মাহমুদ দারবিশ। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি। ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ ফিলিস্তিনের গ্যালিলি প্রদেশের বিরোহা গ্রামে জন্ম। গ্যালিলিতে উদ্বাস্তু হিসাবে বড় হয়েছেন। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হিসাবে বড় হওয়া শিশু হিসেবে দেখেছেন মানবিক বিপর্যয়। কবিতা পাঠের জন্য ইসরায়েলি বাহিনীর হুমকি পেয়েছিলেন বার বছর বয়সে। দারবিশ তবুও থেমে যাননি। ফিলিস্তিনি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা বলেছেন কবিতায়। ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে মৃত্যু।
মাহমুদ দারবিশের পাঁচটি কবিতা দ্রাবিড়ের জন্য অনুবাদ করেছেন আদিল মাহমুদ।
এক.
আব্বা, আমি তোমার ইউসুফ
আব্বা, আমি তোমার ইউসুফ
ও আব্বা!
আমার ভাইয়েরা আমাকে ভালোবাসে না
তাদের কাছে আমি যেতে চাই না।
ওরা আমাকে অযথা মারধর করে
পাথর ছুঁড়ে মারে
অপমানের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়।
আমার ভাইয়েরা আমার মৃত্যু কামনা করে।
ওরা তাই মিছেমিছে প্রশংসা বিলায়
আমার মুখের সামনে ওরা—
তোমার দরজা বন্ধ করে দেয়।
আমি হয়েছি বিতাড়িত
তোমার জমিজমা শস্যখেত থেকে।
ও আব্বা!
ওরা আমার আঙুরবন বিষে ভরে দিয়েছে।
বয়ে চলা বাতাস যখন আমার চুল নিয়ে খেলে
ওরা সবাই তখন হিংসায় মরে
তোমার আমার প্রতি ক্রোধ ছুঁড়ে মারে।
আব্বা, ও আব্বা!
আমি ওদের কী এমন ক্ষতি করেছি?
কোনো অপকার করেছি?
প্রজাপতির দল আমার কাঁধে বিশ্রাম নেয়
গমখেত মাথা নত করে
পাখি আমার হাতের উপরে ঘুরে বেড়ায়
আব্বা, আমি কী তাদের ক্ষতি করেছি!
কেন তবে এতো লাঞ্ছনা?
তুমিই আমার নাম রেখেছো ইউসুফ!
ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল—
গভীর কুয়ার অতলে
দোষ চাপিয়েছিল নেকড়ের ঘাড়ে।
ও আব্বা! ওই যে নেকড়ে
সেও আমার ভাইদের চেয়ে অনেক দয়ালু।
যখন আমি আমার স্বপ্নের কথা বলেছি
তখন কী কারো ক্ষতি করেছি?
কারো অসুবিধা করেছি?
আমি স্বপ্নে দেখেছি—
এগারোটি গ্রহ, চন্দ্র-সূর্য, আমাকে সিজদা করছে।
‘আনা ইউসুফুন ইয়া আবি’ অবলম্বনে
দুই.
কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো না
তোমার কৃতকর্মের জন্য—
কখনোই ক্ষমাপ্রার্থনা করো না।
আমি মনে মনে নিজেকে বললাম
নিজের অন্য সত্তাকে বললাম
‘এসবই তো তোমার দৃশ্যমান স্মৃতিসমূহ—
বিড়ালের ঝিমুনীতে দুপুরের একঘেঁয়েমি
মোরগের ঝুঁটি
ক্ল্যারির সুগন্ধ
আম্মার বানানো কফি
বিছানা ও গদি
ঘরের লোহার দরজাখানা
সক্রেটিসের চারপাশে উড়ে বেড়ানো মাছি
প্লেটোর মাথার উপরে মেঘ
উদ্দীপনাময় কবিতার সংকলন
বাবার ছবি
মু’য়জামুল বুলদান
শেক্সপিয়ার
তোমার তিন ভাই ও তিন বোন
শৈশবের বন্ধুরা এবং অন্যান্যরা।’
‘এই কি সে?’
—উপস্থিত সবাই একমত হতে পারল না
হয়তো সে বা তার মতো অন্য একজন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
‘তাহলে সে কে?’
কিন্তু তারা আমাকে উত্তর দিলো না।
আমি নিজেকে ফিসফিস করে বললাম
‘সে কি আসলেই ‘তুমি’ ছিলে? … আমি?’
দৃষ্টি অবনত হলো।
তারপর তারা আমার আম্মার দিকে ঘুরে তাকালো
যেন তিনি সাক্ষ্য দেন–
আমিই সে।
এরপর আমার আম্মা তাদের বললেন
‘আমিই সেই মা, যে তাকে জন্ম দিয়েছি
কিন্তু কালের স্রোত তাকে বড়ো করেছে।’
আমি নিজের অন্য সত্তাকে বললাম
‘তোমার আম্মা ব্যতিত অন্য কারো কাছে
নিজ কৃতকর্মের জন্য—
কখনোই ক্ষমাপ্রার্থনা করো না।’
‘লা তায়তাযির আম্মা ফাআলতা’ অবলম্বনে।
তিন.
আমার আম্মা
আমার মন কাঁদে—
আম্মার হাতের বানানো রুটি, বানানো কফি
এবং তার হাতের স্পর্শের জন্য।
দিনের পর দিন
আমার ভেতরে ছেলেবেলার স্মৃতি জেগে ওঠে।
মৃত্যুর সময় আমার জীবনের দাম আছে
একমাত্র আমার আম্মার কান্নার জন্য।
মৃত্যুর পর একদিন যদি আমি ফিরে আসি—
আমাকে তুলে নিও
তোমার চোখের পাপড়ি হিসেবে
ঘাঁসে ঘাঁসে ঢেকে দিও
আমার হাড়গুলোকে
আমাকে দুআ দিও
তোমার পদচিহ্ন দিয়ে
আমাকে বেঁধে রেখো
তোমার চুলগুচ্ছে
—অথবা বেঁধে রেখো
তোমার কাপড় থেকে লতিয়ে আসা সুতো দিয়ে।
যদি তোমার হৃদয়ের গভীরতাকে স্পর্শ করি
আমি অমর হয়ে যাবো
ঈশ্বর হয়ে যাবো।
আমি যদি ফিরে আসি—
আমাকে ব্যবহার করো
তোমার আগুনে চিলকাঠ হিসেবে
—কিংবা আমাকে বানিয়ো
তোমার ছাদের উপরের ক্লথলাইন
তোমার দুআ ছাড়া
আমি হীনবল দাঁড়াতেও অক্ষম।
বুড়ো হয়ে গেছি আমি
ছেলেবেলার নক্ষত্রের মানচিত্রটা
ফিরে দাও তুমি।
যেন মৃত্যুর পর ঐ পরিযায়ী পাখির মতো—
তোমার ঘরে ফিরে আসতে পারি।
‘আহিননু ইলা খুবজি উম্মি’ অবলম্বনে।
চার.
রিতা
রিতা ও আমার চোখের মাঝখানে—
একটি রাইফেল।
যারা রিতাকে চিনে
তারা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসে
তার নিষ্পাপ দু’চোখের প্রেমে।
আমি রিতাকে চুমু খেয়েছি
যখন সে টগবগে যৌবনা।
আমার মনে আছে
রিতা কিভাবে—
আমার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে আসতো
আমার বাহুর নিচে তার প্রেমময় ফিতারগুলো
কিভাবে হারিয়ে যেত।
আমার রিতাকে মনে পড়ে—
যেভাবে চড়ুই মনে রাখে তার ফিরতি পথ।
আহ্ রিতা!
আমাদের মাঝখানে সহস্র চড়ুই ওড়াওড়ি করে
আমাদের অসংখ্য সাক্ষাতের স্থান—
রাইফেল দ্বারা পুড়ে গেছে।
একসময় রিতা নাম
আমার মুখে সুস্বাদু খাবারের মতো ছিল
তার শরীর ছিল আমার রক্তের উন্মাদনা
আমি নিজেকে তার মাঝে হারিয়ে ছিলাম দু’বছর
আর সে দু’বছর ঘুমিয়ে ছিল আমার কাঁধে।
আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—
সুন্দরতম পেয়ালার দিকে তাকিয়ে।
ঠোঁট পুড়িয়ে ছিলাম রাঙা ওয়াইনে
আমরা হাজারবার জন্মেছিলাম নতুন নতুন প্রেম।
আহ্ রিতা!
রাইফেলের নল কি তোমার থেকে
আমার চোখ ফেরাতে পেরেছে—
একটা বা দুইটা পলক ফেলা ছাড়া
কিংবা নীলাভ মেঘগুচ্ছ কি পেরেছে
আমার চোখ ফেরাতে?
আহ্ রিতা!
এককালে আমার আবছা ভোরের অন্ধকারের—
চাঁদ হয়েছিল তার চোখ
কিন্তু ভাগ্যেরলীলা, তা আর স্থায়ী হলো না।
একদিন সমস্ত শহর গায়কদের গানে ভেসে গেলো—
আহ্ রিতা, আহ্ রিতা!
তখন রিতা ও আমার চোখের মাঝখানে
একটি রাইফেল ছিল।
পাঁচ.
আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না
বাসযাত্রী এক মুসাফির বলে ওঠে—
‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না
না রেডিও
না সকালের সংবাদপত্র
না পাহাড় চূড়ার দূর্গ
আমি কাঁদতে চাই ।’
ড্রাইভার বললো—
‘বাস স্টেশনে পৌঁছার অপেক্ষা করো
তারপর একাকী যত ইচ্ছে কাঁদো।’
এক ভদ্রমহিলা বলে ওঠে—
‘আমারও কিচ্ছু ভালো লাগে না
আমার ছেলেকে আমার কবর দেখালাম
তার সেটা ভালো লাগলো
এবং ঘুমিয়ে পড়লো
আমাকে বিদায়ও জানালো না।’
ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র বলে উঠলো—
‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না
আমি আর্কিওলজি পড়লাম
কিন্তু পাথরে কোনো পরিচয় খুঁজে পেলাম না
আমি কি সত্যিই আমি?’
এক সৈন্য বলে ওঠে—
‘আমারও কিচ্ছু ভালো লাগে না
প্রতিনিয়ত আমি আমাকে পাকড়াওকারী ভূত পাকড়াও করে বেড়াই।’
স্নায়ুতন্ত্রের চালক বলে ওঠে—
‘এই যে!
আমরা শেষ স্টেশনের কাছে চলে এসেছি
নামার প্রস্তুতি নাও।’
এ শুনে তারা সবাই চিৎকার করে বলে ওঠে—
‘আমরা স্টেশনের পরে যা আছে
তা দেখতে চাই
তুমি যত পারো সামনে চলো।’
কিন্তু আমি বললাম—
‘আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও
আমিও তাদের মতো
আমারও কিচ্ছু ভালো লাগে না
তবে আমি আর সামনে যেতে চাই না
কারণ, সফর করতে করতে আমি
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’