তিরিশের দশক ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সকল কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপনকালে তাঁদের কবিতা ও কবিপ্রতিভা নিয়ে যেসব আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে, তার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, নির্ধারিত কবির নাম অঙ্গীকার বা অস্বীকার করার পরপরই যে-নামটি সর্বত্র উচ্চারিত হয়, সেটি জীবনানন্দ দাশের। আধুনিকতার নিরিখে গতশতকের ওই সময়কার কাব্যতৎপরতা মূল্যায়নকালে একটি বিশেষ প্রকল্পে জীবনানন্দসহ পাঁচজন কবিকে গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটি ছিল নানা কারণে দুঃসাহসী ও বিতর্কিত। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত দীপ্তি ত্রিপাঠীর এই প্রকল্প আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় যখন প্রথম বাজারে এল, তখনো অন্য আলোচকদের আলোচনায় প্রেমেন্দ্র মিত্র বিস্মৃত নন, সমর সেন দেরিতে আবির্ভূত হলেও কাব্য-পরিণামে তিনিও ছিলেন আলোচনার দাবিদার, তাই কোনোভাবেই তর্কাতীত ছিল না বইটি, কিন্তু সত্য হলো : শেষপর্যন্ত প্রকল্পটি ওই পাঁচজন কবি জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী তাঁদের প্রতিভা ও মননক্ষমতার জোরে একটা সময় পর্যন্ত বাঙালি পাঠকের মনে ছাপ রেখে যায়। পাঠকেরা জানেন, আধুনিকতার প্রশ্নে সেই বইয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র বা পরে-প্রকাশিত সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের থাকা না-থাকা বিষয়েও কথাবার্তা এখনো জারি রয়েছে, কিন্তু সেখানে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো কবির নাম নেই। কথা হলো, সঞ্জয় ভট্টাচার্য কি এতটা অপ্রাসঙ্গিক ও অপাঙ্ক্তেয়? বাংলা কবিতার পাঠকের পাঠকের পক্ষে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে দীপ্তি ত্রিপাঠীর কৈফিয়ত ছিল, তিনি ‘রবীন্দ্র-যুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের কবি’, আর সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বিষয়বস্তুর দিক থেকে একদেশদর্শী। আধুনিক জীবনের জটিল রূপের বিচিত্র পরিচয় এঁদের কাব্যে নেই’…‘এঁদের লেখায় স্ফূর্তি থাকলেও বিত্ত কম’…‘বিভিন্ন ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ এঁদের শিথিল’ ইত্যাদি। কিন্তু এ-জায়গায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দিতে হয়নি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সৃজন-মনন উভয়কেন্দ্রী সক্রিয়তা সত্ত্বেও সে-বইয়ে তাকে আধুনিক হিসেবে বিবেচনা করা তো দূরের কথা, অনাধুনিক গণ্য করারও কোনো দরকার পড়েনি! সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে নিয়ে বিভিন্ন সময় কয়েকজন আলোচক আলোচনা করলেও এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্যতা বিষয়ে কেউ কখনো তীব্রভাবে লিখেছেন বলে জানি না। একথা ঠিক যে, কখনো কখনো কোনো বইয়ে বা সংকলনে কোনো কবির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কথা তোলা সংশ্লিষ্ট কবির জন্য অমর্যাদাকর ও আলোচকের জন্য অরুচিকর মনে হতে পারে, তবু আমরা এখানে এজন্যই প্রসঙ্গটি সামনে আনতে চাই যে, এটি—আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়—এমনি এক প্রভাববিস্তারী বই, যেটি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে [তো অবশ্যই, আরও ক-জনকেও স্থায়ীভাবে] আচ্ছন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। অশ্রুকুমার সিকদার তাঁর ‘তিনের দশক : আদিম দেবতারা’ শিরোনামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, একদিন এক মহিলা সূতিকাকারে নুন খাইয়ে যে-কবিদের খুন করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তাদেরকে নিয়ে অন্য আরেকজন মহিলা ‘গবেষণাগ্রন্থ লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধি পেলেন’, এই দ্বিতীয় ‘মহিলা’র নাম দীপ্তি ত্রিপাঠী, বইয়ের নাম আগেই বলেছি আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়, যার সূত্র ধরে তিনি লিখেছিলেন :
যারা ছিলেন নিষিদ্ধ প্রবাসী, গরিষ্ঠের ধারণায় উন্মার্গগামী, তাঁরা আজ স্বীকৃত শুধু নন, প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস, এমন কি উত্তরকালের স্বতন্ত্র বিদ্রোহের তাঁরা সম্মুখীন। ১৯৩০ সালে সুধীন্দ্রনাথের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৪১ সালে মৃত্যু হল রবীন্দ্রনাথের। এই দুই ঘটনার মধ্যে তিনের দশকের বৃত্তসীমা রচনা সম্ভব। ত্রিশ বছর পরে সেই দশকের কবিদের রচনাবলীর দিকে ফিরে তাকিয়ে আজ তার সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা চলে; অতি নৈকট্য ও অতি দূরত্বের দুই রকম অসুবিধা থেকেই আমরা মুক্ত।
এমন স্বস্তি ও সস্থির সিদ্ধান্ত ওই বইটির প্রসঙ্গ ধরেই, এবং শুধু অশ্রুকুমার সিকদারই নন, ওই সময়কার আধুনিক বাংলা কবিতাবিষয়ক বহু আলোচনায় ওই বইয়ের প্রভাব দেখা যায়। এই মুহূর্তে উল্লেখ করা যেতে পারে ইউজিসির অনুদানে অনুষ্ঠিত সেমিনারের পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকাশিত ও জীবেন্দ্র সিংহরায় সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা : বিচার ও বিশ্লেষণ [১৯৮১] সংকলনের অন্তর্ভুক্ত মৃণালকান্তি ভদ্রের ‘ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব ও আধুনিক বাংলা কবিতা’ শিরোনামক প্রথম প্রবন্ধটির কথা, যেখানে তিনি আধুনিক কবি বলতে ত্রিপাঠীকথিত ওই পাঁচজনকেই বুঝেছেন এবং তাঁরই কবিক্রম অনুসরণ করেছেন। ওই পাঁচ কবিকে প্রতিষ্ঠাদানকারী দীপ্তি ত্রিপাঠীর এই বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য উপস্থাপিত এবং আধুনিক কবিতাবিষয়ে অল্পজ্ঞাত এবং অন্য বিষয়ের খ্যাতকীর্তি গবেষক শশিভূষণ দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে রচিত। এটি যার তত্ত্বাবধানেই রচিত হোক না কেন, প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সেখানে বুদ্ধদেব বসুর ‘অমিত উৎসাহ’ই ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ‘তাঁর সাহায্য ভিন্ন এ-গ্রন্থের অনেকখানি অপূর্ণ থাকত’ এই কথাটি বইয়ের ‘সূচনা’য় উল্লেখ করেছেন এর লেখক। বইয়ের রচনাকাজে বুদ্ধদেবের স্বহস্ত পরিচর্যার উল্লেখ অবশ্য কোথাও নেই, থাকলেও উল্লেখ থাকার কথা নয়, তবে চিন্তা-উপাদানগত যোগ এবং কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে-পরামর্শ রয়েছে তার প্রমাণ খুঁজে পাব বুদ্ধদেব বসুর আমার কবিতাভবন বইয়ের স্মৃতিকথায়ও। কবিতা পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করার সময় সক্রিয় কবিদেরই যে তিনি নির্বাচন করেছিলেন তার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি যাদের নাম উল্লেখ করেছিলেন, এরাই ছিলেন দীপ্তি ত্রিপাঠীরও গণ্য-অগণ্য কবি। তিনি লিখেছিলেন : ‘আমার কৃতিত্ব হয়ত এটুকু যে উৎসাহের ঝোঁকে দু-একবার ভুল ক’রে থাকলেও মোটের ওপর ঠিকঠিক ঘোড়াগুলিকেই ধরেছিলাম। জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী; দ্বিতীয় দফায় সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়’। আর কবিক্রম বিষয়েও একথা বলা যায় যে, ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত বইয়ের আলোচিত কবিদের ক্রম-নির্ণয়ে জন্মসাল বা অন্য কোনো বিচারেই জীবনানন্দ দাশের আগে বুদ্ধদেব বসুর নাম যুক্ত হতে পারে না, কিন্তু, কার্যত তা-ই হয়েছিল; তাতে তাঁর সরাসরি যুক্ততা ছিল তা বলব না, কিন্তু এক্ষেত্রে গবেষকের ‘সাহায্য’কারী হিসেবে তাঁর সায় ছিল এ-অনুমান মিথ্যে হওয়ার সম্ভাবনা কম। বইটি প্রকাশের আগেই জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হওয়ায় ভালোই হয়েছে, নাহলে একারণে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হতো তার প্রমাণ আছে অন্য প্রসঙ্গে বলা ভূমেন্দ্র গুহর লেখায়। তবে, এ-বিষয়ে তাঁর গুণগ্রাহিতার পক্ষে অশোভন হলেও বুদ্ধদেব বসু হয়ত নিজেকে জীবনানন্দের চেয়েও বড়ো কবি মনে করতেন, কেননা মহাপৃথিবীর পর থেকে তিনি আর জীবনানন্দের কবিতা পছন্দ করতে পারছিলেন না। অথচ এ-পর্যায়ের কবিতাকেই বিশেষভাবে পছন্দ করেছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য—এ-প্রসঙ্গে ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছিলেন :
মহাপৃথিবী’র সময় থেকেই প্রায় জীবনানন্দ’র কবিতা বুদ্ধদেব বসুকে আর টানছিল না; খ্রি. ১৯৪৬ তিনি কবিতা পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখে জীবনানন্দ’র সাম্প্রতিক কবিতাকে একেবারে নস্যাৎ ক’রে দেন। অপর পক্ষে, এই সব নস্যাৎ-করা কবিতাই জীবনানন্দ’র কাব্যের প্রৌঢ় পরিণতি বলে মনে করেছেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য; এই রকম মনে করার ফলে জীবনানন্দ’র ও তার কবিতার বিষয়ে যে-সব দায়িত্বশীলতা অর্জিত হয়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দ’র জীবনের শেষ-দিন পর্যন্ত সে-সম্বন্ধে সচেতন থেকেছেন।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তিরিশের দশকের কবি ও পাঠকদের আবিষ্টতা ও দ্বিধা দুইই ছিল; এছাড়াও গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে ছিল বিভিন্ন মতও—এরকম কোনো কারণে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে কি কোনোরকম দূরত্ব তৈরি হয়? বিষয় ও কেন্দ্র যেখানে জীবনানন্দ, সেখানে তা বিলকুল উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এ-কথা সত্য যে, প্রথম দিকে দুজনেই ছিলেন জীবনানন্দের কবিতার অনুরাগী ও প্রচারক, এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘকালীন বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া না-গেলেও দুজনেই কিছুদিন অন্তত পরস্পরের কার্যক্রমের সহযোগী ছিলেন। পূর্বাশার প্রথম পর্বের প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, একাঙ্কিকা প্রভৃতি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হওয়ায় সেখানে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বুদ্ধদেব বসু; ১৯৪৪ সালে ‘তিনজন আধুনিক কবি’ নামে যে-বইটি লেখেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তার তিন কবির মধ্যে একজন ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, কবিতা পত্রিকা প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ পূর্বাশা প্রেসে বিনামূল্যে ছেপে দিয়েছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। অন্যদিকে কবিতার প্রথম সংখ্যায় কবিতা লিখেছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, এরপর তাঁর আর কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা সেখানে ছাপা হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল বইয়ে একাধিক গৌণ কবির আলোচনা থাকলেও সেখানে সঞ্জয় ভট্টাচার্যর মতো কবি ছিলেন অনালোচিত। কিন্তু আসলেই কি এরকম অনালোচিত থাকবার মতো কবি তিনি ছিলেন?
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তিরিশের দশকের কবি ও পাঠকদের আবিষ্টতা ও দ্বিধা দুইই ছিল; এছাড়াও গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে ছিল বিভিন্ন মতও—এরকম কোনো কারণে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে কি কোনোরকম দূরত্ব তৈরি হয়? বিষয় ও কেন্দ্র যেখানে জীবনানন্দ, সেখানে তা বিলকুল উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এ-কথা সত্য যে, প্রথম দিকে দুজনেই ছিলেন জীবনানন্দের কবিতার অনুরাগী ও প্রচারক, এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘকালীন বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া না-গেলেও দুজনেই কিছুদিন অন্তত পরস্পরের কার্যক্রমের সহযোগী ছিলেন।
কবিতা লেখার শুরুতেই যে-কবি রবীন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথের মতো উচ্চম্মন্য কবি-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তিনি কিভাবে এতটা অনালোচিত রয়ে যান এই প্রশ্ন যে-কারও মনে জাগা স্বাভাবিক। বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর সেটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠালে তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকের ভালো-মন্দ বিচার করে তিনি যে-চিঠিটি লিখেছিলেন সেখানে সঞ্জয় ভট্টাচার্যর কবিতা বিষয়ে সপ্রশংস উল্লেখ ছিল। কুমিল্লায় থাকা অবস্থায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয়-এ কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, এরপর ‘পরিচয়-পত্রিকার অভ্যর্থনা’ নিয়ে কলকাতায় আসেন এবং সেই ‘শহরের স্নায়ুর সঙ্গে যাবজ্জীবন’ জড়িয়ে পড়েন। উভয়ের কবিতার স্বভাবগত পার্থক্য থাকলেও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অল্প কয়েকটি কবিতার মধ্যে ‘সময়যোগ্যতা’ লক্ষ করে সুধীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন : ‘আপনার লিরিকগুলো নৈর্ব্যক্তিক হয়’…‘আধুনিক বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রকৃত গীতিকবিতা লেখেন কেবল আপনি’, এবং আরও লিখেছিলেন :
বিপর্যস্ত আধুনিক কাব্যের আবহাওয়ায় এ কাব্যের বিশেষত্ব আছে—যে সমস্ত স্বপ্ন, যে সমস্ত অনুভূতি অত্যন্ত সন্তর্পণে আলতো পায়ে আমাদের কল্পনার মাটি মাড়িয়ে চলে, লেখক তাদের ধরে রাখতে চেয়েছেন সোনালি ভাষার ইন্দ্রজালে।
সুধীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি নিঃসন্দেহে সদর্থক ও স্বাগতিক; কিন্তু এরপরও এই ভাবনা হয় যে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর এই লিরিকপ্রিয়তার কারণেই আধুনিক কবিগোষ্ঠীর বাইরে চলে গিয়ে প্রচারপ্রদীপের আড়ালে পড়ে যান কি না। বিষয়টি চোখে পড়েছে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো আরেক অল্প-আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ কবি ও সমালোচক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তিনি খেয়াল করেছিলেন, প্রথম বইয়ের আলোচনাকালে পরিচয় পত্রিকায় সুধীন্দ্রনাথ-প্রদত্ত কবিপরিচয়টি কীভাবে কবিতা পত্রিকায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অথচ তিনি এই বইয়েই খুঁজে পেয়েছেন ‘প্রথাঅতিগ’ নিজস্ব ‘আধুনিকতা’ এবং বইয়ের মুখপাতে-লিখিত সূক্তির উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে সিকতার সঙ্গে আশ্লেষময় সাগরের ছবির কথা বাদ দিলে থাকে ‘শর্বরীর স্রোত বা স্বপ্নকলনাদ—সবই ব্যাকরণভাঙা আধুনিক আর্যপ্রয়োগ, জাক্সটাপোজিশন।’ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কোনো কবিমূর্তিই যেহেতু আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি, বা যেটুকু তৈরি হয়েছে, তা তো এক নিদ্বর্ন্দ্ব লিরিক-রচয়িতারূপেই, সেকারণে দেবীপ্রসাদের এই মন্তব্য অনেকের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তাই তাঁর এই অনুসন্ধানী মন্তব্যের সূত্র ধরেই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতাজগতের দিকে তাকাতে পারি।
তাঁর প্রথম বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘নিশীথ-নগরী’ কবিতায় রয়েছে রূপকথার আবহ, কিন্ত তার পরিবেশ নাগরিক; নগরীর ট্রাম, লরি আর খড়বোঝাই গরুর গাড়ির চলার আওয়াজে কান্নায় বিদীর্ণ হয়ে-যাওয়া কেউ-একজন রাজকন্যার জাগরণের অপেক্ষা করছে, কিন্তু নগর-যন্ত্রই সেখানে বাধা : ‘দেখ তো কোনো পাখি জেগে উঠেছে কি না/হতেও পারে সে তার হীরামন।/বেজে উঠল হঠাৎ মোটরের তীক্ষ্ণ হর্ন—/মিথ্যে কথা, রাজকন্যা তো জাগেনি।’
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘ইলেকট্রিসিটি’ কবিতায় রয়েছে ঘরে-বাইরের সংবাদ যা কোনোটাই এখন আর কাম্য নয়—ঘর থেকে বাইরে গেলে সেই পুরোনো চাঁদ, পুরোনো জ্যোৎস্না, পুরোনো রজনীগন্ধার গন্ধ, কিন্তু ঘরে এলে আবার নতুন দানব : ‘ফিরে যাই ঘরে/জ্বলছে যেখানে নতুন দানব/ইলেকট্রিসিটি’; তাহলে ঘরে-বাইরের নতুন-পুরোনো আলোর বাইরে আর কী চাচ্ছেন কবি?
সূর্য থেকে মুছে ফেলো সাত রঙ
………………………—দেখো নতুন কারা আসে :
আকাশের নীল পাথর ঢেকে রেখেছে কাদের
……………………...— আসুক তারা বেরিয়ে—
ফিরিয়ে আনো মাটির যৌবন।
কোনো নতুন শব্দ নয়, নতুন ধরনের বাক্যও নয়, কিন্তু এরপরও নির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল, আকাশের নীল পাথরে ঢাকা ওরা কারা; তবু, ধারণা করি, যারা ‘মাটির যৌবন’ ফিরিয়ে আনবে, এরা হলো তারা; তখন হয়ত নতুন দিন, নতুন সময়ও ফিরে আসবে। এই যে নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না, হয়ত এই সকল রহস্যের কারণেই দীর্ঘদিন প্রচারপ্রদীপের আড়ালে-পড়ে-থাকা কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ‘নীল পাথরের আকাশতলায়’ নামে একটি কবিতাই লিখলেন, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত বইয়ের নামও রাখলেন নীল পাথরের আকাশ। পড়ে দেখা যেতে পারে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতার না-বোঝা বিষয়রহস্যের কোনো তফসির বা কুলকিনারা পাওয়া যায় কি না :
টুকরো একটু নিস্তব্ধ জ্যোৎস্না—যেন রহস্য মন্দিরের চূড়া
সামান্য একটু উন্মনা হাওয়া—যেন জন্মান্তরের দরজায় খেলুড়ি
প্রাচীন নীল পাথরের আকাশ—যেন অব্যক্তের অনতিচ্ছদ আদিভূমি
শুধু আজ নয়—মাত্র এইটুকু নিয়ে বহু রাত কেটে গেছে, যায়,
আলম্বিত-কেদারায়-বসা লোকটির
বয়স অনেক হল, তবু এখনো তো মনে হয়
পৃথিবীর আদি কথা, রহস্যের অন্ত্য অঙ্ক—ওদেরি হাতের মধ্যে স্থির।
সে যেন দরজার বাইরে বসে আছে কবে থেকে
মন্দিরসোপানে—
যত দিন যায়
মনে মনে
সিঁড়ি ভেঙে ঊর্ধ্বে ওঠে—
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে শেষে অব্যক্ত মেলায়।
মূল ও বিস্তার এই দুই জায়গায়ই সেই অব্যক্ত বার্তা : ‘প্রাচীন নীল পাথরের আকাশ—যেন অব্যক্তের অনতিচ্ছদ আদিভূমি’। ঠিক বোঝা যায় না আলম্বিত-কেদারায়-বসা এই লোকটি কে, হয়ত সঞ্জয় ভট্টাচার্য, হয়ত মণীন্দ্র গুপ্তের কাছেও কবিতাটি রহস্যময় মনে হওয়ায় আদিকবিকে চরিত্র বানিয়ে কবিতাটি লিখেছেন। কবিতার নিহিতার্থ স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও এখানে এই কথাটি আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, কবি ও সমালোচক জহর সেনমজুমদার কেন সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে ‘কবিদের কবি’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন কিভাবে প্রতিটি পঙ্ক্তির শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে পাঠক ও সমালোচকেরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। যারা তাঁকে লিরিকরচয়িতা আখ্যায়িত করে সসম্মান আগলে রাখেন, তারা পড়ে দেখতে পারেন তাঁর ‘বর্তমান’ শিরোনামক কবিতাটি :
আবারো সে সূর্য আসে—কত ক্ষয় হয়ে গেলে পর
এ আলো নূতন আলো—প্রাক্তন সে বিদ্যুতাণুগুলি
কোথায় হারিয়ে গেছে হয়ে সময়ের পথ-ধূলি,
এখনো সূর্যকে তবু পায় পল্লী, প্রান্তর শহর
প্রথম বিস্ময় যেন। আমাদের ভবিষ্যৎ নেই :
নপুংসক বর্তমান ক্ষুদ্র রাসায়নিকের মতো
রক্তময় অতীতের বীজাণূ মিশায় অবিরত,
প্রেতের ছায়াকে নিয়ে মরি শেষে সেই ছায়াতেই
এ-কবিতার শেষ স্তবক :
অনেক আলোর ক্ষুধা অসমাপ্ত চিত্র পৃথিবীর।
এ আলো নূতন আলো—কোনো শিল্পী পারে এনে দিতে
ইস্পাতে, শস্যের ক্ষেতে, মানুষের অজস্র হাসিতে
তখন পৃথিবী সূর্য প্রতিদিন উজ্জ্বল, অস্থির ॥
উদ্ধৃত স্তবকের অর্থ এই যে, ক্ষয়িত সূর্য বা সূর্যালোক ও তার বিদ্যুতাণূগুলি সময়ের ‘পথধূলি’তে হারিয়ে যাওয়ার পরে কবি আকাক্সক্ষা করছেন এমন কোনো শিল্পীর, যার কর্মে ও তৎপরতায় নানা স্তরের—ইস্পাতের, শস্যক্ষেতের—মানুষের জন্য নতুন আলোর বার্তা আসবে, তথন পৃথিবী সূর্য উজ্জ্বল ও অস্থির হয়ে উঠবে। এখানে ‘অস্থির’ বিশেষণটি যে চলনশীলতারই অর্থ বহন করছে তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখা জরুরি, এই কবিতাটি ১৯৪২ সালে প্রকাশিত সংকলিতা বইয়ের অন্তর্ভুক্ত, এরও আগে আরও সহজভাবে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত পৃথিবী কাব্যগ্রন্থের ‘ঘাম’ কবিতায় পৃথিবীর প্রতি তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, আর ফুলের গন্ধ নয়, এবার ঘামের গন্ধ তার ভালো লাগছে, কেননা ঘামের দামে সবুজ শস্য, সূর্যময় কয়লা, শক্তিময় শ্বেত ইস্পাত পাওয়া গেছে আর শিল্পীদের ঘর্মাক্ত হাতেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর ‘নূতন প্রতিমা।’ বইয়ের ‘শহর’ কবিতায় দেখেছেন ভিক্ষুকের অক্ষম দেহে, গণিকার নিষ্প্রভ চোখে এক ‘নেই জীবনের অবিরাম মৃত্যুস্তুতি’, এবং লক্ষ করেছেন সেখানে মানুষের অজস্র প্রয়োজন কীভাবে অজস্র আয়োজনেই সমাপ্ত হয়ে যায়। এই সবই নগরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা; কিন্তু আবার এখানে বসেই ‘বাংলাদেশ’ নামক এক অসাধারণ কবিতায় তিনি আঁকছেন সৌন্দর্য এবং ভাঙা-গড়ার চিত্র :
গাছের ছায়ারা ভিজে কালো করে দিয়ে যায় জল
সেখানে কচুুরিপানা সবুজ ঝিনুকে তবু করে ঝলমল,
যেটুকু বা আছে অবকাশ
কাঁটাঝোপে এলোমেলো ঘোলাটে আকাশ।
তারপর—
এাটির নরম স্রোত নদী হয়ে ভাঙে পাড়, গড়ে বালুচর—
আবার বাংলার ছবি ধানের রোমশ দেহে জেগে ওঠে
…………………………………..চাষী বাঁধে ঘর।
মনে রাখতে হবে ১৯৩৯ ও ১৯৪২ সালে যথাক্রমে পৃথিবী ও সংকলিতা কাব্যগ্রন্থে যখন এই কবিতাগুলো প্রকাশিত, তখন ওই দিকে ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হলো বনলতা সেন এবং ১৯৪৪ সালে মহাপৃথিবী—এই সময় জীবনানন্দের কবিতার ভালো-মন্দ বিচারের জন্য বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য এগিয়ে এলেও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা বিচারের জন্য কেউই এলেন না। অথচ উপরের উদ্ধৃতি থেকে তো অবশ্যই, এছাড়াও তাঁর উক্ত বই দুটিতে আরও কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে যা পড়লে বোঝা যায় যে-সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে জীবনানন্দ ক্রমশ সমাদৃত হতে থাকবেন, তার কিছু পরিচয় ওই দৃষ্টান্তগুলোতেও বর্তমান। তবু সমভাব সত্ত্বেও জীবনানন্দকে নিয়ে শুরু থেকেই উদারভাবেই লিখে চললেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, এবং লিখেছেন এমন সময়ও যখন মহাপৃথিবীর বিরূপ আলোচনা করলেন বুদ্ধদেব বসু। যে-বইটি পড়ে বুদ্ধদেব বসুর মনে হলো জীবনাননন্দ তাঁর নিজের পৃথিবীর বাইরে চলে গেছেন, সেটি পড়েই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মনে হয়েছিল তাঁর সমাজ-ইতিহাসের পারিপাশ্বিক চেতনা এখানে প্রৌঢ় পরিণতি লাভ করেছে। এ-বিষয়ে ১৯৫২ সালে সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে-লিখিত এক চিঠিতে জীবনানন্দ জানিয়েছিলেন, আমাদের দেশে সঞ্জয় ভট্টাচার্যই একমাত্র খাঁটি ভাবুক ও সমালোচক যিনি ধূসর পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত সমস্ত বইয়ের দোষগুণ ঠিকভাবে বুঝেছিলেন, তাই তিনি তাঁর হাতে কবিতা ছেড়ে দিয়ে আশ্বস্ত হতে পারেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবি জীবনানন্দ দাশ-এর মতো অনবদ্য বইটি তো দুজনের কেউই দেখে যেতে পারেননি, শুধু মৃত্যুর আগে অসুস্থ থাকাকালে তার প্রুফ সংশোধন করে যেতে পেরেছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং এটিই ছিল তাঁর মূত্যুর আগে লিখিত সর্বশেষ গদ্যরচনা। এই বইয়ে তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন : ‘জীবনানন্দ যুগের মানসিকতার যোগ্য ভাষা দিতে পেরেছিলেন। জীবনানন্দ আমাদের যুগের মনোভঙ্গির প্রথম কবি’…‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙালি কবিতা-পাঠকের চিত্তে যদি কেউ প্রগাঢ় সাড়া এনে থাকেন তাহলে তিনি জীবনানন্দ দাশ’ এবং এ-ও বলেছিলেন, আধুনিক কবিতাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় নিয়ে যেতে যারা সচেষ্ট, তাদের মধ্যে মুখ্য কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। বইয়ের পরিশিষ্ট পড়লেও বোঝা যায়, জীবনানন্দের প্রতি আর কোনো কবিই এতটা উদার ও সংবেদনশীল ছিলেন না। এতে কবি হিসেবে জীবনানন্দের যে লাভ হয়েছে তার স্বীকৃতি তো তাঁর চিঠিতেই রয়েছে, ভক্তদেরও তা অজানা নয়, কিন্তু এর ফলে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কি কোনো ক্ষতি হয়েছে? কবিতার মূল্যায়ন, প্রচার প্রভৃতি ছাড়া বৈষয়িক কাজেও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উপর নির্ভর করতেন জীবনানন্দ, তিনিও সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতার চেষ্টা করতেন; ভূমেন্দ্র গুহর স্মৃতিকথা পড়ে বুঝতে পারি, প্রীতিবশত কখনো কখনো জীবনানন্দের দৃশ্যত/আপাত অস্বস্তিকর ইচ্ছারও প্রশ্রয় দিতেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, কিন্তু এই সব নিয়ে তাঁর কোনো খেদ এজন্যই ছিল না যে, কবিতাক্ষেত্রে কিছুটা সমভাব থাকলেও দুজনের সাহিত্যিক অভিপ্রায় ছিল আলাদা, রুচিও ছিল ভিন্ন। খেদ থাকলে, অন্যান্য কবিকে নিয়ে লেখা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে কোনো মূূল্যায়ন না-লেখার কারণে জীবনানন্দের প্রতি রুষ্ট হতেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, এবং রুষ্ট হলে মৃত্যুর আগমুহূর্তে তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই লেখার চেষ্টা করতেন না। কথাগুলো এজন্যই উঠছে যে পবিত্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘উত্তর জীবনানন্দ বাংলা কবিতা’ [১৯৮১] প্রবন্ধে একটি সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করেছেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখতে গেলে যা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তিনি লিখেছেন :
জীবনানন্দের মায়াবী ইশারায় ঠিক অনুরূপ আত্মবিসর্জনে বিস্মৃত হলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, যার মৌলিক ক্ষমতা ছিল না তা নয়, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গেল জীবনানন্দ-মুগ্ধতায়। কোনো ক্ষমতাবান কবি অন্যপ্রতিভা, তা যতই প্রভাবশালী হোক, তার দ্বারা আচ্ছন্ন হন কি ভাবে?
এখানে বিস্মৃতির প্রসঙ্গটি কেন এল তা বোঝা মুশকিল, বাংলা বা বিশ্বকবিতার ইতিহাস কি এমনটি বলে যে শতবছরের মধ্যেই কোনো কবি স্থায়ীভাবে বিস্মৃত হয়ে যান? জীবনানন্দ-মুগ্ধতা ঠিকই ছিল তাঁর, কিন্তু কোনো দৃষ্টান্ত উপস্থাপন না-করে ‘আত্মবিশ্বাস’ হারানোর প্রসঙ্গটি উঠছে কেন? জীবনানন্দের কবিতার মূল্যায়ন ও কবিতাবহির্ভূত ব্যাপারে অব্যাহত সমর্থনের কথা মাথায় রেখে যদি মন্তব্যটি করা হয়ে থাকে, তাহলে বলব, সঞ্জয় ভট্টাচার্য কখনোই আত্মোপকারে পারদর্শী ছিলেন না, বরং বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর আত্মহারা প্রচারকসত্তা সবসময়ই ছিল প্রবল, এ-ক্ষেত্রে প্রধানত জীবনানন্দ এবং আরো অনেকেই উপকৃত হয়েছেন, তাতে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি ছিলেন খেদহীন, বরং এক্ষেত্রেই তিনি দৃষ্টান্তযোগ্য মহত্তের পরিচয় দিয়েছেন। আর মন্তব্যটি যদি কবিতার ভাষার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তাহলে এর কিছু দৃষ্টান্ত আগেই উল্লিখিত, তারপরও এখানে একথাটিও যুক্ত করতে চাই যে, জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রথম দিককার কবিতাগুলোর পা-ুলিপির রচসাকাল বিবেচনা করলে আমরা পরস্পরপ্রভাবী দৃষ্টান্ত খুঁজে পাব। কিন্তু একথা ঠিক, এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যও তা স্বীকার করেছেন, সেই ভাষাকে নিরন্তর পরিচর্যার মধ্য দিয়ে তার সীমানা বহুভাবে বহুদিকে প্রসারিত করেছেন জীবনানন্দ। জীবনানন্দ যখন এই কাজটি করে যাচ্ছিলেন, এবং প্রতিটি বই প্রকাশের পরে নিজের জায়গা থেকে নানাজনের কাছে আলোচনার জন্য চিঠি লিখছেন, তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্য কবিতায় পূর্ণমনস্ক থেকেও আত্মোপকারের বাইরে দাঁড়িয়ে, ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-নৃতত্ত্ব-এর নানা তথ্য-তত্ত্ব ঘাঁটছেন, পূর্বাশার ভার মাথায় নিয়ে দায়িত্বের সঙ্গে নানা বিষয়ে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে চলেছেন, কবিতায়ও তার ছিটেফোঁটা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। এই সুযোগে তাঁর কোনো কোনো বন্ধু তাঁর কবিপরিচয়ের ওপর তা চাপানোর চেষ্টা করেছেন, যা তাঁকে ভীষণ ব্যথিত করেছে। তাঁর কবিতা পড়ে পাঠক কতটা সাড়া দিয়েছেন সে-বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমনটিই জানিয়েছিলেন : ‘আমার একটা দুর্নাম আছে প্রথম থেকেই—আমি দুর্বোধ্য, আমি মোটেও প্রাঞ্জল নই, আমায় বোঝা যায় না। এটা হচ্ছে আমার প্রতি যারা আক্রমণাত্মক, তাদের কথা। আর যারা বন্ধু হয়ে আমাকে বিপন্ন করেছে, তারা বলেছে যে, ওসব ইন্টেলেকচুয়াল লেখা।’ অথচ এই বিষয়গুলোর মধ্যেই, অর্থাৎ জ্ঞানজগৎ থেকে প্রাপ্ত অবচেতনের স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে-আসা পুরাণ-উপকথার চরিত্র শকুন্তলা-দুষ্মন্ত, ইউসুফ-জোলেখা, ডিডো-হেলেন-এডোনিস, সাইকি-কিউপিড, উমা-উর্মিলা-উর্বশী ও সাত ভাই চম্পার প্রতীকী চলাফেরায় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় খুঁজে পেয়েছিলেন ‘বহুঅপেক্ষিত রবীন্দ্রপ্রমুক্তির রন্ধ্রপথ’। এ-কথার সত্যতা রয়েছে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বক্তব্যেও, তিনি জানিয়েছিলেন, সমকালীন কাব্যতৎপরতায় তাঁর আগ্রহ ছিল কম, শুধু সচেতন ছিলেন লেখা যেন রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র হয়। একারণেই প্রির্যাফেলাইটদের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা ছিল, তাঁর সেসময়কার প্রিয় কবিও ছিলেন উইলিয়াম মরিস। জীবনানন্দ নিজে কখনো না বললেও, তাঁর কবিতায়ও প্রির্যাফেলাইটদের প্রতি মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুও।
কিন্তু এই সবকিছুর পরেও তিনি রয়ে গেলেন অনালোচিত, কারণ কল্পধারণায়-তৈরি আধুনিকতায় আর নগরসভ্যতার নিত্যনতুন ‘সংক্রামে’ আলোড়িত সমাজে তাঁর এই ‘নিস্তাপ’ ‘নিষ্কায়’ প্রতীক-রাজ্যের আধুনিকতা ছিল নতুন মূল্যায়নের জন্য উচ্চাকাক্সক্ষী। তিনি যখন বলেন, ‘হয় আমি সাহিত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, না হয় বাঙলা দেশের পাঠক এবং সমালোচকেরা…’, তখনো এ-বিষয়ে শেষকথায় পৌঁছা যায় না। তবে, মৃত্যুর কিছু আগে, ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে-প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে এ-ও বলেছিলেন যে, ‘আর এক ছত্রও লিখতে ইচ্ছে করে না আমার’। মননক্ষেত্রে এতটা সক্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি যে-পরিমাণ কবিতা লিখে গেছেন, তা কি কোনোভাবে কম? ভূমেন্দ্র গুহ-কর্তৃক সম্পাদিত কথার ভেতরে কথা সংকলনটির কবিতা পড়ে সেগুলোকে ‘হীরকখ-ের স্মারক’ বলে সম্বোধন করেছেন, ‘সে-হিরে ‘কোমল, উজ্জ্বল অথচ অকর্তিত।’ আমরাও একবার এই সংকলনটি পড়ে বুঝে নিতে পারি আমাদের পরবর্তী সময়ের কবিতাচর্চা যে-পথে যে-চেতনা লালন করে এগিয়ে গেছে, তার সঙ্গে এ-কবিতাগুলোর কোনোপ্রকার যোগসূত্র রয়েছে কি না। যদি থেকে থাকে, তাহলে, কথাসাহিত্যের দুই মজুমদারকে আমরা ভালোভাবে না-পড়েই যেভাবে সসম্মান আগলে রেখেছি, তাঁকেও কেন সেভাবে আগলে রাখা হচ্ছে তার জবাব খোজা সহজ হবে। এ না হলে, এখানেও, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটি ছত্রও না-লেখার ব্যথিত সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।