আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ পৃথিবীতে অন্যতম একটি বিপ্লব। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা যেভাবে শিল্পের অন্যান্যদিকের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীলতা দেখতে পারি, ঠিক তেমনি ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। মৌলিকভাবে দর্শনের একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সফলতা আজকের আলোকচিত্র। দর্শনের জন্মের পর থেকেই মানুষ জেনে আসছে প্রতিফলনের বিজ্ঞান। পর্দায় কোনো একটি বিষয়কে প্রতিফলিত করার বিষয়টি অনেক পুরোনো ধারণা। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মানুষ জানতো, অন্ধকার চারকোনা বাক্সের সামনের তলে একটি সুইয়ের খোঁচা সমান ছিদ্র থাকলে এবং ঠিক বিপরীত দিককার তলে একটা সাদা পর্দা দেয়া হলে সেই পর্দায় উল্টোভাবে সামনের দৃশ্য ধরা পড়ে। ছিদ্রটার যায়গায় যদি একটা কাচের লেন্স বসিয়ে দেয়া যায়, তাহলে এই ছবি আরো স্পষ্ট হয়ে আসে। কিন্তু মানুষের জানাশোনা ততোদিন পর্যন্ত ছিলো এই সামান্যই। ছবিকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার প্রযুক্তি আরো পরের। বিশ্বের প্রথম সফল ক্যামেরা আবিষ্কার হয় ১৮২২ সালে। দীর্ঘদিনের সাধনা এবং পরিশ্রমের পর ফরাসি আলোকচিত্রী জোসেফ নিসেফোর নীপস প্রথম ফটোগ্রাফটি আবিষ্কার করেন। এটি একটি বিপ্লব ছিলো পৃথিবীর জন্য। মানুষের ইচ্ছার ভিতর অতীতকে ধরে রাখার দ্বার উন্মোচিত হয় ক্যামেরা এবং ফটোগ্রাফের আবিষ্কারে। দ্রাবিড়ের পাঠকের জন্য কবি ও আলোকচিত্রী সাইয়্যিদ মুজাদ্দিদের তোলা ছয়টি ছবি প্রকাশ হলো । তার ছবির বিষয়বস্তু প্রাণ ও প্রকৃতি।
ক্যামেরা ও ফোটোগ্রাফের সাথে আমার পরিচয় জন্মে থেকে। বাবা সাংবাদিকতার সাথে জড়িত বলে সব সময় সঙ্গে একটি এস.এল.আর ক্যামেরা থাকতো। বাবার এই ক্যামেরাটি এখন ব্যবহৃত না হলেও আমার কাছে আছে। আমার কৈশোর পর্যন্ত ছিলো নেগেটিভ ফিতার ব্যবহার। বাবার ক্যামেরা ছাড়া বাসায় আরো কয়েকটি সাধারণ ক্যামেরা ছিলো আম্মু, ছোটফুফুর। কোনো বিশেষ দিনে নেগেটিভ ফিতা কিনে এগুলো দিয়ে ছবি তোলা হতো। আমরা অপেক্ষা করতাম স্টুডিওর পথের দিকে চেয়ে। নেগেটিভ থেকে ছবি তৈরি হয়ে যখন হাতে আসতো, আনন্দ লাগতো। ক্যামেরা ও আলোকচিত্রের প্রতি সেই তখন থেকে মুগ্ধতা।
আমরা বড় হতে হতে পৃথিবী অনেকখানি পরিবর্তন হয়, প্রযুক্তি উন্নত হলে উন্নত ক্যামেরা আসে। বিশেষত মোবাইল ফোনের ক্যামেরা আলোকচিত্রকে অনেকটা সহজ করে দেয়। আমারও বয়স বাড়তে থাকে, দুর্বলতা বাড়ে ক্যামেরার প্রতি। প্রথম মোবাইল ফোনের সংযুক্ত ক্যামেরায় চেষ্টা করি ফটোগ্রাফ তৈরি করার। সে সময়ের কথা আসলে আমার শৈশব-কৈশোরের বন্ধু অলি রেহমানের কথা মনে আসে, আমরা বের হয়ে বিভিন্ন আইডিয়া তৈরি করতাম ছবির জন্য। শহরের নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে তৈরী করতাম দারুণ সব আলোকচিত্র। কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় ঐভাবে পারতাম না। পৃথিবীর অনেক ফটোগ্রাফারদের কাজ দেখতাম। দেখে শিখতে চেষ্টা করতাম ফোটোগ্রাফের জ্ঞান। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততা একটা সময় আমাদেরকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। আমাদের মজ্জার ভিতরে ক্যামেরার শাটার তড়পালেও ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে দেয়।
এইসব ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত দেশ-বিদেশের ফোটোগ্রাফি দেখছি। একসাথে বসলে ফটোগ্রাফের চুপচাপ স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতাম আমরা। আধুনিক ডিএসএলআর ক্যামেরা ব্যবহারের ইচ্ছা থাকলেও তা সম্বন্ধে তখনো জ্ঞান হয়নি। নিজস্ব কোনো ক্যামেরা নাই বলে শিখতে পারছি না, এমন একটা ব্যাথা আছে শুধু। এই ব্যথার সামান্যতম উপশম হয় সৈয়দ ফাহাদ গাজী ভাইয়ের মাধ্যমে। বিলেত থেকে তাঁর জন্য ক্যামেরা এসেছিলো, ফাহাদ ভাই আমাকে ইচ্ছামত ব্যবহারের সুযোগ দিলেন। এই ক্যামেরা নিয়ে আমি ছুটতাম বন্ধু নাওয়াজ মারজানের কাছে। এ সম্বন্ধে আমার প্রাথমিক জ্ঞান তার কাছ থেকেই পাই। বিশেষ করে ছবি উঠানোর ফ্রেমিং শিখি মারজানের কাছে। পরবর্তীতে সুনামধন্য আলোকচিত্রী বন্ধু আলী আশরাফ সিদ্দিকী সায়েম আমাকে অনেক কিছু শেখায়। আমার আলোকচিত্রী জীবন তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে সব সময়।
বিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের কাজ পরবর্তীতে আমাকে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষত তাঁর পোট্রেটগুলো আমাকে পোট্রেট ফটোগ্রাফির দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। আলোকচিত্র সম্পূর্ণ আমার সখের একটি বিষয়। কোথাও ঘুরতে গেলে ক্যামেরা সঙ্গে নিতে ভালোবাসি। মানুষের-প্রকৃতির ছবি ধারণ করায় আনন্দ পাই। কবি পরিচয়ের পাশাপাশি আলোকচিত্রী পরিচয় আমাকে আপ্লুত করে। পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর আমার ক্যামেরায় ধারণের স্বপ্ন দেখি সব সময়।
তোমার আলোকচিত্রের মুগ্ধ দর্শক আমি