প্রবন্ধ

বাংলা এক‌ডেমীর ভাষার রাজনী‌তি : যবনঘৃণার মাধ্যমে শু‌দ্ধিকরণ?

কে প্রথম এই বানানরীতি চালু করেছে, সেই অনুসন্ধানের চে' জরুরী কেন করেছে। কেন করেছে সেটা বুঝতে পারলে আমরা তাদের চিনতে পারবো। 'বিদেশী' শব্দ ও 'যবন' শব্দ একটি সমান্তরাল ভাবনা।

ন্ত্যজনেরা কী পাপ করেছিলেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে? এ প্রশ্ন আজ হাড় ও জিগর কেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। হাজার বছরের ঘৃণা ও ক্ষোভ যেন ফেটে পড়তে চায়। এই বঙ্গভূমি যখন অরক্ষিত তখন একদল মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বড়দাগে এই নিগৃহীত জনগণই ছিলেন নমশূদ্র বা অন্ত্যজন। তাদের না ছিলো ভাষার মূল্য আর না ছিলো মানুষমূল্য। তারা একদল সুফীচিন্তকদের সংস্পর্শে এসে বদলে গেলো। সাহসী হয়ে ওঠলো। প্রত্যাখ্যান করলো পিতা ও পিতামহের বিশ্বাস, ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি—যে ধর্মের শ্রেণীবর্ণগোষ্ঠী তাদেরকে ক্ষুদ্র ও ঘৃণার বস্তু করে রেখেছিলো।

ধর্ম ও বর্ণ ত্যাগ করার পরও যেন আজও সেই প্রতিশোধের বিষবাষ্প তাদের ধেয়ে আসছে। বাংলার তথাকথিত প্রগতিবাদী যাদের কোনো অগ্রগতি নেই তাদের সহায়তায় উচ্চবর্ণ ও আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে পূর্বপুরুষদের সেই স্পর্ধা দেখানোর প্রতিশোধ নিতে কি তারা উদগ্রিব?

এ প্রশ্নগুলো এখন ঘুরেফিরে আমাদের হাড়ের ভেতর কম্পন তুলছে। বাংলা কোনোভাবেই দিল্লির শাসনভার মেনে নেয়নি, এটা ইতিহাস স্বীকৃত। কখনো নোরম আর কখনো কঠোর সম্পর্ক ছিলো বাংলার সঙ্গে দিল্লির। এই তথাকথিত সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে দিল্লির আরএস এর ‘ঘর মে ওয়াপস আও’ এর পদধ্বনী বাংলায় শুনতে পাচ্ছি। প্রগলভ প্রগতিবাদীরা সেটা টের পান কিন্তু রুখে দাঁড়াবার সাহস তাদের নেই। অথবা এমনটাও হতে পারে, তাদেরও মনের মধ্যে সেই খায়েস জেগে আছে। অথবা দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় তারা যেটা সংস্কৃতি মনে ভেবে  চর্চা করে আসছেন, সেই বৃত্ত ভাঙতে তারা ভয় পান। ভয় পাবারই কথা। তাদের প্রগতির সঙ্গে উচ্চবর্ণের সাংস্কৃতিক চেতনা একেবারে লেজেগোবরে অবস্তা। আমরা যেখানে রবীন্দ্র চর্চা করি তারা সেখানে পূজাঅর্চনা করেন। এ দুয়ের ব্যবধান অনেক। তাদের পূজাযাত্রাকে কৌশলে আমাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখে মিশিয়ে দিয়ে কৌশলী যে বর্ণগোষ্ঠীর চর্চা করতে চান সেটা এখন স্পষ্ট।

এসব যে কোনোভাবে রুখতে হবে। সব শক্তি দিয়ে রুখতে হবে, এ চর্চার বিরুদ্ধে ভয়হীন চিত্তে রুখে দাঁড়াতে হবে। না হলে বিভাজনই আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।

আজ আমাদের আনন্দ শোভা যাত্রাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিয়ে মুছে ফেলতে চাচ্ছে। আনন্দ শোভাযাত্রা কি অমঙ্গল যা ধর্মীয় প্রতীক ‘মঙ্গলপ্রদীপ’ নামে আমাদের জাতে তুলতে চায়? বাংলাভাষাকে ধর্মীয় ব্যাকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে সাম্প্রদায়িক বানানরীতি প্রবর্তন করা হয়েছে। এটা করেছে বাংলা একাডেমী। কোলকাতার সাম্প্রদায়িক বানানরীতি অনুসরণ করতে গিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বাংলা একাডেমী। স্লো পয়জন দ্বারা এই সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক নীতিই ঠিক করে দিয়েছে ঈদ বানা হবে হ্রস্বই দিয়ে। যখন একটা প্রতিবাদের লেহর বইতে ণ্ডরু করে তখন বাংলা একাডেমী মুইজুই করে প্রচার করলো দীর্ঘঈ দিয়ে লেখলেও হবে তবে উত্তম হ্রস্বই দ্বারা ঈদ লেখা উচিৎ। এই উচিৎ বিচারের মানদণ্ড সেই ‘যবনীতি’ যা দ্বারা একটি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে রাখার পায়তারা।

অন্যভাষাকে ‘যবন’ বলে ঘৃণা করলে কারা অধিক লাভবান হবে? ভাষার এই ঘৃণ্য রাজনীতি অনেক স‌চেতন ব‌্যা‌ক্তিও বুঝতে চান না। চেষ্টাও করেন না। তারা এক বাক্যে বলে ফেলেন বাংলাভাষাকে সহজ করতে হবে। এই সহজীকরণ বলতে তারা কী বুঝাতে চান তা কিন্তু স্পষ্ট নয়।

একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরুন একটি শব্দ ‘কাণ্ড’ অন্যটি ‘লণ্ডন’। এখন ড+ণ ব্যাকরণ গ্রহণ করেছে কারণ এটি বিজ্ঞান সম্মত। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বানানরীতি বলছে London যেহেতু বিদেশী শব্দ (যবন) সেহেতু এটি সংস্কৃত বানান অনুসরণে করা যাবে না। তাহলে উচ্চবর্ণের সংস্কৃত ভাষা নিম্নবর্ণের যবণভাষার ব্যবধান বুঝা যাবে না। এভাবে ঈদ শব্দকেও বিদেশী (যবন) ভাষা অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণীর শব্দ বলে তাকেও সংস্কৃত থেকে অছ্যুৎ রাখতে হবে। এখন ট ঠ ড ঢ এই বর্গের সঙ্গে কেন দন্ত্যন (ন) যুক্ত করা যাবে না তার যুক্তিসঙ্গত কারণ হচ্ছে— দন্ত্যন (ন) ঐ বর্গকে স্পর্শ করতে পারে না। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। আল্লাহ প্রদত্ত্ব। জোর করলে উচ্চারণ বিকৃত হয়ে যাবে। এই বর্গ সর্বাবস্থায় মূর্ধ্যন (ণ) হবে। কারণ, এ বর্ণগুলোর ব্যাঞ্জন একই স্থান থেকে উৎসারিত। এ বিষয়টি বুঝার জন্য যে কোনো উচ্চারণ শিল্পী অর্থাৎ আবৃত্তি শিল্পী, ভালো নজরুল/রবীন্দ্র শিল্পী অথবা ভালো থিয়েটার গ্রুপকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন তারা কীভাবে উচ্চারণ করেন। ‘লন্ডন’ বানান লিখলেও উচ্চারণ কিন্তু ‘লণ্ডন’ করা হচ্ছে। এমনকি বাংলা একাডেমীর কোনো গবেষক যারা এমন অনাচার বানানরীতি চালু করেছেন তারা চাইলেও দন্ত্যন (ন) এর সঙ্গে ড ঢ ট ঠ যুক্ত করে উচ্চারণ করতে পারবেন না। দন্ত্যন (ন) যেভাবে ‘ত’ বর্ণের সাথে মিশে যায় মূর্ধ্যন (ণ) বর্ণটিও ট ঠ ড ঢ বর্ণের সঙ্গে মিশে যায়। বাংলাভাষার প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী দীর্ঘস্বরের অবলুপ্তি ঘটানো হচ্ছে। যেখানে-সেখানে এখন বাংলাদেশী হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশি। ‘ই’ প্রত্যয় কেবল সংস্কৃত শব্দেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। অন্তর্হিত অর্থ দীর্ঘস্বর ভাষার সৌন্দর্যও বটে।

পৃথিবীর যে কোনো ভাষার বানান কেবল উচ্চারণের বিষয় নয়, দেখারও বিষয় রয়েছে। একটি শব্দ বানান রীতির মাধ্যমে তার ঐতিহাসিক পর্বও বহন করে। ইংরেজী ভাষায় বহু শব্দে এমন বর্ণ আছে যা বানানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় কিন্তু উচ্চারণে তা উহ্য থেকে যায়। অর্থৎ এটি দেখার মাধ্যমে ও হৃদম দ্বারা তার ভিন্নতা প্রকাশ পায়। একটি সহজ শব্দই ধরুন know এবং No দুটোর অর্থগত পার্থক্য একেবারেই বিপরীত। এটি দেখার বিষয় এবং কথা বলার সময় বাক্যগঠন আপনাকে উপলব্ধি দেবে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন।

অন্যভাষাকে ‘যবন’ বলে ঘৃণা করলে কারা অধিক লাভবান হবে? ভাষার এই ঘৃণ্য রাজনীতি অনেক স‌চেতন ব‌্যা‌ক্তিও বুঝতে চান না। চেষ্টাও করেন না। তারা এক বাক্যে বলে ফেলেন বাংলাভাষাকে সহজ করতে হবে। এই সহজীকরণ বলতে তারা কী বুঝাতে চান তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। আজ যারা অনেক উচ্চশিক্ষিত তারাই এসব বলছেন। কিন্তু আগের যুগের মানুষ তাদের মতো এতো এতো বিদ্যান না হয়েও বাংলাভাষাকে কঠিন মনে করেননি। বাংলা একাডেমীর গবেষকরা যদি বলতেন ভাষা শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে সহজ ও বোধগম্য করে তোলা দরকার তাহলে এর একটি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতো।

আমাদের ‘সংস্কৃতযুগ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘সংস্কৃতযুগ’ বলতে সংস্কৃত ভাষাকে বুঝানো হচ্ছে না। যে যুগ মানুষের জন্য শ্রেণীবৈষম্য তৈরী করেছিলো। সেই যুগের অন্তর্সারশূণ্য ভাবনাকে ত্যাগ করতে হবে। আধুনিক বানানরীতি বলতে বিজ্ঞানসম্মত বানানরীতিকেই আমরা বুঝি। ‘সংস্কৃতযুগ’ নিম্নবর্ণের মানুষকে ‘যবন’ ভাবে। তাদের ভাষাকেও ‘যবন’ ভেবে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে ব্যবহৃত শব্দের জন্য বিদেশী শব্দ আখ্যা দিয়ে বানাননীতি ঠিক করা হয়েছে। রীতি ও নীতি কিন্তু ভিন্ন অর্থ বহন করে। রীতি একটি পরম্পপরা বিষয়। আর নীতি হচ্ছে আপনি নির্ধারণ করছেন। আপনার নির্ধারণ করার অধিকার আছে। কিন্তু সে অধিকার কোন কোন বিষয়ে কীভাবে প্রযোজ্য তা যুক্তির নিরিখে দেখতে হবে। এই যুক্তিকেই আমরা বিজ্ঞান সম্মত বানানরীতি বোঝাচ্ছি। পৌত্তলিক ধর্মের নীতি দিয়ে যদি বাংলাভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে সে ভাষা আর জনগণের ভাষা বলে গণ্য হবে না। রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার আড়ালে থেকে এসব অনাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলা একাডেমী একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। সেসব জায়গায় এসব বর্ণবাদী চিন্তার মানুষজন বসে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন। এ দ্বারা বাঙালি জীবনে, তার আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দীর্ঘমিয়াদী সংকট তৈরী করে হ‌চ্ছে।

বাংলা একাডেমীর মাথায় এ অনাচার কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোই হলো বর্তমান যুগের ভাষা আন্দোলন, ভাষার লাড়াই। আমরা উদ্দূর্ভাষীদের তো ৫২ সালে তাড়িয়েছি ঠিক কিন্তু সংস্কৃতভাষী দূর্জনদের কীভাবে তাড়াবো? এ সংগ্রামটা কেমন হবে তা আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে।

কে প্রথম এই বানানরীতি চালু করেছে, সেই অনুসন্ধানের চে’ জরুরী কেন করেছে। কেন করেছে সেটা বুঝতে পারলে আমরা তাদের চিনতে পারবো। ‘বিদেশী’ শব্দ ও ‘যবন’ শব্দ একটি সমান্তরাল ভাবনা। বর্তমান সময়ে ‘যবন’ বললে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বুঝি কিন্তু বিদেশী বললে সেভাবে আমাদের ভাবনাকে শঙ্কিত করে না। কিন্তু এই প্রমীত বাংলা ‘বিদেশী’ শব্দ বলার ম‌ধ্যে সাম্প্রদায়িক যবনভাবনা লুকিয়ে আছে। ‘যবন’ এক‌টি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ বিদেশী। এই যুগে আগের মতো অভিধানে ‘যবন’ লিখলে চোখে লাগে। তাই কৌশলে ‘বিদেশী’ শব্দ লিখে উদ্দেশ্য হাসিল করা হচ্ছে। মূলতঃ বি‌দেশী শব্দ উ‌ল্লেখ ক‌রে বানা‌নের ভিন্নত দেখা‌নো কো‌নো যু‌ক্তি নয়, বরং এ‌টি বর্ণবাদী মানসিকতা। এ থে‌কে আমা‌দের‌কে বে‌রি‌য়ে আস‌তে হ‌বে। মূলধারার বানাননী‌তিই বিজ্ঞান সম্মত বানাননী‌তি। প্রকৃ‌তির কূল থে‌কে আমরা এভা‌বেই ভাষা‌কে পে‌য়ে‌ছি যার ম‌ধ্যে কো‌নো দ্বৈতনী‌তি নেই। আ‌ছে এক ধারার বানানরী‌তি। সেটা তৎসম শব্দ হোক আর বা যে কোনো মাতৃক্রোড় থে‌কে আসুক সে বাংলা মা‌য়ের নিয়‌মেই প‌রি‌চি‌তি পা‌বে।

আপনার মতামত জানান

আহমদ ময়েজ

আহমদ ময়েজ; কবি ও চিন্তক। জন্ম- ১৯৬৮ সাল (সরকারি হিসাব অনুযায়ী) সুনামগঞ্জের সৈয়দপুর গ্রামে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপন করেন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে। তারপর দীর্ঘদিন বাউল সঙ্গ। লেখালেখির শুরু হয় ছড়ার মাধ্যমে। ছড়া, কবিতা, গদ্য ও সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। প্রকাশিত বই ‘একমুঠো রোদ্দুর’, ‘কেউ করো না মানা’ এবং বিমূর্ত চরণে রাখি কালের ক্ষমা। সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ভূমিজ। বর্তমানে বিলেতের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।