সন্ধ্যার আলো যখন ফুটে উঠলো, রাতে হারিয়ে যাবার আগে, দিনের আলোকে ছেঁকে যেটুকু রস, ওই যে সন্ধ্যাবেলার, সেটুকু পান করতে করতেই দেহমন চাঙ্গা হয়ে উঠল। কার আবার? আমার। গল্প বলছি না, তামাশা করছি। তামাশাই তো, নইলে এমন কথা কেউ বলে যে সন্ধ্যাবেলার আলো হতে রস বের করে খেয়েদেয়ে চনমনে খোশগল্প করা! খুলে বলি, বলবার জন্যই তো তামাশাটা করছি। তোমরা এ তামাশায় যুক্ত হলে ভাল, নইলে অন্য কেউ তো আছেই। এই যেমন ধরো রাতচরা পাখিদের পিঠে ভর করে আসবে কিছু প্রেতাত্মা এবং তাদের জামাই। মানে মেয়ের জামাই, নাতজামাই, পাশের বাড়ির পেত্মীর জামাই, দুঃসম্পর্কের কাজের বেটির জামাই। তো, এনারা মানে প্রেতাত্মারা জামাই ছাড়া তাদের কোথাও যাওয়া হয় না। জীবনভর তারা নিজেরা জামাই হতে পারেননি বটে কিন্তু প্রেতলোকে জামাই ধরে ধরে এনে আদরযত্ন করে আর খাওয়ায়। কী খাওয়ায়? এ জন্যই তো আমার কাছে আসছে এরা এ ভরসন্ধ্যাবেলায়, আমি যা খাই মানে সন্ধ্যার রসপান করি ঠিক তা নয়, গল্প খায় এরা। রাত গভীর হলে আমার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। আমিও ঘুমাই।
হয়েছে তোমার গল্প খাওয়া। নিনা তার বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তুমি যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বল এসব শুনেই মা বোধহয় তোমার প্রেমে পড়েছিল।
তোমার মা আমার গল্পের ক্যারেক্টার। ওটা প্রেম নয় অস্তিত্ব সংকটের টান।
আচ্ছা তোমার কি আমাদের ছোট মনে হয় সেই আগের মতই? আমরা তো বড় হয়েছি। নিবিড়ও দেখো তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর গোঁফ গজিয়েছে, কলেজে যায়। আমিতো রাজি হলে কালই আমায় বিয়ে দিয়ে দেবে। ছোট তো আর নই। এখনো তুমি আমাদের গল্প শোনাও আগের মতই। আর তোমার ক্যারেক্টার হিসেবে মাও কিন্তু আর নেই।
না না, সে আছে। তোমরা দেখতে পাচ্ছো না।
কোথায়? আমার তো মনে হয় তুমি বরং মায়ের ক্যারেক্টারে পরিণত হয়েছো। মা কেবল গল্পটা বলতে জানে না কিন্তু নীরবে সেই তোমাকে নাড়ায়।
নিনার বাবা বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, আসলেই সে বড় হয়ে গেছে! থেমে যায় তার চোখ মেয়ের মুখের দিকে। কথা বলতে পারে না। একসময় চোখ চলে যায় দেয়ালে, যেখানে ঝুলছে নিনার মায়ের বাঁধাই করা ছবিটা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। কতকাল ধরে এ মহিলার সঙ্গে সংসার করছে তা মনে নেই কিন্তু কোথায় যে একটা বেদনা জেগে উঠলো, নিনার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার মা তো নেই।’
পাশের ঘর থেকে ভদ্রমহিলা, মানে নিনার মা, বাজার থেকে ফিরে এসেই এসব তামাশার আলাপচারিতা শুনতে পায়; বললেন, ‘নিনা, তোমার বাবাকে বলো গোসল করতে যেতে, গিজার ছাড়া আছে, নইলে গরম পানিতেই চেপে ধরবো।
নিবিড় হাসতে হাসতে দাঁত মাজতে লাগলো। সে সন্ধ্যেবেলায় দাঁত মাজে। বিকেলে ঘুমায়। সকালেও মাজে কিন্তু সেটা দাঁত-পেস্ট-ব্রাশ ঠিকমত সঙ্গৎ হয় না। নিনা ভাইয়ের গা হতে গামছাটা বাবাকে দিয়ে বলে, ‘ যাওতো, মা যে আছে এবার নিশ্চিত হলে? গোসল সেরে আসো, আমরা বাইরে যাবো।’
আখতার সাহেব, মানে গল্পকার, মেয়ের কথায় ঠিকই গেলেন গোসলখানায়। রাতে গোসল না করলে তার ভাল ঘুম হয় না, কেবল জেগে জেগে গল্প বলেন। আর আখতার সাহেবের ক্যারেক্টার, মানে নিনার মা, কিংবা আখতার সাহেব যার ক্যারেক্টার এখন, ফারজানা আপা, তিনি স্কুলশিক্ষক। মাঝে মাঝে স্বামীকে ধরে পেটান, আখতার সাহেব পেটাতে দেন বলেই।
আখতার সাহেব, মানে গল্পকার, মেয়ের কথায় ঠিকই গেলেন গোসলখানায়। রাতে গোসল না করলে তার ভাল ঘুম হয় না, কেবল জেগে জেগে গল্প বলেন। আর আখতার সাহেবের ক্যারেক্টার, মানে নিনার মা, কিংবা আখতার সাহেব যার ক্যারেক্টার এখন, ফারজানা আপা, তিনি স্কুলশিক্ষক। মাঝে মাঝে স্বামীকে ধরে পেটান, আখতার সাহেব পেটাতে দেন বলেই। কারণ, তিনি একবার তার শ্যালিকা বিথিকে বলেছিলেন, ‘তোমার বোনকে আমি মাঝে মাঝে পেটাতে দেই, কারণ আমার তখন মায়ের কথা মনে পড়ে। মা আমার, একদিন পেটাতে পেটাতে মরে গেল। তখন বয়স দশ। তোমার বোন ঠিক আমার মায়ের মতই।’
বিথি নিনার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বিয়ে করেছে। আখতার সাহেবই ছেলে দেখে দিয়েছেন। সে ছেলে, মানে বিথির বর, আখতার সাহেবের ভক্ত। তার গল্পের। এসব গল্প বিথির বর, মানে তমাল সাহেব, ছেপেটেপে বই করেছে আট-দশখানা। একটি বইয়ের নাম ‘চোখের মণির ঝাড়ু’। চোখের মণির যে ঝাড়ু হয় সেটা গল্পটা না পড়লে বোঝা যাবে না। বিথি গল্পটা পড়েছে, খুব মজা পেয়েছে। গল্পটা আসলে রূপকথার সে ডাইনি ও তার ঝাড়ুর কথা, যে ঝাড়ুর গোড়ায় বসে দিগন্ত হতে দিগন্তে উড়ে বেড়ায়। তো, একদিন নাকি সে ডাইনি ঝাড়ুসমেত উড়ে এসে আখতার সাহেবের বাঁ চোখের মণিতে ঢুকে পড়ে। এবং তারপর থেকেই তিনি তাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন সেখানে, মাঝে মাঝে ডাইনিকে বেরুতে দেন। মানে, ইয়োরোপ মুলুকে যখন ডাইনি হতচ্ছারীদের ধরে ধরে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল, তখনকার কথা। সে তখন পালিয়ে এ বাঙ্গালমুলুকে আখতার সাহেবকেই খুঁজে পায়। কারণ, তার মত এত বড় চোখ ও মণি আর কারো দেখতে পায় নি। সে মণিতে নাকি আশ্চর্য সব গল্পেরা ঘুরে বেড়ায়।
তো, এসব কথা বিথির সাথে আখতার সাহেব বলেন, আর বিথির বর তা ছাপে। নিনা ও তার ভাই নিবিড় পড়ে আর পেছন থেকে তাদের মা, মানে ফারজানা আপা আলাপ ও বিস্তারের ভেতর তবলার ধমক না দিলে জমেই না।
এই হলো আখতার সাহেবের পরিবারিক কেচ্ছা। যদিও আখতার সাহেব নিজে কখনো কেচ্ছা বলেন না, তিনি বলেন তামাশা। তো, তিনি যে গোসলে গেলেন সে কখন, ঘণ্টাখানেক পর নিনার মায়ের মনে পড়লো। দরজা নক করে আখতার সাহেবকে বের করতে না পেরে নিবিড়কে ডাকলেন।
নিবিড় তার মায়ের হাত ধরে টেনে আনে। বলে, বাবা বোধহয় আরেকটি তামাশা ফাঁদছে। একটু পরই বের হয়ে যাবে।
কিন্তু আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন তিনি বের হলেন না তখন নিবিড় নিজেই দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিনার মা ভয় পেয়ে গেলেন। কেঁদে উঠলেন ফারজানা আপা, ছেলেকে ঠেলে নিজেই দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। এখন কী হবে, যদি কিছু হয়ে যায় ওর?
হুট করেই বের হয়ে এলেন আখতার সাহেব। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, নিনার মা ইচ্ছেমত পেটাতে শুরু করলেন। আখতার সাহেব মার খেতে খেতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন। মিসেস ফারজানা আপার রাগ একটুও কমলো না, পিটিয়েই চলছেন তার স্বামীকে। কী দিয়ে? হাতের মুঠো দিয়ে, কনুই দিয়ে, নখের খামচি দিয়ে, চড় দিয়ে, ঘুঁষি দিয়ে, গুঁতো দিয়ে—একসময় আখতার সাহেবের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে।
না এটাই আসল আঘাত, যা প্রতিটি স্বামীসোহাগী নারীরা দিতে চান, কিন্তু আখতার সাহেবের মত তামাশাবাজ স্বামীর অভাবে তারা অবদমিতই রয়ে যান।
নিনা এতক্ষণে চলে এসেছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তুমিও দেখি বাবার মতই আমাদের ছোট ভাবছো। আমরা তো বড় হয়েছি নাকি? এখনো এসব করতে তোমাদের লজ্জা পায় না!’
আখতার সাহেবের বুকখানি ঢের বড়, কেবল চোখই নয়। নিনা ও তার ভাই নিবিড়ও সে বুকে মুখ গুঁজে মায়ের সাথে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। রাত গভীর হয়ে যায়, রাতচরা পাখিরা একটু পরই উড়ে আসবে এক এক করে। তাদের পিঠে কত নাম না জানা চরিত্ররা আর তাদের আহ্লাদের জামাইবাবুরা। সব এসে জড়ো হবে এখানে, তবুও আখতার সাহেবের বুক খালি পড়ে রইবে। যার চোখের মণি বড়, দৃষ্টি যার দূরদিগন্তে মেশে, তার বুক যে কত বিশাল, সেখানে আস্ত এক দুনিয়াই গুঁজে দেয়া যায়; তারা নিবিড় এক আনোখা তামাশাময় গল্পের চরিত্র হতে হতেই ঘুমিয়ে পড়ে রোজকার মত।