গল্প

সবুজছায়া বৃদ্ধাশ্রম

‘কী ভাবো তুমি আমাকে! তুমি যা-ই বলবে তা-ই শুনতে হবে আমাকে? যা চাইবে তা-ই দিতে হবে? তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান থাকলে এতোক্ষণ এভাবে এখানে বসে থাকতে না। তাছাড়া কাণ্ডজ্ঞান, নীতি নৈতিকতা, মান-অপমান আত্মসম্মানবোধ-এইসব সুন্দর সুন্দর বিশেষণ তোমার জন্যে নয়। আমি জানি এতোসব কথাবার্তা আমার উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতোই। তোমার শরীরে যে চামড়া আছে সেটা তো ‘দুর্ভেদ্য-বুলেট প্রুফ’।

কথাগুলো অনর্গল বলে একটু থামলেন জেসমিন সুলতানা। চলে গেলেন ভেতরের রুমে। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এতোসব তুচ্ছতাচ্ছিল্যপূর্ণ কথার বান নিক্ষেপ করা, সেই ছেলেটি যেমন বসেছিলো সোফায় নিচের দিকে তাকিয়ে তেমনি আছে।

সম্পর্কিত

কিছুক্ষণ পর জেসমিন সুলতানা ফিরে আসলেন ড্রইং রুমে। দেখলেন যার ওপর তীব্র শব্দের তীর বিদ্ধ করেছিলেন কিছু সময় আগে, সেই ছেলেটি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বাড়ির গেইটের দিকে। পেছন থেকে ডাক দিলেন। ‘সজিব, এদিকে আয়। নিয়ে যা’-

বলেই সজিবের হাতে পাঁচ শ’ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘এই নাও, আর কখনও আসবে না আমার কাছে কোন আব্দার নিয়ে।’

চলে গেলো সজিব। রিকশায় উঠলো। গন্তব্য তার মেসের ছোট্ট কামরা। রিকশায় যাচ্ছে আর ভাবছে আজকের ঘটনাটির কথা। মনে মনে বললো- মানুষের আত্মসম্মানবোধ বলে তো একটা ব্যাপার থাকতে হয়, থাকা উচিৎ। আমার মধ্যে কি তার লেশমাত্র নেই?…. ভাবে- দূর ছাই, এই অবজ্ঞা অবহেলারজীবনই তো আমার। ছিন্নমূল কপর্দকহীন একজন মানুষের এতোকিছু ভাবলে চলে না। জীবনপথে যতোই হেঁটেছি ততোই কুড়িয়েছি মানুষের ঘৃণা বঞ্চনা। সুতরাং কেবল মাত্র আজকের ঘটনা নিয়ে ভেবে কী লাভ? বরং মাস শেষ হয়েছে; মেসের ভাড়া খাবারের টাকা কীভাবে দেবো, তা নিয়ে ভাবতে হবে।- মেসে ঢুকেই কিছুক্ষণের মধ্যে বের হয়ে গেলো টিউশনির উদ্দেশ্যে।

আষাঢ়ের বিকেল। গলি পথে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার মুখে আসতেই অকস্মাৎ নেমে এলো মুষল ধারে বৃষ্টি। একটি দোকানের সামনে একটু দাঁড়াতে চাইলো সজিব বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। কিন্তু সেখানেও ঠাঁই হলো না। ইতোমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে দোকানের সামনের খালি জায়গাটুকু। মনের মধ্যে ঝড়, আকাশে মেঘেরগর্জন, একটানা বর্ষণ-সব যেন একাকার হয়ে গেলো সবিজের কাছে। তখন আর বৃষ্টি থাকার অপেক্ষা কিংবা বৃষ্টি ঠেকানোরও কোন ইচ্ছে রইলো না তার। বৃষ্টির ঝাপটা মাথায় নিয়েই ছুটে চললো শহরের একটি অভিজাত এলাকায়। সেখানে একটি বাসায় টিউশনি করছে বছর কয়েক হলো। ভিজে জবুথবু অবস্থা সজিবের। রাস্তার দু’পাশে অনেকেই এদিক-সেদিক দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। রিকশা গাড়ির চলাচলও থামেনি। টুং টাং শব্দে এগিয়ে চলেছে জীবনের গতি। কারণ মানবজীবন বহমান নদীর মতো। সব বিপত্তির বেড়াজাল ছিঁড়ে জীবন নদীর এই ধারা সামনে এগিয়ে যাবেই। সজিবের জীবনও থামেনি কোন ঝড়ের আঘাতে কিংবা বজ্রপাতে।

গন্তব্যে যখন পৌঁছালো ততোক্ষণে চলে গেছে বিদ্যুৎ। সাথে থাকা মোবাইল ফোনের টর্চ লাইটের মৃদু আলো আর আকাশের বিদ্যুৎ চমকই এখন তার ভরসা। কোনমতে বাসায় পৌঁছেই ছোট গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দায় উঠলো। কড়া নাড়াতেই দরোজা খুললো তারই ছাত্র হিমেল।

শহরের একটি নামকরা কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হিমেল স্যারের এই অবস্তা দেখে অবাক। সে একটি টাওয়াল এনে দিয়ে বললো ‘স্যার মাথাটা মুছে নেন। বৃষ্টির পানিতে বেশিক্ষণ মাথার চুল ভেজা থাকলে জ্বর আসতে পারে।’

মাথা মুছতে মুছতে বললো সজিব ‘সামান্য জ্বর আমাকে কিছুই করতে পারবে না। তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।’

কী সমস্যা স্যার? আব্বু বলেছে কোন ধরনের বিপদে পড়লে মনের জোর বাড়াতে যাতে ঘাবড়ে না যাই।

সে তুমি বুঝবে না। এসব বাদ দাও। এখন পড়তে বসো।- বলেই চার্জার লাইটটি একটু সরিয়ে পড়ার বই খুলতে লাগলো সজিব। তখন বিদ্যুতের আলোও জ্বলে উঠলো।

হিমেলকে পড়া দিয়ে সজিব ভাবতে লাগলো- ‘এতোক্ষণে বাইরের আকাশও বুঝি ফর্সা হয়ে এসেছে।’- মনের আকাশের মেঘও কিঞ্চিৎ কেটে গেছে বলেই তার উপলব্ধি হলো। মানুষের এরকম হয় তো মাঝে মধ্যে। মনের মধ্যে দীর্ঘ সময় কোন কিছু নিয়ে তোলপাড় হতে থাকলে হঠাৎ কোন অবচেতন মুহূর্তে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও নিজকে হালকা মনে হয়। রাত প্রায় নয়টা। পড়ানো শেষ করে উঠতে যাবে সজিব। এমনি সময় রুমে ঢুকলেন হিমেলের বাবা। হাত বাড়িয়ে চলতি মাসের টিউশনির টাকাটা দিয়ে দিলেন সজিবকে। সে বললো-মাস তো শেষ হয়নি আংকেল।

না, ঠিক আছে। তোমার তো জরুরি কোন প্রয়োজন থাকতে পারে। তাছাড়া, আজ ২৫ তারিখ। মাস তো প্রায় শেষই।

সাধারণত প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই পূর্বের মাসের বেতন পেয়ে আসছে সজিব বিগত তিন বছর ধরে। কিন্তু আজ এতো আগে বেতন দেওয়ার কোন কারণ বুঝতে পারলো না সে। ‘নাকি হিমেল বলেছে কিছু তার বাবাকে?’

এতোসব ভাবতে ভাবতে মেসে ফিরলো। তবে মেসের ভাড়া আর খাবারের টাকার ব্যবস্থা করা নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিলো, তা তো দূর হলো। যে কারণে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতেও পারবে।

এই ভেবেই নির্ভার সজিব। মধ্যরাতে আবার শুরু হলো বর্ষণ। অঝোর বর্ষণে টিনের চালে একটা মদিরতা জড়ানো আওয়াজ হচ্ছে। এই বৃষ্টি এখন আর তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। বিরক্তও হচ্ছে না সে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ বরাবরই ব্যকুল করে দেয় সজিবকে। মনে পড়ে যায় শৈশবের দিনগুলোতে এরকম বৃষ্টি এলে, নিজেদের ঘরে টিনের চাল ছিলো না বলে চলে যেতো পাশের জেসমিন খালাদের বাড়িতে বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য। কিন্তু আজ সেই টিনের ঘরেই সে বৃষ্টির শব্দ শুনে ঘুমোচ্ছে। হোক না সেটা মেসবাড়ি, অন্যের বাড়ি। কারণ সামান্য পেয়েই যারা তৃপ্ত থাকতে পারে সজিব তাদেরই দলে। সে তো মেস বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে বিমোহিত রোমাঞ্চিত।

পাশের বাড়ি অর্থাৎ জেসমিন খালাদের বাড়িতেই কেটেছে বলা যায় তার শৈশব। তার মা সেই বাড়িতে কাজ করতেন। মা’র সঙ্গেই থাকতো, এটা ওটা কাজও করতো শিশু সজিব। একদিন হঠাৎ করেই তার মা মারা যান। এর বছর খানেকের মধ্যেই তার বাবাও মারা যান দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তখন এই জেসমিন খালাই অসহায় এতিম ছেলেটির দায়িত্ব নিলেন। রেখে দিলেন নিজের বাড়িতে। নিজের দুই সন্তানের মতোই আদর সোহাগ দিয়ে লালন-পালন করতে লাগলেন সজিবকে। লেখাপড়াও শেখাতে লাগলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের ছেলে মেয়ে জিসান-শানুর সঙ্গে সঙ্গে সজিবকেও। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে শহরের বাসায়ও নিয়ে গেলেন ছেলেমেয়েসহ সজিবকেও।

এক কথায় একহারা গড়নের রূপসী রমণী জেসমিন সুলতানা। দীঘল কালো চুল কখনও দুয়েকটা ছিটকে পড়ে কপাল কিংবা কপোল বেয়ে চিবুকে গড়াগড়ি করে; তখন পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই মহিলাকে অকস্মাৎ তরুণী ভেবে কারও ভ্রম হতে পারে। এই বয়সেও এমন গঠন আর শারীরিক কারুকাজ অটুট রাখা সবার কাজ নয়। তাছাড়া, এখানে সৃষ্টিকর্তারও অপার করুণার বিষয় রয়েছে। প্রবাসী স্বামী প্রায়ই ভিডিও কল করেন। বলেন-কী ব্যাপার, তুমি কি কখনও বুড়ো হবে না? বিয়ের বয়স তো হয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ। কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে তোমাকে সেই প্রথম দিনের মতোই। এর রহস্য কী?

-একটু হাসেন জেসমিন। টোল পড়া দুই গালে যেন লাবণ্য ঝরছে। মোবাইল ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে নিজের চেহারাটাকে লুকাতে চাইলেন স্বামীর কাছ থেকে। বলেন-

দূরে আছো বলেই এমন মনে হচ্ছে। কাছে এলেই কেটে যাবে সব মোহ।

না যাবে না। মোহ তো কাটেনি এতোদিনে! প্রতিক্ষণ তো মনে হয় এক পলকেই পাড়ি দিই সাত সমুদ্দুর তেরো নদী।

শুধু স্বামী নয়, বান্ধবী প্রতিবেশী আর সহপাঠীরাও সব সময়ই জেসমিন সুলতানার রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শৈশবে গ্রামের পথে স্কুলে হেঁটে যেতে চেয়ে থাকতো সবাই। স্কুল-কলেজে অনেক ছেলে ঘুরেছে তার পেছনে। কিন্তু মানুষের সব ধরনের ক্ষমতাই সীমিত। প্রশংসা ধারণ করার মতো ধৈর্য্য থাকে না সবার। প্রশংসা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিজেকে ভাবে সবার আলাদা এক ভিনগ্রহের বাসিন্দা। আত্মঅহমিকার। পারদ উঠতে থাকতে কেবলই ওপরে। ইউরোপ প্রবাসী স্বামীর পাঠানো কাড়ি কাড়ি টাকা, সেই সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ, শহরের অভিজাত এলাকায় আলীশান বাড়ি, গ্রামের বিশাল জমি জিরাত। এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৃষ্টিকর্তার উপহার। তার রূপ-সৌন্দর্য্য।ে যেন সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার?’

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী ছেলে মেয়ে জিসান-শানুও বেড়ে উঠছে মায়ের পছন্দমতো। প্রচলিত সমাজ সভ্যতা, চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি, আচার আচরণ কিংবা এই ভূ-খণ্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটা নাক ছিটকানো অবস্থায় থাকে দু’জন সর্বক্ষণ। যেন তাদের এদেশে জন্ম নেয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। লেখাপড়াও করছে ভিনদেশী ভাষায় আয়ত্ত করছে ভিনদেশী কালচার। সেই আদলে বাসার পরিবেশকেও গড়ে তুলেছে মা, ছেলে ও মেয়ে তিনজন মিলে। অডিও প্লেয়ারে বাজে সব সময় ইংলিশ গান। ড্রইং রুমের দেয়ালজুড়ে থাকা বিশাল সাইজের টিভির পর্দায় বিদেশী চ্যালেন ছাড়া দেশি কোন চ্যানেল টিউন করা হয় না। মায়ের পছন্দ মাইকেল জ্যাকসন, এলটন জন, বলি এম এজ। সন্তানদের পছন্দ এই সময়ের হার্টথ্রব সিঙ্গাররা। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝগড়াও হয়, মা মেয়েতে কিংবা মা-ছেলেতে। কিন্তু এই উদ্ভট রাজ্যে নিজেকে খুবই বেমানান মনে হচ্ছে সজিবের। সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে সময় কাটতে লাগলো তার। যেন একটি জলসাঘরে অনাহুত একজন দর্শক হয়েই থাকতে হচ্ছে সজিবকে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাছাড়া, একদিন পাশের রুমে জিসান-শানুর কথোপকথন সজিবকে খুবই আহত করে। মনে মনে কেঁদে ওঠে সে। জিসান বলে-

দেখছিস শানু, ওই খেতটা আমাদের জন্য কতো বড় উটকো ঝামেলা সৃষ্টি করেছে?

হ্যাঁ, দেখছি তো। মা যে কেমন। কতোদিন বললাম যন্ত্রণাটাকে বিদায় করো, তিনি শুনছেন না। আমাদের বাসার পরিবেশটাই নষ্ট করে দিয়েছে এই উপযাচক ছেলেটি।

হ্যাঁ, সাহায্য করবে, করো। টাকা পয়সা দাও। তাই বলে বাসায় এনে রাখতে হবে?

তাইতো আজ মা-কে বলতেই হবে। এর একটা সমাধান চাই।

সজিব শুনছে পাশের রুম থেকে। কিছু একটা বলতেও চাইছে। ইচ্ছে হচ্ছে বলতে- এই খেতই আমাদের সবার শিকড়। খেত না হলে আমরা বেঁচে থাকতাম না, আমাদের সৃষ্টিও হতো না। মাটি থেকেই তো মানবজাতির সৃষ্টি, এই মাটিই আমাদের আহার যোগায়, আবার এই মাটিতেই একদিন আমাদের মিশে যেতে হবে। আর তোমার পূর্ব পুরুষরা এই খেত থেকেই ওঠে এসেছে। তাই আমি একজন খেতই। এটাই আমার গর্ব।’

কিন্তু কিছুই বলতে পারে না সে। সাহস হয় না। কারণ গরীবদের মুখে সব সত্য কথা শোভা পায় না। গরীবরা যদি সত্য কথাগুলো বলতে পারতো, তবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই পাল্টে যেতো।

এমনি অবস্থায় একদিন সুযোগটা এসে যায় তার সামনে। জেসমিন খালাই একদিন বলে বসলেন গম্ভীর স্বরে-

সজিব, তোমাকে একটা কথা বলবো। আশা করি তা তুমি সহজভাবেই নেবে।

কী খালা?- একটু অবাক হলো সজিব।

না, বলছিলাম এখানে কি তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে? দেখছি সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকো।

জ্বি না খালা। এ কথা বলছেন কেন? আপনাদের আশ্রয়ে আছি, এই তো অনেক পাওয়া। এর চেয়ে তার কী চাওয়ার থাকতে পারে।

দেখো সজিব, তুমি এখন কলেজে পড়ছো। আর ছোট নও তুমি। আমার মনে হয় তোমার এখানে নিজেকে খাপ খাওয়াতে অসুবিধাই হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের এই পরিবেশে তুমি অনেকটাই অপাংক্তেয় বলে আমার ধারণা। আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সঙ্গে তোমার মর্যাদার পার্থক্যটা কেবলই বাড়তে থাকবে। যে ব্যবধান কখনও কোন অবস্থাতেই তুমি ঘোচাতে পারবে না। তাই, যদি মনে কিছু না নাও, তবে একটা কথা বলতে চাইছিলাম।

কী?

বলছিলাম, তুমি যদি কোন মেসটেসে ওঠে যাও তাহলে তোমারও সুবিধা, আমাদেরও সুবিধা।

অনিশ্চিত গন্তব্য। মেস পাবে কোথায়? শহরে কে তাকে চেনে? আর মেসের ভাড়া, খাবার দাবারের টাকা আসবে কোত্থেকে? জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদানগুলোর কোন সংস্থান নেই। তারপরেও খালার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে মুহূর্তেই নিজেকে হালকা মনে হলো। ভাবলো সে এখন মুক্ত বিহঙ্গ। খোলা আকাশ পুরোটাই এখন তার। আর সাথে সাথেই মনটা বিমর্ষ হয়ে গেলো, যখন মনে হলো- খালার বাসা থেকে বের হয়ে যাবে কোথায়?

দুই

রের একটি পুরনো আবাসিক এলাকার এক প্রান্তে একটি মেসে উঠলো সজিব। জুটিয়ে নিলো দুটি টিউশনি। এই তার সম্বল। মাঝে মধ্যে জেসমিন খালার কাছ থেকেও সাহায্য হিসেবে কিছু টাকা পেয়ে থাকে। সেদিন পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে যখন বললেন- আর এখানে আসবি না কোন দিন, সেদিন থেকেই বন্ধ করে দিলো তাদের বাসায় আসা যাওয়া। বন্ধ করে দিলো সব ধরনের যোগাযোগ। গড়তে শুরু করলো নিজের একটা জগৎ। টিউশনিতে যাওয়া, কলেজের ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত হওয়া আর দিন শেষে মেসের চেয়ার টেবিল বিছানার সঙ্গে সখ্যতা- এই হলো সজিবের দৈনন্দিন কার্যতালিকা। কিছু দিনের মধ্যে টিউশনি পেয়ে গেলো আরেকটি। এখন সপ্তাহে সাত দিনই ক্রমান্বয়ে যেতে হয় টিউশনিতে। দম ফেলার ফুরসত নেই। এছাড়া, উপায়ও ছিলো না। দু’টি টিউশনির টাকায় মেসভাড়া, খাবার আর হাত খরচ চলছিলো না। নতুন টিউশনি নেয়ার পর হয়তো সেই অভাব ঘোচানো সম্ভব হবে। তবে এতে তার শরীরের ওপর চাপ পড়ে যাবে। তারপরেও কী আর করা?

সময় নদীর স্রোত থেমে থাকে না। কেউ থামাতে পারেও না। সজিবের জীবন চাকাও তেমনি ছুটে চলেছে। তবে সেটা স্রোতস্বিনী নদীর মতো নয়। বরং মৃতপ্রায় নদী যেভাবে বয়ে চলে, সেভাবে। কষ্টের জীবন তো টেনে নিতেই হবে। এমন জীবন সে মেনেই নিয়েছে কখনও, মাঝে মধ্যে হয়তোবা ‘অবচেতন’ মুহূর্তে মনে পড়ে তার জেসমিন খালাদের জৌলুস আর চাকচিক্যময় জীবন যাপনের চিত্র; যা ছেড়ে এসেছে অনেকদিন আগে। আজ নতুন বাসায় পড়াতে গিয়ে ফেলে আসা অতীত দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। কারণ, জেসমিন খালাদের বাসার পাশ দিয়েই যেতে হয় ওই বাসায়।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়া প্রথম দিন পড়তে বসেই হোচট খেলো স্যারের বিষণ্ন চেহারা দেখে।

বললা স্যার, আজ তো প্রথম দিন। আর দেখছি আপনার মনটাও ভালো নয়। তার চেয়ে আজকে পড়বো না। আগামী দিন থেকেই নিয়মিত লেখাপড়া শুরু করবো, কী বলেন?

কেন? কীভাবে বুঝলে আমার মন খারাপ? আজ তো আমাকে প্রথম দেখলে।

বোঝা যায় স্যার। আপনার চেহারাই বলে দিচ্ছে আপনি আজ অন্যমনস্ক।

সেটা কিছু নয়। বই খুলে পড়াশোনা করো; আজ বেশি সময় পড়াবো না।

পড়াতে পড়াতে এক পর্যায়ে স্বাভাবিক হয়ে যায় সজিব। খুঁজে পায় নিজেকে। মনে হলো তার ‘যে দিনগুলোকে ফেলে এসেছি, তাকে তো ফেরানো যাবে না।

অতীত নয়, বর্তমানই বাস্তব; আর অতীত এখন ইতিহাস। মেসে ফেরার সময়ও জেসমিন খালাদের বাসার সম্মুখ দিয়ে আসলো। কিন্তু একবারও ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না।

অথচ যে বাড়ি থেকে নিজেকে আড়াল রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই বাড়ির বর্তমান চিত্রটা কী? কেমন আছেন সেই বাড়ির মানুষজন ঐতিহ্যের কারুকার্য খচিত চমৎকার দেয়াল, দেশী-বিদেশী রকমারি ফুলের সমারোহ বাড়ির আঙ্গিনায়। পাশ্চাত্য আদলে গড়া অপরূপ বাড়িটির ভেতরের দৃশ্যটা কিন্তু অন্যরকম। ঘরের বাইরের দৃশ্য আর ভেতরের দৃশ্যে বিস্তর ফারাক। সজিব এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর এর চিত্র দিনে দিনে পাল্টে যেতে থাকে। জেসমিন সুলতানার ছেলে মেয়ে জিসান-শানুর উশৃঙ্খলতা বাড়তে থাকে। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা, হৈ হুল্লোড় নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুদের বাড়িতে গিয়েও তারা আড্ডা দেয় গভীর রাত অবধি, কোন কোন রাতে বাড়িও ফেরে না। জেসমিন খালারও এক পর্যায়ে ছেলে মেয়ে দুটির এই আচরণ অসহ্য মনে হয়। তিনি বারণ করেন। তারা শুনে না। বলে-

ওহ হো মা, তুমি এসব বুঝবে না। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে তো। না হলে আমরা তো ব্যাক ডেটেড থেকে যাবো।-মা হাসেন একটু। পরক্ষণেই হয়ে যান বিমর্ষ। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগেন। ভাবেন-আপডেটেড লাইফ লিড করেছেন নিজে, ছেলেমেয়েরা তো সেটাই ফলো করছে। এতে তাদের দোষ কী? বলেন-

ঠিক আছে। তোমরা আপডেটেড হও, কোন অসুবিধা নেই। তবে বাবারা একটু সতর্কভাবে চলাফেরা করে অন্তত বাইরে কোথাও দীর্ঘ সময় কাটানো থেকে বিরত থাকো। তাছাড়া, দেখছো তো কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের আশে-পাশের দেশগুলোতে এসে গেছে। আমরাও কিন্তু নিরাপদ নই।

আচ্ছা বুঝেছি। তুমি এবার মুখটা বন্ধ করো তো।

মুখ বন্ধ করলেন জেসমিন সুলতানা। এর দিন কয়েকের মধ্যেই দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আর বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, কলকারখানা। সুনসান নীরবতা দিনে রাতে। ব্যস্ত শহরটা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে দুয়েকটা যানবাহনের শব্দ শোনা যায়। এগুলো জরুরি কাজে নিয়োজিত। বড় রাস্তায় মাঝে মাঝে এম্বুলেন্স-এর হর্ণও শোনা যায়। কখনও লাউড স্পিকারে করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সরকারি নির্দেশনার প্রচারণা কানে আসে। পত্রপত্রিকা, বেতার-টেলিভিশনে আলোচনার বিষয় একটাই। সেটা হচ্ছে করোনা। দেশে দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া মহামারির তাণ্ডবে সন্ত্রস্থ বিশ্ববাসী। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশ-বিদেশে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে খোঁজ খবর নিচ্ছেন জেসমিন সুলতানা। বিলেতে অবস্থানরত স্বামী নাহিদ আলমের সঙ্গেও প্রায় প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে। সব সময়ই তিনি সর্বাত্মক সচেতন থাকার জন্য পরামর্শ দেন স্ত্রী সন্তানদের। সেদিন বলছিলেন স্ত্রীকে-

মনে সাহস রেখো। দুঃসময় কাটবে একদিন ঠিকই। তবে সেদিন হয়তো আমি থাকবো না। বা আমরা অনেকেই থাকবো না।

মানে? এটা কী বলছো তুমি? থাকবো সবাই থাকবো।

না, ধরো আমরা তো আর কেউই চিরজীবী নই। একদিন না একদিন তো এই খেলাঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। কন্ঠে জড়তা জেসমিন সুলতানার। বলেন-

যাবো সময় হলে সবাই। তবে এটা ভেবে এখন মন খারাপ করার কোন মানে নেই।

ঠিক তাই। মন খারাপ করো না। ভালো থেকো। সুখে থেকো। গুডবাই।- বলেই ফোন রাখলেন। নাহিদ আলম। আর এটাই হয়ে গেলো তার শেষ ফোনালাপ। স্ত্রীর সঙ্গে। পরদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কয়েকদিন ঘরে থাকার পর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ধরা পড়ে করোনা পজিটিভ। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তার স্ত্রী জেসমিন সুলতানা, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন। তারা এখানে ওখানে ফোন করে জানতে চান সর্বশেষ অবস্থা। এভাবে শ্বাসরুদ্ধকর সময় অতিক্রম করতে করতে একদিন দুঃসংবাদটি শুনতে হয় তাদের। মারা যান জেসমিন সুলতানার স্বামী নাহিদ আলম।

সময় একটি কঠিন বস্তু। অনেক শক্তিও তার। সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলে যায়। জেসমিন সুলতান ব্যক্তি জীবন, ঘরের চাকচিক্য জৌলুস মলিন হতে থাকে। একদিকে করোনার ধাক্কা, অপরদিকে স্বামী হারানোর কষ্ট। কমে গেছে, মানে বলা যায় বন্ধই হয়ে গেছে সংসারের আয়। অপরদিকে ছেলে মেয়ে দুটিও স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশে যেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। কোন বারণই তারা মানতে রাজী নয়। তাদেরকে বলা হলো- বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক; তোরা যাবে অসুবিধা নেই। কিন্তু তাদের এক কথাই আমরা এখনই যাবো। সাফ সাফ কথা। পরবর্তীতে আর এই সুযোগ থাকবে না।

তবে আমাকে কী করতে বলিস তোরা? এতো টাকা জোগাড় করবো কী করে? আমি তো প্রায় দিশেহারা সংসারই চালাবো কী করে, এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের সম্পদ আছে; বিক্রি করে দাও।

মানে, কী বিক্রি করবো?

এই বাড়ি, না হয় গ্রামের বাড়ি। কী হবে এগুলো দিয়ে? এসবতো আমাদের জন্যই।

গ্রামের বাড়ি তো আমাদের একার নয়। যৌথ বিক্রি করবো কীভাবে? আর এই বাসার প্রতিটিই বালুকণায়ই তোদের বাবার স্মৃতি মিশে আছে। বিক্রি করতে কষ্ট হবে না?

রাখো তো মা তোমার এই সস্তা ইমোশন। যা করার তাড়াতাড়ি করো। এখন করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পরে যদি আবার পরিস্থিতি অবনতির দিকে চলে যায়, তবে সব প্লানই ভেস্তে যাবে।

ছেলেমেয়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন জেসমিন সুলতানা। শহরের বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। স্বামীর নিজ হাতে সাজানো পরিপাটি আবাসনটি বিক্রি করে দিলেন। ক্রেতার কাছ থেকে মাস তিনেক সময়ও চেয়ে নিলেন। এর মধ্যে ছেলেমেয়েকে প্রবাসে বিদায় দিয়ে চলে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। মোটামুটি এই রকমই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।

তিন

দুনিয়াব্যাপী বিভীষিকাময় তাণ্ডব চালিয়েছে করোনা বছর কয়েক। তারপর কিছুটা দমে যায়। মানে ঢালাওভাবে আর সংক্রমণ হচ্ছে না। তবে আছে এর উপস্থিতি। এখানে ওখানে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। তবে এর উন্নত চিকিৎসাও বেরিয়েছে। তাছাড়া, বেশির ভাগ মানুষই নিয়েছেন করোনা প্রতিষেধক টিকা। সবাই একে আর পাঁচটা সাধারণ অসুখ বিসুখের মতোই বিবেচনা করছেন। ইতোমধ্যে যা করার করে ফেলেছে করোনাভাইরাস। লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখশান্তিও হরণ করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডের ধ্বংস যজ্ঞ খালি চোখে দেখা যায়; তবে এই করোনা ক্ষতটা সেভাবে দৃশ্যমান নেই। আয় রোজগার কমেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির। ওঠে দাঁড়ানোর নানা কসরত করে চলেছে তারা। বিত্তবানেরা যে খুব সুখে আছে, তেমন নয় কমেছে তাদেরও বিত্তের উত্তাপ। সজিব যে তিনটি পরিবারে এতোদিন টিউশনি করে আসছে সেই পরিবারগুলোও মোটামুটি সচ্চলই ছিলো। কিন্তু করোনার জোয়ারে তাদেরও সাংসারিক হিসাব কিতাবে গড়মিল শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি দিন ধরে যে ছাত্রকে পড়াচ্ছে সজিব, সেই হিমেলের বাবা একদিন বললেন-

তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। অবশ্য যদি তুমি মনে কিছু না নাও।

কী আঙ্কেল; বলেন।

দেখো বাবা, তুমি দীর্ঘদিন ধরে আমার ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছো। আর হিমেল তো মাশাআল্লাহ ভালো ফলাফলই করছে। তাছাড়া, এবার সে এসএসসিও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অপরদিকে আমাদের পারিবারিক আয়ও আগের মতো নেই। তাই বলছিলাম আপাততো কিছুদিন….. সবিজ আর বলতে দেয় না কিছু আঙ্কেলকে। সে বুঝে নেয় তিনি কী বলতে চান।

ঠিক আছে আঙ্কেল। আমি বুঝতে পেরেছি সবকিছু। বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। এছাড়া তো উপায় নেই।

আমি আসলে বলতে চাইছিলাম…..

না না, অসুবিধা নাই। তবে আমি মাঝে মধ্যে আসবো হিমেলের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর নিতে।

অবশ্যই-অবশ্যই। তুমি তো আমাদের পরিবারের একজন। বিদায় নিলো সজিব।

 

হিমেলদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে আর ভাবছে- হিসাবের রোজগার তো কমে গেলো, চলবে কীভাবে? আবার এটাও ভাবে যে, করোনা বিপর্যয়ে সবার অবস্থা তো এরকমই। জানি না বাকি টিউশনি দুটির কী অবস্থা। একটা আতংকের দোলাচলে সময় কাটতে লাগলো। এমনই আশঙ্কাজনক অবস্থায় পরবর্তী মাসের শুরুতেই আরেকটি টিউশনি চলে গেলো। বাকি থাকলো সর্বশেষ জেসমিন খালাদের বাড়ির কাছাকাছি যে টিউশনিটি নিয়েছিলো, সেটি। দ্বিতীয় টিউশনিটি চলে যাওয়ার পর মনটা তার ভেঙ্গে গেলো। কিছুটা হতাশা, কিছুটা শংকা নিয়েই ফোন করে ছাত্রীর বাসায়। ছাত্রী লিজার মা-ই ফোন রিসিভ করেন।

আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা। আমি সজিব বলছিলাম। আজ কি পড়াতে আসবো?

আলাইকুম আসসালাম। না বাবা; লিজা তো অসুস্থ দু’দিন ধরে। পড়তে পারবে না।

কী হয়েছে?

প্রচণ্ড জ্বর আর মাথাব্যথা। কিছ্ইু খাওয়া দাওয়া করছে না। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। দেখা যাক কী হয়।

ঠিক আছে খালা, আমি একবার লিজাকে দেখতে আসবো।

সে তো ভালো হয়।

অস্থিরতা বিরাজ করছে সজিবের মনে। তবে এই সান্ত¦না যে, সর্বশেষ টিউশনিটা অন্তত যায়নি। তর সইলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে গেলো লিজাদের বাসায়। সে বিছানায় শুয়ে আছে। করোনার কারণে অটোপাস করেছে এসএসসি। এতে সে খুশি নয়, যদিও তাকে জিপিএ-৫ দেয়া হয়েছে। স্যারের কাছে বললো তার এই কষ্টের কথা। সজিবের জবাব-এছাড়াতো উপায় ছিলো না। সবার যা গতি, তোমারও তাই।

তা ঠিক।- মৃদুস্বরে বললো লিজা।

তুমি কি কলেজে ভর্তির ব্যাপারে কিছু ভাবছো।

ভাবছি। দেখা যাক কী হয়।

সজিব চা খেয়ে মোটামুটি কোন ধরনের অস্বস্থিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়েই বেরিয়ে এলো লিজাদের বাসা থেকে। সে এখন কিছুটা স্বস্তিতে এই মনে করে যে, শেষ টিউশনিটা অন্তত এখনই যাচ্ছে না। কিন্তু অস্বস্তির আরও কারণ রয়েছে। রোজগার তো তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এলো। দিনযাপন কীভাবে?

পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলো সজিব নিজের আবাসস্থলের উদ্দেশ্যে। শরতের গোধূলী। আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা। শহরের এই এলাকাটি একটু নিরিবিলি। আবাসিক এলাকাটি গড়ে ওঠেছে বেশি দিন হয় নি। সে হিসেবে আবাসিক ভবনগুলো গিজ গিজ অবস্থায় নেই। বেশ ফাঁক ফাঁক করেই নির্মিত হয়েছে বাসভবনগুলো। হঠাৎ চেয়ে দেখলো একটি সুউচ্চ ভবনের কাছে নারকেল সুপারির গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শরতের চাঁদ। মনে পড়ে যায় গ্রামের বাড়ির কথা। শৈশবের স্মৃতি জাগানিয়া গ্রাম যেন তাকে হাতছানি দিচ্ছে। হাঁটছে পিচঢালা পথে, অথচ কল্পনায় ভাসছে তার গাঁয়ের মেঠোপথ। ভাবতে ভাবতে এক সময় চলে আসে জেসমিন খালাদের বাড়ির কাছে। পাচিলের ওপরে মাথা তুলে একটু তাকালো বাড়ির ভেতরে। নিস্তব্ধ সবকিছু। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। আশেপাশে সব বাসায় বাতি জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু জেসমিন খালাদের জিসান-শানু মহলে বাতি জ্বলছে না বললেই চলে। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মনে হলো কোন একটি রুম থেকে বৈদ্যুতিক বাতির কিছুটা আলো ঠিকরে পড়ছে বাইরের দেয়ালে। ভাবলো তবে কি বাসায় কেউ নেই? আবার মনে হলো কেউ না কেউ তো আছে; না হলে এই বাতি জ্বালাবে কে? অবশ্য জেসমিন খালা এবং তার ছেলে মেয়ে দুটি যে বাড়িতে নেই, এটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ তারা বাসায় থাকলে এভাবে আধো আলো আধো অন্ধকার থাকতো না। পুরো বাড়িটিই আলোয় ঝলমল করতো। সে সিদ্ধান্ত নিলো বাসার ভেতরে ঢুকে দেখবে ঘটনাটা কী? কিন্তু ঢুকবে কীভাবে? গেইটতো বন্ধ ভেতর থেকে। গেইটের ডানদিকে পিলারে কলিং বেল-এর সুইছে বারবার টিপতে লাগলো। ভেতরে কোন শব্দ হচ্ছে কি না বোঝা যায় না। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে গেইটের ভেতরে দাঁড়ালো।

কে? কাকে চান?- একটু কর্কশ স্বরেই বললো সে।

আমি জেসমিন খালার সঙ্গে দেখা করবো। গেইটটা কি একটু খুলবেন?

গেইট খোলার দরকার নেই। কারণ, আপনি যার কথা বলছেন তিনি এখানে থাকেন না।

কেন?

তিনি বাসা বিক্রি করে চলে গেছেন অনেক আগে গ্রামের বাড়িতে।

আর ছেলে মেয়ে দুটি?

তারা তো বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর জন্যই তো এই বাড়ি বিক্রি করতে হলো।

ও-আচ্ছা।

সজিব ধীর পায়ে মেসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। তবে পা যেন চলতে চায় না। কী থেকে কী হয়ে গেলো। জেসমিন খালার এতো সাজানো গোছানো সংসার কি তছনছ হয়ে গেলো? এতো কষ্ট করে যে নিবাসটি গড়ে তুলেছিলেন, সেটা হাত ছাড়া হয়ে গেলো এই ক’দিনের মধ্যে?… ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায় স্মৃতির গহিনে। একবার মনে হলো ফোন দেবে জেসমিন খালাকে, ফোন নম্বর তো আছে সেভ করা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভয় এসে ভর করে মনে। ফোন করবে কি করবে না। চিত্তদুদোল্যমান। ফোন করলে যদি তিনি রেগে যান। কারণ তিনি তো যোগাযোগ না রাখতে বলে দিয়েছেন। আবার তখন এই ভাবনাও আসে মাথায় পরিবারে এতো বড় একটা ঝড়ের ঝাপটা বয়ে যাওয়ার পরে জিসমিন খালার মনটা নিশ্চয় কিছুটা হলেও নরম হয়েছে, হয়তো তার প্রতি যে ক্ষোভ ঘৃণা এতোদিন জমা ছিলো তা এখন উবে গেছে। এরকম অনেককিছু ভাবনার পর সজিব সিদ্ধান্ত নিলো ফোন দেবে না জেসমিন খালাকে। যে রাস্তা থেকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিলো, তার নাম নেয়ার কোন দরকার নেই।

চার

গতিই জীবনের ধর্ম। সময়ের ঘড়ি চলতেই থাকে। বিরাম নেই। জীবনটাও তেমনি। চলবে। চলতেই হবে। গতি যেমনই হোক। সামনে ডিগ্রি ফাইনাল পরীক্ষা। এই সময়ে টিউশনিগুলো গেলো হাতছাড়া হয়ে সজিব মনোনিবেশ করলো নতুন টিউশনির সন্ধানে। কিন্তু কে দেবে তাকে টিউশনি? তবে সে আশাবাদী এই জন্য যে, করোনার ধাক্কা সামলে মানুষ কিছুটা হলেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর এই বিশ্বাস থেকেই অবশেষে সমর্থ হলো সে একটি টিউশনির ব্যবস্থা করতে। আপাতত এই দুইটি টিউশনির টাকায়ই তাকে চলতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। ব্যস্ত হয়ে গেলো সে নিজেকে নিয়ে। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো পুরনো স্মৃতিগুলো। এমনি একদিন সন্ধ্যায় সজিবের মোবাইল ফোনে রিং বেজে উঠলো। দেখলো স্ক্রিনে ভেসে ওঠেছে জেসমিন খালার নাম। সে তো অবাক; আবেগে আবার আপ্লুতও। অন্যকিছু না ভেবে ফোন রিসিভ করে-

হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়াআলিকুম আসসালাম। কেমন আছো বাবা সজিব?

 

এতো মোলায়েম সুর কেন; কণ্ঠের সেই তীর্যক রূপ কই? কর্কশতা কই?- প্রশ্নগুলো ভেতরে রেখেই জবাব দেয় সে-

এই তো ভালোই আছি খালাম্মা। আপনি কেমন আছেন? আপনি কি বাড়িতে চলে গেছেন? সেদিন আপনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় কেয়ারটেকার বললো- বাসা বিক্রি করে বাড়ি চলে গেছেন।

হ্যাঁ, ঠিক আছে। সে অনেক কথা। তুমি এখন কোথায়?

আমি টিউশনিতে। স্টুডেন্টকে পড়াচ্ছি। আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে যাই, দেখে আসি আপনাদের, দেখে আসি জন্ম মাটি।

কালই আমি আসছি শহরে তুমি আমার সঙ্গে চলে আসবে।

ঠিক আছে খালাম্মা।-মনে মনে কিছুটা আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো সজিবের।

পরদিন পড়ন্ত বিকেলে সাক্ষাৎ জেসমিন খালার সঙ্গে। কিন্তু দেখেতো বিস্ময়ে বিমূঢ় সজিব। চেহারার লাবণ্য কই? যে তারুণ্যদীপ্ত জেসমিন খালাকে দেখেছিলো সজিব, তিনি এখন একজন বৃদ্ধা।

জেসমিন খালার গাড়িতে চড়ে তারই সঙ্গে সজিব চলেছে শহর ছেড়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে। শহর থেকে পশ্চিমমুখী পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে নানা বর্ণের বৃক্ষরাজি-তাল, সুপারি, বট, হিজল। দূরে সবুজ গাঁ একটার সঙ্গে আরেকটি যেন হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের মাথার ওপর সূর্যটা ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে শরতের বিকেলের মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস গাড়ির জানালা গড়িয়ে যেন তাদেরকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আচমকা। বিমোহিত সজিব। তার ভালোই লাগছে সবকিছু। এর মধ্যে ভালো না লাগারও একটা বিষয় ঘুরপাক খায় তার মাথায়। এই যে সবুজে ঢাকা গাঁয়ের হাতছানি, সেখানে তো তার কোন বাড়ি নেই, আশ্রয় নেই; নেই আপন বলতে কেউ। এই ভেবে ভেবে সে জেসমিন খালাকে জিজ্ঞেস করে-

খালাম্মা। কী বলতে চিয়েছিলেন যেন গতকাল?

কী?

না, বলছিলেন অনেক কথা আছে। খালুর কথা বলেন, ভাই বোনদের কথা বলেন। তাছাড়া, এতো আদরে গড়া বাড়িটি বিক্রি করে দিলেন কেন?

জেসমিন খালা একনাগাড়ে বলতে লাগলেন সব কথা; স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ, ছেলে মেয়ের বিদেশ যাওয়া ইত্যাদি। সবকিছুই। বলতে বলতে এক সময় দু’চোখের কোণে জমে ওঠে অশ্রুর ফোঁটা। জেসমিন খালার চোখে জল দেখলো সজিব সম্ভবত জীবনে এই প্রথম। তার দেখা অতি কঠিন হৃদয়ের একজন মানুষ কীভাবে সময়ের আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে একটি অবুঝ শিশুর মতো হয়ে যেতে পারে, সেটাই ভাবছে সে। তিনি বললেন

সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে, স্বামী হারিয়ে, বাসা বিক্রি করে যখন শ্বশুরের বাড়িতে এলাম, তখন পড়লাম আরেক ঝড়ের মুখে। জিসানের দুই চাচা বললেন, তোমার এখানে জায়গা হবে ন্ াতোমার স্বামীই বাড়ির অংশটুকু বিক্রি করে দিয়েছেন আমাদের কাছে। আমি বললাম, কই শুনলাম না তো কোনদিন?

তোমার স্বামী যদি তোমাকে কিছু না বলে তাতে আমাদের কী করার আছে? তারা এভাবে আমার কোন কথাই শুনতে চায় নি। বলে- তোমার তো সম্পদের অভাব নেই। স্বামী রেখে গেছেন অনেক কিছু, আবার ছেলে মেয়ে দু’টিও বিদেশে।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছেন জেসমিন খালা। খুব তাড়াতাড়ি চেহারায় হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন। যাকে বলে কষ্টের হাসি। বলেন-

ভাবনা কীসের? আমার ছেলেমেয়ে বিলাতে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছে। তারাই আমার জন্য একটি নতুন বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে।

তাই নাকি? তা হলে তো খুব ভালো। আপনার কোন চিন্তা নেই। কোথায় সেই বাড়িটা?

সেখানেই নিয়ে যাবো তোমাকে। আমাদের গ্রামের প্রবেশ মুখেই। সুন্দর সবুজের ছায়াঘেরা পরিবেশে পরিপাটি বাড়িতে আমরা বেশ কজন থাকি সুখ দুঃখ, হাসিকান্না ভাগাভাগি করে। আমরা সবাই একই পরিবারের মতোই আছি যেন এক বাঁধনে। আমরা সারা মাসের খাবারের বাজার একদিনে করি। আজ গিয়েছিলাম শহরে এ মাসের বাজার নিয়ে আসতে। এই যে দেখছো যে গাড়িতে আমরা এলাম, সেটাও তো আমাদের জন্য কিনে দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে অনেক প্রশ্নই জেগে উঠছে সজিবের মনে। কিন্তু বলার সুযোগ পাচ্ছে না। জেসমিন খালা অনর্গল বলে চলেছেন কথাগুলো। ততোক্ষণে সূর্যটি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তাদের গাড়িও গ্রামের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। বৃক্ষরাজির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো তীরের মতোই যেন বিদ্ধ হচ্ছে তাদের চলন্ত গাড়িতে। একসময় গাড়িটি থামলো রাস্তার পাশে। চারপাশের সবই অচেনা লাগছে সজিবের কাছে। তবে এই রাস্তাটি তার অচেনা নয়। ছোটবেলায় দেখেছে রাস্তাটি। যখন জেসমিন খালার সঙ্গে শহরে গিয়েছিলো, তখন এই রাস্তায়ই যেতে হয়েছে তাদের। অবশ্য তখন এটি কাঁচা রাস্তা ছিলো। আজ ভালো পিচঢালা সড়ক। তবে তাদের গাড়িটি যে জায়গায় থেমেছে, সেখানে দক্ষিণ দিক থেকে একটি রাস্তা এসে সংযুক্ত হয়েছে। যেটা আগে ছিলো না। সে ভাবলো- এক সময়ের নিভৃত পল্লী আজ ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে।- জেসমিন খালা বললেন- নেমে পড়ো, আমরা এসে গেছি।

সজিব দেখলো রাস্তার পাশে দেয়াল ঘেরা একটি চারচালা টিনের ঘর। চারদিকে অসংখ্য গাছগাছালি। ভেতরে বেশকিছু নারী কন্ঠের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ির ভ্যান থেকে মালামাল নামাচ্ছে। সজিব কেবলই চারদিকে চোখ মেলে সবুজ প্রকৃতি অবলোকন করছে। দিনের আলো ডুবে গেলেও দিনের আবহ এখনও মিলিয়ে যায়নি। গুন গুন করে গাইতে চাইলো- ‘ওগো, চলো চলো আজ এই ধূপছায়া সন্ধ্যায়….. গাইলো, তবে মনে মনে; জেসমিন খালার সামনে গলা ছেড়ে গান গাইতে ভয়ই হলো, কিছুটা লজ্জাও। গেইট কুলে ভেতরে সব পণ্যদ্রব্য নিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার, এমন সময় গেইটের ওপরে চোখ পড়লো সজিবের। দেখলো একটা সাইনবোর্ড সাটানো আছে। তাতে সবুজ অক্ষরে লেখা- ‘সবুজছায়া বৃদ্ধাশ্রম’।

আপনার মতামত জানান

আবদুস সবুর মাখন

আবদুস সবুর মাখন; কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। পেশা সাংবাদিকতা। দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।