সুনামগঞ্জের ছাতকের রেলস্টেশন ও রোপলাইন স্টেশন থেকে শুরু উপন্যাসটার। মানে কাহিনি শুরু ওইখানকার পাথরশ্রমিক, বেদে ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জীবন-চরিত্র দিয়ে। যা বিস্তৃত হয়েছে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থার বর্ণনায়। এই অঞ্চলের অর্থাৎ সিলেটের মানুষের জীবনমান ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাহিনি দিয়ে আগে কোনো উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নাই। ভালো কিছু হলে পড়া হোক না-হোক নামটা অন্তত শুনতাম। সেই অভাব বা শূন্যতাটা পূরণ করেছেন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক ইয়াহইয়া ফজল। সম্প্রতি তাঁর প্রথম উপন্যাসের বই ‘পরানে পড়িয়াছে টান’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটাতে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকালীন নানান ঘটনা উঠে এসেছে। তাই বলে বইটাকে আঞ্চলিক ট্যাগ দেওয়া উচিত হবে না। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্যের আঞ্চলিক ভাষা-বিষয়-আশয় যেমন আমরা গ্রহণ করেছি, সেটা আমাদের সবার হয়ে উঠেছে। তেমনি অন্য সব আঞ্চলিক ভাষা-বিষয়-আশয় উঠে আসুক শিল্পসাহিত্যে। এবং তা আমাদের সবার হোক।
ইয়াহইয়া ফজলের এই কাজটা ভালোমানের হয়েছে বলা যায় নির্দ্বিধায়। তাঁর একটা জিনিস বাড়তি ভালো লেগেছে যে, তিনি সংলাপে সিলেটি মাতকথা ঢুকিয়েছেন। শব্দ-বাক্য প্রয়োগে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকে দৈন্যতা দেখান। এ অঞ্চলে (সিলেটে) বসে, অন্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা-ব্যাপার-স্যাপার ঢোকান (এক অঞ্চলে থেকে অন্য অঞ্চলের ভাষা-ব্যাপার-স্যাপার ব্যবহার করা যাবে না, তা বলছি না। শুধু দৈন্যতার বিষয়টার ইংগিত করতে চেয়েছি)। তারা মনে করেন, সিলেটি কথা ঢোকানো মানে ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত ব্যাপার। কিন্তু এইখানে ইয়াহয়া ফজলের উদারতা দেখতে পাই আমরা। বিষয়টাকে তিনি শিল্পে রূপান্তর করেছেন। পাঠকমাত্রই এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।
এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা-বিষয়-আশয় আমাদের দেখা ও জানাশোনা মোটামুটি। কিন্তু ইয়াহয়া ফজলের গদ্যভাষা তা আমাদের অন্যভাবে, অভিনব কায়দায় দেখায়, শিল্পের নিরিখে। পড়তে পড়তে মনে হবে চোখের সামনে কোনো ভিডিও চিত্র ভেসে উঠছে। সাধারণ বিষয় অসাধারণ সব আবেদন তৈরি করছে।
বইটা একবসাতেই পড়ে শেষ করতে বাধ্য হয়েছি। ঝরঝরে গদ্য। সহজ-সাবলীল ভাষা ও বর্ণনা। কোনো ধরনের গোঁজামিল নাই গল্পের ভেতর। কোনো বিরক্তির উদ্রেক হয়নি। এই বইপাঠ চোখ ও মনের পথ্য হিসাবে কাজ করেছে। সজীবতা অনুভব করেছি।
গল্পের কেন্দ্রচরিত্রে রয়েছে আলফু ও রাবেয়া নামের তরুণ-তরুণী। আলফু রজ্জুপথ মানে রোপওয়ে কর্মকর্তাদের রান্নাবান্না অর্থাৎ বাবুর্চির কাজ করে। আর রাবেয়া যাত্রাদলের সদস্য। যাত্রার প্রতি যার তীব্র আবেগ-আহ্লাদ-মমতা। দুইজনের মধ্যে একটা ভাব বলি আর সম্পর্ক বলি গড়ে ওঠে। সে সম্পর্ক প্রেমের অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। একটা সময় তাদের সম্পর্কে টান পড়ে। আলফু রোপওয়ে ম্যানাজারের সঙ্গে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে ম্যানাজারের মাথায় বাড়ি দিয়ে আলফু পালিয়ে আসে ছাতক থেকে সিলেটে। তার চোখের সামনে শুরু হতে থাকে জরুরি অবস্থা। একাত্তর সাল। মানুষ মারার দৃশ্য। এসব দৃশ্য বা অবস্থা আলফুকে মানসিকভাবে আহত-বিক্ষত করে। সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। নিজেকে মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে নিবেদন করে।
গল্পে বঙ্গবীর জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর বীরত্বের, মহানুভবতার নানা বিষয় উঠে এসেছে। এছাড়া সি আর দত্ত, মীর শওকত আলীসহ অনেক বীরের কথা এসেছে। যারা এই অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায়। এইসব বিষয়বস্তু নিয়েই পরানে পড়িয়াছে টান উপন্যাসের জমিন।
মুক্তিযুদ্ধের এসব বিষয়-আশয় লেখকের নিজ চোখে দেখা নয়। এগুলো তিনি বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। পেশাগত কাজের অংশ হিসাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব বয়ান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই গল্পের শরণ হয়েছেন। ভূমিকায় তা উল্লেখ করেছেন ইয়াহইয়া ফজল।
ইয়াহইয়া ফজলের উপন্যাস ‘পরানে পড়িয়াছে টান’ প্রজন্মের পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ও উৎকৃষ্ট শিল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে আমার মনে হয়। প্রকৃত বিচারে আমরা ভালো কিছু পেয়েছি। আমি তাঁর গদ্যের বন্দনা করি।
পরানে পড়িয়াছে টান
ইয়াহইয়া ফজল
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
প্রকাশক : চৈতন্য