ফাতিমার সাথে তার খুব একটা বনিবনা হয় না যেমনটা আমার সাথে হয়। বিশেষত রাতের বেলায়, সে আমার কাছাকাছি থাকে, আর পুরোটা অবসরে এবং ডাইনিংয়েও। এটা ফাতিমার গায়ে লাগে। মানুষ কেবল মানুষকেই হিংসা করে এমন না, অন্য কোন প্রাণী বা জড়কেও হিংসা করতে পারে। ফাতিমা আর নুমাইরার বেলায়ও তাই। ফাতিমা আমার স্ত্রী আর নুমাইরা আমাদের পোষা বেড়াল। আমরা যখন থেকে মোটামুটি ভদ্র জীবন যাপন করছি তখন থেকেই নুমাইরা আমাদের সাথে। কোনো এক কারণে সেও আমাদের মতো নিঃসন্তান। তার সন্তান হয় না বলে আমরা খুব স্বস্তি বোধ করি, যাক বাবা ঝামেলা থেকে বাচা গেল।
কিন্তু একদিক দিয়ে বাঁচলেও কিছু কিছু বিষয় আছে যে, আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কিছু দিন আগে আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু এলেন। আমাদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে, কুশল বিনিময়ের পর যখন কথা কমে আসলো অথবা আমাদের ফ্ল্যাটটা দেখা শেষ হয়ে গেলে তাঁর আর কিছুই করার থাকলো না। তিনি বাধ্য হয়েই আলোচনাটা বিড়ালের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন- তা আপনাদের বিড়াল কয়টা বাচ্চা দিল এবার? বাচ্চাগুলো কী করছেন? আবার বাচ্চা হলে আমাকে একটা দিবেন কিন্তু… ইত্যাদি। এসব প্রশ্নে আমরা বরাবরই বিব্রত হই। অতিথিরা এমনই বাচ্চা-কাচ্চা সম্পর্কে জানতে চায়। নুমাইরা শুনলে খুব মন খারাপ করবে, যদি সে আমাদের আলাপটা বুঝে থাকে। সামগ্রিকভাবে এটা আমাদের তিনজনের জন্যই অস্বস্তিকর। বিয়ে হয়ে গেল বাচ্চা নিচ্ছি না অথবা নুমায়রার অনেকগুলো বাচ্ছা নেই এসব যেন ফৌঁজদারি অপরাধের ভেতর পড়ে।
আমরা মোটামুটি সুখী এটা আবারো বলতে হচ্ছে, কিন্তু এই সুখী-শান্ত পরিবেশের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের তীর্যক মন্তব্য আমাদের তিনজনকেই খুব বিব্রত করে ফেলে। একজন তো বলেই ফেললেন যে, আপনাদের বাচ্চা নেই তো কি হয়েছে বিড়ালটা কতো কিউট। সেটা অন্তত আপনাদের বাচ্চার অভাব পূরণ করবে। আমরা আরো ক্ষিপ্ত হই, আমাদের যে অভাব আছে সেটা তো বলিনি। তাছাড়া ফাতিমা নুমাইরাকে বাচ্চা মানতে নারাজ। নুমাইরার বয়স যথেষ্ট সে ইচ্ছা করলেই বাইরের পুরুষ বেড়ালদের সাথে মিশতে পারে, মিশেও হয়তো।
এবার শীত আসলে আমাদের তিনজনের সম্পর্কের মধ্যে একটা কুটনৈতিক জটিলতা শুরু হয়। আজকাল ফাতিমাকে দেখতেই পারছে না নুমাইরা। আমি বাসায় না থাকলে সে বাইরে বেড়াতে যায়, ছাদে ঘুরে। বেলকনিতে বসে আকাশ দেখে। বিড়ালরা সাধারণত আকাশ দেখে কম যতোটা না মাটির দিকে মনযোগ থাকে। কিন্তু নুমাইরা এমন নয়। ছাদে গেলে সে চঁড়ুই ধরতে লাফ দেয়, কখনো কখনো মনে হয়ে সে যেন উড়াল দিতে যাচ্ছে। তার এসব আগ্রাসী কখনো বা উদাসী আচরণ নিয়ে ফাতিমার কৌতূহলটা আমার ভালো লাগছে না। আসলে কৌতূহল তো নয়, এক ধরনের গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে ফাতিমা। যা উচিত নয় বলেই আমার ধারণা।
শীতের কথা বলছিলাম। আগে নুমাইরা আমাদের মাথার কাছে ঘুমাতো, আজকাল ঘুমাচ্ছে কম্বলের ভেতর। তাও আমার বুকের কাছে। গত সপ্তাহে মাঝরাতে এক বিচ্চিরি ব্যাপার ঘটে গেল। ফাতিমা নুমাইরাকে বালিশ দিয়ে পেটাতে শুরু করলো, অকারণে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে থ মেরে শুয়ে রইলো। আমি ঠেলে বিদেয় করলাম। এমনটা আশা করিনি, কল্পনাও না। পরদিন সারাদিন তার খোঁজ নেই। দ্বিতীয় দিন অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে যাব, দেখি- নুমাইরা লাফ দিয়ে পেছনের সিটে বসলো। আমার সাথে সেই দিন অফিস করলো সে। এদিক ওদিক ঘুরে সবার সাথে পরিচিত হয়ে গেল। একজন আবার আহ্লাদ করে ই-কমার্স সাইট থেকে ক্যাটফুড এনে দিল। অনেকের কৌতূহল কিংবা নুমাইরার সাথে সেলফি তোলার কারণে ফাতিমা তক খবরটা পৌঁছে গেল।
বাসায় পৌঁছার পর নুমাইরা যথারীতি সরাসরি ঘরে না ঢুকে ছাদে চলে গেল। বৈকালিক নাস্তার পর ফাতিমা গম্ভীর মুখে জানাল, আজ বিকেলে একটা পুরুষ বেড়াল আসছিল নুমাইরাকে খুঁজতে, তাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে কাজটা ঠিক করোনি। আমি ভুল স্বীকার করলাম। বললাম- বিড়ালটাকে কিছু খেতে দিয়েছিলে? আমাদের ঘরের কিছু খেতে চায় না সে। আগেও দুয়েকবার দেখেছি নুমাইরার সাথে, অথচ কিছু খায়নি। নামটাম জানো তার বা কোথায় থাকে? আমার কথার উত্তর না দিয়েই টিভি দেখতে চলে গেল ফাতিমা।
টিভির শব্দ কিছুটা ভেসে আসছে ডাইনিংয়েও। সবাইকে কোভিডের বুস্টার ডোজ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। যারা দেয় নাই তাদেরকে দ্রুত দেয়ার তাগিদ দিল। সাথে পোষাপ্রাণীকে নতুন একটা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে আগাম ভ্যাকসিন দিতেও বলা হচ্ছে। আমরা সেটা গত সপ্তাহেই দিয়ে রেখেছি। ভ্যাকসিন দেয়ার পর থেকেই মনে হয় বড় একটা পরিবর্তন আসছে তার মধ্যে। এর মধ্যে মাস পনেরো চলে গেল, ফাতিমা আজকাল খুব যত্ন নিচ্ছে। কিসব খাবার দাবার কিনে আনছে বিড়ালের জন্য, নুমাইরা সন্তানসম্ভবা। এর মধ্যে পুরো দেশে বুস্টার ডোজও দেয়া শেষ। গতকাল-ই এক নায়িকার একটা বাচ্চা হলো, টিভিতে বলা হলো এটিই নাকি আগামী দশ বছরের জন্য সর্বশেষ মনুষ্যসন্তান প্রসবের ঘটনা। আমরা বুঝতে পারি পৃথিবীতে অনেক বিড়াল দরকার, যতোটা না মানুষ আছে তার অধিক।
পুরুষ বেড়ালটা আজ খুব স্বতস্ফুর্তভাবেই ঘরে ঢুকলো। নুমাইরার সাথে ব্যালকনিতে কথা বলছে হয়তো, তারা আকাশ দেখছে। আমরা ভাবছি আমাদের আত্মীয়দের কথা, যারা আগামী দশবছর সন্তান নিয়ে কথা বলতে পারবে না।
৩১ আগস্ট ২০২২ • কাওরানবাজার।