ভোরের আলো-আধাঁরে গাছগাছালি ঢাকা বিশাল টিলাটা নিঝুম হয়ে আছে। লতাপাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মিষ্টি আলোর চিরল চিরল ধারা। স্তব্ধ-নির্জন আর অপরূপ প্রকৃতির মাঝে সিঁড়ির শেষ ধাপে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম রূপার অপেক্ষায়। সিঁড়ির পাশে জামরুল গাছের ডালে বসে একটা তক্ষক আমাকে দেখছে অবাক চোখে। আমার চতুর চোখ-মুখ দেখে এক ঝাঁক শালিক পাখি উড়ে যায় আতাফল গাছের নিচ থেকে। আমি বুঝি পাপিষ্ট, উৎপীড়ক, অন্যায় ভাবে তাদের শান্তির দেশে এসেছি হানা দিতে !
ছাই রঙের হাড্ডিসার তক্ষকটার ঠাণ্ডা চোখে চোখ পরতেই আমি শিউরে ওঠি। ওর চোখের মণি থেকে একটা ধারালো তরল ধারা এসে আমার চোখে ঢুকছে। তার ঘৃণা ভরা অটল গাম্ভীর্যের মাঝে আমি বদলে যাওয়া পৃথিবীর দুঃখজনক ইতিহাসের পাতাগুলো দেখতে পাই। তার হতবাক ভঙ্গির মাঝে আমি মানব সভ্যতার হঠকারী অধ্যায়গুলো পড়তে পারি। এক দিকে প্রকৃতি আরেক দিকে মানুষ। পরস্পর বিপরীত মুখী। ভাবি, আমরা কত কালের চেনা; তবু পরস্পর বন্ধু না। তারা প্রতিদিন পিছিয়ে যাচ্ছে, উজাড় হচ্ছে। আমরা তাদের সমাধির উপর বিনির্মান করছি আচাভুয়া এক পৃথিবী। সেই শিকার-যুগ, পশুপালন-যুগ…লক্ষ লক্ষ যুগ পেরিয়ে সুপারসনিক যুগে এসে তারা আজ মহাবিপণ্ন!
আমাদের অলক্ষ্যে হাতে টান পড়লে আমি চেয়ে দেখি রূপা : তার শরীরের শ্যামলা রঙে সবুজ আগুন আর চোখে-মুখে বন্য হাসি আমাকে ভাবের দুনিয়া থেকে রক্ত-মাংসের দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়।
পথ থেকে ঘাসে নামবার আগে আমি ঘাড় ত্যাড়া করে জামরুলের ডালে নজর ফেলে অবাক হই। তক্ষকটা তখনো তার ঠাণ্ডা চোখের চিকচিকে দৃষ্টিটা আমার উপর থেকে একটুও সড়ায়নি! এবং সে আরো বিমর্ষ।
টিলাটার যেখানে শেষ এবং অন্যটার শুরু সেখানে একটা জাম্বুরা গাছের নিচে আমরা দু’জন নিবিড় হয়ে বসি। গাছটার ঘন জাফরি বন্ধুর নির্ভরতা দিয়ে আমাদেরকে জগৎ-সংসার থেকে আড়াল করে রাখে। রূপার হাতের পুরুষ্ট আর লম্বা লম্বা আঙুলগুলো তখনো আমার হাত ধরে রেখেছে। আমি ওর চোখে চোখ রাখি। স্নেহ-প্রেম-কামের আগুনে উজ্জ্বল চোখ দুইটাতে নারীর ভালোবাসা দপদপ করছে। একটু আগের গাঢ় ঘুমের সংকুচিত আভাকে তাড়িয়ে আবেগের দীপ্ত লাভা সেখানে এসে টুকটুক করে জায়গা নিচ্ছে । রূপা আমাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার বউ কই ?
রূপার কৌতূহলী গলা শুনে দ্রুত বলি, হোস্টেলে ।
কোন ইয়ারে?
এম.এ ফাইনাল ।
রূপা নীরব হয়ে যায়। একটু বুঝি ভাবে। চিরকাল নারী আমার কাছে একটা জটিল ধাঁধাঁ। তাই আমি কিছুই ভাবি না, বলি না। শুধু বোকার মতো মুখ ক্যাবলা করে বসে থাকি। অপেক্ষা করি। শুমারহীন খন্ড খন্ড অপেক্ষার প্রহর মিলে মানব জীবন একটা তীর্থের কাক।
আমি চোখ বন্ধ করে রূপার প্রসাধনহীন শরীরের তাজা ঘ্রাণ লই। তুলসি পাতার মতো একটা তেজী সুভাস আমার অর্কমন্য পিটুইটারিকে জাগাতে উৎসাহ জোগায়। আমি জানি এটা ওর কুমারী মাংসের উত্তাপ এবং এও জানি বিয়ে হয়ে গেলে ওর মাংস এই সুবাস হারাবে। আমি আরও জানি, সে বিএ পাশ করে বিয়ের প্রতিক্ষায় তিন বছর…। একটু একটু করে অনেক দিনে সে নিজেই আমার মাঝে তার নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, জংলি লতার মতো একটু একটু করে আমাকে জড়িয়ে নিতে চাইছে।
রূপা হাসে। শ্যামলা মেয়ের ডাগর হাসি। যা নির্থক কিম্বা সাঙ্ঘাতিক ইঙ্গিতময়। আমি জানি এইসব মুহূর্তে আত্মসর্মপণই নিরাপদ। বলতে লজ্জা নাই, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জীবনে অনেক নারীর সঙ্গ পেয়েছি এবং বারবার বহু আজব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেনেছি, এইসব ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে গেলে বেশির ভাগই বিপর্যয় ডেকে আনে। রূপা আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, তোমার বউ যদি কলেজে প্রেম করে?
এই কথা বলে সে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসে। ছোট ছোট সুন্দর দাঁতের ফাঁকে ঝলক দেওয়া এই হাসিটা আমার একটুও ভালো লাগে না। তবু আমিও হাসি। সে কি আমাকে চমকে দিতে চায়? ভড়কে দিতে চায়? না ঈর্ষা থেকে এইসব বলে আর আমার প্রতিক্রিয়া দেখবার লোভে সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে? আমি হেসে হেসেই বলি, করুক।
যদি কারো সাথে ভাগা দেয়?
দেওক।
আমি জানি, মানুষ হচ্ছে সব চেয়ে বুনো জীব। তার কাছে স্বাধিনতার দাম জীবনের চেয়ে বেশি।
এইবার আমার ভেতরটা একটা চোরা হাসির ঝলকে প্রসারিত হয়। কারণ আমি জানি মেয়েদের মন মাংসে না হাড়ের গভীরে।
পেছনের টিলাটা পঞ্চায়েতি গোরস্থান। অসংখ্য গাছ-বৃক্ষের ছায়ায় অষ্টপ্রহর সে গুজবের রহস্যে থোম মেরে থাকে এবং পাড়ত পক্ষ্যে এ তল্লাটে কেউ খুব একটা আসে না। তবু আমার হাতের তালু ঘামে ভিজে যাচ্ছে। রূপা উড়নার পাড় টেনে টেনে বলে, জানো তোমাকে প্রথমদিন দেখেই আমার বুকটা জুড়িয়ে গেছিল। বড় আপন মনে হইছিল। যেন কতকাল ধরে তোমাকে চিনি, জানি। কারণ আমি পশুর মতো বেঁচে আছি। অসুস্থ বাবা সারাদিন সিগারেট টানে আর কাশে। ছোট বোনটা চব্বিশ ঘন্টা শুধু চিটকিবিটকি নিয়ে আছে। যেন পাখা গজিয়েছে। ফাঁক পেলেই উড়াল দেবে। ভাইয়া…। রূপা লম্বা করে দম ছাড়ে। ভাইয়া যে কেন বিদেশ গেল…। আচ্ছা কও দেখি, টাকাই কি সব?
রূপা তুলসির ঘ্রাণময় শ্যামলা গালটা আমার গালের এতটা নিকটে নিয়ে এসে কথা বলছে যে তার চামড়ার উত্তাপ আমার গালের চামড়ায় লাগে। শুনেছি ব্যাংকে রূপাদের অনেক টাকা। তাজা তকতকে তিনাটা বাস। শহরে চারতালা বাড়ি। তবু টাকার বোঝা আরো ভারি করতে তার একমাত্র ভাই ইউরোপের বরফে চৌপরি দিন ছুটছে। আমি মাথা নোয়াতেই আমার বাবার মুখটা পস্ট দেখি। মৃত্যুর আগে বাবার হাড্ডিতে শুধু চামড়াটাই ছিল। বাবা তার চোখের আলোর সাথে দেহের সৌন্দর্য ও মনের কোমলতা হারিয়ে ছিলেন। আসলে পৃথিবী মানুষকে যা দেয় তা শুধু পৃথিবীর নিজের জন্যই, করব কিম্বা শ্মশানে নেবার জন্য না।
আমার মতো রূপারও ভেতরটা কাঠ-কাঠ হয়ে যায়। তক্ষক আর অসংখ্য পাখপাখালীর ডাকাডাকিতে দিনটা একটু একটু জেগে ওঠছে। এই পাহাড়ি ঝাড়-জংলা, আরণ্যক বাতাস আর লতাপাতার ভেষজ মায়ায় রূপা বুঝি তার নারীত্ব্য দিয়ে মমত্ব্যের বাঁধনে আমাকে বেঁধে ফেলতে চায় ?
অনেকক্ষণ পর রূপা আমার হাত দুটো টেনে নিয়ে তার দু’গালে চেপে ধরে মাথা নোয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে বসে থাকে। আমাদের চার পাশে চিরল চিরল আলো, ভেষজ-বাতাস, আমার কোলে ঢলে পড়া রূপার কুঁকড়া চুলের ঢল। তবু আমি চেয়ে থাকি কুমারীর লম্বা আর চিকন-সিঁথিটার দিকে। ওটা যেন আমাদের চৌপাশের দৃশ্য আর অদৃশ্যের মাঝে অনুভবের বাণী দিয়ে অজর-অমর এক কবিতা রচনা করতে চায়।
রূপা অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে তাকায়, আমার হাত দুটো ধরে তার দিকে জোরে টানে। আমি আবেগে থরথর প্রেমিকের মতো তাকে চুম্বন করবো ভেবে ঠোঁট জোড়া মুখিয়ে তুলি। কুমারীর ছোট-ছোট স্তন তার তার গলার নিচে, কামিজের ইউ-কাট-ফাঁক দিয়ে আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, ইশারায় ডাকে। আমাদের গরম নিঃশ্বাস পরস্পরের মুখে লাগতেই মাথার উপর কে যেন ডেকে উঠে তকক্ তকক্ তক্কে…।
দু’জনেই চমকে ওঠি, কেঁপে ওঠি। মাথা তুলে দেখি ছাইবর্ণ সেই তক্ষকটা জাম্বুরা গাছের ডালে বসে আমাদের দিকে রক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। চাবুক খাওয়া মানুষের মতো আমরা দু’জনেই ছিটকে যাই। লজ্জায় রূপার শ্যামলা মুখ লাল হয়ে ওঠে আর এক করুণ বিবর্ণ লাভায় কুমারীর দু’চোখ ধীরে ধীরে বিস্ফারীত হতে থাকলে আমি চুম্বন অসমাপ্ত রেখে পালিয়ে আসি।
ইসহাকপুর : ০৬.০৪.২৩–০৯.০৪২৩ ইং