গদ্যস্মৃতিগদ্য

যেভাবে নদীর নাম জাদুকাটা হলো

বাড়ি যাব! যেকোন বোধের মধ্যেই এই কথা মনে পড়ে৷ যখন বাড়িতে কথা বলি, ফোনের মধ্যে সবাই একসাথে এমনভাবে কথা বলা শুরু করে মনে হয় উঠানে কাঁঠাল গাছের নীচেই আমি বসে আছি। কে কোন রঙের জামা পরে আছে এইখান থেকেই আমি সব দেখতে পাই। বৃষ্টি আসলে জলিতে পানি বাড়ার মতো বাড়ি যাবার তাড়না আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। মনে পড়ে এই বর্ষায় চুলার পারেই হয়তো সবাই গোল হয়ে খাইতে বসছে৷ পাশে উঠানের পানি গড়ায়া যাচ্ছে, মাছের কাঁটাগুলো ওই পানিতেই ছেড়ে দিচ্ছে সবাই৷ কী কী নিয়ে কথা বলছে তারা সেই আলাপের মধ্যে আমি আছি কিনা, জানি না। আমিই তো একমাত্র যে বাড়ি থেকে অনেক দূরে এই বর্ষার দিনগুলোতে!

নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকি এই বর্ষায়। রাতের ঘুম আর আধাখেঁচড়া স্বপ্ন। রাগ করে ঘুমায়া গেলে পাশ ফিরে শুই কিনা বুঝতে পারি না। এই বর্ষাকালে আমি আমার ব্যর্থতাগুলো জানি। হাত ধরে ধরে দেখায়া না দিলেও আমি জানি, কী কী পারি না। কিন্তু এমন না, আমার সফলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে৷ কী করলে নিজেকে সফল ভাবা যাবে তার কোনো ধারণা আমার কাছে নাই। আজকাল লাগে, এই বিস্তীর্ণ শুয়ে থাকাই আমার জীবনের লক্ষ্য। যেখানে ঘুমাই তারচেয়ে নরম কোনো বিছানার প্রতি আমার আগ্রহ নাই। যা খাই মন ভরে ওঠে। বাড়ি ছাড়া আর কোনো স্বর্গের আকাঙ্ক্ষা আমার বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে না।

সম্পর্কিত

এই বর্ষাকালে আমাদের কী কী ভেসে যাবে? ভাতের মাড় গালতে গিয়ে কী কী মনে পড়বে তোমার! আরেকটু ভালো জীবনের দিকে যেতে যেতে কী যে ক্লান্ত হয়ে আসে মন। ঘুরেফিরে আবারো বাড়ি যাইতে ইচ্ছা করে। কোথাও যাওয়ার কথা বললে, মা যেমন বলে এই বাড়ি ছাড়া কোথাও যাইতে মন চায় না, কোথাও গিয়ে আরাম পাই না আমি! আমারো তেমন আড়ার দিকের দরজা খুলে দিয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে ঘরের ভেতর!

বাড়িতে, আমার ঘরের দরজার সামনে যে ডালিম গাছ বড় হচ্ছে তার ছোট পাতা, কচি রঙ আমি কল্পনা করতে পারি। জীবনকে আরেকটু সরলতার দিকে আগায়া দিতে ইচ্ছা করে। সারারাত ভরে যে ঘন হওয়া কুয়াশা টিনের চাল ভেদ করে ভোরের ঘুমের উপর টপাস করে পড়ে যায় তার ঠান্ডা ঘ্রাণ আমি টের পাই এই কংক্রিটের নীচে চাপা পড়া শরীরে। জীবনের এত ফাঁদ, এত প্রত্যাশা আমি তার কতটুকু বুঝি। জীবনকে আরেকটু সহজ রোদের মধ্যে বসায়া রাখতে ইচ্ছা করে৷ যে জীবন বড় আপাদের দেখাদেখি কাঁথাতে ফুল ফোটাতে গিয়ে আঙুল ফুটা করে ফেলে।

জীবন, আমি এখনো ভুলোলাগা জঙ্গলে শাদাকালো বকরি খুঁজতে যাওয়া ১৩ বছর বয়স, আমার কানের লতিতে লাল হয়ে আছে গতরাতের ভূতে পাওয়া স্বপ্ন…. তবুও এই শরীর এমন ভারবাহী ট্রেনের মতো লাগে যাকে আব্বার কাঁধ থেকে নামায়া

দেয়া হইছে বাঁধ না থাকা সরু ব্রিজের উপর…..

হতাশ না, নিরবচ্ছিন্ন লাগে সবার থেকে। সবকিছু থেকে৷ কোথাও কোনো টান নাই। যদি বাড়িতে থাকতে পারতাম হয়তো কোথাও যাইতে চাইতাম না আর। কোন টান, কোনো সম্ভাবনাই আর জমকালো লাগে না৷ কিন্তু মানুষ কোথায় কোথায় চলে যায়৷ আমার মনে পড়ে কাফকার ছোট্ট একটা গল্পের কথা। যেখানে এমন একটা কথা আছে, ” জীবন এত ছোট, মানুষ ঘোড়ায় চড়ে পাশের গ্রামে যাওয়ার সাহস করে কিভাবে৷” আমিও তো বাড়ি থেকে কতদূরে পড়ে থাকি।

বাড়িতে, এই শীতের দিনগুলোতে আরো অনেক বেশি কাছাকাছি থাকতাম আমরা। ২০১৮ এর দিকে মনে হয়, শীতে বাড়ি গেলাম। এতই ঠান্ডা ছিলো সেবার, দুইটা লেপের নীচেও হু হু করে কাঁপতেছিলাম। মা লেপের নীচে সারারাত চেপে ধরে রাখলো। এই শীতের রাতগুলো আমাদের অনেক কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়। এমন নিকটে আসে সবাই যে কেউ তার গোপন বেদনাও সিদ্ধ ধানের পাশে সহজেই বলে যেতে পারে।

এই শীতের দিনগুলোতে শীতের স্মৃতিচারণা ছাড়া আর কিছু নাই আমার। লাল সোয়েটার পরে পাড়ার মোড়ে রোদ পোহানোর কথা আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে জুবুথুবু হয়ে কুয়াশায় মিটমিট করে মক্তবে যাওয়ার কথা। প্রতি বছরেই তো শীত আসে কিন্তু আমরা যে যার মতো করে বড় হয়ে গেছি নিঃসঙ্গতার দোজখে পা রাখার জন্যে। কখনো এমন আউলা লাগে মনে হয় উত্তরের কোনো বাতাস এসে আমাকে আরো বিরান করে দেয়। যেভাবে ফজরের আজান ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে ওঠে আমি কেবল আমার জীবন ভরা শীতে চুলার উপর হাত মেলে বসে থাকতে চাই।

আপনার মতামত জানান

রুম্মানা জান্নাত

রুম্মানা জান্নাত; কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।