গদ্যস্মৃতিগদ্য

হারানো পাখির জীবন

এইসব সময় হারিয়ে এদ্দিনেতে এসে বুঝেছি আমার ফেলে আসা শান্তিমতোন দিন, একটা ভীরু পোষা পায়রার চেনা বৃত্তের বাইরে পা রাখার আনন্দময় সময়গুলো আসলে ছিল স্বাধীনতা।

লঘড়ির ছন্দ হয়ে অদ্ভুত দ্যোতনায় কেটে যাওয়া সময়ের গল্প। ভাসা ভাসা কিছু স্মৃতি, সময়। আমি যার সাথে আজকের নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারছি না কেমন। সময়ের পাটাতনের দুই মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা আমিরই দুটো ভাগ যেন। আমার অতীত জীবনে ফেলে আসা পশলা বৃষ্টির মতো স্বাধীনতার আনাগোনার দিন তখন। হৈ-হুল্লোড়ে কাটিয়ে দেওয়া শৈশব-কৈশোর আমার ছিল না কোনদিন। গৎবাঁধা যাপিত জীবনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটা শৈশব, কৈশোর পার করে এসেছি। জন্মাবধি আজতক জীবনের এই দীর্ঘ সময়গুলো কেটেছে বন্দী জানালায় মুখ রেখে।
স্বাধীনতা কী জিনিস তখন বুঝতাম না। শুধু যাপিত জীবনের শৃঙ্খল কোন পলকা হাওয়ার টানে আলগা যেতো যদি— মনে মনে ভাবতাম ওইটুকুই আমার শান্তি। ওই সময়টা একান্ত আমার। নিয়মের এখানে প্রবেশাধিকার নেই। নিয়ম এখানে আসবে না আমার মাথা খেতে। আমি যেন পাখির ডানায় উড়তে থাকা কেউ। দুলকি চালে দৌঁড়োতে থাকা হালকা কোন মেঘ। আমায় ছুঁয়ে দেয় এমন সাধ্যি আছে কার? কাঁচের বয়াম ভরা রঙিন মার্বেলের মতো সেইসব দিন পার করে এদ্দিনেতে নিজেকে এসে প্রশ্ন করি ওইদিনগুলো আসলে কী ছিল?

আমার চেনা বৃত্তের বাইরে একটুখানি পা রাখার সেইসব সময়। হেফজখানায় ঘন্টাখানেক আগে ছুটি পেয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠা। কোন একদিন সবক শুনানোর চিন্তা নেই। রমজানের সকালে বাসার সবাইকে ঘুমে রেখে চুপিসারে বের হয়ে যাওয়া। পুকুরে সময় না বেঁধে ঝাঁপাঝাঁপি। এসব কী ছিল আসলে? ঝিঙেফুলের মতো হলদে রোদ্দুর মাথায় করে শূন্য মাঠে ঘুরে বেড়ানো,জলপাই তেল রঙা রোদ উঠা বিকেলে শুকনো ধানের খেতে বউ ছি খেলা। স্কুলে আগামীকাল হাফ ডে—দুটো বই কম নিলেই চলবে। বিজ্ঞানের মিস আজকে আসেননি অথবা একটা দিন স্কুল ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত বাসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। এই স্বস্তিদায়ক অনুভূতিটা কী ছিল?

সম্পর্কিত

একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে এইসব শান্তি মতোন দিন কেমন পাল্টে গেলো। সুযোগ পেলেই প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর দিনগুলো বুড়ো নিমফুলের মতোই ঝরে গেলো আলগোছে। তারপর শান্তি বলতে রইলো ক্লাসের ফাঁকে দুয়েকদণ্ড আড্ডা দেবার খণ্ড খণ্ড অবসর, পিছনের বেঞ্চে বসে কাগুজে নৌকা বানিয়ে খাতার সব পাতা ছিঁড়ে ফেলা, ছুটিছাটায় সুযোগ পেলে পুকুরের টলটলে জল দেখা। তখন বুঝতে পারছিলাম আমার শান্তিগুলো একটা বৃত্তে আটকা পড়ে গেছে। কিসের বৃত্ত? অতকিছু কী আর বুঝি তখন! শুধু জেনেছি আগের মতো বিস্তর প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো পাখিটি অজান্তেই পা রেখেছে সময়ের ফাঁদে। ফুরিয়ে গেছে চড়ুই পাখির মতো বাধাহীন উড়ে যাওয়ার, শীত সকালের মোহমুগ্ধতা ছড়ানো—শিউলিফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে শিশির বিন্দুর মতো ইচ্ছেমত গড়িয়ে পড়ার দিন।

জীবনের এই মধ্য সময়ের শুরুর প্রহরে নস্টালজিয়ার একটা উত্তরী হাওয়া হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে মনের আঙ্গিনায়। মন যেন পলকের জন্যই হারিয়ে যায় কোথাও। মোমের মতো গলে গলে পড়তে থাকে স্মৃতিরা। জমাট হয় বুকের পাটাতনে।

 

এইসব সময় হারিয়ে এদ্দিনেতে এসে বুঝেছি আমার ফেলে আসা শান্তিমতোন দিন, একটা ভীরু পোষা পায়রার চেনা বৃত্তের বাইরে পা রাখার আনন্দময় সময়গুলো আসলে ছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকে যতদিনে চিনতে পেরেছি ততদিনে বদলে গেছে আমার স্বাধীনতার রূপরেখা। হারিয়ে গেছে স্বাধীনতা মানেই বাঁধনছেড়ার গল্প— এই অর্থটা। এখন তো স্বাধীনতা বলতে আছে একটা প্রহর দায়িত্বহীন কাটানো, খুচরো দুপুর, কেজো হয়ে যাওয়া আমার একান্ত একটা রাত। ব্যস্ততা দিয়ে বিষণ্নতাকে একটা ধূসর, রংচটা চাদর পরিয়ে রাখার সার্থকতা। দুঃসময়ে বিরহী হবার ইচ্ছেটুকু শক্ত আবরণের ফাঁক গলে হঠাৎই মনে জায়গা করে নেওয়া।

ঝরাপাতার মৃদু খসখসানিতে অবুঝ সময়ের স্বাধীনতার কথা ভেবে নস্টালজিক হওয়াটাকেও আজকাল স্বাধীনতা মনে হয়। যেন খোলা একটা জানালাপথে উঁকি মেরে দেখছি নিষিদ্ধ পুরনো আমিকেই। জীবনের এই মধ্য সময়ের শুরুর প্রহরে নস্টালজিয়ার একটা উত্তরী হাওয়া হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে মনের আঙ্গিনায়। মন যেন পলকের জন্যই হারিয়ে যায় কোথাও। মোমের মতো গলে গলে পড়তে থাকে স্মৃতিরা। জমাট হয় বুকের পাটাতনে। নির্বিকার আমি মুহূর্তের জন্য উচ্ছল হই কি? শান্ত দীঘিটায় হঠাৎ জোয়ার আসার মতো!

সময়ের ঘূর্ণনে স্বাধীনতায় কী তুমুল পরিবর্তন আসতে পারে তা আমার নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। স্বাধীনতার এই পরিবর্তন আমাকে বিষণ্ণ, উদ্বেগ করে তুলে। ভেতরে ভেতরে পরাধীন পাখির মতোন ডানা ঝাপটিয়ে বেদনার বেনোজলে ভিজতে থাকি সময়ে অসময়ে। জীবন যেন হয়ে উঠে ঘাসফড়িঙের পলাতক জীবনের জলছাপ। মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা। আমার দীর্ঘশ্বাসের করিডোর ধরে একটা নিঃসঙ্গ হলুদ পাখি উড়ে যায়। শূন্য আমি আরও শূন্য হয়ে যাই। জলমগ্ন পানকৌড়ির মতোন আমাতে নিমজ্জিত আমাকে মনের ভেতর কুনকুন করতে থাকা পোস্তদানা মনটা বলে— তুমি মেয়ে। এ তোমার জন্ম জন্মান্তরের দায়। স্বর্ণালতার মতো মেয়ে—তুমি মুক্ত বিহঙ্গ নও।

আপনার মতামত জানান

সুমাইয়া মারজান

সুমাইয়া মারজান; গদ্যকার। সিলেটের হবিগঞ্জে ২০০০ সালের ১৭ নভেম্বর জন্ম। নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রিকা ও ওয়েব জার্নালে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।