মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাকে ‘অদ্ভুত’ বলেছিলেন সুজিত সরকার, বিকল্প কোনো শব্দ ব্যবহার করলে বা শব্দভাণ্ডারে এই শব্দটি না থাকলে হয়ত বলতেন ‘অভাবিত’-এই বিশেষণটি তাঁর একটি-দুটি কবিতার জন্য নয় শুধু, বাংলা কবিতার যে-মেজাজ ও আঙ্গিক, তার সঙ্গে মণীন্দ্র গুপ্তের অধিকাংশ কবিতার পারম্পর্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘আমার শেষ কবিতার বই’ শিরোনামক একটি কবিতায় মজা করে লিখেছিলেন, তাঁর শেষ বইয়ের প্রথম দশটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের ‘নির্বন্ধাতিশয্যে’ প্রথম সবুজ পত্র-এ প্রকাশিত হয়, পরে সেগুলো পুনর্মুদ্রিত হয় প্রবাসীর কষ্টিপাথর বিভাগে এবং সেই সময় সেগুলো নিয়ে শাহেদ সুরাওয়ার্দি ও অপূর্ব চন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত; বইয়ের পরবর্তী পনেরোটি কবিতা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার পরে সেগুলো ওড়িয়াতে অনুবাদ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়, পরে তা ফরাসিতেও অনুবাদ হয়; কুমারী আং দত্ত এ-কবিতাগুলোর ফরাসি ভাষান্তর যখন হাতে পেলেন তখন প্যারিসের সমস্ত বাগানের ফুলেদের আর ঘুম এল না। কবিতাটির তথ্য যে সত্য নয়, তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, কারণ তাঁর শেষ কবিতার বই লিখিত হয়েছে একুশ শতকেই, ফলে বোঝাই যাচ্ছে এতে কবিতার মুদ্রণ-প্রকাশ-প্রচার ও তার সময় কাল প্রভৃতিকে গুলে হাস্যকর-করে-তোলার জন্যই এই বর্ণনা। এমনিতে এই কবিতার কল্পনায় যেমন রয়েছে একটি [মিথ্যা-] সত্য আরোপনের ব্যাপার, যা পড়ামাত্র ভাবতে হয় যে ‘এতে কবিতাত্বটা ঠিক কোথায়’, কিন্তু কবিতার শেষ স্তবকে এসে যখন পড়ি :
বারোক গির্জার দেয়ালে, আর হাম্মুরাবির কোড-এর ফলকে
এই বইটির ২৬ সংখ্যক কবিতা
বাণমুখ লিপিতে উৎকীর্ণ রয়েছে।
তাহলে এই কবিতাবলির জন্মউৎস কত দূর অতীতে?
মনে হয়, কূর্মাবতারের শক্ত খোলার পিঠে
প্রলয়সমুদ্রের অন্ধকার নিশীথ জল আর
ফসফরাস আর বালি
অতি ধীর লয়ে
এখনো খোদাই করে চলেছে
৬৮ সংখ্যক কবিতা,
যা বইটির শেষ কবিতা।
তখন ‘জন্মউৎস’-এর প্রশ্নে কূর্মাবতারের শক্ত খোলার পিঠ, প্রলয়সমুদ্রের অন্ধকার নিশীথ জল, ফসফরাস, বালি আর অতি ধীর লয়ে খোদাই-করে-তোলার প্রসঙ্গে আমরা যেমন চমৎকৃত না-হয়ে পারি না, তেমনি তাঁর কবিতার উৎস ও বিস্তার এবং আবহমান অখ- সময় সম্পর্কেও ধারণা নিতে পারি। কবিতার উৎস-বিস্তার ও সময়-প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলা কবিতার তিরিশ-চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিতার প্রধান কাব্য-বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখলে নিরাশ হতে হবে, তাঁর কবিতার ‘অদ্ভুত’ত্ব, অভিনবত্ব বা বিশেষত্বও সেখানে।
মণীন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৯২৬ সালে, ২৩ বছর বয়সে ১৯৪৯ সাল থেকে কবিতা লেখার শুরু, তারপর প্রায় দেড় দশকের বিরতি। কবিদের জীবনপঞ্জিতে সচরাচর এরকম তথ্য পাওয়া না গেলেও, তা ‘অদ্ভুত’ ও অভিনব কবিতা রচনার সপক্ষ কোনো যুক্তি ধারণ করে না। তাহলে কি তাঁর বেড়ে-ওঠার ভূগোল-পরিবেশ ও নিবিড় অধ্যয়নই এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে? তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ও সেই প্রকৃতি-পরিবেশজাত কবিতাভাবনা তো সেই প্রমাণই দেয়।
তাঁর জন্মস্থান জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশের গ্রাম বরিশালের গৈলায়; শৈশবও কেটেছে সেখানে, পড়াশোনা শিলচরে ও কলকাতায়। তিনি লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের অন্তিম দিকের বইগুলো আমার কিশোর বয়সে বেরিয়েছিল-আজও মনে পড়ে সেই অনন্য সুখের অনুভূতি, যখন সাধ্যায়ত্ত দামে সেই আনকোরা বই কিনে এনে পাতা উল্টোতাম, একটু একটু করে মধ্যে ঢুকতাম। এসব আমার দুর্লভ ভাগ্য।’ আন্দাজ করা যেতে পারে যে, ধীরেসুস্থে কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেই কবিকিশোর : জীবনানন্দ-পরবর্তী অনেক কবির ক্ষেত্রে যা হয়েছে, এই কবি যে সেই পথের যাত্রী নন তা সহজেই বোঝা যায়। এমনিতে একই জায়গায় জন্মগ্রহণ করার ফলে জীবনানন্দের কবিতার জগৎ সহজেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝতে পেরেছিলেন যে জীবনানন্দের কাব্যজগৎ আর তাঁর কাব্যজগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই এক সাক্ষাৎকারীর প্রশ্নের জবাবে জীবনানন্দ-সম্পর্কে লিখেছিলেন : ‘আবহমান সময়ের ঢেউ সর্বদা তাঁর চেতনায়-কিন্তু তাঁর সেই সময়প্রসৃতির আদিতেও মানুষ, অন্তেও মানুষ। এই যুগের মানুষেরই মুখ যেন রূপান্তরিত হয়ে আছে অতীতের মধ্যে-ছায়াচ্ছন্নতায় বা কলরোলে।’ আর নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার চিন্তা ঐ রূপান্তরের থেকে জন্মান্তরের দিকেই বেশি চলে। অভিব্যক্তির স্তরগুলির দু দিকে সময়ের শেষ নেই বলেই মানুষ, জন্তু, গাছ, পাথর, গ্রহ, তারা যাবতীয় প্রাণী ও আপাত-জড়কে আমার কেবলই মনে হয় এক।’ মণীন্দ্র গুপ্তের অনেক কবিতায়ই এ-কথার সত্যতা পাওয়া যায়, আর তাঁর একটি কবিতায় তো সরাসরিই আছে এই চিন্তার প্রতিফলন :
জন্ম থেকে দেখে আসছি, আমাদের ডানপাশের বাড়িটা বাঁদরদের,
বাঁপাশের বাড়িটা বেড়ালদের।
মধ্যিখানে আমরা কাকাতুয়া বদ্রিকা আর মুনিয়া পুষি বলে
আমাদের বাড়ির নাম হয়েছে পাখিদের বাড়ি।
আমি বড় হয়ে এখন দুই বাড়ির দুটো মেয়েকে ভালোবাসি।
… …
বাঁদরী আমাকে নিয়ে চলে যায় গাছে গাছে লাফ দিয়ে দিয়ে
বোর্নিওর বনে বনে। বিড়ালী নিয়ে যায় সুন্দরবনের বাদায়-
বাঁদরী আর বিড়ালীকে মেয়ে বলে সম্বোধন করাটাকে কে কীভাবে গ্রহণ করবেন সে-কথা আলাদা, কিন্তু তিনি এরকমই ভাবেন এবং তা এতটাই স্বভাবগত যে, তাঁর কাছে ঘড়ির ঘণ্টা আর সরীসৃপের চেঁচিয়ে-ওঠাকেও মনে হয় একই ব্যাপার-এই ভাবে মানুষ, জন্তু, গাছ, পাথর, গ্রহ, তারা, প্রাণী ও আপাত-জড়বস্তুর সমবায়ে একটি কাব্যজগৎ তৈরি করেছেন মণীন্দ্র। এই জগৎ তাঁর নিজস্ব, যা গিয়োম আপোলিনের বা টেড হিউসের কাব্য/প্রাণিজগতের সঙ্গে মিলবে না। আপোলিনেরের বেস্টিয়ারিস-এর কবিতাগুলোর চেয়েও মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা গভীর ও ব্যঞ্জনাময়। আপোলিনেরের ‘হাতি’ কবিতায় কবি তাঁর মুখস্থ সম্পদের সঙ্গে হাতির দাঁতের ঐশ্বর্যের তুলনা দিয়েছেন, লিখেছেন ‘নীল মৃত্যু’ আর মিষ্টি শব্দে গাওয়া গানে কিনে-আনা খ্যাতির কথা, আর, মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘হাতি’ শিরোনামক কবিতায় গারো পাহাড়ের ঘনগভীর গাছের জগৎ, সুসঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ও হাজংদের কথা উল্লেখ করে দখল ও আগ্রাসনের কথাই বললেন এবং শেষে লিখলেন, গারো পাহাড়ে এখন সুসঙ্গের রাজবংশ, হাজং, হাতি কেউ রইল না, ‘রইল শুধু গারো পাহাড়’। ‘ময়ূর’ কবিতায়ও আপোলিনের প্রকাশ করেছেন একটি ছোট্ট বক্তব্য : পেখম ছড়িয়ে ঘাাসের-ওপর-চলা এই পাখি হয়ত সুন্দর, কিন্তু সে উদোম করে ফেলে তার নিতম্ব; কিন্তু মণীন্দ্রের ‘ময়ূর’ কবিতার গল্পটা একদমই অন্যরকম : বিকেল চারটায় একটি ময়ূর আসবে, তার জন্য চার মেয়ে অপেক্ষা করছে-ময়ূর আসার এই তথ্য তারা দিচ্ছে চাপা ও অর্থপূর্ণ হাসি হেসে; তারা মোক্ষম লাস্যে শরীর মোচড়ায়, দেখায় জিভ আলজিভ গোলাপি গ্রসন ঝিল্লি…এবং ‘একস্তূপ ফুল-পাতা-রুক্ষ ডাল জমাট নীল হয়ে ডেকে উঠল কর্কশ ধাতব’-সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রতীক ও পরিবেশ। আপোলিনেরের সঙ্গে মণীন্দ্র গুপ্তের চেতনাগত দূরত্ব যতটুকু, টেড হিউসের সঙ্গে ততটা নয়; তাদের মেজাজ পৃথক, কিন্তু প্রতীকী ব্যঞ্জনায় দু-জনেই অতলস্পর্শী। টেড হিউসের ‘দি থট-ফক্স’ কবিতায় দেখি, তিনি মনে-মনে গড়ে তোলেন এক ‘মধ্যরাত্রি-মুহূর্তের বন’, সেখানে শেয়ালের কথা আছে, সেই সঙ্গে অন্য-কারও/কিছু-একটা অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, যে-কিনা শেয়ালের ক্ষীপ্র তীব্র উষ্ণ ঘ্রাণ বুকে নিয়ে অন্ধকার মাথার গর্তে ঢোকে, বোঝা যায়. তা আসলে ‘চেতনা-শৃগাল’-এরই বর্ণনা আর মণীন্দ্রের ‘শেয়াল’ কবিতায় দেখি, তিনি কবে মধ্যপ্রদেশের এক গাঁয়ে দেখেছিলেন একটি শেয়াল, তার কথা, যে-কিনা জোনাকিপুঞ্জের মতো গাছের আড়ালে জ্বলে-নিভে জ্বলে-নিভে নিজস্ব অনিশ্চয়ের দিকে চলে গেছে, এরপর আছে মানুষী অস্তিত্ব আরোপের তথ্য : ‘…আজ তার ভাই মারা গেছে’ এবং সেই ‘ধূসর শেয়াল বনের ধূসর শুঁড়িপথে যাতায়াত করে’। সেই যে ১৯৪৯ সালে, কবিতা লেখার শুরুতে ‘জীবনায়ন’ কবিতায় লিখেছিলেন মণীন্দ্র, ‘জীবন দুর্জয় ছিল/ঘরছাড়া বন্য মানুষের।/তাদের সন্তান আমি, আধুনিক এক মানবক-/বিবর-বুভুক্ষু আত্মা’ তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচয় রয়েছে পরবর্তী সময়ের, এমনকি এখনকার কবিতায়ও। এ হলো সেই জগৎ, যা কোনো অর্থেই একপাক্ষিক বর্ণনার জগৎ নয়, এই জগৎ নানা ভাবনার রসায়নে তৈরি এবং তা অদ্ভুত নয় শুধু, তাতে কখনো পাওয়া যায় মজা-পাওয়া মানুষের বর্ণনা, আছে বিদ্রুপ, আছে ভয়ংকর ও শিহরনকর বর্ণনাও।
চীন দেশের লোকাচার নিয়ে লিখিত একটি মজার কবিতার উদাহরণ হলো ‘চীনে পদ্ধতি’ কবিতাটি, যেখানে তাঁর চীনে পুত্রবধূ ইউ-ছান তাদের দেশীয় ক্যালেন্ডারের ভূতের মাস বলে খ্যাত সপ্তম মাসটির বর্ণনা দিচ্ছিল : ওই সময় মৃত পূর্বপুরুষেরা পাতাল থেকে পৃথিবীতে এসে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়, তখন তাদের পুজোআচ্চা করতে হয়, আমরা তাদের পাতালের ব্যাংক-একাউন্টে টাকা জমা দিই, টিভি-ফ্রিজ-জামাকাপড় উপহার দিই, ‘আমাদের যা যা দরকার ওদেরই বা সেসব ছাড়া চলবে কী করে!’ তাই আমরা পুরো মাসজুড়ে হাজার হাজার ডলার, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার-মিউজিক সিস্টেম পুড়াই ‘যাতে ধোঁয়া হয়ে জিনিসগুলো ওই বায়ুশরীরীদের কাছে পৌঁছে যায়।’ তা শুনে মণীন্দ্র হায় হায় করে উঠলেন, বললেন ‘ভূতের শ্রাদ্ধে তোমরা এত টাকা পয়সা আর দামি দামি জিনিস পুড়িয়ে ফেল!’ তখন উত্তরে ইউ-ছান আসল কথাটা বলে যে, তুমি এতো ভেবো না ড্যাড, তখন বাজারে বান্ডিল বান্ডিল ছাপা ডলার কিনতে পাওয়া যায়, জিনিসপত্র বাগান-পুকুর-ঘরবাড়ি সবকিছুর ছবি কিনতে পাওয়া যায়, আমরা সেই সব পুড়াই। তা শুনে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, বললেন ‘…ওঃ প্রতীক পূজা! ওই শর্ট কাট তো/আমাদেরও আছে। ইউ-ছানদের সঙ্গে আমাদের বেশ বুদ্ধির মিল আছে দেখছি।’ এই কবিতায় আরও রয়েছে চীনেদের প্রদীপ-ভাসানোর রীতির কথাও, তারা ওখান থেকে যে-প্রদীপ ভাসায় সেগুলো নাকি পশ্চিমের দিকে অর্থাৎ ভারতের দিকে আসে। এই সব মজার গল্প শুনে মণীন্দ্র কবিতাটি শেষ করলেন এভাবে : ‘আর হঠাৎ ইচ্ছে হল, নাতিনাতনিরা জন্মাক, আমিও মরে যাই।/জন্মমৃত্যু না হলে সমুদ্র আর ঝড় পেরিয়ে প্রদীপ আসবে কোন পথে।’ কৌতুকপ্রদ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এরকম মৃদু সমালোচনার কবিতা অবশ্য অল্পই লিখেছেন মণীন্দ্র, বরং বিপরীত প্রবণতার কবিতাই লিখেছেন বেশি।
নিম্নোক্ত কবিতার দুটি স্তবক পড়লে আমরা তাঁর বিপরীত প্রবণতার উদাহরণ পেতে পারি :
কুমারী কনের বুকে দুধ ভরে দিয়ে
কেউ নয়, এক কানামাছি অদ্ভুতকর্মার হাসি হেসে খুন;
সমাজের হেটমু- ব্রীড়া পোড়ানো শিকের মতো লাল
ব্রহ্মা, তুমি খাও মেয়েটিকে।
… … … …
রৌরব-ফাটলে জন্ম, বালা, সে তো কিছুই জানে না;
ঝিরঝির নিজের ঝর্নার শব্দে
শ্যাম গয়নার মতো দেহে তার আলোছায়া জ্বলে-
আর্তনাদ ভুলে, কলরব করে প্রেতাত্মারা-
অচরিতার্থ থাকতে কার সাধ!
একদিন উদর ভাসিয়ে, ফুলে, নিজের জলেই ডুবে
ভেসে ওঠে শব।
এই বর্ণনা শিহরনকর তো বটেই, কিন্তু এরপর কবিতার শেষ স্তবকে যখন দেখি মেয়েটি তার বরের বাড়িতে ফিরে দেখছে সেখানে কেউ নেই, শুধু ভাঙা কলসি, ছেঁড়া চাল আর চকমকিহীন সন্ধ্যা আর ‘ভস্ম হেটে যায়-সামনে জল-দুকূলপ্লাবিনী গঙ্গা’, তখন সেই মেয়েটির বেদনা আমাদেরও আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাঁর ‘শ্মশানে ভোজ’ কবিতাটি শিহরনকর নয় শুধু, ভয়ংকরও, এবং তা শুধু মানুষের জন্যই ভয়ংকর নয়, ভয়ংকর, প্রেতের জন্যও-যে দেখে এক তীব্র রশ্মি তার পোড়া মাংস আনন্দের সঙ্গে চাখছে, দলবদ্ধ ক্ষুধার্ত আগুন ডিংগো কুকুরের মতো তাকে খেয়ে ফেলছে, আর সব শেষে আছে রহস্যপূর্ণ দুটি বাক্য : ‘আগুনকে হরিধ্বনি আক্রমণ করে-/চোখের গর্ত থেকে লকলক ওঠে জ্ঞানশিখা-’ উল্লেখ্য যে, ডেশ-এর মাধ্যমে শিখার অ-শেষ অবস্থার (ইশারা-)চিহ্ন দিয়ে শেষ হয়েছে ব্যঞ্জনাগর্ভ বাক্যটি।
এমন কবিতা আরও লিখেছেন মণীন্দ্র, সেই কবিতাগুলোর বর্ণনায়ও তাঁকে সাধারণত নির্মম বা নিবার্য বলেও মনে হয় না, এর পেছনে একপ্রকার গূঢ়ত্ব থাকে বলেই মনে হয় স্বাভাবিক। ‘নীল’ কবিতায় যখন বলেন ‘বৃদ্ধ কুকুরের চোখের মতো বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেছে আমার পুংস্ত্ব।/অবলুণ্ঠিত শরীর বহুদিন হল নীরব অপমানের কাছে আত্মসমর্পিত’, তখন দুটি বাক্যের ‘বিষাদগ্রস্ত’তা ও ‘নীরব অপমানের’ গূঢ় তথ্যটি তাঁর জীবনের এই আত্মঘটনা জানা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় কি না সেই প্রশ্নটাকেই গৌণ করে দেয়। তা হয়ত এই জন্য যে, তিনি কবিতায় পৃথিবীর কথা বলেন, বন মরুভূমি, প্রস্তরযুগের শিকারিদের ঘরে-ফিরে-আসা, গুহা থেকে ককটেল পার্টির ডান্স ফ্লোর, সবকিছুর প্রতিক্রিয়া ধরতে চান, এর মধ্যে যেখানে নিজের কথা বলতে চান, সেখানেও থাকে মূলের সঙ্গে যুক্ততা, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ চেতনা : জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক ও জড়-জীবের সঙ্গে একাত্মতার বোধ। মনে পড়ছে ‘প্রথম মণীন্দ্র গুপ্ত’ কবিতাটির কথা, যেখানে প্রেতবর্ত্মে মৌমাছিরা প্রবেশ করে আর তিনি সেই জ্যোৎস্নালোকে ঢুলে ঢুলে পুনর্জন্মে যান; মনে পড়ছে, ‘মু-’ কবিতাটির কথাও, যেখানে বিকেলে গোধূলিআকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় তিনি শিগগির ছিন্নমূ-ে ফিরে যাবেন, কারণ ঝুলে-পড়া জিভে অন্ধকার বাতাস এসে লাগছে।
এ-যুগে একটি ঘটনার রেশ শেষ হতে না-হতেই আরেকটি ঘটনা এসে যখন বিপর্যস্ত করে ফেলে আমাদের জীবন, তখন মণীন্দ্র গুপ্তের পরিণত কবিতাগুলো একালের পাঠকের জন্য স্বস্তিকর বা স্বাভাবিক মনে হওয়ার কথা নয়। তার উপর এই কবি যদি বলেন, ‘সময় এবং বিশ্ববস্তু অনন্তসম্ভব। কে আমার উপাস্য? মানুষের অধিকারে আমার বিশ্বাস নেই-আমি বোধ হয় জাতিদ্রোহী’, তা হলে, নানা সমাজ-রাষ্ট্র ও জাতিগত সংস্কারের কারণেই তাঁর চিন্তা গণগ্রাহ্য না-হওয়ারই কথা। কারণ আগেই উল্লেখ করেছি, এই চিন্তা ‘ক্রমপরিণতিপ্রাপ্ত’ অর্থাৎ ক্রমপরিণামেরই দৃষ্টান্ত, ফলে তাঁর কবিতা ঠিক নির্মমতার উদাহরণ না হলেও, ঔদাস্য ও নিস্পৃহতার উদাহরণ। এই নিস্পৃহতা এমনি-এমনি আসেনি, এসেছে ধীরে ধীরে। অথচ আগে, অন্যদের মতো তারও ছিল দুঃখ-কুড়ানো শৈশব, নানা রকমের দুঃখ ও বেদনা এবং সবকিছুর সঙ্গে লিপ্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা।
শৈশবের দুঃখবোধ আর জন্মলজ্জাজড়িত বেদনার কথা লেখা আছে তাঁর অক্ষয় মালবেরি বইয়ে : দশমাস বয়সে মাতৃহারা হলে তার পড়োশি-কুটুম্বরা সখেদে বলত ‘হায় পোড়াকপালিয়া, জন্মাইয়াই মারে খাইছ!’, তখন এই সকল মন্তব্য তাঁর মধ্যে নির্বোধ অস্বস্তি সৃষ্টি করত, যে নেই তার জন্য অপরাধবোধ জাগত এবং তাঁর ‘মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা’… ‘খালপাড়ে অথবা উঁচু ঢিবির উপর বিশাল শিরীষগাছের তলায় যেখানে কেউ যায় না, সেখান থেকে দেখতাম, দিগন্তে মেঘের মধ্যে কি যেন ঘনিয়ে উঠছে। আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুঁজতাম, মাটির কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে’। (কিন্তু পরে একসময় জানলেন) ‘…আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সংসার-সমাজের এজেন্সিগুলো আমাদের মধ্যে সুখ ও দুঃখের ধারণা জন্মিয়ে দেয়, যে ব্যথা ভোগ করার নয়, সেই ব্যথা ভোগ করায়’ ফলে যে-মাকে নিয়ে এত কথা দুঃখ অপরাধবোধ, সেই মাও আর কোনো নির্দিষ্ট/বাস্তব মায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না :
গ্রামের ছায়া ভরা জংলা পথে
বালিকা মেয়ে ঘুরে বেড়ায়।
মায়া আর নির্মায়ায় ভরা মুখখানি যেন অর্ধকালীর,
দক্ষিণ বাম যে দিক দিয়েই দেখি : অপরূপ।
গোলঞ্চ তার মাথায় ঝরে পড়ে,
বকুল ঝরে ঝরে উড়ে আসে পায়ে।
নীরব গাছজগতের এই অপাপ যোনিগুলি তার বড় প্রিয়।
সে নীল অপরাজিতা আর লাল জবার কাছে গিয়ে
ফুলের গর্তে কু দেয়।
কাকলির মতো সেই মিষ্টি ধ্বনি নীরব বনের মধ্যে দিয়ে চলে যায়
তিমিমাছ সিন্ধুসিংহের হিম জল, স্বর্ণ ঈগলদের ধূ ধূ আকাশ পেরিয়ে
নীহারিকাদের কানে,
তাদের জাগিয়ে দেয়।
এই পরিবর্ত-রেখা অর্থাৎ দুঃখবোধ থেকে সুখ-দুঃখবোধের বাইরে চলে-যাওয়ার আরেকটি দীর্ঘ বিবরণ আছে ‘প্রকৃতিলীন’ কবিতায়। ইতিহাসের খ–খ- চিত্র, চরিত্রানুষঙ্গ এবং নৃতত্ত্বের নানা উপাদানে এই কবিতাটি জটিল, তবু তাঁর প্রাকৃতিক মেজাজ ও অনুসন্ধান অস্পষ্ট নয়। তিনি লেখেন, মানুষের যা আছে তা পশু-পাখি-পতঙ্গের চেয়েও বেশি আর ঈশ্বর-রূপে রূপান্তরিত হতে গিয়েই তার যত ভুল, যার মাশুল তাকে দিয়ে যেতে হয় : ‘ভাষা, বৃত্তি, লিঙ্গবুদ্ধি, পোশাকে সে/যেন ন্যাকড়া ও বার্নিশে/আপাদমস্তকচুল/মমিদের মতো,/আজ, চার হাজার বছরের পরে/ব্যান্ডেজের কান ধরে টানলেই মাথা ছিঁড়ে আসে।’ এই দীর্ঘ কবিতায় আরও রয়েছে আবহমান মানবযাত্রার নানা প্রসঙ্গ : ‘আকাশের দলবাঁধা ক্রেংকার, ঝংকার, শিস, কাকলির এই পারে/স্তব্ধতায় ধুলোর রাস্তায় পড়ে আছে যুগ/মরা পাখিদের/হার্তুকির মতন শুকনো মাথা’। এই মানুষ পতঙ্গের কাছে গিয়ে দেখেছে সাতরঙা দেশ : সোনার পাত আর রাংতার পাত, তবু সঙ্গে-সঙ্গে প্রশ্ন করতে ভুলছেন না যে, ‘কিন্তু যত সুখী ততই কি সুখী?’ কারণ : ‘অণুবীক্ষণের কাচে দেখা যায়/ভয়ানক শুঁড়, চোখ ঘোরে/গুঞ্জন স্টেরিয়োফোনে গর্জনের মতো কানে আেেস।’ কবিতাটি শেষের দিকে রয়েছে আরও নেতিদৃশ্য, যেখানে মানুষ দেখে অন্নহীন রসহীন পৃথিবী, মরুজ্যোৎস্না, মেরুজ্যোতি, ন্যাড়াপাহাড়ের পাকস্থলী থেকে লাফ-দেওয়া সূর্য, গ্লেসিয়ারে ফেটে-যাওয়া চাঁদ এবং আরও কত কিছু…, কিন্তু এরপরও রোমহর্ষক দুটি পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে কবিতাটি, যা আবহমান মানুষ-বিষয়ে বলা যদিও, তবু এ তার নিজের কথাও তো বটে :
তার কোনো দুঃখ নেই
কারো জন্য কোনো দুঃখ নেই।
তাই যদি হয় কারও জীবনের উপলব্ধি, তাহলে তাঁর কবিতা-তা আমরা গ্রহণ করি বা নাই করি-অন্য সকল কবির চাইতে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য। এর জন্যই তাঁর কবিতা সংস্কারহীন, চেতনাঘন হয়েও আলগা, বাঁধনহীন এবং মতবাদমুক্ত। তিনি ভাববাদী বা বস্তুবাদী নন, তিনি নাগা-কুকিদের মতো কিছুটা সর্বপ্রাণবাদী; কোনো কিছু নিয়ে যখন ভাবেন তখন তাঁর কল্পনা সহজেই চলে যায় মানুষের আদিম অবস্থার দিকে; তিনি সমকালের মানুষ, তাদের রাজনীতি, লড়াই, যৌনতা, লোভ, জাতিবৈর প্রভৃতি নিয়ে যখন ভাবেন তখনো তাঁর মনে পড়ে, ‘শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, পিকিং মানুষ, নিয়ান্ডারথাল মানুষের ক্ষুধা, শিকার, রিরংসা, ভয়, হিংসা ও অকালমৃত্যুর দিনগুলো’র কথা, তিনি উপস্থাপন করেন অরণ্যপ্রাণীদের জীবন, বলেন, ‘হরিণের দল থেকে সিংহী এসে শিকার তুলে নেবার পরমুহূর্তেই সিংহী ও মৃত হরিণের পাশে পুরো দল নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়’, তাঁর মতে, মানবসমাজও সেরকম, আমরা মানুষকে অযথা অনেক গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। সবকিছুকে এইভাবে যিনি ব্যাখ্যা করেন তাঁর কাছে দুঃখ, সংবেদন, পশু-মানুষের ভেদ-জ্ঞান সবকিছু ভিন্ন হতে বাধ্য, তিনিই সহজেই বলেেত পারেন ‘আমি তো সবসময় চেয়েছি-লোকসংখ্যা কমুক, বৈভব তৈজস কমুক। মাছ পাখি পশু বাড়–ক, বন বাড়–ক। পৃথিবী শান্ত সৌন্দর্যে টলমল করুক। মানুষের মুখরতাকে চাপা দিয়ে বয়ে যাক বনমর্মর’। এমন কবির কাছ থেকেই তো আমরা পাব এরকম প্রাকৃতিক কবিতা :
দূরে, ঐ নীল পাহাড়ের মধ্যে পৃথিবীর রক্তপাথরের ভাঁজে ভাঁজে
উন্মুখ উড্ডীন গাছ, গাঢ় বাঘনখ গুল্ম, ধ্যান, অনুভূতি;-ঐখানে
সন্ন্যাসী শিকারি, দৈত্য-তিন বন্ধু একসঙ্গে থাকে;
বাতাসে চিন্তার ধ্বনি, দগ্ধমাংসগন্ধ আর ভয়ংকর স্বাধীনতা
ভেসে আসে-উঠে যায় নীলে
মগ্ন, স্বপ্ন, অট্টহাসি
বোঝা যায়, শুধু সুখ-দুঃখবোধের ব্যাপার নয়, প্রচলিত নীতি-ন্যায্যতার ধারণাও মানছেন না তিনি, মানছে না তাঁর কবিতাও; তাঁর চোখে সন্ন্যাসী শিকারি ও দৈত্য তিনজনই এক ও বন্ধু; অন্যত্র, শব্দের অনুষঙ্গে কবিতায় বলেছেন, ‘বনস্থলী’ ও ‘দেবস্থলী’ তাঁর কাছে একইরকম : দেবস্থলীতে লোকেরা ‘দেউল প্রাচীর সমাগম’ দেখলেও, তিনি সেখানে দেখেন মহাপাদপের তলে লুকোনো খেলাঘর। এই দেখা কোনো একচক্ষু কারও দেখা নয়, জীবনকে বহুজনের বহু চোখের আলোয় না দেখলে এই রকম মনে হওয়ার কথা নয়। বিপরীত দৃষ্টিগুলো মিলিয়ে না দেখলে কারো চোখে বস্তু বা ঘটনার স্বরূপ ধরা পড়ে না, তাই হিটলারকে ইহুদির চোখে, আব্রাহাম লিঙ্কনকে রেড ইন্ডিয়ানের চোখে, পিরামিডকে ক্রীতদাসের চোখে, প্রজাতন্ত্র দিনের উৎসবকে বাস্তুহারার চোখে এবং বলি-হওয়া ছাগটির অপলক চোখে দুর্গোৎসবকে দেখতে হবে। কবিতার ক্ষেত্রেও তাঁর এমন ধারণা : ‘কবিতা গান্ধারীর পুত্রদের মতো একটিমাত্র পি- থেকে জন্মায় না, কুন্তীর ছেলেদের মতো তাদের এক-এক জনের এক-এক রূপ, এক-এক গুণ, এক-এক চরিত্র। ধর্ম, আকাশ, বাতাস, ভেষজ, নিরাময় সবাই এসে জীবনের গভীর উৎসব সম্পূর্ণ করেন। পাঠক দ্রৌপদীর মন নিয়ে দেখলে ঠিকই বুঝতে পারবেন’। একথা মনে রেখেই হয়ত ‘কয়েকজন কবি’ কবিতাটি লিখেছিলেন মণীন্দ্র, যেখানে আছে এমন কয়েকজন কবির কথা যাদের একেকজনের জন্য ছিল একেকটি গর্ত, যারা ফোঁপড়া পাহাড়ে, বর্ধিষ্ণু অন্ধকারে, পাগলের মতো ক্বাথ ঘন করে, ছাঁকে, জ্বাল দেয় এবং অবসিডিয়ন ছুরির সামনে শিখার মতো একা বসে থাকে। এই কবিদের একজনই তো মণীন্দ্র গুপ্ত, যিনি একাই লিখেছেন নানা চরিত্রের/রকমের কবিতা, যে-কবিতাগুলি দাবি করে দ্রৌপদীর মতো সহিষ্ণু গ্রহিষ্ণু এবং দীক্ষিত মনের পাঠক।