প্রবন্ধ

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন

দিলওয়ার জীবনের কঠিন বোধলব্দ অভিজ্ঞতা ও দার্শনিক প্রজ্ঞায় কবিতাকে সাজিয়েছেন অন্যরকম আঙ্গিকে। যাতে উচ্চকিত হয়েছে সমাজের ভাঁজে ভাঁজে গোপন হয়ে থাকা অসাম্য, শোষণ আর বঞ্চনা।

মকালীন প্রবণতা ও কাব্যচেতনার স্রোত কবি দিলওয়ারকে ভাসাতে পারেনি। একই সময়ে বসবাস করে, একই ভূগোলে থেকে দিলওয়ার ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। সামষ্টিক চর্চার বিপরীতে তাঁর কাব্যভাষা ও দর্শন ছিলো একান্ত-ই নিজস্ব। সহজ-সরল অথচ গহীন। তিনি মানুষের হয়ে মানুষের কথা বলতেন। তাঁর কাব্যভাষা মূলত সাধারণ মানুষেরই অভিব্যক্তি। চারদিকের বৃহত্তর মানবতার দারুণ শোকাবহ জীবন। এইসব দুঃখ ভারাক্রান্ত সময় ও যাপন দিলওয়ারকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতো। ফলে অত্যন্ত সাদামাটা সেই জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ বক্তব্য-ই তাঁর কবিতার মূল বক্তব্য ছিল। যেহেতু তাঁর কবিতার বিষয় ও মেজাজমর্জি গণজীবনের ধারাবর্ণনা বা এমন একটা আয়না, যেখানে আমজনতারই মুখ ও তাদের আশপাশের অভাব-অনুভূতি, সুখ-সন্তর্পণ- এইজন্য তাকে গণমানুষের কবি বলাটাই যথার্থ।

নিঃসঙ্গ পৃথিবীর বিষাদ ও মনমরা সময়ের আর্তনাদ থেকে দিলওয়ার নিজে দূরে থাকতেন। অন্যদেরকেও দূরে রাখার প্রয়াস করতেন। এইজন্যই তাঁর কবিতায় ঐক্যের আহ্বান ব্যাপারটি প্রবল। মানুষের মিলন ও মুক্তির কামনা তাঁর কবিতাকে অন্যরকম মহিমা দান করেছে। তাঁর কবিতায় বারবারই ফুটে উঠেছে গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সংঘবদ্ধ মানুষের কোলাহল ও কলকাকলি বিস্তৃত জায়গাজুড়ে নন্দিত হয়ে আছে। মানুষের সম্মিলিত আনন্দ ও পারস্পরিক সম্প্রীতির আহবান তাঁর কবিতায় প্রোজ্জ্বল।

দিলওয়ার যে নিজের ভেতর থেকে একাকীত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে আরও অনেক জীবনের সঙ্গে মিশে যেতে চান, আরও অনেক প্রাণের সঙ্গে একাত্ম হতে চান, এর প্রমাণ মেলে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যের নামকরণেই।
মুহম্মদ ইমদাদের ভাষায়- ‘তিনি যে বড় জীবনের কথা, বড় জীবনের শোক-অসুখ লিখতে চান, মিলিত হতে চান সবার সাথে, সকল জীবনের সাথে—তা যে খুব সচেতনভাবেই তিনি স্থির করেছিলেন তাঁর কবিতার আদর্শ হিসেবে, এর প্রমাণ মেলে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম থেকেই। কেননা কাব্যগ্রন্থটির নাম ঐকতান। তিনি একা গাইতে চাননি তাঁর একার গানটি। তিনি সকলের সাথে চেয়েছেন সকলের গানটি গাইতে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।’ আর দিলওয়ার লিখেছেন তাঁর মন বেঁধে মনে কবিতায়—
মন বেঁধে মনে এসো তো দু-জন এখানে দাঁড়াই।
দিলওয়ারের কবিতার এই চেতনা, মনকে মনে বেঁধে ফেলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিকে জাগায়, জাগিয়ে ভেঙে ফেলে নির্জনতা। কারণ, ওই সদ্য জাগ্রত ব্যক্তিটি মিলিত হয় আরও আরও ব্যক্তির সাথে আর জনতায় পরিণত হয় তারা। নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বের গহ্বর থেকে তারা মুক্তি পায়।’

দিলওয়ারের কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে বিপ্লব। পৃথিবীব্যাপী বর্বর হত্যাকাণ্ডে মানব সভ্যতার ধ্বংস তাঁর কলমকে ম্লান করেনি, বরং তা আরও ধারালো হয়েছে বিপ্লব ও গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। জঘন্য সময় ও সভ্যতার ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে কবি উচ্চারণ করেন —

বিপ্লবের রক্তঅশ্ব ডেকে গেছে বহুবার
বাঁধন ছিঁড়ে-
সর্বহারা মানুষের ভিড়ে
বহুবার একখানি বাঁকা তলোয়ার
কেটে গেছে জমাট আঁধার,
জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন নেমেছে কতো না তাই
মৃত্তিকার সুলভ কুটীরে,
শান্তির গান গেয়ে ধীরে‘
– শাণিত অতীতের গান, জিজ্ঞাসা

কবি দিলওয়ার (১ জানুয়ারি, ১৯৩৭ – ১০ অক্টোবর, ২০১৩) । ছবি : সংগৃহীত

কবিতাটি তাঁর প্রথম বই থেকে নেয়া। বিপ্লব ও গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা দিয়েই শুরু হয় কবিতায় তাঁর যাত্রাধ্বনি। গেয়েছেন সর্বহারা মানুষের গান। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে যে যুদ্ধের দামামা, শোষণ ও বঞ্চনার নানা ঔপনিবেশিক জাল বিস্তার করেছিল, দিলওয়ারের চিত্রকল্পে তা ধরা দিয়েছিল জমাট আঁধার  হিসেবে। এজন্য তিনি কামনা করেছেন একটি বাঁকা তলোয়ার। যেন বিপ্লবের প্রশ্রয়ে মৃত্তিকার সুলভ কুটীরে শান্তির গান গেয়ে বেড়াতে পারেন নির্মলে, নির্বিঘ্নে।
অস্বীকার করার উপায় নাই, কবির অনুভব অন্যদের অনুভব থেকে আলাদা। কবির দেখার চোখ অন্যসব মানুষের মত নয়, ভিন্ন। তবে কবির ভাবনায় আরও অনেক মানুষের অনুভূতি একীভূত হয়। এজন্য দিলওয়ারের কবিতায় যে মুক্তি, মিলন ও প্রাণসঞ্চারের বারিশ, তা মূলত সর্বমোট মানুষেরই স্বপ্ন ও বাসনা ।

বলতে দ্বিধা নেই, বারবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দিলওয়ারের কবিতার উল্লেখযোগ্য একটা দিক। চারদিকে অশান্তি, শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচার দেখে, শক্তিহীন দরিদ্র মানুষকে শক্তি সঞ্চয়ের ও ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। চেয়েছেন, সকলের সম্মিলিত আয়োজনে এমন একটা পৃথিবী গড়ে ওঠুক- যেখানে শোষণ-বঞ্চনা নেই, নেই ক্ষুধার উহুরুহু’ যন্ত্রণাধ্বনি। স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা পৃথিবী হোক সকলের। এমন আগ্রহ-আকুতি কবির উচ্চারণকে দ্রোহে পরিণত করেছে কখনো কখনো। যেমন—

ভুলতে পারিনে আমি অতর্কিতে মনে পড়ে যায়
সেই কবে পথে দেখা রোঁয়াওঠা কুকুরের ছবি,
দেখেছি নীরবে তারে জনস্রোতে ভেসে যেতে হায়,
বুভুক্ষায় দেহ ক্ষীণ : জান্তব আকাশে ম্লান রবি।
– মানবিকতা, ঐকতান

উদ্ধৃতাংশে মানবতাবাদী দিলওয়ারের কাব্যিক রোদনের শব্দ শুনা যায়। ‘পথে দেখা রোঁয়াওঠা কুকুরের ছবি’ দেখে যার কবিতায় আছড়ে পড়ে আর্তনাদের তরঙ্গ। কবির ব্যক্তিগত আকাশে সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসে। এই চিত্রকল্প মূলত তাঁর মানবতাবোধ। এখানে পৃথিবীবাসীর করুণ ও দুঃসময়ের ইঙ্গিত দেন দিলওয়ার।
বিষয়টা এমনও বলা যায়, দিলওয়ারের কবিতা মানে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্লোগান। তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গানের মধ্যে ধ্বনিত হওয়া সুর এই অনুমানকে আরও স্পষ্ট করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই ‘গণমানুষ’ শুধু বাংলাদেশের না। এটা পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া মানুষের সমষ্টি। এই আন্দোলনে কবি যেমন সুরমাপারের মানুষকে যুক্ত করেন, তেমনি যুক্ত করেন টেমস তীরের মানুষকেও। ইউরোপে বর্ণবৈষম্যের স্বীকার মানুষও যুক্ত ‘গণমানুষ’-এ। সর্বোপরি তাঁর কবিতা পৃথিবীতে সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। যেন কোথাও ধনী গরিবের ব্যবধান না থাকে। শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থার আহ্বান দিলওয়ারের কণ্ঠে প্রবল—

এবং জননীরা
ভগিনীরা
প্রেয়সীরা
সময় কে ভাগ করে নিয়ে,
প্রাত্যহিক কর্মের অবসরে
আমাদের শ্রম-সুন্দর মহাচেতনাকে
গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা আংগুরের মতো
বণ্টন করে দেবে :
সুখ, শান্তি, মৈত্রি আর প্রেম।

[…]

জগতের মানবিক সমস্ত হৃদয় :
হাতে হাত,
বুকে বুক
সুষম চলার উল্লাস।
ঘৃণার বল্লমে বিঁধে
অরাতির বুক
পূর্বাশার পাদপীঠে
একবিশ্ব : একটি জীবন।
– একটি বিশ্ব : একটি জীবন, ঐকতান

যাদের চোখের মণি জ্বলে ওঠে
রাত পোহাবার আগে
পৌঁছিয়ে দিতে পৃথিবীর কথা
সূর্যের পুরোভাগে,
শ্রমজীবী সেই মহামানবের
রক্তগোলাপী হাতে
ছড়িয়ে দিলাম আমার কবিতা
নিদ্রাবিহীন রাতে
– প্রবেশক, উদ্ভিন্ন উল্লাস

এইসব কবিতায় সমাজে সাম্য-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট। গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা আংগুরের মতো সমবণ্টন ও সাম্যব্যবস্থা চেয়েছেন দিলওয়ার। তাঁর কবিতায় খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদী আদর্শের—

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়,
আমরা কি আজো দিতে পারলাম
মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খণ্ডে খণ্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে
মানুষের বিধাতাকে।
– শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন, রক্তে আমার অনাদি অস্থি

দিলওয়ার জীবনের কঠিন বোধলব্দ অভিজ্ঞতা ও দার্শনিক প্রজ্ঞায় কবিতাকে সাজিয়েছেন অন্যরকম আঙ্গিকে। যাতে উচ্চকিত হয়েছে সমাজের ভাঁজে ভাঁজে গোপন হয়ে থাকা অসাম্য, শোষণ আর বঞ্চনা। মানুষের খণ্ডে খণ্ডে ভাগ হয়ে থাকা দিলওয়ারের মনে জন্ম দিয়েছে বিস্ময়কর এক অপরাধবোধ। ‘দম্ভদূষিত’ অঞ্চলে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছেন, পৃথিবীর তাবৎ মানব এখনও মানুষ হয়ে ওঠতে পারেনি। মানুষের মধ্যে এখনও আছে মানবতার তীব্র সংকট। এইসব দৃশ্যে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে কবির সরল অভিযোগ, বিনীত ক্ষমাপ্রার্থনা।

আপনার মতামত জানান

হুসাইন ফাহিম

হুসাইন ফাহিম; কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৯৭ সালের ১ নভেম্বর সুনামগঞ্জের হবতপুর গ্রামে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তাকমিল ফিল হাদিস (মাস্টার্স)। পেশায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার। প্রকাশিত বই - ‘পাগল হেসে অন্ধকার’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।