ইতিহাসে প্রাকৃতজনের জীবন সংগ্রাম স্পষ্টভাবে লেখা হয় না। তাদের দ্রোহ কিংবা এর কিছু স্ফুরণের ছায়াপাত প্রসঙ্গক্রমে আমরা দেখতে পাই। রাজরাজড়াদের ন্যায় পুঙ্খানুপুঙ্খ করে লিপিবদ্ধ হয় না। কিন্তু জনমানবে তাদের সংগ্রাম ও যাতনার কাহিনী মিথ হয়ে বেঁচে থাকে।
বিদগ্ধ লেখক ঔপন্যাসিক শওকত আলী তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাস সে ধরণের মিথ ও প্রাকৃতজনের নানা বর্ণের কাহিনীকে আধার করে লেখা একটি অনবদ্ধ উপন্যাস। এটিকে তিনি দুই পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্বে রয়েছে মূল নামকরণ ‘প্রদোষে প্রকৃতজন’, দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে ‘দুষ্কালের দিবানিশী’। লেখকের এমত দুপর্বের মধ্যে তেমন ব্যবধান নেই। কারণ,কাহিনী বর্ণনায় এর সময়কালের তফাৎকে তেমন প্রস্ফুটিত করে না। তথাপি তিনি ‘দুষ্কালের দিবানিশি’ বলে উল্লেখ করেছেন মূল রাজবংশ লক্ষণসেনের রাজ্যকেন্দ্র থেকে ছুটে আসা তুর্কি ঘোরসোয়ারদের বর্ণনা তুলে ধরতে। ততদিনে লক্ষণসেন পালিয়েছেন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যা অন্ত্যেজনেরা পূর্বেই আভাস পেয়েছিলো কিন্তু সামন্ত ও মহাসামন্ত প্রভুরা উপলব্ধি করতে পারেনি। কেন তারা উপলব্ধি করতে পারেনি সে বয়ান পাওয়া যাবে উপন্যাসের প্রকৃত চরিত্রগুলোর মুখে মুখে।
এ গ্রন্থের পটভূমি গৌড়েশ্বর লক্ষণসেনের সময়কাল। তিনি সেন রাজত্বের চতুর্থ রাজা (১১৭৪—১২০৬ খী:)।
আমরা জানি, কাল্পনিক চিন্তা-ভাবনা আর ইতিহাসের পাড় ধরে চরিত্র রূপন করা একেবারেই ভিন্ন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গ্রন্থের ফ্লেপে লিখেছিলেন, ‘ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীর কাহিনী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়তো অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে, হয়তো অন্যকালেও।’
প্রাজ্ঞজন শওকত আলী রাজদরবারের অনেক দূর থেকে চিত্র অঙ্কণ করেছেন। রাঢ় বরেন্দ্রভূমির ছোট বড় কিছু গ্রাম ও মানুষদের কেন্দ্র করে তুলে ধরেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজনে’র কাহিনী। আত্রেয়ী-করতোয়া সঙ্গম ও ব্রহ্মপুত্রের কূল ঘেষে গড়ে ওঠা এসব গ্রাম ও মানুষ। রজতপট,কুসুম্বী,বিলম্বগ্রাম,বর্ণপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোর চমৎকার নাম আমাদের আভাস দেয় সে সময়কালের প্রকৃত রূপ।
এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শ্যামাঙ্গ, অভিমন্যু, লীলাবতী, বসন্তদাস, মায়াবতী আর গুরু বসুদেব। তাদের উপলক্ষ করে ওঠে এসেছে আরো যে সব চরিত্র যা একটি উপন্যাসের কাঠামোগত ক্যানভাস সাজাতে সহায়ক হয়ে ওঠে।
এ উপন্যাসে আমরা বড় দাগে তিনটিরূপ দেখতে পাই। এক, শ্যামাঙ্গ যার পুরো বক্ষজুড়ে রয়েছে এক শিল্পীমানস। অন্তর্মুখী প্রেম যা ক্ষণে ক্ষণে প্রজ্জ্বলিত হয় শৈল্পীক আধারে। যার কর্ম মৃৎশিল্প এবং একদিন সে আবিষ্কার করে, যে চিত্র সে আঁকতে চায় সেখানেই বঙ্কিম রেখা নিয়ে এক লীলাবতী রমণী এসে তাকে আচ্ছন্ন করে তুলে।
দুই, কেন্দ্রীয় রাজ্যপাঠ যা ছায়ারূপে উপন্যাসের বিভিন্ন পর্যায় ব্যাপ্ত হয়েছে।
তৃতীয়, প্রান্তজন যারা সমাজ পরিবর্তনের মূল সহায়কশক্তি। কিন্তু তাদের উপস্থিতিও প্রগাঢ়ভাবে উপন্যাসের মূল চরিত্র হয়ে ওঠেনি। তাদেরকেও লেখক অনেকটা ছায়ারূপে প্রকাশ করেছেন। তারা আছেন কিন্তু দালিলিকভাবে লিপিবদ্ধ হননি। এ বিষয়গুলো নিয়েও আমরা আরো কিছু পর্যালোচনা করবো।
এই উপন্যাসের পটভূমি সেন রাজাদের রাজত্বকাল। আমরা ইতিহাস পাঠ করি এক ধরণের উপলব্ধি নিয়ে যেখানে, সন-তারিখ, স্থান-কাল-পাত্র এবং বড় দাগে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে যে বক্তব্য আসে তা নিরীক্ষা করে দেখা। কিন্তু সেই ইতিহাসের সময়কালের সাধারণ মানুষজন যখন কথা বলে, তারা হাসে, গায়, নীরবে চোখের জল মুছে — তখন সেই উপলব্ধি অন্য এক স্তরে এসে পৌঁছে যেখানে আমরা এর ভেতর দিয়ে সময়কে আবিষ্কার করতে পারি। একই সঙ্গে বুঝতে পারি সেসব মানুষের সমাজচিন্তা, সাংস্কৃতিক উপলব্ধি, বহমান রুক্ষতার আক্রোশে কীভাবে তাদের পাঁজর ভেঙে খান খান হয় ইত্যাদি। এ উপন্যাস অনেককে নানাভাবে ভাবতে সেখাবে। অদ্ভুদ ও সৃজনশীল চরিত্র শ্যামাঙ্গ। তার শিল্পবোধ এবং সমকালের মুখোমুখি হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া — সেই সময়ের যুগযাতনাকে আত্মস্থ করার মানুষ, যারা কখনোই হার মানতে জানে না। আমাদের মৃৎশিল্পের এই বিবর্তন এমনি এমনি ঘটেনি। সবসময়ই একজন শ্যামাঙ্গ গুরুবাদী হয়েও গ্রীবা উঁচিয়ে পুরানো ভাবনাকে ভাঙতে শিখিয়েছেন। শ্যামাঙ্গের সে রকমই এক মানসজগৎ। মাটির কলসিতে যখন যমুনায় জল আনার দৃশ্য অংকন করেন সেটা তিনি প্রচলিত ধারাকে ভেঙে নতুনভাবে সাজাবার চেষ্টা করেন। সেই পুরানো আর নতুনের ব্যবধান ছিল যৎসামান্য। সেই একই ছবি একই রূপ। রাধা কলসি কাঙ্কে নিয়ে যমুনায় যাচ্ছে — একেবারে সরল অঙ্কন। কিন্তু শ্যামাঙ্গের সেটা ভালো লাগেনি। তিনি সেই গমনের মধ্যে আনলেন নতুন গতি। তুলে ধরলেন নিজের মতো করে। রাধাকে ভাঙলেন। তার চঞ্চল পায়ে একটু ঠমক তুলে দিলেন। এই ঠমকটুকুই ছিলো তার অপরাধ। গুরুকর্তৃক ভর্ৎসনার শিকার হলেন। গুরু গম্ভীর স্বরে বলেন, ছি!। সেই ‘ছি’ বলার অর্থ ছিলো রাধার যমুনাগমন মুহূর্তটি আরো স্বচ্ছ হতে হবে। নির্মোহ হতে হবে। ঠমক দেয়া চলবে না। কারণ, এই ঠমক যৌনাশ্রিত। মনের দুঃখে একরাতে সমস্ত কলসি ভেঙে সে পলায়ান করে। এই পলায়নটাই ছিলো তার সারা জীবনের অর্জন। এর ভেতর দিয়ে সে শাসকগোষ্ঠী ও বহিঃরাগতদের আগমন পর্যবেক্ষণ করেছে। যে লীলাবতীকে ভালোবেসেছিল সেখানে আসে এক চরম দ্বন্দ্ব। এ সময়টাকে ‘হিন্দুইজম’ চিহ্নিত করেছে যবনদের আগমনকাল হিসেবে। শ্যামাঙ্গের ভেতর চরমভাবে সন্দেহ দানা বাধে। লীলাবতী শেষতক ধর্মান্তরিত হয়ে যায় কি না। কিন্তু তর্কে সে লীলাবতীকে পরাজিত করতে পারে না। আবার সে পালায়। যবনকেন্দ্রে লীলাবতীকে রেখে যায় এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে, সহসা ফিরে আসবে। শেষতক শ্যামাঙ্গের পরণতি কতোটা হৃদয়বিদারক আর কতোটা সময়কর্তৃক নির্ধারিত সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনায় রেখে দিয়েছেন শওকত আলী।
কথাকার শওকত আলী শ্যামাঙ্গের একটি ভ্রমকে সমস্ত উপন্যাসে ছড়ি দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের শেষ প্রান্তে তিনি এক অভিনব কৌশলে টেনে নিয়ে গেছেন। টেনে নিতে গিয়ে কোথাও ছন্দপতন বা ক্লান্তি তৈরী করেননি। এক অর্থে বলা চায় শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতী কাহিনীর মূল চরিত্র এবং তাদের মাধ্যমে আমরা পাঠক হিসেবে পটপরিবর্তনের নানা প্রান্তে প্রবেশ করতে বাধ্য হই। ইতিহাসের পাঠ পড়াতে গিয়ে তিনি আমাদের সে সময়ের শিল্পমান ও সনাতনী ধারার প্রকট দিকটি উন্মোচন করে দেন একজন শ্যামাঙ্গের মাধ্যমে। গুরুদীক্ষায় শ্যামাঙ্গ যতোটা নমনীয়, নিজ মানস বুঝার ক্ষেত্রে ততটাই ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যকে সে স্বীকার করে এবং গুরুদীক্ষাকে মান্যও করে। তথাপি এক অভিমান নিয়ে তাকে পালাতে হয়। সেখান থেকেই ‘প্রতোষে প্রকৃতজনে’র যাত্রা শুরু। আমাদের পুরো উপখ্যানকে বুঝতে হলে শ্যামাঙ্গের এই পলায়নমুখিতাকে নজরজ্ঞানে রাখতে হবে।
অর্ন্তমুখী এক তরুণ শিল্পজ্ঞান নিয়ে নিরন্তর পালাচ্ছে। মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও তার শিল্পদৃষ্টি একবারের জন্যও নতমুখী হয়নি। এটি মধ্যযুগের নন্দনশিল্পের দ্রোহ। শওকত আলী যতো না সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে ইঙ্গিতময় করেছেন তার চে’ অধিক নিজেরই অন্তর্মমুখী শিল্পভাবনাকে শ্যামাঙ্গের ভেতর দিয়ে আমাদের দেখাবার চেষ্টা করেছেন। মধ্যযুগের শিল্পসাহিত্য কিংবা বড়দাগে কবিতাঙ্গনকে আমাদের সময়ের অনেক বোদ্ধা গবেষক নীচতার দৃষ্টিতে অবলোকন করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে প্রয়াত লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ চর্চাপদের কবি তথা মধ্যযুগের শিল্পভাবনাকে একগেয়মী ও ক্লান্তিকর বলে বর্ণনা করেছেন। হুমায়ুন আজাদের বোধ মধ্যযুগের ভাবনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি তার ‘আলো ও অধেয়’ গ্রন্থে বড় নির্মমভাবে তাদের অপমান করেছেন। হুমায়ুন আজাদ মধ্যযুগের কবিদের একশ বছরের অধ্যায়ে কোনো দ্রোহ তো খুঁজে পাননি, এমনকি কোথাও এর বুদবুদটুকুও আছে বলে তিনি মনে করেন না। তার এই অবিচারও যে এক ধরণের ক্লান্তিকর স্বভাব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের আজকের আলোচনা শ্যামাঙ্গের পলায়নমুখিতাও কোনো পরাজয় নয়, বরং ঘুরে দাঁড়াবার নতুন প্রত্যয়। নতুন সত্ত্বার স্ফুরণ নিয়ে স্থান ও বোদ্ধার অনুসন্ধন ছিলো তার প্রকৃত মকসুদ। শওকত আলী শ্যামাঙ্গের শেষ পরিণতিকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন এবং নিয়তি তার মৃত্যু ডেকে আনলেও একটি সংকেতের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামাঙ্গদের মতো শিল্পীদের কোনো মৃত্যু নেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো,হুমায়ুন আজাদরা দ্রোহ বলতে কী বুঝেন তা একটু বিবেচনা করা দরকার। আমরা রবীন্দ্রনাথের কোমলভাষার মধ্যেও একধরণের দ্রোহ আবিষ্কার করতে পারি। তিনিও নিজের মতো করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ধরণের ভাষা ব্যবহার করেছেন যা আমরা আমাদের পরিবর্তনশীল মানসিকতা থেকে সেই ভাষা ও বক্তব্য ব্যবহার করে আসছি। আবার কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাও দ্রোহের দাবানল নিয়ে এসেছে। বাঙালি পাঠক দুই পর্যায়ের দ্রোহী ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেছে। মধ্যযুগের সাহিত্যও এক শান্তসরোবরের দ্রোহ চিহ্ন রেখে গেছে যা ড. হুমায়ুন আজাদ এই পার্থক্য নির্ণয় করতে অক্ষম ছিলেন। তার কাছে দ্রোহ বলতে বাঙালির ৭১ সালের মুক্তযুদ্ধ সময়ের রণহুংকারকেই কেবল দ্রোহ বলে বিবেচ্য হয়েছে। মধ্যযুগের কবিদের নিরন্তন পলায়নকেই তিনি দেখেছেন। অগ্নিকুণ্ডে তাদের বলিদান দেখতে পাননি। এবং নিজ ভাষায় কবিতা লেখার অপরাধে জীবন উৎসর্গ করেও মধ্যযুগের কবিরা সেভাষা ত্যাগ তো করেননি বরং তারা তা বাঁচিয়ে রাখতে যখন যেখানে, যেভাবেই হোক তা সংরক্ষণ করে রেখে গেছেন। এটাই ছিলো তাদের দ্রোহ। মৃত্যুর মতো ভয় তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখন যদি হুমায়ুন আজাদ তাদের কাঠামোগত অপিরবর্তনকে কেবল চিহ্নিত করতেন সে হতো অন্য প্রসঙ্গ। বরং তিনি তাদের সমগ্র জীবনযাপনকেই উপহাস রূপে দেখেছেন।
আমাদের আজকের আলোচনা শ্যামাঙ্গের পলায়নমুখিতাও কোনো পরাজয় নয়, বরং ঘুরে দাঁড়াবার নতুন প্রত্যয়। নতুন সত্ত্বার স্ফুরণ নিয়ে স্থান ও বোদ্ধার অনুসন্ধন ছিলো তার প্রকৃত মকসুদ। শওকত আলী শ্যামাঙ্গের শেষ পরিণতিকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন এবং নিয়তি তার মৃত্যু ডেকে আনলেও একটি সংকেতের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামাঙ্গদের মতো শিল্পীদের কোনো মৃত্যু নেই। যে বঙ্কিম রেখায় শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর গমনমুখী চিত্র ও ঠমক ধারণ করেছিলো, সেটি এখনও কোনো মন্দির বা স্থাপত্যের গাত্রে অঙ্কিত দেখলে বুঝতে হবে, সনাতনপন্থী শিল্পীদের বিরুদ্ধে একটা নীরব বিপ্লব করে গেছেন শ্যামাঙ্গ। এখানেই শ্যামাঙ্গের বিজয়। এ বিজয় ধ্যানী লেখক শওকত আলীরও।
এ গ্রন্থের রাজদরবার নিয়ে আলাদা অনুচ্ছেদ লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কাহিনীর সময়কাল যদিও সেন রাজত্বকালকে কেন্দ্র করে তবু এ উপন্যাসের মূলপ্রাণ রাজাদের রাজদরবার নয়, প্রজাকূল যারা শত শত বছর ধরে উপেক্ষিত।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ গ্রন্থের ভাষারীতি ও শব্দচয়ন নিঃসন্দেহে যে কারোর নজর কাড়বে। প্রশ্ন জাগতে পারে লেখক শওকত আলী এ কোন ভাষা ব্যবহার করেছেন? তাঁর অন্যসব উপন্যাস পড়লে আমরা বুঝতে পারি এটি সম্পূর্ণ এক আলাদা ভাষারীতি। এর বাক্য গঠন, শব্দচয়ন শওকত আলী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। কারণ, তিনি পাঠককে সেই সময়ের ভেতর দিয়ে হাটাতে চান যে সময়টা মানুষ ঐভাবে কথা বলতো। সময়ের পরিবর্তন আমাদের ভাষা অন্য জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। এটি সময়ের দাবীও বটে। এই গ্রন্থের চলিতরীতি বর্জন করে যদি আমরা সাধুরীতিতে পড়তে শুরু করি, তাহলে অনেকের কাছে মনে হবে বঙ্কিমযুগের কোনো উপন্যাস পাঠ হচ্ছে। তথাপি লেখক চলিতরূপই ধরে রেখেছেন কিন্তু একই সঙ্গে সাধুভাষার গাম্ভির্যও গ্রন্থের পুরো বক্ষজুড়ে অবস্থান করছে। কিছু বাক্য-শব্দ ও সংলাপ উদ্ধৃত করা যাক:
‘কি ভ্রাতঃ বিজয় উৎসব দেখতে যাবে না’
‘আপনি কি আমাদের সঙ্গী হবেন?’
‘যখন নীবিবন্ধ স্পর্শ করে অভিমন্যু, তখন লীলাবতি চিৎকার করে ওঠে।’ যে সব শব্দ এখন আর ব্যবহৃত হয় না সেসব শব্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ‘উদরে’, ‘উত্তম কথা’, ‘কি মহাশয়’ ইত্যাদি।
উজুবট গ্রামের বাসিন্দারা একদিন সত্যি সত্যি আক্রান্ত হলো। তা কিন্তু সেই প্রান্তজনদের কেন্দ্র করে যাদের সমাজে সবচে নিম্নেশ্রেণীর বলে গণ্য করা হতো। আজও হিন্দু (সনাতন) সমাজে এই অচ্যুত প্রথা আগ্রাসনদৃষ্টি নিয়ে বেঁচে আছে। উজবুট আক্রান্ত হলো স্বজাতিদের ক্রোধে। উজুবটের গ্রামপতি ও সাধারণ মানুষ সেই শিকার থেকে নিস্তার পাননি। আর যেদিন মধ্যরাতে এই অঘটন ঘটে সেদিন শ্যামাঙ্গও সেই গ্রামেই ছিলো। কেন গিয়েছিলো, মায়াবতীর মায়ের চরণ স্পর্শ করতে? নাকি লীলাবতির গ্রীবা বাঁকানো ধনুকী দৃষ্টিপাত তাকে টেনে নিয়ে গেছে? ঐ রাতে গ্রামখানি আক্রান্ত হয়েও কিছু লোক বেঁচে গিয়েছিলো। তারা পালিয়ে গিয়েছিলো বনভূমির দিকে। সামান্ত ও মহাসামন্তপ্রভুদের দ্বারা আক্রান্ত হলে হরিজন ও ভীক্ষুরা তুর্কিদের ডেকে আনে। তারা এসে আরো এক প্রস্ত আক্রমণ চালায়। সে উপখ্যান পাঠক পুরোটা পড়লেই বুঝতে পারবেন, কেন এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলো এই প্রান্তিকজনগোষ্ঠী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা যাদের প্রান্তিকজনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করি এই গ্রন্থে প্রান্তিকদের দ্বারা আরো প্রান্তিকজনগোষ্ঠী বারবার আক্রান্ত হচ্ছিল। সেই প্রান্তজনের কাউকেই লেখক মূল চরিত্রে ঠাই দেননি। কিন্তু কেন? অভিমুন্যদাস, শ্যামাঙ্গ, লীলাবতি, মায়াবতি, বসন্তদাস, শুকদেব, উপাধ্যায় সোমজিৎ — এসব মানুষ তো সামন্ত প্রভুদের কাছাকাছি থাকার লোক। যদিও তারাও নির্যাতিত। কিন্তু মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মানুষজন। আমরা প্রান্তিকজগোষ্ঠীর এক তরুণী ‘কুসুম ডোমনী’ ছাড়া আর কাউকে উল্লেখ করার মতো খুঁজে পাইনি। হ্যা, কুসুম ডোমনী জীবন দিয়ে একটি সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে। সে সলতে ভীক্ষুজনেরা বহন করে নিয়ে গেছে দূরদুরান্তের জনপদে। প্রথমেই বলেছিলাম লেখক তাদেরকে ছায়ার মতো রেখেছেন। এবং সেই ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে দিকদিগন্তে। তারাই ডেকে এনেছিলো তুর্কি সেনাদের — যাদের যবন বলে আখ্যা করেছিলো সামন্তপ্রভুরা। কিন্তু তাদের রোধ করার শক্তি তাদের ছিলো না। কারণ, ততদিনে বাংলার মূল জনশক্তিকে সামন্তপ্রভুরা শত্রুতে পরিণত করে তুলেছে। এটি ইতিহাসের একটি পরিণতি। লেখক এই পরিণতিকে আধার করে নির্মাণ করেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।
আরো ছোটখাটো বিষয় তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে আনলেও মূলত সেটা আর প্রাসঙ্গিক থাকেনি। যবন কেন্দ্র। যকবকেন্দ্র বলতে কী বুঝায়? সে সময়ের জন্য এটি নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিলো সমাজে। তারা সেবাদান করতো প্রান্তিকজনগেষ্ঠীকে যেটি রাষ্ট্রের দেবার কথা। মানুষজন ক্রান্তিকালে সেখানে দলে দলে আশ্রয় নিতে থাকে। এবং একদিন সেখানে শ্যামাঙ্গও গিয়েছিলো লীলাবতির সন্ধানে। সে একদিন খবর পেয়েছিলো,লীলাবতি সেখানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হতে চায়। লীলাবতির ক্রোধ ছিলো, যে ধর্ম তাকে রক্ষা করতে পারেনি, যে সমাজ তাকে সংসার দেয়নি কীসের ভরসায় সে তাদের পদদলিত হবে? এ ছিলো সেসময়ের পরিস্থিতি। শওকত আলীর মুসলিম সুফীদের নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ তা সময়ের সঙ্গে কিছুটা অযৌক্তিক মনে হবে। কারণ, তিনি দীর্ঘদেহী মানুষদের যে বর্ণনা ও পোশাকের পরিচয় দিয়েছেন সেটি কেবল আরবদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলে বা তাদের পোশাক ও সংস্কৃতির সঙ্গে চলনসই হলেও সুফীধারার মানুষজন দেড়হাজার বছর ধরে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন কিন্তু এই যবনসেবা কেন্দ্রের মানুষদের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সম্ভবত লেখক প্রচলিত অর্থে মুসলমান বলতে সৌদী পোশাকের ধারণাকেই তিনি প্রাধান্য করেছেন। আসলে কি সেটা সঠিক বলে মনে হয়? হাজার বছর আগে ভ্রহ্মপুত্রের কুলঘেষে ময়মনিসংহ অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছিলেন সৈয়দ সুলতান। আজও তার মাজারের শীলাপাথরে সনতারিখ অঙ্কিত রয়েছে। শওকত আলী আরো কিছু অগ্রসর হলে তাদের আরো দূরতম খবর নিতে পারতেন। সেদিকে তিনি আলোকপাত করেননি। এ গ্রন্থে প্রান্তিকজনগোষ্ঠী ও যবনপরিচয়ে বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে আসা মুসলমান সুফীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অসঙ্গত মনে হয়েছে।
প্রান্তিকজন বলতে যে ডোম, নাপিত, ডোঙ্গা, দাস ইত্যাদি শ্রেণীগোষ্ঠীই মূলত অস্পৃর্শ। তারা হিন্দুসমাজে পূর্বজনেমর পাপের পাশ্চিত্য বহন করছে — এটাই তাদের বিশ্বাস। তাই সমাজপতিদের বিধানও তারা নির্যাতিত হওয়া সঙ্গত। এটা তাদের পাপের প্রাপ্য। কী অদ্ভুত এক সমাজব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বঙ্গভূখণ্ড আজও বেঁচে আছে। অধিক জনগোষ্ঠী আজও মুক্তি পায়নি।
শেষাংশ:
হ্যা, নগর উৎসবে অনেক ভিক্ষু শরীক হয়েছিল। স্বদেশীরা যবনদের আগমনের সুযোগ নিয়ে যে লুণ্ঠনে হাত দিয়েছিল সেসব বিহারে বসে শ্যামাঙ্গও অবলোকন করেছে। তার সকল পর্যবেক্ষণ এক জায়গায় এসে হঠাৎ থিতু হয়। সমস্ত দিন বিহারে কাটায়। এমন শঙ্কাকালীন মুহূর্তেও তার চোখ আটকে যায় বিহারের প্রাচীন গাত্রে। অবাক বিস্ময়ে মৃৎপটগুলো দেখে। আরো আকৃষ্ট হয় প্রস্তর মূর্তিগুলো দেখে। তার মনে পড়ে গুরু বসুদেবের কথা। মৃৎ অঙ্কনের গ্রীবা, মস্তক, কটিদেশ, স্কন্ধ, বস্ত্রাচ্ছাদিত স্তনযুগল — সব কিছু ছাপিয়ে লীলাবতীই তার নজরে আসে। সে সারা জীবন যে চিত্রের দিকে ধাবিত সে তো আর কেউ নয় — লীলাবতী।
পাঠের ভেতর দিয়ে এমন মনে হবে যেন একটি দালিলিক চিত্রকর্ম দেখছি। গ্রন্থটি পাঠের ভেতর আমরা পাই কীভাবে তুর্কীদের আগমন। সেনদের অত্যাচারের কারণে জনমানসে তার প্রভাব। প্রদোষে প্রাকৃতজন এভাবে আমাদের সামনে অতীতকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে। রাঢ় বরেন্দ্র বঙ্গ সমতটবাসীকে সংগ্রামী হিসেবে তিনি চিহ্নিত কররেছেন। শওকত আলী তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, আমি যতোটুকু তথ্য-উপাথ্য সংগ্রহ করেছি তার ভিত্তিতে তাদের ভাষা কেমন ছিলো তা বুঝার চেষ্টা করেছি। হ্যা কথাটা সত্য, আমরা যে সময়ে বাস করছি, যেভাবে কথা বলছি নিঃসন্দেহে সে সময়ের মানুষজন এমনভাবে কথা বলতো না।
গ্রন্থ: প্রদোষে প্রাকৃতজন (উপন্যাস)
লেখক: শওকত আলী
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪, পঞ্চম মুদ্রণ ২০০২