গদ্যমুক্তগদ্য

সানা, একটি অমর ফুলের নাম—অন্ধ কবরে ফোটে

এখন তার বয়স ৪৫ আর ৪৬-এর মাঝামাঝি। তখন ছিলো ৭ মাস। আর তার বড় ভাই’র ছিলো সাড়ে ৪ বছর। আবোলতাবোল। যখন-তখন সাত মাসের গালে গাল রাখে, নাকে নাক। রাতে আম্মার দুই পাশে দুইটা ঘুমায়। ৭ মাস যেন  সাড়ে ৪ বছরের খেলনা। ঘুমালে জাগিয়ে দেয়। আম্মা বকেন। আব্বা বাজারে নিয়ে যান। কাঁধে করে। বাজার থেকে চিনি, পরোটা, দুধ, বিস্কুট আনে। ৭ মাস কিছু খেতে পারে না। সাড়ে ৪ বছরের কী দুঃখ! কবে দাঁত উঠবে। খেতে পারবে। অপেক্ষা শেষ হয় না।

৭ মাসের বড় হওয়ার অপেক্ষায় থাকা সাড়ে ৪ একদিন অসুস্থ হয়। ৭ মাস তার কিছু জানে না। সে আগের মতোই ঘুমায়। জাগে। কাঁদে। হাসে। অসুখ তারে ছোট ভাইয়ের গালে গাল রাখতে দেয় না। নাকে নাক রাখতে দেয় না। অসুখ ভুলিয়ে দিচ্ছে আম্মাকে। আব্বাকে। নিজেকেও সে ভুলে যাচ্ছে । ক্রমশ।

সম্পর্কিত

কিন্তু অসুখ তো চিরস্থায়ী না। ওষুধ আছে পৃথিবীতে। ডাক্তার আছে। আব্বার আল্লার পায়ে পড়ে চিৎকার আছে। আম্মার চোখের পানিতে ভেজা মোনাজাত আছে। অসুখ কমবেই। আর, আবার ছোট ভাই’র কাছে যাবে। দাঁত উঠছে কিনা পরীক্ষা করবে। মুখে ঢুকিয়ে দেবে চকোলেট। আম্মা বকবেন। ফুফু এসে নিয়ে যাবেন। ফুফুর কোলে বসে পাখি দেখবে, প্রজাপতি দেখবে। একটা ফড়িং দেখে কোল থেকে নেমে যাবে। ফড়িং-এর পিছেপিছে দৌড়ে ক্লান্ত হবে। ফড়িং ধরতে পারবে না। কেঁদে ফেলবে। ফুফু অনেক কষ্টে একটা ফড়িং ধরে দেবেন। হাতে নিয়েই ছেড়ে দেবে। কামড় দেয়।

আম্মা ডাকবেন। গোসল করাবেন। প্যান্ট-শার্ট পরাবেন। খাওয়াবেন। ঘুম পাড়াতে নিয়ে শুবেন। ঘুমাবে না। আম্মাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে উঠানে চলে যাবে। রোদে। ধূলি ধরবে। পকেটে ধূলি ভরবে। মাথায় ধূলি দেবে কয়েক মুঠো। ঘুমন্ত কুকুরটার গায়েও দেবে এক মুঠো। কুকুর গা ঝেড়ে চলে যাবে রাস্তায়।

আম্মা ঘুম থেকে উঠে ধূলিমাখা পুত্রসোনাকে ধরবেন। দাদি এসে নিয়ে যাবেন। ফুফু হাত-মুখ-মাথা ধুয়ে দেবেন।

একদিন নানা আসবেন। নিতে। বাড়িতে একটা বেবি ট্যাক্সি আসবে। একেবারে উঠানে। সে সবার আগে গিয়ে উঠে বসে থাকবে। ড্রাইভারের সাথে গল্প করবে। ড্রাইভারকে বলবে বড় হয়ে সে বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভার হবে। আম্মা-আব্বা আর ছোট ভাই রেডি হয়ে এলে গাড়ি ছেড়ে দেবে। নানাবাড়ি নেমেই বড় মামার কাঁধে উঠে চলে যাবে পুকুর ঘাটে। নানি খুঁজে আনবেন। খালা কপালের এক পাশে কালো একটা বৃত্ত এঁকে দেবেন।

নানবাড়ি থেকে আসার তারিখ ঘনিয়ে আসবে। নানি কাঁদতে থাকবেন। চলে আসার দিন বেবি ট্যাক্সি পাঠিয়ে দেয়া হবে বড় রাস্তায়। যাতে বড় রাস্তায় যাওয়ার পথে একটু একটু করে সবাই কোলে নিতে পারে। খালার কোল থেকে ছোট মামা; ছোট মামার কোল থেকে নানা; নানার কোল থেকে বড় মামি…।

আর সে নানা বাড়ি যাবে না, এমন তো হতেই পারে না।

আর সে বড় মামার কাঁধে উঠবে না, হতেই পারে না। নানার সাথে মসজিদে যাবে না। নানির পাশে ঘুমাবে না। বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে না। হতেই পারে না।

আব্বার দোকানের জবুরের কাঁধে বসে বাজারে যাবে না। জবুর না আসলে চিৎকার করবে না, জবুর আমারে নিয়া যা, জবুর আমারে বাজারে নিয়া যা—বলবে না, তা হতেই পারে না।

কিন্তু আশ্চর্য!

আর সে নানাবাড়ি যাবে না। আম্মার সাথে আর নামাজ পড়বে না। মাথায় ধূলি মাখবে না। জবুরের কাঁধে উঠবে না। ৭ মাসের গালে গাল রাখবে না। কারণ, আল্লাহর পায়ে পড়ে আব্বার চিৎকার। আম্মার চোখের পানিতে ভেজা মোনাজাত। নানার দরগায় মানত। সবকিছু বাতিল করে ঐ সাড়ে ৪ বছর বয়সেই, পৃথিবীতে যখন বিকাল আসে, ঠিক তখন; বিছানার যেখানে আম্মার পাশে সে ঘুমাত, ঠিক সেখানেই ঘুমিয়ে পড়বে। যাকে বাংলা ভাষায় আমরা বলি—চিরনিদ্রা।

আত্মীয়-স্বজন আর আশপাশের মানুষের স্নেহকে বোবা করে পরেরদিন দুপুরবেলা সে পৃথিবী থেকে চলে যাবে। নানাবাড়ি থেকে যেমন সে বাড়িতে আসত। বা, বাড়ি থেকে যেভাবে নানাবাড়ি যেত, সেরকম যাওয়া না। অন্যরকম যাওয়া। নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে সবার আগে বেবি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ার মতো যাওয়াও না।

কারো সাথে কোনো কথা না বলে। এমনকি ছোট ভাইকে একটা ছোট চুম্বনও না দিয়ে। আম্মাকে না বলে। আব্বাকে না বলে। বাড়ি ভরতি মামা, নানা, নানি, দাদা, ছোট চাচা, ছোট ফুফু…। কাউকে কিছু না বলে। ঘুমন্ত। শতীল। কয়েক টুকরা সাদা কাপড় শরীরে জড়িয়ে। এমন জড়ানো যে কিছুই দেখাবে কাউকে তার শরীরের। শুধু যাওয়ার আগে দুইপাশে একটু সরানো হবে কাপড়, যাকে আমরা বলি কাফন, কেউ সরাবে, যাতে মুখটা দেখা যায়। যাতে আম্মা দেখতে পান পুত্রের শেষ মুখ!!

তার পর চলে যাবে। সবার কাঁধে হয়ে। এত ছোট মানুষের শরীর বহনের জন্য এত কাঁধের দরকার নাই। আব্বার কাঁধই যথেষ্ট। তবু এত ভারি হয়ে যাবে এই শরীর। যাকে আমরা লাশ বলি, যে, এত এত মানুষ নিয়ে যাবে তবু ঠিক নেয়া হবে না। কারোর পা ঠিক চলবে না। তবু যাবে। মসজিদে। মসজিদের পাশের গোরস্তানে। ছোট কবরে

তার আগে, রাতে, বাড়িতেই থাকবে। আম্মার পাশে না। একা। আব্বার পাশে না। একা। ভাইয়ের পাশে না। একা। রাতে কিছু খাবে না। হিসু করবে না। ঘুমাবে। এমনকি মাথার নিচে একটা ছোট বালিশও থাকবে না। পড়ে থাকবে। পাথর। যেন কাউকে সে চেনে না। কেউ তার না।

তারপরে সকাল আসবে পৃথিবীতে। পাখির ডাকে যেরকম আসে। সে কিছু শুনবে না। কারণ

ঘনিয়ে আসবে তার যাওয়া। গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নেয়ার মতো। বাড়ি থেকে। আম্মার কাছ থেকে। তাকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

আব্বা তার পুত্রকে শুইয়ে দেবেন মাটিতে। ভেজা মাটি। মাটি কি কাঁদতেছে! একে একে বন্ধ হবে কবরের দরজা। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সে। অন্ধকারে। এতটুকু একটা ছেলে। একা।

৭ মাসের ছোট ভাই। বড় হবে। বড় হতে হতে অনেক বড় হবে। ৪৫ আর ৪৬ বৎসরের মাঝামাঝি। আম্মার কাছে শুনবে বড় ভাইয়ের মরণের কথা। আর গভীর গভীর রাতে লুকিয়ে লিখতে বসবে সে রাতের কথা। যে রাতে তার ভাই বাড়িতে ছিলো সকালে কবরের প্রতীক্ষায়। অথচ সে ৭ মাস থাকার অপরাধে জানতে পারে নি। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারেনি বড় মৃত্যুবিদ্ধ শরীর।

আপনার মতামত জানান

মুহম্মদ ইমদাদ

মুহম্মদ ইমদাদ; কবি ও অনুবাদক। জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭৮, কটারকোনো, মনু, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই- ‘অন্ধ পৃথিবীর জানলাগুলি’ (কবিতা), ‘নদীমাতৃক পৃথিবী মেঘমাতৃক আকাশ’ (কবিতা), ‘প্রেগন্যান্ট পাগলি ও অন্যান্য কবিতা’ (কবিতা), ‘চূর্ণচিন্তন’ (অনুবাদ), ‘দূরাগত স্বর’ (অনুবাদ), ‘আর্থার শোপেন হাওয়ারের কথাগুলি’, ‘আধুনিক কবিতা বিষাদবৃক্ষের ফুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (প্রবন্ধ), ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।