কথাসাহিত্যগল্প

নালজমি

এসব অভিযোগ পাত্তা পায় না। হারিয়ে যায় বাতাসের অশ্লিল স্রোতে। সে স্রোত বড় নিষ্টুর হয়ে, ভয়ঙ্কর হয়ে আঁচড়ে পড়েছিল, ফটিক আর তার সঙ্গীতের উপর। সবাই আক্রান্ত হলেও, ফটিকের প্রাণ পাখিটা উড়ে গেছে। উড়ে, উড়ে, ডুবে, ডুবে হারিয়েছে হাওয়ার মসনদ।

এই যে আগের দিন বৃষ্টি হলো। সে বৃষ্টির ছাট যেমন আজ সকাল থেকে নেই। ঠিক তেমনি নাদিয়ার চেহারায় নেই আগের রাতে বয়ে যাওয়া ঝড়, শরীরের খানাখন্দে অযাচিত দখলযুদ্ধচিহ্নও। ধোয়ে মুছে শরীরটাকে ছাপ-ছুতরো করা গেল বৃষ্টির জলে। আচ্ছা হৃদয়টা কি হলো—পরিস্কার, ছাপ-ছুতরো? দক্ষিণ পাশের জানালার রড ধরে একটা হালকা হাওয়ার রেখা বয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক তার পাশের আতা ফলের গাছ থেকে ঝরছে পাতা, বৃষ্টির জল, বিলাপও। ছোট বেলার মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। অদম্য সত্য, তুলনাহীন কোমলতা। কালিমা-কলঙ্ক, ক্ষুধা, ড্রিপিং, ড্রিপিং, ড্রিপিং…।

দূরে হলুদ ক্ষেত। সরিষার বাগান। মাঠঘাট যেন রঙিন। রঙের বাহারের সঙ্গে নানা সুবাস এখানকার বাতাসেও। ব্যস্ত চাষি-শ্রমিকেরা। মাঠ রাঙাচ্ছেন তারা। এসব দেখছে নাদিয়া। তার মন রাঙাতে পারা যাচ্ছে এসবে? না, হয়ত না। হালকা হাওয়ার যে রেখা বয়ে যাচ্ছে তার মতোই এক বিষাদ মাখা স্রোত নাদিয়ার শিরায় শিরায়।

সম্পর্কিত

আজ ফটিক মিয়াকে মনে পড়ছে নাদিয়ার। চিৎকার করে ডাকবে এমন সুযোগও নেই। তবু মনে পড়ছে। তবু ডাকছে। বেসুরে। আস্তে আস্তে। ভেতরে, ভেতরে, বুক ফাটছে। আগুনের হল্কা বের হচ্ছে তার বুক থেকে। বুঝে, বের হয়ে গেছে পাখি, নদীর পথে।

এবার যেন সেই হল্কা কিংবা ডাকার ইচ্ছা, কোনো কিছুই আর স্থায়ী হলো না। ফুড়–ৎ করে জানালায় বসা চঁড়–ইটি উড়ে যাওয়ার মতো-উড়ে গেল। শুধু নাদিয়া নয় এ গ্রামের অনেকেরই কাঁচা মিয়াকে দেখলে এমন হয়। কিম্ভুতকিমাকার। লম্বা-কালো আর টেলিভিশনে দেখা রেসলার রিকিশির মতো গড়ন। একটু ধাতস্ত হতে হয়, ভাবতে হয়, এ কে? মানুষ? চেহারাটা কাঁচা মিয়ার এমনই। ভাবায়। হলুদ শরিষা বাগানের আলপথ ধরে এগুচ্ছে সে, নাদিয়ার দিকে, নাদিয়ার বাড়ির দিকে। মুরাদপুর মানেই কাঁচা মিয়া-ছানা মিয়াদের রাজত্ব। নারী, জমি, আলপথ, রাজপথ সবই যেন গ্রাস করে নিতে চায় তারা দুই ভাই। খালপাড় ও তুরুকভাগসহ আরও দুএকটি গ্রামের মানুষও হন্তদন্ত ছুটছেন, খুঁজছেন জমি, সড়ক, নারী ও ফসল বাঁচানোর পথ। তবু কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। ভয়ে আড়ষ্ট, ভয়ে নির্বাক।

নাদিয়ার শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। ঘিন ঘিন। গতরাত, অন্ধকার, বাংলা মদের গন্ধ। নাদিয়ার শরীর সাপের মতো বাক নিচ্ছে, বমিবমি, অন্ধকার-আধাঁর…।

‘নাদিয়া দরজা খুল’- সে রাতে কাঁচা মিয়ার গর্জন। ঠিক গর্জন নয়, গর্জনের মতো করে ডাক। এ গর্জনে বা ডাকে ভয় পায় না নাদিয়া। গত এক বছর ধরেই এ গর্জন সে শুনে আসছে। শুরুটা ফটিকের মৃত্যুর দুই মাসের মাথায়।

খালপাড়ের বাপ-দাদার ফসলি জমি, বাড়ির নিজস্ব রাস্তা, বসত ভিটার আশ-পাশের জমির সঙ্গে যেন জন্ম বিরোধ ছানা-কাঁচা মিয়াদের ইট ভাটার। এ ইট ভাটার যাত্রাকাল থেকেই এ এলাকায় মাটির দখল নিয়ে শুরু হয় টানাটানি। মুরাদপুর, খালপাড়, তুরুকভাগসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের নাল জমিই যেন ছানা-কাঁচা মিয়াদের বাপ-দাদার সম্পদ।


নদী ও হাওর পাড়ে ঘর ভাঙনের সুর নতুন নয়, তবু জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া, চলাচলের রাস্তা কেটে ফেলা এবং গহীন গর্ত তৈরি করা অসহায় মানুষের ঘরবাড়ি আরও বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ সে মাটি লালচে আগুনে পুড়ে ইট, দালান, অট্টালিকা হচ্ছে। ফটিকদের খালি একটুকরো জমিই যাচ্ছে, কয়েকদলা মাটিউ যাচ্ছে-এমনটাই যেন ভাব সরকারি কর্তাদের। কাঁচা মিয়ার দাপটের কারণে কেউ মুখ না খুললেও ফটিক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বিপরিতে।


নাদিয়া জানে, নজরুল তাকে বলেছিল, ‘কাচা মিয়ার বিপক্ষে মাতে না খেউ, মাততে চায়ও না। ইতা লইয়া মাতলে রাইতকুর আন্দাইরো হয় ঘর জ্বালাইব নায় বউ তুইল্লা নিবগি-ওলা অইত্যাছার করে।’- নজরুলের এমন অভিযোগ সত্য, সেটাও জানে নাদিয়া। পারুলের কথা মনে আছে তার। সে গল্প বিয়ের কয়েক মাস পরেই শুনেছিল। তার বাসুরের বউ, নাল জমিতে এস্কভেটরের আঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করেছিল তার বাসুর শফিক। সেদিনই পারুলকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কাঁচা মিয়া। এরপর আর খোঁজ মিলেনি শফিক ও পারুলের।

পরের বাপ-দাদার জমিতে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে সেই জমির ফসলে মিশে থাকা রোদ-মেঘকে নিজের নামে লেখিয়ে নেওয়াই কাঁচা মিয়াদের কাজ। নিয়েছেও অনেক। নিঃস্ব নয় কেউই, তবু তাদের দাপটে সর্বহারা হতে হয়েছে একেকজনকে। দাসত্ব মেনে নিতে হয়, জমির হিস্যা কিংবা ফসলের হিস্যাতেও কামড় পড়ে কাঁচা মিয়ার। এসব বিরোধ। বিরোধ-বিরোধ খেলা…। রক্ত, জীবন ও মৃত্যু হাওয়ায় ভাসে এখানে। এমন এক বিরোধেই গত বছর ফটিক মিয়ার মৃত্যু হয়েছিল। রাতের আঁধারে। কাঁচা মিয়ারা সেদিন বর্বরের মতো ঝাপিয়ে পড়েছিল। খানখান হয়েছিল ফটিকের শরীর, আর নাদিয়া সেদিন থেকেই হারিয়েছে পথ।

নদী ও হাওর পাড়ে ঘর ভাঙনের সুর নতুন নয়, তবু জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া, চলাচলের রাস্তা কেটে ফেলা এবং গহীন গর্ত তৈরি করা অসহায় মানুষের ঘরবাড়ি আরও বেশি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ সে মাটি লালচে আগুনে পুড়ে ইট, দালান, অট্টালিকা হচ্ছে। ফটিকদের খালি একটুকরো জমিই যাচ্ছে, কয়েকদলা মাটিউ যাচ্ছে-এমনটাই যেন ভাব সরকারি কর্তাদের। কাঁচা মিয়ার দাপটের কারণে কেউ মুখ না খুললেও ফটিক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বিপরিতে।

নালজমির এসন ভাঘ্যবিড়ম্বনা মেনে নিতে পারেনি ফটিক। তাইতো দাঁড়িয়েছিল, বুকচেতিয়ে, আঙুল তুলেছিল আইফেল টওয়ারের মতো-শক্ত-টানটচান মেরুদন্ড ছিল তার। তারপর অভিযোগ দেয় বড় কর্তাদের কাছে। থানার ওসি, উপজেলার বড় কর্তা, ভূমির কর্তা সবার ঘরে অভিযোগ নিয়ে যায়। আঙুল তুলে। সে দিন তার সঙ্গে ছিলেন মো. লাল মিয়া, দুদু মিয়া, মনজুর হোসেন, আজির আলী, উছমান মেম্বার, কিবরিয়া, টেনু মিয়াসহ অনেকে। সাহস বাড়ে। জেলার কর্তার কাছেও অভিযোগ নিয়ে যায়। প্রভাব, অর্থের আর ক্ষমতার। এসব অভিযোগ পাত্তা পায় না। হারিয়ে যায় বাতাসের অশ্লিল স্রোতে। সে স্রোত বড় নিষ্টুর হয়ে, ভয়ঙ্কর হয়ে আঁচড়ে পড়েছিল, ফটিক আর তার সঙ্গীতের উপর। সবাই আক্রান্ত হলেও, ফটিকের প্রাণ পাখিটা উড়ে গেছে। উড়ে, উড়ে, ডুবে, ডুবে হারিয়েছে হাওয়ার মসনদ।

স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ ফসলি জমিটা যেন আর অন্যের দখলে না যায়, যেন বুক থেকে মাটি কেঁটে নিয়ে না যায় কেউ, সেই চেষ্টাই করেছিল নাদিয়া। আর তাই সব জেনেও এমন টানটান, জলাধারে শিক্ত নারীর শরীর নিয়েই যেতে হলো কাঁচা মিয়ার সামনে। যেতে হলো! আর কোনো উপায়ও ছিল না তার। যে জমিটুকু ছিল, সেই জমির ফসল দিয়েই নাদিয়ার পেঠ চালাতে হতো। আর কোনো পথও খোলা নেই। শেষ পর্যন্ত তাকেই দাঁড়াতে হলো তারই চিরশত্রুর সামনে। নাল জমির মাটি বাঁচাতে নিজের একান্ত উর্বর জমি। খুব বেশি চাষবাস হয়নি যেখানে। সেই জমিটাই বন্দক দিতে হয়েছিল। বিনা শর্তে।

শর্তহীনভাবে এ জমিতে যেদিন চাষবাস শুরু করেছিল চাঁন মিয়া সেদিন থেকেই নাদিয়া অনুভব করে ভেতরে ভেতরে ক্রন্দন, বিলাপ ও বিদ্রোপের স্রোত। ছোট বেলার মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। অদম্য সত্য, তুলনাহীন কোমলতা। কালিমা-কলঙ্ক, ড্রিপিং, ড্রিপিং, ড্রিপিং…। আবারও ফটিক মিয়াকে মনে পড়ছে নাদিয়ার। মনে পড়ছে, ডাকছে, বেসুরে, আস্তে আস্তে, ভেতরে, ভেতরে, বুক ফাটছে।

আপনার মতামত জানান

বেলাল আহমেদ

বেলাল আহমেদ; কবি, গল্পকার ও আলোকচিত্রী। জন্ম ১৯৮৩ সালের ৫ জুলাই সিলেটের বিশ্বনাথে। পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক সিলেট মিররে কর্মরত। প্রকাশিত বই- ‘স্বপ্নভোক শালিক’ (২০০৭) , ‘উফাক’ (২০০৯)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।