রাত কত হলো কে জানে। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। একটি বিড়ালছানা উপোস আর শীতে কুঁকড়ে ঠিক আমার চোখে চোখে তাকিয়ে মিউ মিউ করছে। আমাদের পোষা কুকুর কাঙালটা উঠোনের ঐ কোণে এক পা উঁচিয়ে হিসু দিচ্ছে। বিড়াল ছানাটার এতিমচোখী দৃষ্টি বড়ই মায়াময়। কাঙালটা এগিয়ে আসছে দারোয়ানি আর বাহাদুরি করতে। ছানাটির দিকে শিকারি পায়ে এগুচ্ছে। আমি ঠেঙানোর ভয় দেখাতেই সরে গেলো। মার বাঁচানো দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগলো। আমাদের বলতে আমাকে আর বিড়াল ছানাটাকে। জোসনাডুবো চোখ দুটোতে ঝলমলে কী এক আর্তি যেনো ছানাটার। তারপর আমি ঘুমোতে চলে গেলাম।
– অলক, অলক ঐ ছেড়া উঠ। উঠানে হাপের খেলা দেখাইতাছে।
– বু’ কয়টা বাজে।
– ঘড়ি দেখি নাই, তয় সূর্য তিন নল উপরে উঠছে।
– বু’ ও বু’, হেনাবু’ …
চলে গেছে ডাক শুনেনি হয়তো। হেনাবু’ রুকন কাকার বড় মেয়ে। হাতেখড়ি বয়স থেকেই খেলাধুলা, পাঠশালা, খাওয়া-দাওয়া, সব একসাথেই। আগে কতো যে শিশুতোষ গল্প হতো আমাদের।
– জানোস অলক, জ্যাঠায় আগে উজানে যাইতো কাম করতে। একদিন হের মালিক বাড়ি ডাকাইত পড়ছে। জ্যাঠায় কী করছে, একলাই তিন ডাকাইত মাইরা ফালাইছে!
– হুঁ, আব্বার যে সাহস। খন্ডা বিলে আমাগোর তিন কানি খেতে পানি দিতে যাইয়া রাইত হইয়া গেছিলো। দুই ভূত আইয়া আব্বারে ধরছে। দুইডা ভূতরেই মাইরা বাপ ডাকাইছে।
এখন এ রকম আর হয় না। চৈতালি ন্যাংটো পুকুর ও দুপুর, আষাঢ়ের উদোম ঢল কিংবা সেই বুনোগিরি এখন আর নেই যে কথায় কথায় হেনাবু’কে যেখানে সেখানে কিল চিমটি মারবো। কী এক স্পর্শকাতর নোটিশ সেঁটে আছে ওর শরীরে। লুকোচুরি, চড়ুইভাতি, চান্নি রাতে কুতকুত খেলার অধীরতা এখন আর নেই। অনেক দিন-অনেক সময় খুব কাছে থেকেও যেমন চোখে পড়ে না শাপলা ফোটার দৃশ্য কিংবা পাতার নেকাব ফুঁড়ে ফল ফসলের বাড়ন্ত মুখ-তেমনি হেনাবু’ যে কবে থেকে কাঁধে বুকে লম্বা ওড়না ছড়িয়ে রাখা শুরু করেছে ঠিক মনে নেই। সাপ খেলা দেখতে গেলাম। প্রচুর হিসু চেপে আছে। বেদেনি এখনও সাপ বের করেনি। নাহ, কাজটা সেরেই আসি।
একি! রাতের বিড়াল ছানাটা খড়ের গাদার নিচে খোড়ল করে তৃপ্তিভরে চোখ বুজে আছে। ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম।
আড়াই হাত লম্বা গোখরাটার লেজটা পোড়া না কাটা বুঝা যাচ্ছে না। গেরস্থের দুটো মেয়েকে কেটেছে। আসলে সাপের চেয়ে বেদেনিকে দেখতেই আমার আগ্রহ বেশি। হেনাবু’ জানতো তা। বেদেনি, তালুর উপরে টান করে বাঁধা মস্ত খোঁপা, চকচকে কালো চুল, পান রাঙা ঠোঁট, সুরমালেপা চোখ আর নাকে নথ ভীষণ ভালো লাগে আমার। বয়ঃসন্ধি চোখে বেদেনিদের হাঁটার ছন্দটাও বেশ লাগে। কোমর ভারি কি চিকন দোল খাবেই।
মা, চাচি, হেনাবু’কে কতো যে বকে। বেদেনিদের মতো কোমর দুলিয়ে হাঁটে সে। মা বলে ‘ছেড়ি ডাঙ্গর হইছস চলাফেরা একটু সাবধানে করিস। বাইদ্দানিগো মতন কোমর মোচড়াইয়া হাঁটস ক্যান।’ হেনাবু’কে আমার খুব ভালো লাগে। সর্পোজ্জ্বল চোখ, স্বর্ণরেণু হাসি আর ওর বেদেনি বেদেনি চলা আমাকে মুগ্ধ করে। একদিন ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে সুরমা মেখে ট্রাংকে তোলা চাচির একটা টিয়ে রঙের শাড়ি পড়েছিলো হেনাবু’। ‘পাষাণ পাষাণ বন্ধু আমার’ গাইছিলো, ওমনি কাকার সামনে। সেকি গালাগাল কাকার। অপমান, অভিমানে রাতে ভাত খাবে না মেয়েটা। বাড়ির সবাই সাধাসাধি করলো কিন্তু খাবে না সে । বিটলে বিটলে হাসি চেপে হেনাবু’র কাছে গিয়ে বসলাম ।
– হেনাবু ,তোমারে আমার খুব ভাল্লাগে। তোমার বাইদ্দানি বাইদ্দানি হাঁটন আমার জব্বর পছন্দের।
– যা কইতাছি , আমার লগে কথার ভালমাইনষি করতে হইবো না ।
কিন্তু হেনাবু’ সত্যই জানতো আমি বেদেনি ভালোবাসি। তাইতো পাড়ায় বেদেনি এলে আমাকে খবরটা পৌঁছে দেবে সে। আর আড়াল থেকে দেখবে আমি সাপ দেখি না সাপিনী । তারপর বলবে ‘গাবর ছেড়ার পছন, বাইদ্দানি বিয়া কইরা বাইদ্দা হইব।’
আমি জানতাম বেদেনি ভালো লাগায় হেনাবু’ আমাকে ভালবাসতো। সেই সাথে আমার গেঁয়ো চোখের গোঁয়ার ভালো লাগা লাঙল ফলার মতো তার প্রতি ভালোবাসা খুঁড়ে দিল। ডাঙর ফসলের দোল যেমন চেনে কৃষক, তেমনি আমি বুঝে নিতাম অভিমান সিক্ত ‘গাবর ছেড়া’ বলার অর্থ। রোদ-জলে ঝলকা হাসির তরজমা বুঝে নিতাম ঠোঁটের কোণে লাজের নোঙর দেখে ।
উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। ঐ তো সেই বিড়াল ছানাটা লোমশ শরীর নিয়ে দুলে দুলে যাচ্ছে।
– হেনাবু’, ও হেনাবু’…
– এই ছেড়া ডাকছ ক্যান?
– দেহো না বিলাই বাচ্চাডা তোমার মতন বাইদ্দানিগো লাহান হাঁটে। এইডারে পুষ লও, তোমার মিতা হইবো।
সেই থেকে বিড়ালটা হেনাবু’র। ওটাকে নিয়ে আদিখ্যেপনার শেষ নেই মেয়েটার। পুঁতির মালা গলায় দিল। শরীরটাও আচঁড়ে দেয় মাঝে মাঝে। আমিও কাঙালটাকে নিয়ে কম যাইনি। হেনাবু’ যখন বিড়ালছানাটা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করছিলো তখন কাঙালটাকে নিয়ে আমিও প্রতিপক্ষ সাজলাম। নতুন বেল্ট কিনে গলায় লাগালাম। সাবান মেখে গোসল করাই। আর একটু ধনীপনা করে সর্ষের তেল চুরি করে গায়ে মাখাই।
এসব দেখে হেনা বু’ আমাকে ডাকতে লাগল ‘কুত্তা’।
আমি ডাকতাম ‘বিলাই’।
স্বপ্নমাথাল পড়ে অনাগত দিনের বিলাসী আবেশে ঘুরে বেড়াই। স্বপ্নমথিত মনটা অনমনীয় প্রস্তরে বাধা পায় যখন তখন ভয় ভয় হাঁটা শিশুর পড়ে যাওয়ার মতো। স্বপ্নের ফর্সা পরশে বুনো আদরের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠে আড়াল কথা। ফুটো বেড়ার ফাঁকে চুঁইয়ে পড়া আলোর মতো ছটাক ছটাক শিহরণ। বেড়াল উষ্ণতায় হেনাবু’র কথা চিন্তা করে দিন কাটে। হেনাবু’ আমার কাছে হেনাবু’ থাকে না। কিন্তু হেনাবু’কে যে কখনো পাওয়ার নয়।
আজ হেনাবু’র বিয়ে। ঝড়পিষ্টিত নারকেল ডালের মত আমার অবস্থা। বর্ণচোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। হেনাবু’র বিড়ালটা বিয়েবাড়ির লোকারণ্যে অবাক। কাঙালটা আছে হাড় কুড়ানোর তালে। বর এসেছে। কিছুদিন ধরে হেনাবু’র সামনে যাচ্ছি না। সন্ধ্যায় বউ নিয়ে যাবে। আমাকে ভেতরে ডেকে পাঠাল হেনাবু’। সামনে যেতেই হাওরমোদি বাতাসের মতো আমার ওপর ঝাপটে পড়ে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো ‘কুত্তা, কুত্তারে… কই থাকছ ও কুত্তা’।
মা, চাচীসহ অন্যরা খুব অবাক হলো। পাশের বাড়ির দাদী বলল ‘এক লগে বড় হইছে দুইডা ভাই বইন, মায়া গো, মায়া।’ আমি নির্বিকার। টেউলো বাতাসে পোড়া খড়ের মতো আমার কষ্টগুলো বড়ই উদাস। কান্না থামিয়ে হেনাবু’ বললো, ‘আমার বিলাইডারে দেখিস।’ কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। সবাই বলছিলো আমি যেনো ওর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাই; কিন্তু আমি গেলাম না।
তারপর দিন যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হেনাবু’ বাপের বাড়ি আসে যায়। আমার সাথে কথা বলে শুকনো ডালপালার অনাগ্রহে গাছে ঝুলে থাকার মতো। আমার মনে হতে লাগলো স্বার্থমাখা ভালোবাসার একটা অর্থবহ সংজ্ঞা দেয়া চলে এবং সেটাই নির্জলা সত্য। কিন্তু স্বার্থহীন ভালবাসার মাঝে বড় কুৎসিত একটা স্বার্থ লুকিয়ে আছে। সেটা আত্মপ্রশান্তি। আত্মপ্রশান্তির জন্যই কি আমাকে ঠোঁটের কোণে লাজের নোঙর ফেলে ‘গাবর ছেড়া’ ‘কুত্তা’ বলা হতো? আমি কি বুঝিনি এসব বলার ধরন কেমন ছিলো, কীইবা ছিলো অর্থ। না, না, এ স্নেহ নয় অন্য কিছু। আমার সাথে ঢলাঢলি করতে কে বললো, অন্তত বেদেনি চোখে থাকিয়ে দু’টো মিষ্টি কথা বললে এমন কী দোষ হয়! স্বামী আছে বলেই আমাকে ‘গাবর ছেড়া’, ‘কুত্তা’ বলা যাবে না? আর ওই বিড়ালটারই কি খবর রেখেছে মেয়েটা?
গতকাল সন্ধ্যায় ‘নাইওর’ এসেছে হেনাবু‘। আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্তও করেনি। দরজা বন্ধ করে পুতুপুতু স্বামী নিয়ে ব্যস্ত। কীভাবে হেনাবু’কে কষ্ট দেওয়া যায় ভাবছি। ভেতরে ভেতরে অভিমানে ফুঁসে আছি। কয়টা বাজে জানি না। সূর্যটা হয়তো তিন নল উপরে উঠেছে। বিড়াল কোলে দাঁড়িয়ে আছি উঠোনে। হেনাবু’ উঠোনে এলো। আশেপাশে কেউ নেই। বিড়ালটাকে দুই হাতে ধরে জোরসে ছুঁড়ে দিলাম হেনা বু’র পায়ের কাছে। প্রচ- ব্যথা পেয়ে এক পলক তাকালো বিড়ালটা, এতিমচোখী দৃষ্টি। তারপরেই দৌড়ে পালালো।
‘কুত্তা, কুত্তারে, ও কুত্তা কী করলি।’ বলে জল চোখে তাকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো হেনাবু‘।
এটাই তো চাইছিলাম আমি।