প্রতিনিয়ত যে স্মৃতি আমরা তৈরি করছি, পরবর্তীতে সেগুলো লতাপাতার মতো আঁকড়ে ধরে। পিছনে ফেলে আসা সুখ আর অসুখের সময়গুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তরুণ বয়সে। আমরা যেন আল্লার কাছে দোয়া করি যদি শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম, অন্তত কৈশোরে গেলেও হতো। হায়! বর্তমানও তো একটা সময়ে স্মৃতি হয়ে যাবে ।
আমার শৈশব জুড়ে ছিলো বার্মিংহাম এবং সিলেট শহরের সংমিশ্রণ। দু’জায়গার অনেক স্মৃতিই এখনো জীবন্ত হয়ে আছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো কবিকে জানার বয়স হয়নি তখনো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ, সুকুমার রায়ের পরে বাবাই ছিলেন আমার বা আমাদের ভাই-বোনের চোখে একমাত্র কবি। আমরা জানতাম না কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে বা তাঁর বাবা গণমানুষের কবি দিলওয়ারকে। হিসাবে সাতটা বসন্ত অতিক্রম হয়েছে মাত্র। একদিন বাবার চেহারায় দেখতে পাই বিষণ্ণতা, মন খারাপের ছায়া। খুঁজে বের করি, বাবার বন্ধু ‘কিশওয়ার ভাইয়ের’ মৃত্যু এই বিষাদের কারণ। আমাদের শিশুমনেও এ ছায়াটি পড়েছিলো। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মৃত্যুর এই সময়টা আরো বেশী দাগ ফেলে দেয়, যখন বাবার কাছ থেকে শুনি উনার বৃদ্ধ পিতার কথা। যিনি বার্ধক্যের এই সময়ে এসে এমন শোকে কাতর হয়েছিলেন। যদিওবা বুঝতে পারিনা সবকিছু, তবু দুঃখের বিষয়টা ঠিকই শক্ত তা অনুভব করেছিলাম।
কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার মৃত্যুবরণ করেন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। কয়েক মাস পর এক ঈদুল ফিতরের দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরলে বাবা বলেন, কবি দিলওয়ার তোমাদেরকে তাঁর বাসায় নিয়ে যেতে বলেছেন। স্মরণ নেই, তবে কীভাবে যেন জানতে বা বুঝতে পারি কবি দিলওয়ার বাবার বন্ধু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের পিতা। আমরা আনন্দিত হই- নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আনন্দ অনুভব করি। ছোটবেলা মানুষ ঈদে অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতো ৷ চাচার বাড়ি, ফুফুর বাড়িসহ আরো কতো আত্মীয়ের ঘরে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে সবাই একসাথে থাকায় এই ঘুরতে যাওয়াটা সম্ভব হয়নি। আর ফুফুরা বা অন্যান্য বেশীরভাগ আত্মীয়ের বিলেতবাস এর অন্যতম কারণও। যারজন্য কবি দিলওয়ার বিশেষত বাবার বন্ধু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের বাসায় ঘুরতে যাওয়া আমাদের জন্য ছিলো আলাদা এক ভালো লাগারই ঘটনা।
ঈদের সন্ধ্যায় বাবার গাড়িতে করে আমি, বড়বোন মারহামা, চাচাতো ভাই জাবির এবং ছোটবোন মাইমুনা যখন কবি দিলওয়ারের বাসায় পৌঁছাই। আমাদেরকে এগিয়ে নিতে আসেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের ভাই কামরান ইবনে দিলওয়ার। ঘরে ঢুকে দেখি একজন হাস্যজ্বল, সুন্দর মানুষকে অনেকেই এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ছবি তুলছেন। তখনই প্রথম মনের মধ্যে উঁকি দেয়, উনি সাধারণ কেউ নয় অবশ্যই, বিখ্যাত কেউ হবেন। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন, কিশওয়ার ভাইয়ের বাবা কবি দিলওয়ার বলে। আমরা সোফায় বসে থাকি। বাবা পরিচিত কয়েকজনের সাথে আলাপ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে অনেকেই চলে গেলে সেই বিখ্যাত হাস্যজ্বল মানুষ কবি দিলওয়ার এসে বাবাকে বলেন, আইজ তোমার লগে কোনো মাত নায়। আমি আমার নাতিনোশার লগে আড্ডা দিমু।
আমরা অবাক হই, আমাদের বাবার মতো তাঁরও লেখা বই আছে, তিনিও কবি। যেন এই পরিচয়টা আরো গভীরে ভালোবাসা তৈরি করে ফেলে। আমাদের ঘর ছাড়া তখনো এতো বই, অগোছালো বইয়ের বিশালতা আর কোথাও দেখিনি। ফিরে এসে আম্মুকে বলেছিলাম, শুধু আমাদের ঘর না, কিশওয়ার চাচ্চুদের ঘরও এমন বইয়ে অগোছালো থাকে।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই নতুন পরিচয়ের লাজ ভাঙতে শুরু করে, কবি দিলওয়ার এতোটা সারাল্য নিয়ে আলাপ জমিয়ে ছিলেন মনে হলো এই ঘর আমাদের, এই মানুষ আমাদের অনেক অনেক দিনের আপন। আমরা খুব সহজেই কবি দিলওয়ারের কোলে-কাঁধে চড়ে বসি। কখনো মনে হয়নি সময়ের বিখ্যাত একজন, যেন প্রতিদিন দেখা বিকেলে বারান্দায় বসে থাকেন আমার দাদাভাই কিংবা বইয়ের ভিতর থেকে বারবার চোখ তুলে তাকানো নানাভাই এই মানুষটি। আমাদের আঙুল ধরে ধরে পুরো বাড়ি ঘুরেন, ছড়ানো বইয়ের স্তুপ থেকে নিজের বই বের করে দেখান। আমরা অবাক হই, আমাদের বাবার মতো তাঁরও লেখা বই আছে, তিনিও কবি। যেন এই পরিচয়টা আরো গভীরে ভালোবাসা তৈরি করে ফেলে। আমাদের ঘর ছাড়া তখনো এতো বই, অগোছালো বইয়ের বিশালতা আর কোথাও দেখিনি। ফিরে এসে আম্মুকে বলেছিলাম, শুধু আমাদের ঘর না, কিশওয়ার চাচ্চুদের ঘরও এমন বইয়ে অগোছালো থাকে।
২.
কবি দিলওয়ারের বাসা ছিলো সুরমা পাড়ের এলাকা ভার্তখলার খাঁন মঞ্জিলে। সুরমা নদীর নাম আমার মনে গেঁথে যায় কোন বয়সে মনে পড়ছে না। তবে মনে আছে বাবার গানে-কবিতায় দেখতাম সুরমা নদীর কথা– ‘তুমি আসমানেরও চান্দ/আমি সুরমা নদীর নাইয়া/একবার যদি দিতায় দেখা/চান্নিঘাটো আইয়া’। তখনো সুরমা নদী আমার অনুভবে থাকলেও মূলত ছিলো কল্পনার এক নদীর মতো, যেমন হুমায়ুন আহমদের বিখ্যাত চরিত্র হিমুর কল্পনায় থাকে এক ময়ূরক্ষী নদ। বর্ষায় কখনো এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের পাশের খালকে ভেবেছি সুরমা নদী, আবার মাঝেমধ্যে মনে হতো টিবি গেইটের খাল মনে হয় গানে পাওয়া আমার সুরমা নদী।
আড্ডায়, আনন্দে সন্ধ্যা শেষে অনেকটা রাতে আমরা কবি দিলওয়ারের বাসা থেকে বের হই। সিলেট শহরে আসার সময় এক দীর্ঘ নদীর উপর বাবা গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের জিজ্ঞাস করলেন, এই নদীর নাম কী? আমার কাছে তখন শুধু একটা নদীর নামই ছিলো, যা এতোকাল থেকে আমি খুঁজছিলাম। আমি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই দারুণ অনিশ্চয়তাসহ বলি সুরমা নদী। বাবা সাথেসাথে পকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে আমাকে উপহারা দেন। আমি শৈশবের সেই বিস্মিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি সুরমার জলের দিকে। যেন এ এক অদ্ভুত রহস্য উন্মোচিত হয়েছিলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাবা যখন নতুন ব্রিজের উপর থেকে নামছিলেন, আমার মন তখনো আনন্দে সুরমার মাঝে আটকে থাকে।
আমার কল্পনায় যে নদী এতোদিন লালিতপালিত হচ্ছে- তার সাথে প্রথম পরিচয়ের, নাকি একজন কবি দিলওয়ারের স্নেহপূর্ণ ভালোবাসার সময় নাকি বাবার হাত থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত পাঁচ টাকা পাওয়ার আনন্দ বেশী ছিলো আজ আর মনে পড়ছে না। তবে সুরমা নদীর সাথে কবি দিলওয়ারের সম্পর্ক অনুভব করি এখনো, যখন আমি চান্নিঘাটে যাই, ক্বিনব্রীজের নীচে আড্ডা দেই। মনে হয় ওপারে গেলেই পাবো কবি দিলওয়ারকে, বাবার বন্ধু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে। আর নদীর বুকের দিকে তাকালে হুহু করে ওঠে হৃদয়, হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সময়কে ধরে রাখার দায়ে যেন সুরমা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রেমের উত্তাপে।