাস্তার চলিষ্ণু ক্রাউড (যা মাত্রই জ্যাম ছেড়ে গতি পেয়েছে) আড়াআড়ি পাড়ি দিতে থাকে। ক্রমে পুলিশ, ডিভাইডার, একটা সিএনজি,অটো, একটা রিকশার সামনে চাকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কি শ্লেষিল ভঙ্গিতে ওপারে পৌঁছে গেল সে- যেন এভাবেই খুব সাবলীল। সে; এই কাঞ্চা নাম যার কিভাবে তার নাম কাঞ্চা না জানলেও কোনো ক্ষতি ছিলো না, এমনকি যার নাম সেও এই নামের সদর্থ হোক বা প্রেক্ষাপট কিছুই জানে না, বেওয়ারিশ কুকুর যেমন নাম নিয়ে আপত্তি করে না, সেও। তবু যতোদূর আঁচ করি কাঞ্চা সম্ভবত কাঞ্চন এর অপভ্রংশ (যখন তার জন্ম ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ তখন বড় পর্দায় সুপারহিট সিনেমা- দিনে পাঁচ ছয়টা করে শো চলে, শহরের হলগুলা জমাটি টিকিট ব্ল্যাকার, বয়স্ক-অবয়স্ক যুগল, আড্ডাবাজ, কলেজপড়ুয়া, ফিল্মিদর্শক। মোছওলা ইলিয়াস কাঞ্চন নায়িকার সদ্যভেজা পেট ছুঁয়ে দিতে হলজুড়ে শিস-সিটি-সিটথাবড়ানোর ধুম, সেখান থেকেই হয়তো নামটা মেরেছে তার বাপ, হয়তো অর্থ না বুঝেই। সে বাপ এমনকি স্মৃতিতেও আবছা হয়ে কবে মরে গেছে,তার দেয়া নামও ছেঁটে দিয়েছে লোকে- কাঞ্চনফাঞ্চন কিছু না, স্রেফ কাঞ্চা, টিপটপ বাহুল্যবর্জিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ- যার আগেপিছে কিছু নাই- থাকলেও ধার ধারতো না কেউ। সে বার যখন মাদকঅভিযানের নামে বস্তির আধাডজন বাচ্চাধাচের ছেলেকে(তাদের মতে কিশোর অপরাধী) থানায় নিয়ে একরাত বেদম প্যাঁদাচ্ছে পুলিস, তখনও পুলিশের খাতায় তার এই নামটাই ছিলো- নো সার নেম, নিক নেম- স্রেফ আর স্রেফ কাঞ্চা।
কমপ্লেক্সের সামনের জটলা টেনেছিঁড়ে সামনে যেতে যেতে একটা টিশার্ট পড়া যুবক, একজন ছিমহাতা রিকশাওলা, এক বয়স্ক চাচা, একটা ফুলওয়ালি ময়লা ফ্রক পরা মেয়ে, বগলে মাইক হাতে তেলাপোকা-পিঁপড়া মারা চকবিক্রেতা, ক্যানভাসার, আরো কয়েকজন ঠেলে সে পৌঁছোলো যাকে ঘিরে ছোটোখাট একটা জটলা লেগে আছে- কয়েকটা পথশিশু, কি ফুলওয়ালা, বাদাম বিক্রেতা অথবা তৎসম উসকোখুসকো কিশোর কিশোরী কাছাকাছি চেয়ে আছে। হতাশ হয়, কাঞ্চা, নাহ! এই মেম সেই মেম না।
গতবছর গ্রীষ্মেই হবে অথবা বর্ষার গাঁঘেষা দিন, তখন ইটের ভাটায় কাজ করতো কাঞ্চা- রৌদ্রের ছেঁদা তাপে লালচে পোড়া ইট থাকথাক সাজানো দুইসারির মাঝখানে খালি জায়গায় ছাঁচ থেকে প্রসবিত ইট একের পর এক পৃথিবীর মুখ দেখছে- তখনো পর্যন্ত কোনো গন্ডগোল ছিলো না, গ্যাঞ্জাম যখন হয়েছিলো তখন বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল মসে পিছলে গিয়ে চিমনির আগুনে যখন করিমের বাঁহাত কণুই পিঠের প্রায়টা পুড়ে গিয়েছিলো, যে করিম সেই মাসেই প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে কাজ নিয়েছিলো ভাটায়। তখন থেকে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক অমুক-তমুকের আসা-যাওয়া, যারা আগে কোনোদিন আসেনি। এরমধ্যে একদিন এসেছিলো সেই মেম; কি যে একটা কঠিন নাম সে মনে করতেও হোঁচট খায়- তবে সেইদিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে তার। বর্ষার দিন, তবু ফর্সা আকাশ, বাতাসে বৃষ্টির ভাবটা রৌদ্রেরঝাঁজে শুকিয়ে আসছিলো, ভাঁটা শ্রমিকদের আঠালো শরীর কিছুটা সহজ হয়েছে- মঞ্জুরের ভাঁটা; এই ভাঁটার অধিকাংশ শ্রমিকই কিশোর বয়েসের, আরেকটু বেশি হলে সর্বোচ্চ কুঁড়িবিশ- অর্ধেক পারিশ্রমিকে পাওয়া যায় এদের।
যাইহোক, এতোকিছুর মধ্যে মেম এর কথাই আলোচ্য- মাত্র বারদুয়েকই এসেছিলো সে। চৌরাস্তার মোড়ে গার্মেন্টসের দোকানটায় যেসব সাদাসাদা পুতুল, বোঁটাহীন মাইওয়ালা মেয়েমানুষের পুতুল, সন্ধ্যার সোডিয়াম রোডলাইটে যেগুলো আশ্চর্য জীবন্ত আর ত্বক প্রায়টা সোনার মতোন অথবা তার চেয়ে কিছুটা ফ্যাকাসে তাদের মতোই মেম; কাথরিন হ্যাঁ, তাই তো বলেছিলো সে। হিওমান রাইট আরো কি সব বলেছে, যদিও আধো আধো ভাঙা বাংলার সিকিটাও বোঝেনি কেউ। শুধু ফটো তুলেছে- বিভিন্ন পোজে, চিমনির উপর, মাথায় ইট নিয়ে, ছাঁচ দিতে দিতে- আরো কতো! কাঞ্চার গাল ধরে টিপে দিয়েছিলো যখন লজ্জায় চোখ বন্ধ হয়ে গেছিলো, তারপর যাবার সময় একটা রঙের বাক্স দিয়েছিলো, শেষবার দিয়েছিলো একটা ফটোগ্রাফ; কাঞ্চারই ছবি।
তারপর বিস্তর ক্যাচাল হয়ে গেলো। এতো অল্পসময়ে এতোটা পরিবর্তন কখনো দেখেনি সে, এতোটা বিচলিতও করেনি কিছু। একদম স্পষ্ট দাগ হয়ে আছে সেই দিনগুলো, এমনকি সেদিনও যেদিন তার বাপ মরে গেছিলো সেদিনও এতোটা স্পষ্ট মনে পড়ে না। কেননা তার ছিলো লিভারের ব্যারাম, অনেকদিন ধরে বিস্তর ধুঁকে। বমি, রক্তবমি কিছুটা বিরাম আবার বমি পুনশ্চ পুনশ্চ মেঘমেদুরতার মতো মৃত্যুর জানান দিয়ে আসছিলো মরার আগে থেকেই- তাই হতচকিত হবার মতো মৃত্যু ছিলো না, বরং যেন কিছুটা বমির টক গন্ধের অভ্যাস থেকে নিস্তার পাওয়া অথবা সহ্যসীমাবর্হিভূত কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া রুগ্নর প্রতি কিছুটা করুণাবশত স্বস্তিই হয়েছিলো। অথবা মায়ের যাবো যাবো করে বহুদিনের প্রস্তাবপ্রস্তুতির জড়তার ভিতর একদিন ছেড়ে চলে যাওয়া, তাও তেমন ঠেকেনি তার কাছে- কেননা এ আভাসও পেয়েছিলো বাপের ওসুখ থেকেই। বাপ বিছানায় পরার পর ওষুধপাতি তো আছেই সাথে দুজনের খাওয়াদাওয়া (কেননা বাপের খাওয়ার মতো ছিলো না কিছুই, যা খেতো তাই উগড়ে দিতো) বাবদ খরচ, কিংবা-এমনকি মনে হয় বাপের বমিগন্ধওলা হাড়সর্বস্ব শরীরে কাফন-সাবান-লোবানের পয়সাও বাইরে থেকেই এসেছে। অতএব সেই একটা আসা-যাওয়া গোপন ফিসফাস তাও চলে আসছিলো বাপের অসুস্থতার প্রায় পরথেকেই। অতি অস্পষ্ট বয়েসেই বাস্তবতা শিখে নিতে হয়েছিলো কাঞ্চার- মায়ের চলে যাওয়ার আগে থেকেই একটা দূরত্ব একটা অতৃপ্তি একটা অমমতা তার তৈরি হয়ে গেছিলো রক্তসম্পর্কের প্রতি।
দুই
কাটকাট বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, এলজেবরার মতো জটিল। বৃষ্টির জল আধসাদা গেঞ্জি চুইয়ে চুলকানিতে একটা মেনথলের মতো ঠান্ডা ভাব এনে দিয়েছে, তবে তা সাময়িক- কাঞ্চা জানে এইভাবে ভিজালে জিনিসটা চুলকাবো আরো। বস্তিতে ফিরতে ফিরতে দুপুর। ‘তার আগে মহাজনের কাছে গিয়ে প্লাস্টিকগুলা ওজন দিয়া ট্যাকা নেবে’- ভাবে। যদিও ভাব হয় নাই আজকে। মোটরগ্যারাজের পিছনের ডোবাটার পাশে যে জঙপড়া, থেবড়ানো সাইলেন্সারটা সে কয়দিন ধরে নজরে রাখছিলো, ওই রাস্তায় গেলেই একবার করে যে দেখে আসতো, আজকে গ্যারাজ মালিক সেটা হয় ভাঙারির কাছে বেচেছে বা অন্য কেউ ঝেরে দিয়েছে। ফুলভেজা হাফহাতা গেঞ্জিটা কৌশলে মাথা দিয়ে গলিয়ে বগলের নিচ দিয়ে অন্য হাত পর্যন্ত নিয়ে আসে- বস্তার হাত চেঞ্জ করে গেঞ্জিটা পুরো খুলে ফ্যালে। তারপর গোটা শহরের বৃষ্টিটাকে শরীরের ঘায়ে ভেজাতে ভেজাতে খিঁলগাও বস্তিতে হাজির হয় যখন, তখন দুপুর কিনা দুপুরের শেষমেশ বিকাল আকাশে মেঘ থাকায় ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছিলো না।
বস্তার ওজন দিয়ে যে সত্তর টাকা হয়েছিলো তার বেশিটাই জিআই পাইপটার জন্য, যেটা ও রেলঅফিসারের বাসার পিছনের দেয়াল টপকে বাগানের পিছনের ভাঙাচোরার ভিতর থেকে মেরেছিলো, ঘাটাঘাটির সময় কি একটাতে লেগে বুড়া আঙুলের ইঞ্চিখানেক জায়েগা কেটে গেছে, হয়তো মরিচাধরা টিনেই- তাড়াতাড়ি ময়লাআঙুল মুখে দিয়ে ছিপ করে রক্তটুক চুষে নিয়েছিলো, লাল! এখন খাবারের মশলা হাতে লাগতেই জায়গাটা জ্বলতে আরম্ভ করেছে- গায়ে জ্বর, দুপুর থেকেই কিছুটা আবছা গরম লাগছিলো। ভাত খেতে বসে বারবার কাটা জায়গা চাটতে চাটতে সামনের রাস্তায় দেখছিলো কাঞ্চা। বালিবালি বৃষ্টির ভিতর পিছনের বস্তির ভ্যানওলা সুরুজ বৌকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে, হাতে বড়ো ব্যাগটা বউ আঁচলে করে বৃষ্টি থেকে বাঁচাইয়া রাখতেছে- সুরুজের বউ পোয়াতি, তার আরো একটা বাচ্চা আছে, কাঞ্চারই বয়সী।
রাস্তায় জল জমেছে, কন্সট্রাকশনের গাদা করা রাবিশ বৃষ্টিতে ধুয়ে লাল জল রাস্তার ঘোলা জলের ভিতর মিশেছে- তার ভিতর ইউনিফর্ম হাঁটুওব্দি তুলে প্রাইমারি ইস্কুলের মেয়েরা ফিরছে। একটা দুইটা করে সিএনজি, অনেক রিকশার আসা যাওয়ায় নদীর মতো ঢেউ এসে মিশে যাচ্ছে দুপাশের দোকানগুলোর ঢালে। এসব দেখতে দেখতে সে আবার ভাবে, কোথায় তার ভাবনার ভিতর নাচতে দেখে একটা অসুস্থ ময়ূর, সকালের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রোদ, শিশুপার্কের সাদা বিদেশি মোরগ, খরগোশের খাঁচার ভাঙাভাঙা ফুলকপি, ইটের ভাঁটার চুল্লিতে কমলারঙের ইট, মেমের চওড়া মাজায় জিন্স, টাটকা শোল মাছের চোখ, হঠাৎ মাথার উপর টং করে একটা মধ্যাঙ্গুলের টোকায় উফ! করে ওঠে। সামনের জলের গ্লাসটা ঢেলে জল গড়িয়ে যায় টেবিলের বাইরে।
আরেহ দিলি তো- স্যাটার পো!
– দিছি কি এমনে!
টোহা মারলি ক্যা?
– দেখলাম ভাবতাছোস- কি ভাবতাছোস, ভাবতে ভাবতে প্লেটে মাছি পড়তাছিলো
– প্লেটে মাছি পড়তাছিলো, মাছি মারতন, আমারে মারলি ক্যা!
– মাছির তো ভাবনা নাই, এই মারলা তো আবার আইলো, মাইরা মাছি ভাগান গ্যালে কি দোহানে এতো মাছি থাহে?
– হ তোর চ্যাড!
বলে খাবার আধাআধি রেখে উঠে যায় কাঞ্চা, হাত ধোয় না, আঙুলের ফাঁকে তার পাতলা ডালের হলুদ শুকনা প্রলেপ লেগে আছে, পিঠের ভেজা গেঞ্জিটা দিয়ে ক্যাশের টেবিলে একটা জোর বারি মেরে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়, গায়ের রাগ ঝাড়ার ইচ্ছা থাকলেও পারে না। কারন দোকানদার নেই দোকানে, হামজা’রে এক ঘা দিতে গেলে তার চার ঘা খেতে হয়, তারপর আবার সারাদিন বৃষ্টি ভিজে শরীরে জ্বর, গা ব্যাথা হয়ে আছে।
পিছন থেকে হামজা জোরেই বলে- বিল কে দিবো? হালার পো
– বিল কাইল একলগে দিমু, ট্যাকা নাই- যেতে যেতে কাঞ্চা বলে যায়।
তিন
দুপুরের সুষম রৌদ্রের মতো সারারাত টিনের চালে বৃষ্টি ঝরছে, একটা আশ্চর্য সিম্ফনি আছে এর, ইটকংক্রিটের ছাদোয়া ঘরে এই সুর পাওয়া যাবে না, যেন এই আওয়াজেই ঘুম ঘুম চলে আসে- মাথার কাছে একটা কেরোসিনের বাতি পুরোদমে জ্বলছে- এর মানে তেল শেষের দিকে এখন শুধু দইসা পুড়ছে, দইসার মতো জ্বরে জ্বরে পুড়ছে কাঞ্চার সমস্ত শরীর। বিকালে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে যাবার পর মাঝরাতে যখন সে ওঠে শরীরে ছিপছিপ জ্বর, কাঁপুনি আসছিলো- উঠে সে মাথার কাছে কেরোসিন বাতিটা জ্বালে, কিন্তু বাতিতে কেরোসিন প্রায় শেষ। শীতে পুরানো কম্বলটা পাটাতন থেকে নামাতে হবে, উঠতে গিয়ে বুঝলো শরীরের সমস্তটাই শুষে নিয়েছে যেন জ্বর- তবে আশ্চর্য এক জাদুতে পেটের চুলকানিটা যা আগে রাত হলে বেদম জ্বালাতো কমে এসেছে কিছুটা শরীর সম্ভবত আর টের পাবার অবস্থায় নেই, সবকিছু ফুরিয়ে যেতে চাইছে কেরোসিন বাতির মতো। অঝোর বৃষ্টি। চারদিকের টিনের চালগুলো জলের আক্রোশে তারস্বরে ডাকছে। সম্ভবত গলির রাস্তায় জল জমে গেছে, টিন থেকে নিচে বৃষ্টির গড়িয়ে পড়া ছুপছুপ শব্দে বোঝা যাচ্ছে সেই জল যা মূলত ড্রেনের গর্ভ ভরিয়ে উঠেছে, বস্তিতেও ঢুকে গেছে তা। নিশ্চয়ই সাথে অনেক প্লাস্টিক, পলিথিন, শোল-চ্যাং-টাকি, এমনকি একেকটা ময়লাজলের তেলাপিয়াও থাকবে।
কম্বল পাড়তে গিয়ে ভিতর থেকে আবিষ্কার করে সেই ছবিটা- ইট মাথায় দুপুরের রৌদ্রে ফ্লোরোসেন্ট মাখা হাসি, সেইবার মেম তুলেছিলো। তারপর কি জানি তোলপাড় হয়ে গেলো অনেক, এমন অল্প সময়ে এতোটা আকস্মিক ঘোলাটে অবস্থা হয়নি কখনো, কয়েকজন বলেছিলো টিভিতেও নাকি দেখা গেছিলো তারে- একদিন সদলবলে পুলিশ এলো, সে এক ধুন্ধুমার, মালিককে না পেয়ে মালিকের চামচা ইউনুসরে ধরে নিয়ে গেছিলো- তারপর কিসব কেসফেস, ভাটা ছয়মাস বন্ধ- সেইখানে এখন কিসব উঠবে কমপ্লেক্স-টেক্স, সেইখানে বড়বড় দোকানে কাঁচের ঘরে সাজানো থাকবে মেমপুতুলেরা। উঁচুউঁচু বুক, চওড়া পাছা, ভ্রুহীন বিকেলগুলায় সে তাকিয়ে থাকবে, মেম কবে আসবে? অথবা আর আসবে না, যেমন এতোদিনে আসেনি।
বাতির দইসায় আগুন ক্রমস চওড়া হয়ে আসে, অস্পষ্ট আগুনে কালির পরিমাণ বাড়ছে, জ্বর বাড়ছে, কাটা আঙুলটা ফুলেছে যেন গমের খেতের ভিতর হঠাৎ একটা একা গাছে সুপুষ্ট ঢেঁড়স ফলে আছে- বাইরে যেন বিষাদে ভিজতে আকাশে গা মেলেছে রাত- কাঞ্চার সামনে একেকটা, একটা একটা আবছা দৃশ্য ভেসে ওঠে। যেন কিশোরীর চুল কেউ শুকাতে দিয়েছে সুতায়, শৈশবের নাটাই উড়ছে, ঘুড়ি সুতা কেটে ভাসান- নিস্তার নিস্তেজ হয়ে উড়ে যাচ্ছে যেখানে যাবার কথা নয়। আবার হামজাকে ধরে মারছে কেউ, মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। সুরুজ ট্রাকে চাপা পড়েছে, হাসতে হাসতে কোলের শিশুকে রোদ গেলাচ্ছে তার বউ। মাঝেমধ্যে মৃত বাপ ধুমসে গলায় হাত চেপে বমি করছে, বমি গিয়ে পড়েছে মায়ের শাড়িতে, মা রাগ কোরছে, পাশের ঘরে ফিসফাস চলছে- এরমধ্যে দইসা পুড়িয়ে দপ করে কালোধোয়া ছেড়ে কেরোসিন বাতির বাকিটা নিভে গেল, চোখের সামনে তবু রঙিন হয়ে আছে, ময়ূরের পালকের মিশেলঘোলাটে রঙ। ঘরের একমাত্র জানালা যা বহুদিন বন্ধ, খিলের লোহায় জঙ ধরে স্টিফ হয়ে আছে তা খুলে গেলো। জানালা দিয়ে ঘরে চলে এলো পরী; মেম পরি। সেই বা গালের নিচের দিকটায় তিল, থুতনীটা স্পষ্ট ও তেকোনা, কানে একটা চকচকে, কিছুএকটা। জঙ ধরা গজাল সরাতে গিয়ে তার হাতটা কেটে গেছে, বুড়ো আঙুলটা ফুলে গ্যাছে, অসম্ভব রাত্রির অসুস্থতা আঙুলে আঙুলে ভর করে আছে। ভাঙা লোহা, মরচে, টিটেনাস, জ্বর, ডানা ঝাপটে ঝাপটে তীব্র ব্যাথা জানাচ্ছে পরী; মেম পরী। কতোদিন পরে দেখা, মনে হয়েছিলো, বিশ্বাস ছিলো আবার দেখা হবে, সব সমস্যা সব সমাধান নিয়ে আসবে মেম, হাতের ক্যামেরার লেন্সটা বারবার ফ্ল্যাশ করছে। জ্বরে পুড়ছে ঘর, জানালা, গরাদ, জঙ ধরা গজাল, ক্যামেরা, শরীর- দাঁতে দাঁত আটকে গ্যাছে কাঞ্চার, পিঠের শিরদাঁড়া ধনুকের মতো যদ্দূর সম্ভব বেঁকে গিয়ে সব নিস্তেজ হয়ে গ্যাছে, গলা থেকে ভীষণ একটা শব্দ বেরোতে চাইলো, নিস্তব্ধ তারপর। বাইরে শুধু বৃষ্টির সমবেত অর্কেস্ট্রা।