১
যেসব শীতের কুয়াশায় প্রিন্ট করা ভোরবেলা হুইসেল কানে এলেও বিরক্তির উদ্রেক হয়, এমন ঘুমোপযোগী ভোরবেলা টেলিফোনে তাগাদা পেয়ে জিপ নিয়ে মেয়রের শালার বাড়িতে ছুটছেন ওসি শহীদুল। তড়িঘড়ি ইন ভুল করা প্যান্টের ওয়েস্ট লুপ থেকে স্যান্ডোগেঞ্জির কানা বের হয়ে আছে। খাপের পিস্তল বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে, বহুদিন এর কোনো ব্যবহার নেই তবু বের হলেই খামাখা এই উৎপাতটাকে সাথে নিয়ে বের হতে হয়। এমনিতেই গাউটের ব্যাথায় মাজা-কোমড় থিতু মেরে থাকে এরমধ্যে এই আরেকটা বাড়তি ওজন, পুলিশের ইউনিফর্মটা বিলোপ করে পোশাকের স্বাধীনতা দেয়া দরকার। অন্তত ইন-ফিন তো উঠিয়ে দেয়া যেতে পারে, শহীদুল সাহেবের এই মত। চাকরির প্রথমদিকে বেশ লাগতো- ইউনিফর্ম, ইন করা প্যান্টের লুপে বেল্ট, চামড়ার খাপে অস্ত্রটা ভরলেই শরীরে একটা আলাদা উত্তেজনা হোতো। যেন তাপমাত্রা বেড়ে গ্যাছে দুই ডিগ্রি। এখন আর সেই উপযোগ নেই- তবে কিছুটা তো আছেই হাতে একটা লোডেড পিস্তল থাকলে আর অন্যের সামনে তা নাচিয়ে নাচিয়ে দ্যাখানো গেলে পুরুষের শান বেড়ে যায়।
‘ধুরো! এই বেইন্নাকালে- মেয়রের শালাবউয়ের কি ওলাওঠা হইছে’, বিরক্তির সাথে বলেন শহীদুল। ওলাওঠা না হলেও কাহিনী নেপথ্যে একটা আছে। মেয়রের শালার একটিমাত্র মেয়ে। সকালবেলা একটা কুকুর কিভাবে যেন দেয়াল ডিঙিয়ে বাড়ির বাগানে ঢুকে তাকে কামড়েছে। শুধু তাই না, ধরতে যাওয়াও মন্ত্রীর শালা বউকেও আঁচড়ে দিয়েছে। কুকুরটা এখনো বাড়ির বাগানে, ভয়ে বাড়ির লোকজন কুকুরটার ধারে কাছে যাচ্ছে না, বাড়ির বাইরেও বের হচ্ছে না। একধরনের গৃহবন্দী অবস্থায় আছে বলে জানা গেছে। তাই সকাল সকাল মেয়রের তলব, যেন তৎক্ষনাৎ ফোন পেয়ে ওসি তার শালার বাড়ি গিয়ে অহেতুক উৎপাত থেকে রেহাই করে। এতেই ইতি না- এই কুকুর কার? তদারক করে কুকুর মালিকের নামে মামলা ও উপযুক্ত সাজা কার্যকর হতে দেখতে চান তিনি।
‘শালার পুত! কুকুর কামড়াইছে ডাক্তারের কাছে যাও, ইনজেকশন লাগাও, একটাতে না হয় গুষ্টি সুদ্ধা সবাইরে ধইরা ধইরা পাছায় ইনজেকশন ভইরা দাও, মেয়রের শালার, শালাবউর, লাগলে মেয়রের সুন্দরী বউডারেও দুইটা হান্দাইয়া দাও- দমকল ডাকো- পুলিশ ক্যান? পুলিশের চাকরী কি নাকি কুত্তা ধাবড়াইতে লইছি! …মারানির পোলা!’ শহীদুল সাহেব বরিশালের লোক রাগ হলেই তার আঞ্চলিক পরিচয় তার গালাগালিতে ফুটে ওঠে। পাশে বসে কনস্টেবল জাফর ঝিমায়, মাঝেমধ্যে ওসির কথায় জোর দিতে হুঁ, হুঁ করে, শহীদুল সাহেবের নির্দেশ। ‘কথায় হ্যাঁবোধক তাল না দিলে আসলে গুরুত্ব থাকে না- লাখ টাকা দামের কথাও দুই পয়সার মনে হয়’। ওসি শহীদুলের ফিলোসোফিনামার অনেকগুলো বয়ানের মধ্যে এটা একটা।
‘কুকুর তো ধরতে যাচ্ছি তা বন্দুক পিস্তল ছাড়া তো সাথে কিছু নাই, কি নেয়া যায় কও দেহি?’
কনস্টেবল- হুঁ
‘কুকুর তো আবার গুলি করে মারা যাবে না, মেয়রের নির্দেশ মালিক খুঁজে শাস্তি কার্যকর করতে হবে- না মেরে কিভাবে ধরা যায়? আর কুকুর তো যে সে কুকুর মনে হয় না, পুরা একটা বাড়িসুদ্ধা লোকেরে লাড়াইয়া দিছে যখন… ধরতে কি নেওয়া যায়?’
কনস্টেবল – হুঁ
‘তাছাড়া কামড়াইলে এই সকালে ডাক্তার কি পাওয়া যাবে? কুকুরের আবার জলাতঙ্ক-টঙ্ক আছে কিনা কে জানে? কি করা যায়? কি নেয়া যায়? এবারও কনস্টেবলকে উদ্দ্যেশ্য করেই বলে সে।
কনস্টেবল – হুঁ
নিজের আঞ্চলিক খাস বাংলায় একটা কুবাক্য বের হয়ে আসে জনাব শহীদুল অফিসার ইন চার্জের মুখ দিয়ে। ঝাড়ি শুনে হুঁশ ফিরে সোজা হয়ে বসে কনস্টেবল।
– জ্বী ছার, জ্বী! খালি কমান্ড করেন, কি করতে হবে-বান্দা হাজির যেকোনো খেদমতে।মাথাব্যাথা করতেছে? টিপা দেবো?
‘ব্যাটা হারামী এতোক্ষণ ঘুমাইতে ছিলি তুই! সরকারী বেতন খাইয়া খাইয়া প্যাটটারে ব্যারেল বানাইছো অলরেডি। সারাদিন নাকে তেল দিয়া ঘুমাও সব কয়টা? তোমার নানার কি তেলের দোকান আছে? এতো ত্যাল কই পাও এক একজন?’
– জ্বী ছার, না ছার- আসলে কাল রাইতে বউয়ের সাথে ঝগড়া হইছে- শালায় বিয়ায় সে ফ্রিজ দিতে চায়। ওদিকে আমার নিজের বোনের বিয়ায় ই আমি কোনো সোনার জিনিস দিতে পারি নাই। দিছিলাম একটা টিভি, এখন শালার বিয়ার ফ্রিজ দিলে লোকে কুৎসা করবে না? সারারাইত এই নিয়া ঝগড়া হইছে, ঘুমাইতে পারি নাই ছার?
একটা জোরেসোরে ধাপার দিয়ে ওঠে ওসি শহীদুল, ‘টিভি, ফ্রিজ, বটে! কয় টাকা বেতন পাও তুমি? এইসব কইত্থেকে আসে? ঘুষের ট্যাকায় খাওয়া মায়ের সাথে বিবাহ করা সমান- হাদিস পড়ো নাই! ব্যাটা অশিক্ষিত!’
এর বেশি এগোন না শহীদুল। বউয়ের প্যানপ্যানানি তিনিও শোনেন। তাছাড়া গতমাসে মেয়ের বিয়েতে নতুন মেয়েজামাইকে যে দেড় কোটি টাকার ফ্ল্যাটটা উপহার দিয়েছেন তাও সর্বজনবিদিত, কিন্তু গোপনীয়। কনস্টেবল এতোক্ষণে কিছুটা সামলে নিয়েছে। তার মাথা এতোক্ষণে খুলতে আরম্ভ করেছে। তার মাথার চাবি সবসময় নিজের কাছেই থাকে, তাই যেকোনো সময় ইচ্ছামতো খুলতে পারে। বুদ্ধির দৌড়ে সে খুব সহজেই ওসি শহীদুলকে টেক্কা দেয়। নেহাত দুইটা পাশ বেশি দিয়েছে বলে আজকে সে ওই চেয়ারে। আর তাছাড়া একটা গুজব আছে শহীদুলের চাকরির সময় তার দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয় মন্ত্রনালয়ে কেরানি না কোন পোস্টে ছিলেন- মন্ত্রীর হাগাচাটা লোক। শহীদুলের বাপ যিনি গুজবমতে ইপিজেড এর নিচে মূলত ফুঁ দিয়ে লোকের কাছে হাত পাততেন (অপ্রিয় লোকেরা বলে খয়রাত), তার জমানো ঘুষের টাকা হাগাচাটা কেরানির থ্রু মন্ত্রীর পকেট পর্যন্ত গিয়েছিলো। নইলে কনস্টেবল হয়েও বুদ্ধির দৌড়ে অংশ নিলে জাফর যে রেসে ঘোড়া, সেই রেসে শহীদুল ছাগলের মেডেলও পাবে না। তা শহীদুলও জানেন, তাই সবসময় কনস্টেবল জাফরকে সাথে সাথে রাখেন শহীদুল।
কনস্টেবল- ছার, কুকুর কোন জাতের তো জানি না, তবে ওইটা সম্ভ্রান্ত এলাকা, নিয়মিত পৌরসভা ওই এলাকায় কুকুর মারে। নেড়ী কুত্তা ওই এলাকায় নাই, যা আছে সবই পোষা। তাই কাজটা শিক্ষিত কুত্তারই মনে হয়। দ্যাখেন কার বাড়ির শিকল খুলে পালাইছে। আমরা একটা শিকল কিনা নিয়া যাই। কুত্তারে ঘুষ আইমিন বাগে আনতে খাবার নেয়া যাইতে পারে, খাবারে ঘুমের ওষুধ মিলাইয়া…’
বাহ বেশ, আইডিয়া মন্দ না- এইজন্য জাফরকে পছন্দ করেন শহীদুল সাহেব।
‘কি নেয়া যায়? চকলেট? ক্যাডবেরি-ফেরি নেয়া যাইতে পারে? বিদেশি কুত্তা যেহেতু আরো শিক্ষিত সেই হিসাবে আরো দামী কিছু…?’
কনস্টেবল- স্যার চকলেটে ওষুধ মিলাবো ক্যামনে? ওতে তো ইনজেকশন মিলাইতে হবে? ইনজেকশন মুখে খাইলে কি কুকুর ঘুমাবে?
শহীদুল সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন, ইনজেকশন মুখে খেলে কাজ করে কিনা তা তিনি জানেন না, এদিকে উত্তর না দিতে পারলেও সম্মানটা কমে যায় কনস্টেবলের কাছে।
‘কাজ হবে হয়তো- কিন্তু ব্যাপারটা হইছে তাতে ডায়রিয়া হইয়া যাবে, শেষে থানায় নিতে গাড়ি নষ্ট করবে, দ্যাখা গেলো কোনো বড়লোকের কুকুর, শেষে পয়জনিং এর কেস- ওই এলাকা তো ভিআইপি জোন।
২
পুলিশের গাড়ি থামলো একটা দোকানের সামনে, দোকানদার সম্ভবত কিছুটা ভীত। ‘সকাল সকাল পুলিশের জিপ দোকানের সামনে! গোপন মালের ব্যবসা টের পাইয়া গ্যালো নি?’ তাড়াতাড়ি দোকানের সামনে এসে ‘সালাম স্যার, কি দেবো স্যার, বলেই এক প্যাকেট বেনসন এগিয়ে, চলে স্যার?’
শহীদুল সালামের উত্তরে হু করেন শুধু। প্যাকেটটা নিয়ে বুক পকেটে রেখে দিলেন, এখন ধূমপান করার মুড নেই। মুড হলে খাবেন। তিনি ধূমপায়ী কিন্তু সকালের বিশুদ্ধ বাতাসে ধূমপান করাকে বিশেষ অপছন্দ করেন। যারা সকালের বাতাসটা ধূমপান করে নষ্ট করেন তাদেরকেও অপছন্দ করেন। সকালবেলা পরিবেশ আন্দোলনকারীগুলা কই যায়? তিনি মন্ত্রী হলে আইন করে সকালবেলা বিড়ি খাওয়া নিষিদ্ধ করতেন। যেগুলো সকালে বিড়ি খেয়ে পরিবেশ নষ্ট করবে প্রত্যেকটাকে গারদে ঢুকিয়ে এক লাছা গরম ডিম থেরাপি দেয়া হতো। সকালটা হচ্ছে এমন সময় যখন আল্লাহ নাকি জান্নাতের দরজা খুলে দেন পৃথিবীর দিকে- এইসময় নেশাদ্রব্য দিয়ে হাওয়ার হোলি ফ্লেভারটাকে হেল করে দেয় শালারা!
শহীদুল সাহেব, ‘আচ্ছা কুকুর কি খায় বলো তো?’
দোকানদার ভ্যাবাচেকা খেয়ে গ্যাছে, ‘ইয়ে মানে কুকুর তো সব খায় স্যার’।
কনস্টেবল একটা ধাপার দিয়ে, ‘ধুরো কি বলেন আপনি! কুকুর কি ছাগল নাকি, যে সব খাবে? ছাগল হইলে কথা ছিলো। গাছ, পাতা থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এমনকি কাগজ প্লাস্টিকের ঠোঙ্গা সব চিবায় ছাগলে- শোনেন নাই কথায় বলে ছাগলে কিনা খায়, কুকুরে কিনা খায় শুনছেন কোনোকালে?’
দোকানদার এই অপ্রস্তুত আলোচনায় বোকাচ হয়ে গ্যালো। মুখটা সেইরকম করেই চেয়ে রইলো। পলিথিন প্যাকেটে পাউরুটি দেখিয়ে জাফর বললো, ‘ওই যে পাউরুটি, পাউরুটি দেন দেখি কয়ডা’
দোকানদার- কলাও দিই স্যার? সকালবেলা কলা-পাউরুটি…
জাফর- হু, ঘি আর মাখন ও লাগাইয়া দেও- শালা বোকাচু (ওসির সামনে এভাবেই কনট্রাকশন ফর্মে গালি দেয় জাফর) এটা তার প্রতি জাফরের রেসপেক্ট বলা যায়।
পাউরুটি হাতে দেখতেই রাস্তার একদল নেড়ীকুকুর সামনে এসে হাতপাখার মতো লেজ নাড়তে থাকে। কয়েকটুকরা ছিঁড়ে দিতে দিতে ওসির দিকে তাকায় জাফর। ওসি শহীদুল তার বুদ্ধি দেখে প্রতিবারের মতো যথারীতি খুশী হন, কিন্তু মুগ্ধতা মুখে প্রকাশ করেন না।
আরো এক প্যাকেট পাউরুটি নিয়ে এবার দাম দিতে যান শহীদুল। ‘কি করেন স্যার, লাগবো না। আপনি তো আমাগোই লোক, দোকান নিজের ভাবেন’।
ওসি রুটির দাম দিতে দিতে, ‘উঁহু আমি ঐ ধরনের লোক না, আমরা উর্দিওয়ালারা পোশাকের সম্মান দিতে জানি- পিঠপিছে পাবলিক উইদাউট কারন পুলিশের দুর্নাম করো, সরকারের উপর রাগ এরা পুলিশের উপর ঝাড়ে। কেউ বলুক এতো বছরের চাকরিতে কারো কাছ থিকা জুলুম কইরা চারপয়সা নিছি- তোমরা হুদাই আমাগো দুর্নাম করো পিছন পিছন! দোকানদার দেবী কালীর মতোন দাতে জিভ কাটে। পাউরুটির দামটা চুকিয়ে দিলেন ওসি, কিন্তু সিগারেটের না, ওটাকে তিনি হাদিয়া মনে করেন। সিগারেট ক্ষতিকারক জিনিস, সেটা বেচে লাভ করো ব্যাটারা! ভাগ দিবি না?
এইবার ফার্মেসীতে ঢু মারে পুলিশের গাড়ি। সকালবেলা অযথা পুলিশের গাড়ির হর্নে কিছুটা বিরক্ত ফার্মেসীওয়ালা, যদিও সে সমীহ দেখায়- ‘স্যার কি দরকার?’
‘ঘুমের ওষুধ কড়া ডোজের’
-প্রেসক্রিপশন এনেছেন স্যার? কোনটা?
প্রেসক্রিপশন কিসের? কুকুরের ঘুমের ওষুধের জন্য প্রেসক্রিপশন, ভাবতেও বোকা বোকা লাগে, শুনলেও হয়তো লোকে হাসবে। চেপে যান অফিসার, ‘না আনিনি- যেকোনো একটা দিয়ে দেন, একটু কড়া দিয়েন।
– স্যার প্রেসক্রিপশন ছাড়া তো নিয়ম নাই।
পাশ থেকে জাফর, পুলিশের সাথে আবার নিয়ম কি মিয়া ভাই?
-তাও ঠিক, তবে স্যার চাইছেন বলে দিচ্ছি, আবার সমস্যা না হয়।
– কোনো সমস্যা নাই, স্যার যেখানে আছেন কিসের সমস্যা? স্যার কি কম শিক্ষিত নাকি? ডাক্তারিটা না হয় করেন নাই- স্যারের ও তো টুকিটাকি… তাছাড়া ওনার দাদা বড়ো কবিরাজ ছিলেন, বড়োই কামেল লোক, নামডাক ছিলো চারমুলুকে।
শহীদুল মনে মনে আবার তারিফ করে জাফরের।
হ্যাঁ তাতো ঠিকই, বলে ফার্মেসীওয়ালা। একটা বাদামী প্যাকেটে ভরে ওষুধগুলো পিন আপ করে আটকে দেয়।
ওসি- আচ্ছা ওষুধ কি পাউরুটিতে দিয়ে খাওয়া যাবে?
– যাবে যাবে, যেকোনো রুটিতে খাওয়া যাবে।
কনস্টেবল একটু দূরে, পান মুখে দিয়ে বন্দুকের নলটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রঙ তুলতে তুলতে পানওয়ালার সাথে কি একটা বলছে দেখে। এইফাঁকে শহীদুল আবার ফার্মেসির দিকে ঘেঁষে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ইনজেকশন কি সিরিঞ্জে পুশ না করে খেলে কাজ হয়?
ফার্মেসীওয়ালা মশকারা কিনা বুঝতে না পেয়ে হাসার মতো করে একটু মুখের কিনারা বাঁকা করলো। এ ধরনের হাসি দিয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বুঝায় না। সম্ভবত এই হাসিকেই সাহিত্যিকরা রহস্যজনক হাসি নাম দিয়েছেন।
এরপর কেনা হলো কুকুর বাঁধার দুটা শিকল, একটা দড়ি। অফিসার কয়েকবার নিজেই ট্রায়াল দিয়ে দেখলেন টেকসই কিনা, কোনোদিকে স্লিপ করার সম্ভাবনা কি আছে? জাফর বিচক্ষণ লোক, সে সাব্যস্ত করলো ঠিক আছে, পারফেক্ট! কোনোরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নন ওসি শহীদুল। এই শীতের সময় ভুলচুক হয়ে গেলে কতোগুলো ইনজেকশন নিতে হবে, সুঁই দেখলেই বেঁহুশ হবার অবস্থা হয় তার। ছেলেবেলায় তাকে ইনজেকশন দিতে আসায় এক ডাক্তারকে ঘুষি দিয়ে চোখ কালো করে দিয়েছিলেন। তখন তিনি নেহাতই ভীতু ছিলেন। কখনোই ভাবেন নি পুলিশ হবার, চোরবাটপার ছিনতাইকারী ধরার কথা। নেহাত ভাগ্যদোষে এই পেশায় এসেছেন। যদিও অস্ত্র কোমড়ে নেবার সাথে সাথে তার ভাব বদলে গেছে, হাতে রিভলবার টা থাকলে সামনের সবাইকে প্রজা আর নিজেকে মহারাজ মনে হয়।
৩
যে গরমে তা দেয়া ছাড়াই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়, তেমন ভ্যাপসা গরমের দুপুর। থানায় তার নিজস্ব ডিজাইনে গদি করা চেয়ারে ম্যাদা মেরে বসে আছেন ওসি শহীদুল। রুম থেকে বের হয়ে ডানে করিডোর, গারদের গায়ে দুই দিকে দুটো শিকল দিয়ে একটা কুকুর বাঁধা। কালো কুচকুচে, গলায় একটা কালো ল্যাশের ছেঁড়া অংশ, শরীর মাঝারি গড়নের তবে পেশিবহুল মেদহীন শরীর। দেখে ল্যাব্রেডর আর দেশি কুকুরের ক্রস বলে মালুম হয়। অবিরত ডাকছে। সকালে ধরে আনার পর থেকেই বেশ দাপটে আছে। এক কনস্টেবল আঁচড় দিয়ে জখম করেছে। ননস্টপ ডাকাডাকিতে থানাকে পশুশালা মনে হচ্ছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ধরা হয়েছে, এখন পরবর্তী কাজ মালিক অনুসন্ধান করা। ‘অবশ্য যার কুকুর সে নিশ্চয়ই খুঁজবে’। দোকানদারের দেয়া বেনসন প্যাকেট উদ্ভোধন করে থেকে এরমধ্যে দুইটা সিগারেট খতম দিয়েছেন ওসি। জাফর একবার বিনয়ের সাথে একটা চেয়েছিলো, তিনি না করেছেন। ‘যে জিনিসের গায়ে লেখা থাকে মৃত্যুর কারণ, সেই জিনিস নিজে খাই যদিবা, অন্যরে কি করে দিই। অন্যের জান নেবার অধিকার পুলিশের এখতিয়ারে নাই- সেইটা জজের কাজ’।
আজকে দিনটা যে ভালো যাবে না, আগেই জানতেন শহীদুল সাহেব, মর্নিং সৌজ দ্য ডে। খবরের কাগজ খুলে রাশিফল দেখতে লাগলেন শহীদুল। যদিও এইসবে বিশ্বাস করা শিরক, তবু ইদানীং নিয়মিত রাশিফল দ্যাখেন তিনি। তার রাশি মেষ, সোজা বাংলায় ভেড়া রাশি। এই নিয়ে অনেকবার বউয়ের কাছে অপ্রীতিকর কথা শুনতে হয়েছে, বউ তো কয়েকদিন তাকে ‘ভেড়ার নাতি’ ও বলেছেন। এমনকি এই বিষয়টা লিক হওয়ায় অফিসে পিছনে পিছনে তাকে ‘ভেড়া ওসি’বলে কনস্টেবলরা, তা তিনি জানেন। কিন্তু জানেন না এমন ভান ধরে থাকেন পাছে খোলাসা হলে সম্মানটা আখেরে তারই কমবে। রাশিফল দেখে মন কিছুটা শান্ত হলো। রাশিফল বলছে দিনটা শুভ। ‘রাশি মেষ- আজকে দিনটা খারাপভাবে শুরু হলেও শেষমেশ শুভ আপনার জন্য। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সম্ভাবনা আছে। আজকে প্রণয় শুভ। পুরনো প্রেম মনের জানালায় উঁকি দেব। বিদেশ যাত্রা শুভ। ভেবেচিন্তে, ধীরসুস্থে পদক্ষেপ নিলে সাফল্য আসবে।‘ সীমিত আকারে মুখে হাসি ফিরে আসে শহীদুলের।
৪
রাস্তার মাথার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ফিরছেন কনস্টেবল জাফর। ওসি সিগারেট দিয়ে শারীরিক ক্ষতি করতে অস্বীকৃতি জানানোয় নিজের ক্ষতি নিজে করতে এক প্যাকেট দামী সুগন্ধি সিগারেট কিনে ফেলেছে সে। প্যাকেটটা প্যান্টের গোপন পকেটে রেখে (পাছে ওসি একটা দাবী করে বসেন) একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে থানার দিকে যাচ্ছে এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে ওঠে, ওসির জরুরী তলব।
জাফর সিগারেট শেষ করে ওসির রুমে ঢুকতে চিকার মতো নাক উঁচু করে সিগারেটের সুগন্ধ শুঁকে শহীদুল বললেন, ‘কিরে আগরবাতি জ্বলে কই! নাকি নতুন পারফিউম লাগাইছো?
জাফর – উঁহু ছার, সিগারেট নতুন ব্রান্ড, গন্ধ এমনই- সুগন্ধী ফ্লেভার- বেশ লাগে!
-ওহ নতুন নাকি?
-হু, ছার
-কি ব্রান্ড?
-গুদাম, গুদাম গরম
– গুদাম গরম! সিগারেটের নাম! তাও যাতে এলাচির ফ্লেভার- বড়োই বেমানান এমন সুগন্ধ যে সিগারেটের তার নাম গুদাম? রজনীগন্ধা বা গোলাপ হইলে তা না হয় মানা যাইতো, শুনলে মনে হয় যেন বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়া কোনো পত্রিকার হেডলাইন। আছে নাকি বাড়তি?
-না ছার একটাই
-ওহ! দাম কতো?
জাফর একটু গর্বের সাথে- ২৫ টাকা পিছ
ওসি- বেতন কতো, ২৫ টাকা দামের সিগারেট খাও? ঘুষ খাইয়া তো এক একজন পেট ফুলাইয়া আছো। থাম খাও, বদহজম হবে। আমারে দ্যাখো এতো বছরের চাকরি, কি করছি আমি? আমার আগের ওসির গুলশান বনানীতে একটা করে ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে একটা সাততলা বাড়ি। আমার মাত্র মিরপুরে একটা বাড়ি- বনানীতে একটা পাঁচতলা বাড়ি আছে বটে, সেইটা বউয়ের নামে। লোকে যতোই গিবত করুক ওইটা আমার শ্বশুরের দেয়া, আল্লাহ স্বাক্ষী। মহাত্মা গান্ধী একবার বলছিলেন, ‘ঘুষ খাওয়া অন্যায়, ওই সভার বাঙালিরা সেইটা চেঞ্জ কইরা বানাইছে ‘ঘুষ খাওয়া অন্য আয়’, স্পয়েল্ট জাতি। ভবিষ্যত অন্ধকার।
– তা স্যার, ফোন করলেন, জরুরী সংবাদটা কী?
– হু, মৎস প্রতিমন্ত্রীর ফোন আসছিলো। তার পোষা কুকুরটা গতরাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, কুকুরের রঙ কালো, মাঝারি গড়নের- আমি বলে দিছি আমরা ফোর্স নিয়া তন্নতন্ন করে খুঁজতেছি এলাকা। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেয়ে তাকে খবর দেবো। আমার যতদূর মনে হয় এই মালই সেই মাল- তোমার কি মনে হয়?
-আমারো তাই মত, স্যার।
-হুঁ, আমিও ফোন করে জানাচ্ছি- অনেক খুঁজে তার কুকুর পাওয়া গেছে।
জাফর ভালোই বুঝেছে ওসির মতলব। ‘সবসময় প্রমোশন লোফার ধান্দা লোফারটার’
– তা স্যার! মেয়রের শালার কি করবেন? সেতো মালিক খুঁজে কেস করবে বলেছে
– ধুরো, রাখো মিয়া মেয়রের শালা-দুলাভাই খেলা। কোথায় প্রতিমন্ত্রী আর কোথায় কি শালা! কই রাজ্যপাল, আর কই চ্যাডের বাল! বললেই হবে পুলিশের গাড়িতে আনার পথে হাতে আঁচড় দিয়ে লাফ দিয়ে পালাইছে। অনেক পেইন দিয়েছে শালারা সকাল সকাল। এক কাপ চাও অফার করে নাই, শালা চামার! তোমার কাজ হলো এই কুকুরের তত্ত্বাবধান করা, মন্ত্রী আসা পর্যন্ত। যা যা খাবে এনে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো। মোড়ের বিরিয়ানির দোকান থেকে বিরিয়ানি, অনেক ধকল গ্যাছে, একদম ফ্রেশ টিপটপ লুক যেন আসে। পালিশ করা কালো জুতার মতো মুখ দেখা যাবে।
-কাছে তো যাওয়া যায় না, স্যার? বেজায় বিটকেল
-যায় না তো দূর থিকা দেবা, আমার প্রমোশন হইলে তোমার জন্যও সুপারিশ করবো। আফটার অল তুমি আমার সবচাইতে বিশ্বস্ত লোক, রাইট হ্যান্ড ম্যান।
পাঁচশ টাকার বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা একটা নোট সে দিলো কনস্টেবলের হাতে, ‘দেখবা কোনো অযত্ন না হয়, ভালো একটা মেলামাইনের বাটিতে খাবার দেবা, মন্ত্রী নিজে আসতেছেন তার কুকুর নিতে।‘
টাকা হাতে জাফর বেরিয়ে গেলো, একটা চেনা গানের কলি গাইতে গাইতে জুতা খুলে চেয়ারে পা তুলে নিলেন অফিসার, ‘লাল মেরি পাত রাখিয়ো ভালা ঝুলেলালান…।’
৫
দুপুরের কড়া রোদ মুছে গিয়ে আকাশে কিছুটা কমনীয় ভাব আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ভ্যাপসা গরম কমছে না, হয়তো বড়সড় একটা ঝড় হয়ে ঠান্ডা হবে। এদিকে অফিসরুমে ওসি শহীদুলের মেজাজও দুর্যোগের পূর্বাবস্থার মতো থম মেরে আছে। কিছুক্ষণ আগে প্রতিমন্ত্রীসাহেব তার কুকুর নিতে এসে আইডেন্টিফাই করে গেছেন এটা তার কুকুর না, উপরন্ত যাবার আগে থানার পরিবেশ নিয়ে বাজে মন্তব্য করে গেছেন। এদিকে গত কয়েক ঘন্টায় কুকুরটা দুইপ্যাকেট বিরিয়ানি, আধাকেজি ছানার মিষ্টি গিলেছে। তাতেও ক্ষুধা যায়নি, তবুও ডাকছে শালা! এদিকে কুকুরের জন্যে আনানো দুই বোতল মিনারেল ওয়াটারের এক বোতল এখনো তার টেবিলে।
জাফর! হাঁক দিয়ে ওঠেন ওসি সাহেব।
জাফরের প্রবেশ, জ্বী, ছার
ওটা থামে না ক্যানো! থানার বাইরে নিয়ে ওটাকে রেখে আসো।
-ছার, ওটার হাগা ছুটেছে, হাজতে ঢোকার রাস্তা পুরো একাকার করে ফেলছে। মনে হয় ডায়রিয়া হইছে।
‘তা এখনো ওটারে লাথি দিয়ে বের করো নাই ক্যান’
-কেউ ধারেকাছে যাইতেই সাহস করছে না স্যার! ওর বিচি চাইরটা, দুইটা মাইনষের, দুইটা শয়তানের।
বলেই জিভে কামড় দেয় জাফর। এতোগুলো টাকা জলে যাওয়ার শহীদুল সাহেবের মেজাজ তখন সপ্তমে। নিজের বেকুবি আর পেরেশানি সবকিছুর কারন হিসেবে সে সর্বপ্রকারে কুকুরটাকে সাব্যস্ত করে। কয়েদি পিটানোর রুলটা নিয় বের হয়ে যায় রুম থেকে। হাতে লাঠি দেখে কুকুরটা আরো ক্ষেপে ওঠে। কনস্টেবল শিকলটা গরাদ থেকে খুলতেই সে এক ঝটকায় হাত থেকে অন্যপ্রান্ত ছাড়িয়ে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিলো শহীদুল সাহেবের হাতে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে, খাপ থেকে পিস্তলটা বের করে চালিয়ে দেন ওসি। পরপর দুইটা বুলেট, কুকুরটা মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কুঁই কুঁই করতে থাকে! অনেকদিন পর খেল দেখানোর সুযোগ পেলো পিস্তলটা। ওদিকে অফিসের লোকজন শব্দে ততক্ষণে জড়ো হয়ে গ্যাছে। জাফর দৌড়ে এসে ওসির হাতটা তার গদির দামী সাদা তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরেছে। ঘনঘন শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাইপ্রেশারের রোগী বিশালবপু ওসি ততক্ষণে বলছেন, ‘ডাক্তার! ডাক্তার!’
বোকামিতে সেরা ও পুরো থানায় বলদের জাহাজ নামে পরিচিত পিয়ন কুদ্দুস বলে, ‘ডাক্তার ক্যান স্যার! কুকুরের কি পোস্ট-মর্ট্যাম অইবো?’ উপস্থিত সকলেই হেসে ওঠে। রাগে হুংকার দিয়ে বলদের বাচ্চা, বলে চিৎকার দিতে দিতে ততোক্ষণে বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়েন ওসি…
৬
জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে সকালের নির্মল রোদের প্রলেপ শহীদুল সাহেবের শরীরে পড়ছে। কালরাতে ঘুম ভালোই হয়েছে, একেবারে ফ্রেশ লাগছে আজ। বুকের ভার ভার ভাবটাও নেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার বলে গেছেন, ‘আগের থেকে কন্ডিশন ইমপ্রুভ করেছে, তবে সপ্তাহখানেক বেডরেস্টে থাকতে হবে’। আজ মেজাজ কিছুটা ফুরফুরে, এমন সকালে হয়তো আজরাইলও নিতে আসে না। শহীদুল সাহেবের ধারনা তিনি দিনের শুরু দেখেই আন্দাজ করতে পারেন দিনটা ভালো যাবে নাকি খারাপ। বহুদিনের অভিজ্ঞতা। এমনভাবে যে দিনের শুরু সে দিন অবশ্যই ভালো সংবাদ আসবে, প্রহর গুনছেন শহীদুল। শহীদুল সাহেব বেডের পাশের হাতলছাড়া চেয়ারে উঠে বসেছেন মাত্র, পর্দা সরিয়ে কেবিনরুমে কনস্টেবল জাফরের প্রবেশ।
-ছার, এখন ক্যামন আছেন?
কনস্টেবল জানালার সামনে দাঁড়াতে কোমল রোদটার পথ আটকে যাওয়ায় কিছুটা বিরক্ত হলেন শহীদুল।
-ভালো, জানালা ছাইড়া একটু পাশে দাঁড়াও। ডাক্তার বলছে আরো সপ্তাহখানেক রেস্টে থাকতে। কি খবর ওইদিকের?
জাফর জানালার দিক থেকে সরতে সরতে, ‘স্যার, খবর দুইটা- একটা ভালো, একটা খারাপ। কোনটা আগে বলি?’
ভালোটাই আগে বলো। পাছে খারাপ খবর শুইনা এমন হইলো, ভালোটা আর শুনতেই পারলাম না।
-স্যার, ভালো খবর হলো প্রতিমন্ত্রীর কুকুর পাওয়া গেছে।
-বাহ! বেশ ভালো তো।
প্রসন্ন মুখটা আরো প্রসন্ন হয়ে ওঠে ওসির।
-খারাপ খবর স্যার, থানায় আপনার গুলি কুকুরটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রিয় তিনটা ল্যাব্রেডরের একটা! উনি থানায় এসে কনফর্ম করেছেন।
আবার ঘামতে শুরু করেছেন শহীদুল, শ্বাস আবার ঘনঘন পড়ছে। বুকে হাত চেপে পড়ে যাচ্ছিলেন ওসিসাহেব, প্রথমে জাফর কোনোমতে লুফে নিলো। কিন্তু পরক্ষণে ওসির বিশাল শরীরের ভার নিতে না পেরে দুজনেই পতাত-ধরণী-তল।