কথাসাহিত্যগল্প

প্রতিদান

হঠাৎ রাশিদ দেখতে পায়, আব্বুজি আর কয়েকজন মিলে একটা লোককে বেঁধে গুদামঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এই লোকগুলো ইদানীং এসে জুটেছে আব্বুজির সাথে। আগে এদের কখনো দেখেনি রাশিদ। একেকটার কী জঘন্য চেহারা।

রাশিদের খুব ভয় লাগছে সকাল থেকেই। গলা শুকিয়ে এসেছে আতঙ্কে। চাইলেই অন্য ঘরে গিয়ে পানি খেয়ে আসা যায়। কিন্তু কোথাও যেতে সাহস হচ্ছে না। আজ সে খুব সাহসের একটা কাজ করবে বলে ঠিক করেছে। কাজটা ভয়ংকর। কতটা ভয়ংকর, সেটা বুঝতে পারছে না বলেই ভয়টা যেন আরও বেশি।

মার্চ মাসের আগেও যখন স্কুল খোলা ছিল, নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যেত সে। লাস্ট ম্যাচে তাদের জিততে ৩৯ রান দরকার ছিল। ছয় ওভারের খেলা। উইকেট পড়ে গেছে চারটাই। শেষ বলে জিততে ছয় রান লাগে। শুধু সে আর মাকিদ ব্যাট করছে। মাকিদ ব্যাটিংয়ে থাকলে এত সমস্যা হতো না। মাকিদের গায়ে অনেক শক্তি। নিয়মিত ব্যায়াম করে সে। প্রতিদিন ভোরবেলা মুঠ মুঠ করে কাঁচা ছোলা খায়, সিদ্ধ ডিম খায় দুটি করে।

সম্পর্কিত

মাকিদ আসলে তাদের দলের সেরা ব্যাটসম্যান। তাকে দলে নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায় রীতিমতো। সমস্যাটা ছিল স্ট্রাইকিং এন্ডে রাশিদ। তারচেয়ে বড় সমস্যা, বল করছে সুবীর।

আম্মুজির হাতের একমুঠো ভাতের পরিমাণও মেঘ ছিল না আকাশে সেদিন। ফলে মেঘনাদের ছুড়ে দেওয়া বাণের মতো সরাসরি তীব্র রোদ এসে পড়ছিল মাথায়। গা পুড়ে যাচ্ছিল; আর দরদর করে ঘামছিল রাশিদ।

পুরো দল তাকিয়ে ছিল তার দিকে। কিন্তু সে কি পারবে? কীভাবে পারবে? এমন ভয়ংকর বল করে সুবীরটা! বল হাতে যখন নন–স্ট্রাইকিং এন্ডের দিকে ছুটে আসে, মনে হয় যেন বিন্ধ্যাচল পর্বত আসছে। মাঝে একদিন ওর বল রাশিদের শরীরের এমন এক জায়গায় লেগেছিল যে সেটা কাউকে দেখাতেও পারে না। দুদিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনি সে।

বুকে হাত না দিয়েও সেদিন টের পেয়েছিল রাশিদ, হৃৎপিণ্ডটা ধড়াম ধড়াম করে বাড়ি মারছে পাঁজরে। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বুক ঠেলে বেরিয়ে আসবে। ভাগ্যিস এখানে কোনো ফুটো নেই। থাকলে যে বের হতোই, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই তার।

কী যে শক্তি ওই সুবীরটার! একবার তো গাবগাছের ডালের স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলেছিল বল করে। সেই বল যদি এসে অমন একটা জায়গায় লাগে!

আহা! সুবীররা রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। কই গেছে, কেউ জানে না। রাশিদ শুনেছে যে সুবীররা সবাই নাকি ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে। সুবীরের বলের সামনে আর কোনো দিন তাকে ব্যাট হাতে দাঁড়াতে হবে না, এটা ভেবেই সুবীরদের চলে যাওয়ায় খুশি হওয়ার কথা ছিল রাশিদের। কিন্তু কেন যেন তার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সবাই বলত যে সুবীর বড় হয়ে অনেক বড় খেলোয়াড় হবে। পাকিস্তান ডেনিস লিলি হবে সে। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা অবশ্য লিলি বললে খুব খেপে যায় সুবীর। লিলি মেয়েদের নাম।

আগে যখন বড়রা এসব কথা বলত, রাশিদ খুব অবাক হতো। সবটা বুঝতে পারত না সে। সে ভাবত, বড় হলে তো সবাই বড় খেলোয়াড়ই হয়। এখন অবশ্য রাশিদ বুঝতে পারে, বড় খেলোয়াড় মানে ‘বয়সে বড়’ নয়। এই ‘বড়’ অন্য ব্যাপার।

রাশিদ আরও শুনেছে, সুবীরের বাবা নাকি পূর্ব পাকিস্তান (যাকে এখন তারা বাংলা দেশ বলে) ফিরে এসেছেন। তিনি এখন মুক্তিযোদ্ধা। আব্বুজি অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পারেন না। গালাগাল দেন। ‘শুয়োরকা বাচ্চা’, ‘জানোয়ারকা বাচ্চা’ ইত্যাদি নোংরা সব গালাগাল। আব্বুজির মুখ দিয়ে এসব গালাগাল বের হতে পারে, রাশিদ কল্পনাও করতে পারেনি।

কেমন যেন হয়ে গেছেন আব্বুজি। অনেক দিন ধরে আব্বুজির আচরণ তার কাছে খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে। কেন এমন হলো!

রাশিদকে বন্ধুরা সবাই রশিদ নামে ডাকে। শুধু বাসায় তাকে রাশিদ ডাকা হয়। তাদের সবার নামেই এমন একটা ব্যাপার আছে। বাইরের সবাই যেভাবে ডাকে, পরিবারে ঠিক সেভাবে ডাকা হয় না। যেমন তার বড় বোনকে বাসায় সবাই রুকিয়া নামে ডাকে, যদিও বাইরের লোকজন ডাকে রুকাইয়া। নাম ছাড়াও অন্য সবার সঙ্গে তাদের বেশ আলাদা কিছু ব্যাপার আছে। সবচেয়ে আলাদা ব্যাপার ভাষা। বাইরে সবাই বাংলায় কথা বললেও বাসায় তারা বিহারি ভাষায় কথা বলে। রাশিদের উর্দু হাতের লেখাও খুব সুন্দর। আব্বুজি সব সময় উর্দু লেখার দিকে জোর দিতে বলেন।

বাসায় বাংলা বলা একধরনের বারণই। আগে এত কড়াভাবে বারণ ছিল না অবশ্য। বছরখানেক ধরে পরিবেশ কেমন পালটে গেছে। এখন বাসায় কেউ ভুলেও বাংলা বললে আব্বুজি খেপে ওঠেন। নোংরা গালি দেন।

সেদিন ভুলে বোন রুকিয়াকে রাশিদ বলেছিল, এক গ্লাস পানি দে তো। আব্বুজি চিৎকার করে ওঠেন। এসে কান খামচে ধরেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ‘জানোয়ারকা বাচ্চা, পানি লানেকো কাহো। ইস ভাষা মে বাত কিউ কার রাহে হো শুয়ারকা বাচ্চা।’

কানটা যেন ছিঁড়েই যাচ্ছিল রাশিদের। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আব্বুজির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভয় ও বিস্ময়ে কাঁদতেও পারছিল না সে। আব্বুজি বললেন, ‘বোল। আব চুপ কিউ হো?’

রাশিদ ফোঁপাতে ফোঁপাতে রুকিয়াকে বলল, ‘এক গিলাস পানি লাও।’

শেষ কিছুদিনে অনেক বেশিই পালটে গেছেন আব্বুজি। কী সরল মানুষ ছিলেন! এত দিন আব্বুজিকে পৃথিবীর সেরা বাবা মনে হতো রাশিদের, এখন আর মনে হয় না। যদিও এখনো সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আব্বুজিকে।


গুদামঘরে লোক ধরে আনার দৃশ্য অবশ্য এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে রাশিদদের কাছে। এমন প্রায় রোজই ঘটে। তবু আজকের লোকটিকে খুব চেনা মনে হলো। খুব! নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না রাশিদ।


‘বাসে’ না বলে এখন অবশ্য ‘বাসত’ বললেই ভালো হয়। কিন্তু আব্বুজির ক্ষেত্রে সে এখনো এভাবে ভাবতে চায় না। আব্বুজিকে এখনো কেন যেন সে ভালোবাসে। এই ব্যাপারটা নিয়ে রাশিদ অবশ্য খুব দ্বিধা আর অপরাধবোধে ভোগে। সে বোঝে, আব্বুজিকে তার আর একটুও ভালোবাসা উচিত নয়। কিন্তু এই যে আব্বুজিকে ভালোবাসা উচিত নয়, এটাই তার অন্যায় বলে মনে হয়। কেউ কীভাবে তার আব্বুজিকে ভালো না বেসে পারে!

রাশিদ জানে, আব্বুজিকে ভালা না–ই বাসা উচিত। কেন? আজকের ঘটনাটাই বলা যাক। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে সে। উঠতে হয়। উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন পড়তে বসে। তারপর এক বাটি সরিষার তেল মাখা মুড়ি খেয়ে উঠানে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। আজও বেরিয়েছিল সে। একমনে হাঁটছিল। কী ঠান্ডা বাতাস! অদ্ভুত সুন্দর গোলাপ ধরে আছে গাছে। আস্তে আস্তে দুলছে। গুদামঘরের ঠিক সামনে পোষা বিড়ালটা খেলছে বাচ্চাদের সঙ্গে। একটু পরপর লেজটা বিছিয়ে দিচ্ছে, বিড়ালছানাগুলি হুমড়ি খেয়ে পড়ছে লেজের ওপর। মা বিড়ালটা লেজ সরিয়ে নিচ্ছে আচমকা। আবার বিছিয়ে দিচ্ছে। যেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সাপ শিকারের।

হঠাৎ রাশিদ দেখতে পায়, আব্বুজি আর কয়েকজন মিলে একটা লোককে বেঁধে গুদামঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এই লোকগুলো ইদানীং এসে জুটেছে আব্বুজির সাথে। আগে এদের কখনো দেখেনি রাশিদ। একেকটার কী জঘন্য চেহারা। রাশিদ জানে, কারও চেহারা নিয়ে এমন ভাবা অন্যায়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পৃথিবীর অন্য সব মানুষের মতো এদের চেহারাও সুন্দর। খারাপ হলো কথা বলা, চলাফেরা করার ভঙ্গি।

গুদামঘরে লোক ধরে আনার দৃশ্য অবশ্য এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে রাশিদদের কাছে। এমন প্রায় রোজই ঘটে। তবু আজকের লোকটিকে খুব চেনা মনে হলো। খুব! নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না রাশিদ।

 

দুই

রাশিদের বুক কাঁপছে। সেদিনের সেই ক্রিকেট ম্যাচের চেয়েও অনেক বেশি জোরে। নিজের ছোট্ট ঘরে বসে আলগোছে বুকে হাত রাখে রাশিদ। হাতটাই কেঁপে কেঁপে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। দেয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল। প্রতি ঘণ্টায় এমন করে ঘণ্টা বাজে। শুরুতে তো ভয়ই পেত রাশিদ।

গত মাসে তার দাদা মারা গেছেন। তিনিই ঘড়িটা দিয়েছিলেন রাশিদকে, গত জন্মদিনে—এ বছর মার্চে চৌদ্দ বছরে পা রেখেছে রাশিদ। মিনিটে ষাটবার এপাশ–ওপাশ করে সোনালি রঙের ভারি পেন্ডুলাম। সেটার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে তার।

১৯৭১ সালের ক্যালেন্ডারটাও দুলছে। এপ্রিলেও কেউ একজন উল্টে দিয়েছিল পাতাটা। তারপর দুমাস হয়ে গেল, আর কেউ ওলটায়নি। ধুলো পড়ে গেছে এপ্রিল মাসে। এখন আর এসব ঘর গোছানোর দিকে নজর দেয় না কেউ। কেমন যেন মৃত বাড়ি হয়ে গেছে।

আসলে ঘরবাড়ি তো সব আম্মুজি গুছিয়ে রাখতেন। তিনি এখন কেমন মনমরা হয়ে বসে থাকেন সব সময়। আব্বুজিকে খুব ভয় পান তিনি। আগে আব্বুজি কখনো আম্মুজির গায়ে হাত তুলতেন না। ইদানীং প্রায়ই মারেন তাকে। কুৎসিত সব গালিগালাজ দেন। সেদিন তো আম্মুজিকে কানে ধরে ওঠবস করালেন। রুকিয়াকে দাঁড় করিয়ে দিলেন গোনার জন্য। এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে পৃথিবীতে!

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আম্মুজির কান ধরে ওঠবস করার চিত্র তার মাথায় একদম নেই। কোনো এক রহস্যময় কারণে দৃশ্যটি মুছে গেছে তার মাথা থেকে। শুধু একটি দৃশ্যই ভাসতে থাকে চোখের সামনে, ময়ূরের মতো ঝলমলে রঙের একটি শাড়ি লুটিয়ে আছে, আঁচল একবার নেমে আসছে মাটিতে, আবার টানটান হয়ে ঝুলে পড়ছে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজকালকার সন্ধ্যাগুলো কী যে নীরব হয়! মাসখানেক আগেও কী অন্য রকম এক পরিবেশ ছিল! রমরমা সব সন্ধ্যা ছিল। মাগরিবের আজান পর্যন্ত বন্ধুরা টানা আড্ডা দিত। খেলত। নামাজ শেষ করে সবাই একসাথে বাড়ির দিকে ফিরত।

পেন্ডুলামের ঘণ্টা বাজা শেষ হতেই পা টিপে টিপে গুদামঘরের দিকে এগোতে লাগল রাশিদ।


ভেতরে ঢুকে রাশিদ প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারল না। গাঢ় অন্ধকার। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল সোজা। খানিক বাদেই একটা গোঙানি ভেসে এল। গোঙানি শুনে রাশিদ নিশ্চিত হলো, যা ভেবেছিল তা–ই। সুবীরের বাবার কণ্ঠ। সকালে সুবীরের বাবাকেই দেখেছিল সে।


তিন

গুদামঘরের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাশিদ। এখানেই মা বিড়ালটা তার বাচ্চাদের নিয়ে খেলছিল। এখন বড্ড নীরব। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে একটানা। আশ্চর্যভাবে ঝিঁ ঝিঁর এই ডাক নীরবতাকে যেন আরও প্রগাঢ় করছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। ঠান্ডা বাতাসে কেমন শীত করতে থাকে রাশিদের।

আগে চাল–ডালের বস্তা রাখা হতো গুদামঘরে। এ ছাড়াও আব্বুজির অনেক কাজের জিনিসপত্র ছিল। এখন অবশ্য বাড়ির কাজে গুদামঘরের ব্যবহার কমে গেছে। চাল–ডাল ঘরেই রাখা হয়। গুদামঘর এখন ব্যবহৃত হয় আব্বুজির ‘বিশেষ’ কাজে। বিশেষ কাজ মানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে আনা। ধরে এনে নানাভাবে নির্যাতন করা হয় এখানে। ঠিক কীভাবে নির্যাতন করা হয়, রাশিদ জানে না। তবে প্রায়ই রক্ত হিম করা চিৎকার ভেসে আসে ভেতর থেকে। সে চিৎকারে রাশিদের কলজে পানি হয়ে আসে। চিৎকারের সাথে সাথে ভেসে আসে গালি, ‘মাদারচোত’, ‘বেহেনচোত’…

মাঝেমধ্যে আলুথালু চুলের নারীদের ধরে আনা হয়। তখন অদ্ভুত গোঙানি ভেসে আসে ভেতর থেকে। তখন শরীর গুলিয়ে আসে রাশিদের। তীব্র আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা অব্যাখ্যেয় শিরশিরানি টের পায় সে তখন।

গুদামঘর সম্পর্কে আম্মুজি জানলেও জানতে পারেন, কিন্তু তিনি এখন এসব বিষয়ে কিছু বলেন না। আব্বুজিকে তো তিনি অনেক ভয় পান। এড়িয়ে চলেন সব সময়। রুকিয়া বুবুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল রাশিদ, ভেতরে কী হয়। বুবু যেন মৃত মানুষের গলায় জবাব দিল, জানি না!

এসব নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও বারণ করে দিয়েছে বুবু। বারণ না করলেও অবশ্য রাশিদ বুঝে গেছে যে এসব চেপে যেতে হয়। রাশিদ বুঝতে পারে, কীভাবে কীভাবে যেন সে বড় হয়ে যাচ্ছে। এই ‘বড়’ হওয়াটাও বয়সে বা সুবীরের বড় খেলোয়াড় হওয়ার মতো কিছু নয়। এই বড়ও অন্য কিছু।

রাশিদদের কারও গুদামঘরের আশপাশেও যাওয়া বারণ। আব্বুজি বারণ করে দিয়েছেন। ফলে কিছুই আন্দাজ করতে পারে না সে। শুধু বুঝতে পারে, যাদেরই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ওখানে, কেউই জীবিত ফেরত যায় না। ভয়াবহ একেকটি রাত পার হয়ে সকালে সবার চিৎকার থেমে যায়। তারপর ধরাধরি করে আব্বুজির সঙ্গীরা তাদের কই যেন নিয়ে যায়। রাশিদ শুনেছে যে, গোমতি নদীতে ফেলে আসা হয় এদের।

সন্ধ্যার দিকে রাশিদ একবার ঘুরে এসেছে গুদামঘরের কাছ থেকে। সন্ধ্যার পরও দুবার এসে ঘুরে গেছে। প্রতিবারই দেখেছে, দুপাশে দুজন বয়সী ছেলে পাহারা দিচ্ছে। এদের একজনকে রাশিদ চেনে। তাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে আসত মাঝেমধ্যে।

গুদামঘরের দরজা বাইরে দিয়ে ছিটকিনি মারা শুধু। চতুর্থবার এসে রাশিদ দেখল, কেউ নেই পাহারায়। বোধ হয় রাতের খাবার খেতে গেছে। এই সময় কেউ থাকে না, রাশিদ খোঁজ নিয়েছে। বুবু বলেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে চলে আসবে। হয়তো আজও নতুন কাউকে নিয়ে আসবে। নইলে আগেরজনেরই চিৎকার শোনা যাবে শুধু সারা রাত ধরে।

ভেতরে ঢুকে রাশিদ প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারল না। গাঢ় অন্ধকার। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল সোজা। খানিক বাদেই একটা গোঙানি ভেসে এল। গোঙানি শুনে রাশিদ নিশ্চিত হলো, যা ভেবেছিল তা–ই। সুবীরের বাবার কণ্ঠ। সকালে সুবীরের বাবাকেই দেখেছিল সে।

চার

সেই যে সুবীরের বল লেগে আহত হয়েছিল একবার রাশিদ, তারপর সুবীর ওর বাবাকে নিয়ে এসেছিল স্কুলে। তাকে আগেও দেখেছে রাশিদ, কথা হয়নি শুধু। আব্বুজি সুবীরের বাবাকে হারাধনদা বলে ডাকত। রাশিদ ডাকত কাকা।

স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। রাশিদ বের হয়ে হাঁটছে বাসার দিকে। তখনো সামান্য পা টেনে টেনে হাঁটতে হচ্ছে। সুবীর এসে পথ আগলে দাঁড়ায় তার। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে।

হারাধন কাকাই কথা বললেন, কেমন আছ, রশিদ বাবু?

রাশিদ খেয়াল করল, সুবীরের চোখ ভেজা। তা দেখে রাশিদেরও চোখ ভিজে উঠছিল। সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল পানি আটকে রাখার। সামান্য মাথা নাড়ল শুধু, যেন এর উত্তর হয়—রাশিদ ভালো আছে।

সুবীরের বাবা বললেন, ব্যথা কমছে, বাবা?

রাশিদ মাথা নাড়ল আবার।

ময়লা, কোঁচকানো পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট কাগজের একটা প্যাকেট বের করলেন কাকা। নিজেই খুললেন প্যাকেটটা। সেখান থেকে বের হলো ছোট ছোট নারকেলের নাড়ু। রাশিদের হাতে দিয়ে কাকা বললেন, সুবীরের মা পাঠাইছে। খাও। আর সুবীররে ভুল বুইঝ না, বাবা। ও খুব কান্নাকাটি করছে আমার সাথে। ইচ্ছা করে তোমার গায়ে বল মারেনি ও।

রাশিদ আবার তাকায় সুবীরের দিকে। সুবীর মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বেয়ে পানি নেমে তার গাল ভিজিয়ে দিয়েছে।

তারপর থেকে সুবীর আর রাশিদ খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়।

পাঁচ

গুদামঘরের অন্ধকার এখনো চোখে সয়ে আসেনি। কাকার মাথায় তার ডান হাত রাখল রাশিদ। ফিসফিস করে বলল, কেমন আছেন, কাকা?

হারাধন কাকা জবাব দিলেন না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে রাশিদের মনে হলো, কাকা মাথা নেড়েছেন, যেন ভালো আছেন। ঠিক সেদিনের মতোই।

রাশিদ টের পেল, কাকাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। দ্রুত হাত চালাচ্ছে সে। বাঁধনগুলো খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতেই ফিসফিস করল আবার, সুবীর কোথায়, কাকা?

হারাধন কাকার গলা শোনা গেল, ওরা ইন্ডিয়ায়।

আমার সাথে একবার দেখাও করে গেল না! রাশিদ একবুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

জবাবে কাকা কী যেন বললেন, ঠিক বোঝা গেল না।

এর মধ্যে দুইটা গিঁট খুলে ফেলেছে রাশিদ। এখন উবু হয়ে বসে পায়ের দিকের দড়ি খুলতে মনোযোগী হলো সে।

খুব বেশি সময় লাগল না দড়ি খুলতে। দুজনই বের হয়ে এল পা টিপে টিপে। বের হতেই রাশিদ বলল, কাকা ছুট দেন।


নুয়ে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে ছুটে আসছে সুবীর। ওই তো বল করছে। আগুনের গোলার মতো ছুটে আসছে বল। ঠিক পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেল সেটা। আম্পায়ার দুহাত প্রসারিত করলেন, ওয়াইড।


হারাধন কাকা যেন শুনতেই পেলেন না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন রাশিদকে। কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা দুর্বোধ্য ভাষায় বললেন, জানো, সুবীর খালি তোমার কথা বলে। ইন্ডিয়া পালানোর সময় খাল পার হইতে গিয়া একটা বাচ্চা পানিতে ডুইবা মারা যাইতেছিল। শুধু পিঠের ব্যাগটা ভাসছে আর ডুবছে। তাই দেইখা সুবীর ঝাঁপ দিল সেদিকে। আমরা কেউ খেয়াল করি নাই। সুবীরটাই দেখল। সে জান বাজি রাইখা কেমনে কেমনে গিয়া বাচ্চাটারে বাঁচাইল। আমি একবার শুধু বলছিলাম, যদি তোর কিছু হইত সুবীর? আমারে ডাক দিলি না কেন?…জানো বাবা, আসলে তখন কেউই আওয়াজ করতে সাহস পাইতেছিলাম না সেই দিন। সুবীর আমার কানে কানে শুধু বলছিল, বাচ্চাটারে দেইখা তার মনে হইছিল যেন ওই বাচ্চাটা তুমি। আমি দেশে আসার সময় আমার কাছে একটা ভালো বল পাঠায়া দিছিল তোমারে দেওয়ার জন্য। বলটা আমি হারায়া ফেলছি, বাবা। আমারে মাফ কইরা দিয়ো।

রাশিদ জোর করে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। ফিসফিস করে তাড়া দেয়, দৌড়। জোরে দৌড়ান, কাকা।

তারপর শুকনো বাঁশপাতা ভাঙার আওয়াজ শোনা যায় শুধু। কাকা ছুটছেন। রাশিদ শুধু আবছা একটা ছুটন্ত ছায়া দেখতে পাচ্ছিল।

হঠাৎ কার যেন গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে, কৌন? কৌন হ্যায় ওয়াহা?

তারপরই বিকট একটা শব্দ শোনা গেল। খুব কাছেই কোথাও থেকে একটি গুলি এসে বিঁধল রাশিদের বুকে। যেখানে হাত রাখলে হাত কেঁপে ওঠে তার। সে ছিটকে গিয়ে পড়ল গুদামঘরের আধবোজা দরজায়। ধড়াম করে শব্দ হলো একটা।

সেই যে, এক বলে আর ছয় রান লাগে, রাশিদ ব্যাটিংয়ে, বল করছে সুবীর। রাশিদের পা কাঁপছে, বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছিল সুবীরের বলটা যেন এসে ঠিক সেই বিশেষ জায়গায় লাগবে। তারপর এক সপ্তাহ সে আর হাঁটতে পারবে না। কিংবা এমনও হতে পারে যে সে মরেই যাবে।

নুয়ে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে ছুটে আসছে সুবীর। ওই তো বল করছে। আগুনের গোলার মতো ছুটে আসছে বল। ঠিক পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেল সেটা। আম্পায়ার দুহাত প্রসারিত করলেন, ওয়াইড।

একে একে ছয়টি বলই ওয়াইড দিল সুবীর। কিছু না করেও, স্রেফ ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিতে গেল রাশিদরা। শুধু রাশিদরা না, অন্যরাও বুঝতে পারল, সুবীর ইচ্ছা করে জিতিয়ে দিয়েছে তাদের। সব ছাপিয়ে রাশিদ শুধু দেখতে পেল ওই দলের সবাই তেড়েফুড়ে ছুটছে সুবীরের দিকে। দৃশ্যটা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ছে রাশিদের।

সবকিছু আরও অন্ধকার হয়ে যেতে যেতে রাশিদ শুনতে পেল, তার ঘর থেকে দাদার দেওয়া পেন্ডুলাম ঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজছে।

রাশিদের ভয় হয়, বুকের ফুটোটা দিয়ে হৃদপিণ্ড এবার না সত্যি সত্যি বের হয়ে আসে। সে জোরে ফুটো চেপে ধরে পড়ে থাকে।

আপনার মতামত জানান

রাসেল রায়হান

রাসেল রায়হান; কবি ও কথাসাহিত্যিক। ১৯৮৮ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম । পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কবিতার বই তিনটি। সুখী ধনুর্বিদ, প্রকাশক : প্লাটফর্ম; বিব্রত ময়ূর : প্রকাশক, প্রথমা; তৃতীয় অশ্বারোহী, প্রকাশক : জেব্রাক্রসিং। প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘একচক্ষু হরিণীরা’, প্রকাশক : দাঁড়িকমা। বিব্রত ময়ূর পাণ্ডুলিপির জন্য মার্কিন গবেষক অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ও প্রথমা প্রকাশনের যৌথ উদ্যোগে প্রবর্তিত ‘জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৫’ অর্জন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।