কথাসাহিত্যগল্প

নাইয়র

মন্নান মিয়া ট্রলারের কাজ তদারকি করছে। চলতি সপ্তাহে ট্রলারের ছাউনি হয়ে যাবে। নিখুঁত যত্নে  বাঁশ ছিলে চাটাই বোনা হচ্ছে। তারপর শুধু রঙ করা বাকি। খুশিতে চোখেমুখে তার চাঁদসুরুজ ফোটে,-মেয়ের মুখ দেখবে অল্পদিনের তফাত। দাওয়াতি ঠিক করে ফেলেছে কে কে নাইয়র আনতে যাবে। নতুন ফতুয়ার মাপ দিয়েছে সে।

চুলা থেকে পোড়ামাটির চলতে তুলে বিস্কুটের মতো আলতো খেয়ে নিচ্ছে সায়েরা। চৈত্রের কাকতিয়াশি রোদে বিলের তলা শুকনো কাদা, আতপচালের কাইয়ের মতো ধবধব করে। সেই কাদামাটি দিয়ে বানানো হাউশের  চুলা৷ অদ্ভুত স্বাদের চুলার মাটি, না টক, না মিঠা, না তিতা। সায়েরা ছোট্ট এক চিলতে মাটি নিয়ে পাখির ঠোঁটে ছোট্ট একটা কামড় দেয়, মনে হয় যেনো অমৃত খাচ্ছে।সায়েরার হাফপ্যান্ট বয়েসে চুলার মাটি খেতো সায়েরার মা।বিষ্ময়ে সায়েরা  বলবো ‘ গিদরের ঝি, চুলার মাটি খায়, বাপ-মা গাওয়াইয়া পয়দা করে নাই’। সায়েরার মা সলজ্জ হেসে বলতো, ‘তোর বাপের ভাত বাঁচাই। ‘

ভাতের গন্ধ নিতে পারে না  সায়েরা,কিন্তু কাঁচা চাল চিবোতে ভালো লাগে। কত কিছু খেতে মন চায় তার,- তেতুল চাটনি, সিংগাড়া, পাঁপড়ভাজা, আমের আঁচার, ডালের বড়া, বিস্কুট। মুখ ফুটে সব বলতে পারে না,ভয়-লজ্জায় খায়েশগুলো ঢোকাগিলে সামাল দেয়। শ্বাশুড়ির কাছে সব কিছু বলা যায় না।স্বামী যে লুকিয়ে এনে কিছু দিবে, তারো সুযোগ নেই। শিশুদের মতো চোখভুখা হয়ে যাচ্ছে সে, নানান জিনিস খেতে মন চায়, কিন্তু কাছে পেলে অনেকেকিছুর গন্ধই নিতে পারে না।

সম্পর্কিত

এক বছর হতে চললো, নাইয়র যেতে পারছে না সায়েরা। বাবা-মা, ছোটো ভাই, – কারো মুখ দেখেতে পায়নি। সায়েরার শ্বশুর গোস্বা করে নাইয়র দেয় না। সায়েরার বাবা বেশ কয়েকবার লোক পাঠিয়ে তদবির করেছে, কাজ হয়নি৷

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দূর হাওরে তাকালে ক্রমশ ফুটে ওঠে পালতোলা নৌকা কিংবা ছোটো ট্রলার। সায়েরার বুক টিপটিপ করে,- এই বুঝি বাপের বাড়ি থেকে সমন এলো।সায়েরা আশায় বুক বাঁধে,এই বুঝি তার ‘আব্বা’ এসে ডাক দিবে, ‘কইগো, আমার আম্মাডা কই’।বাবার হাতে থাকবে অপ্রত্যাশিত রহস্যের পোটলা৷ বাতাশা, মুড়ালি, জিলাপি, লাড্ডু, জামমিষ্টি, চানাচুর, মনাক্কা আরো কতো বিচিত্র চিজ থাকবে পোটলায়!

গাঁয়ের মানুষ যায় ধর্মপাশার হাঁটে। সায়েরা খবর  পাঠায়  হাঁটে বাপের বাড়ির কাউকে পেলে নাইয়র নিতে বলে যেনো৷ হাঁটবারে সায়েরা চড়ুইচঞ্চল হয়ে ওঠে বাপের বাড়ির খবর পায় কিনা। জিন্নত চাচা এসে শ্বশুর-শাশুড়িকে আড়াল করে ডাকে হঠাত হঠাত।

— কই গো বাটপারের বেডি, আজকে তুমার বাপেরে দেখলাম বাজারে বেডারা বাইন্ধা কিলাইতাছে।

চিন্নত আলির রসিকতায় খইফোটা খুশিরে টগবগ করে উঠলো সায়েরা।

— আব্বারে কিমুন দেখলেন কাহা? শইলডা বালানি আব্বার?

— বালা আছে বেডি, তোমার বাপে গরু মরিচ আনছিল বেচনের লাইগা, তোমার লাগি মুরালি আর চানাচুর কিইন্যা দিছে৷

— আমার কথা কি জিগাইছে? নাইয়র নিতে আইবো? কইছে কিছু কাহা? সাতফুল লইয়া আইবো না?

— সামনের মাসে কয়ডা গরু বেচবো, ট্রলারের কাম ধরছে, কাঠ কিনছে রিপসার বাজার থাইকা। মালসামান বানানো অইলে সামনের মাসেই বাজার সদাই কইরা তুমারে নাইয়র নিতে আইবো।কান্দনের কিছু নাই বেডি৷

— বাড়ির সবে বালা আছে কাহা? জিগাইছেন?

— হ বেডি বালা-ই আছে। তোমার ভাইডা বাক্কা ডাঙর অইছে।

মুড়ালির পোটলা ভিজে যায় সায়েরার চোখের জলে। আষাঢ়ি বাদলের মতো  টপটপ পানি পড়তেই থাকে সায়েরার, যেনো এক আকাশ মেঘ জমে আছে বুকে। ছোট ভাইটার মুখ ভেসে ওঠে। সারাদিন টইটই রোদে ঘুরে মুখটা শুকনো করে তাড়া দেয় দিতো, ‘ বুবু ভাত দে তারাতারি, গাংগে আজকে চোঙা পাতমু, তারাবাইম লাগবো, তারাতারি কর। ‘

সায়েরার বাবা কথা দিয়েছিল জামাইকে চল্লিশ সওয়ারির একটা ট্রলার দিবে। জামাইপক্ষ বউকে দেবে গলার হাড়, বালা, নাকফুল, কানফুল। জামাইপক্ষ বউ সাজিয়ে আনলো ঠিকই, কিন্তু সায়েরার বাবা অকাল বন্যায়  ফসল তুলতে না পারায় ট্রলার দিতে পারলো না। সায়েরার শ্বশুর কথা  হলো, ‘ কথাবার্তার ঠিক নাই, এমুন মাইনষের লগে কুটুম নাই। হাওর মনে অয় তেনার একলারই ডুবছে, আমরার ডুবে নাই।এ জামানায় কোন বেডা তিন ভরি সুনা দিয়া বউ সাজায়া আনে? দেখাও আমারে। থাক আমার পুতের বউ আমার বাড়িত।  মিছাখুর মাইনষের বাড়িত বউ নাইয়র দিতাম না ‘।

সাত মাস চলছে সায়েরার, শরীরটা ভারি হয়ে আসছে দিন দিন। হাওরে চাতকচোখে দৃষ্টি ফেলে রাখে, নাইয়রের নৌকা বুঝি আসে। সাত মাসের পোয়াতির জন্য ‘বাপেরবাড়ি’ থেকে আম-কাঠাল, পিঠা, উপহার সামগ্রী বড় বাঁশের ঝুড়িতে সাজিয়ে আনে  নাইয়র নিতে৷ সায়েরার তার ‘সাতফুল’ নাইয়রের ঝুড়ি কল্পনা করে। সাতফুল নিয়ে আসবে- চাচি, আম্মা, ছোট ভাই, আব্বা, বুবু, জেঠা-জেঠি।সাতফুলের ঝুড়ি দেখে পরশিরা বলবে, ‘মাইগ্যো মাই, বাজারটা তুইল্যা লইয়া আইছে!’

পুত্রবধূকে আদরেই রাখে বারেক মিয়া৷পূত্রবধূর প্রতি তার কোনো গোস্বা নেই৷ পীরের দরবারে সে বাতি জ্বালিয়ে মানত করে এসেছে, ‘খোদার রহমতে নাতির মুখ দেখাইলে খাসি দিয়া সিন্নি দিমু। আর মুর্শিদের দরবারে এক মণ বাতাসা উড়ামু।’ অনাগত বংশধর নিয়ে হাউশেরশেষ নেই তার। তার গোস্বা বেয়াইয়ের সাথে। বারেক মিয়া প্রস্তাব দিয়েছিল, বিয়েটা যতসম্ভব কম খরচে সেরে ফেলতে। সায়েরার জেঠা কথাটা বাড়ালো।

— আলাপের পরথমেই যদি ভাইট্টা টান দেন মিয়ারা,   আপনারার হাতে ছেরি দেই কেমনে। আমরার কইন্যা কি গাংগে ভাইস্যা আইছে? এতো হস্তা না।

— আফনার কইন্যা যেমন হস্তা না, আমার পুতেও হস্তা৷ ইনসাফের একটা আলাপ দিছিলাম মিয়ারা। আপনে ছেরি লইয়া গৌরব করলে আমি ছেরা লইয়া পারমুনা কেরে৷ কন আপনারার কইন্যারে কি দেউন লাগবো৷

— কইন্যারব সোনা দিয়া সাজায়া নিবেন। গলার, হাতের, কানের, নাকের -সব দিয়া নিবেন।

— দিলাম। জামাইরে ট্রলার দিবেন আপনেরা। আর কিছু কইলাম না, বাকিটা আফনারার ইনসাফের উপর।

— ট্রলারটা বেইনসাফি অইয়া গেলো মিয়া ভাই৷

— ইনসাফের কথা তো কইছিলাম, চ্যাটের দাম দিলেন না। ভাইট্টা টান কারা মারলো দেখেন অহন।আমার এক বাপ এক জবান৷ কথা মুখের থাইকা বাইর করছি আর মুখে ফিরাইতাম না৷

সায়েরার বাবা মন্নান মিয়া বিপাকে পড়ে গেলো, বড় ভাইয়ের কথায় বাড়তি খরচের ভার বইতে হলো তার৷ কথা ছিল, নতুন বছরের ফসল তুলে ট্রলার বানিয়ে দেবে৷ পাহাড়ি ঢলে হাওর গেলো ডুবে৷ কথার  বরখেলাপ হলো৷ বারেক মিয়া ঠিকই গহনা দিয়ে পুত্রবধূ নিয়ে আসলো৷


পোয়াতিকে  সাত ঘরে খাওয়ানোর রেওয়াজ পালনের আয়োজন করেছে শ্বাশুড়ি৷ প্রথম দাওয়াত পড়লো পাশের বাড়ি। কালবাউসের মাথা ভেঙে মাসকলাইয়ের ডাল রান্না হয়েছে। সায়েরার কয়দিন যাবত ইচ্ছা করছিল মাসকলাইয়ের খাবে৷


সায়েরার মন যেনো বৈশাখের অনিশ্চিত আকাশ, -এই রোদ, এই বৃষ্টি।হাওরের দিকে তাকালে বুক খা খা করে ওঠে। অপার হাওরের আফালভাঙা ঢেউ দেখে হাহাকার জাগে, বিপন্ন-বিষন্নতায়  কাবু করে সায়েরাকে৷ তার মনে হয় দুনিয়ায় তার কেউ নেই, রিক্ত, অসহায় একা সে। ক্ষণে ক্ষণে নিরিবিলি জোয়ারে আর্দ হয়ে যায় চোখ, শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে ফর্সা ত্বকের চোখের নিচে দাগ পড়ে৷ শাশুড়ি প্রবোধ দেয়,’ এই বেবুঝ বেডি, কান্দো কেরে, তুমি যেমনে কান্দা জুড়াইছো, মনে হইতাছে তুমি বনবাসে আছো৷ তুমারে কিসের অভাবে রাখছি? ঘরে দুই চাইরটা ননদ -জা নাই যে তুমারে জায়জ্বালাতন করে৷ জামাইবাড়ির গৌরবডা রাখো বেডি, নাইয়র তো যাইবাই, বেচইন হইছো কেরে। গোস্বা  কি সারাজীবন থাকবো বেডি! ‘

পোয়াতিকে  সাত ঘরে খাওয়ানোর রেওয়াজ পালনের আয়োজন করেছে শ্বাশুড়ি৷ প্রথম দাওয়াত পড়লো পাশের বাড়ি। কালবাউসের মাথা ভেঙে মাসকলাইয়ের ডাল রান্না হয়েছে। সায়েরার কয়দিন যাবত ইচ্ছা করছিল মাসকলাইয়ের খাবে৷ লাউপাতায় সিদল শুটকি মুড়ে কয়লায় পুড়িয়ে, বেশি করে পেঁয়াজ আর কম মরিচে পাটায় পিষে ভর্তা বানানো হলো৷ চাচী শ্বাশুড়ি ফোঁড়ন কাটে,

— বিয়াইনের ঝি, তুমার বাপে যদি সাতফুলে নাউ ভইরা  বাজার না আনে, তাইলে গরুর লগে বাইন্দা ঘাস দিমু।

— আমার বাপের কইজা বড়ই আম্মা, ডর দেখান লাগব না। বাজার কিছু গোরস্থানে আপনের বাপেরে দিয়া আমুনে। কমু নেও বুইড়া খাও, ছাওপোনা কতগুলা পয়দা কইরা গেছ, ময়দা দিয়া যাও নাই।

— আমার বাপের ঠ্যাংগের নাগাল পাইবা না। তুমার বাপেরে পাই আগে বেডি, গলায় কলসি বাইন্ধা দিমু। কিমুন বাপ, সাতফুলের নাইয়র নিতে ভক্করচক্কর করে।

মন্নান মিয়া ট্রলার বানাচ্ছে। রিপশা বাজার থেকে কাঠ কিনেছে। ময়ালের সেরা নৌকার কারিগর এনেছে। চলতি মাসেই  রঙবাহার করে মেয়ের সাতফুল নিয়ে যাবে ট্রলারে করে৷দিনমাদানের খাটনি তার, নৌকার কাজে কোনো ত্রুটি রাখবে না সে। বারেক মিয়ার গরিমা ভেঙে দিবে সে।অকাল কার না আসে, ফসল হারিয়ে নিদানে কে না পড়ে? ভরা বাজারে কি শরমটাই না দিলো তাকে!

— বিয়াই, বাড়িত  মহরমের মাহফিল পড়ামু,আমার আম্মাডারে দিয়েন কয়দিন নাইয়র থাইকা আইবো। আপনেরার দাওয়াত৷

— আপনের কইন্যা নাইয়র নিবেন বালা কথা। আপনে আমার বাড়িত যান৷ দাওয়াত দিতাছেন বাজারে বইয়া। উড়া উড়া দাওয়াত।

— ভাইসাব একলা জানে দৌড়াদৌড়ি করি, উপযুক্ত পুত নাই। বন্দে গেলে বাড়ি নাই, বাড়িত থাকলে বন্দ নাই। আমি ভাই লোক পাঠাইমু, আপনে মেহেরবানি কইরা মাইয়াডারা দিয়া দিয়েন৷

— বিয়াই, আপনে যেমনে দাওয়াত দিতাছেন, মনে হইতাছে আবুইদ্দার নয়া দাঁত উঠার খুশিতে  ছিটখই ছিটাইতাছেন, যার মন লয় টুকায়া খাইবো৷ বাজারে দেখা না অইলে কি করতেন?

— না বিয়াই, দেখা না অইলে তো যাইতামই আমি। বুঝেনই তো ভাই একলা মানুষ, পুটকির মাছি খেদাইবার সময় পাইনা৷

— বিয়াই আপনে আমার বাড়িত যাইবেন, দুইডা ভাব খাইবেন, মাইয়া লইয়া আইবেন৷ আপনেরে কেউ বাইন্দা রাখবো? কোন ডরে পলায়া থাকেন আপনে? ট্রলার আপনে দিলে দিবেন না দিলে নাই মিয়া। জবান ফাসেক হইলে আপনেরার অইবো। বারেক মিয়া ইতার ধার ধারে না৷

কথার ভাঁজে কৌশলে ট্রলার নিয়ে খোঁচা দেয় বারেক মিয়া। বাড়ি গেলে আরো কত কথার বাণে বিদ্ধ করবে, মন্নান মিয়ার সেটা অনুমেয়। তবুও লোক পাঠিয়েছিল কয়েকবার, নাইয়র দেয়নি সায়েরাকে। মন্নান মিয়া নিজেও গিয়েছিল, গৃহস্থালির ব্যস্ততার কথা বলে নাইয়র দেয়নি। সেবারো চিকন কথার বুননে মন্নান মিয়াকে শরমিন্দা করেছে মানুষের সামনে৷ এরপর বছর পেরিয়ে গেলো, মন্নান মিয়ার বেয়াইয়ের বাড়ি যায় না। লোক পাঠালে মেয়েকেও নাইয়র দেয় না। মন্নান মিয়া জেদ করেছে, ট্রলার নিয়েই মেয়েকে নাইয়র আনতে যাবে৷ কথার তলে পড়ে থাকবে না সে।

সায়েরার মন মানে না। প্রবোধহীন প্রসূনের মতো তার বুক  উথলে কান্না আসে। হাওরের আফালের মতো উন্মাতাল মন খারাপের দিন যায় তার।বাবা-মায়ের মুখ দেখেনা বছর ঘুরলো। গাঁয়ের নাইওরিরা সায়েরাকে দেখতে আসে।

— কি কইতাম সায়েরা ভাবি, মা ছাড়া এই জগতে কেউ বুঝতো পোয়াতির মনে কি যায়। শ্বাশুড়ি যতই করুক, মা’র যতন কি করতে পারে ভাবি৷ তরকারির গন্ধ নিতে পারি না, একটু ভর্তা হইলে খাইতে পারি। আমার লাইগা কি আর আলগা পদ বানান যায়!

— আপনের কি শ্বশুড়বাড়িত কান্দন আইতো বুবু?

— হ গো বইন, মনমর্জির ঠিক পাইনা গো বইন। সব থাকলেও বুকটা খালি বাপ মার লাগি খা খা করে। এইডা বেবাক পোয়াতির একই দশা। কেউরে বুঝাইতে পারি না বইন।

— শইকডা ঘিন ঘিন করে বুবু, কবিরাজে নিয়ম দিছে সাবান মাখন যাইতো না৷

— ইতা পুংডা নিয়ম আমারেও দিছে। বাপের বাড়িত আইয়া ঘাটে বইয়া ইচ্ছামতো সাবান মাখছি ভাবি। ইতা হুদা কথা৷

শ্যাওলাপড়া বয়েসি বটের মতো নিরাসক্ত নির্বিকার চালচলন সায়েরার স্বামীর। সায়েরা কেঁদে বালিশ ভেজায়, নিত্য নিত্য বুক বিদীর্ণ করে  ফোঁপায়,- তার স্বামী হালক্লান্ত ষাড়ের মতো নাক ডাকে। কখনো কখনো বধূ বাতসল্যে বলবে, ‘ কান্দো কেরে, কাইন্দো না। কয়দিন পরে আমিই লইয়া যামুনে বাপের বাড়িত। ভাত খাইও বেশি কইরা।’ সায়েরা  তখন আর রাগ সামাল দিতে পারে না। একা একাই অপয়া  কপালের দুর্দশার  নিয়ে খোদার কাছে নৈরাশা জানায়, ‘মাবুদ তুমি আমারে কই ফালাইলা, নুনমরিচ ছাড়া একটা মানুর লগে আমার কপালডা মিলাইলা মাবুদ। নিরালা ধইঞ্চার লগে বিয়া অইলেউ শান্তি অইতো মাবুদ।’ তার স্বামী পাশ ফিরে ঘুমায়। সায়েরার বিলাপ  যেনো আহারপুষ্ট অজগরের কানে ক্ষুদ্র পাখির কিচিরমিচির।

নিরালা আড়ালে সায়েরা পেটে হাত বুলায়।  অপরিসীম মমতায় চেয়ে দেখে স্ফীত পেটটা।  অনাগত সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করে সে৷পুত্র হবে? নাকি কন্যা? মানবসৃষ্টির অপার রহস্যে মনে মনে ‘সুবগানআল্লাহ’ বলে সে। খোদার কি বিষ্ময়কর  মহিমা, পেটে একটা মানুষ নিয়ে চলাফেরা করছে সে! দেখতে কেমন হবে সন্তান? পুত্র হলে কেমন হবে? নানার চেহারা পাবে কি? কন্যা হলে মায়ের? সহস্র কল্পনার নিরিবিলি একান্ত গোপনে অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলে সায়েরা। একাকি শরমের ছটায় লাল হয়ে ওঠে । মাতৃত্বের অমোঘ মায়া অনুভব করে অপার্থিব আনন্দেও চোখে পানি আসে তার।

সায়েরার শরীর ভার হয়ে যাচ্ছে। শান্তি পায়না সে। খিচুনি হয়েছে দুয়েকবার। অজানা অশুভ ভয়ে সায়েরার মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে আসে।পাশের বাড়ির দাদি খেয়াল করে।

— কিগো সায়েরা, মুখ ইমুন মরা মরা কেরে তোর? ভাত খাস না?

— খাই বুবু। শইডা থরথরাইয়া কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে। শ্বাস টানতে কাহিন অই, বুকের মইধ্যে মনে অয় পাত্থর বান্ধা।

— কয় মাস তোর?

— আট মাসে পড়ছে বুবু। হেইদিন দেখি হলুদ হলুদ দুধ ফোঁটা ফোঁটা পড়তাছে। দুইদিন আগে রাইতে উঠছে খিচনি বুবু। তুমার নাতি হাত পাও টিপ্পা দিছে। আমার হউরি আম্মা জানে না কিচ্ছু।

— আট মাসে ত ইতা অইবার কথা না৷ আটমাইস্যা অয় নি আবার কেডা জানে। তোর হউরি আম্নারে জানা। বাপের বাড়িত খবর দে। ডরাইসনা ছেড়ি, আল্লাহ ভরশা৷

— বুবু আমি নি মইরা যামু ?

— দুরু অলক্ষি ছেরি, কু ডাক ডাকস কেরে। আল্লারে ডাক, তিনি রহম করবো।

মন্নান মিয়া ট্রলারের কাজ তদারকি করছে। চলতি সপ্তাহে ট্রলারের ছাউনি হয়ে যাবে৷নিখুঁত যত্নে  বাঁশ ছিলে চাটাই বোনা হচ্ছে। তারপর শুধু রঙ করা বাকি। খুশিতে চোখেমুখে তার চাঁদসুরুজ ফোটে,-মেয়ের মুখ দেখবে অল্পদিনের তফাত। দাওয়াতি ঠিক করে ফেলেছে কে কে নাইয়র আনতে যাবে৷ নতুন ফতুয়ার মাপ দিয়েছে সে।

সাতফুলের আয়োজন করছে মন্নান মিয়া, দুয়েকদিনের মধ্যেই মেয়ে আনতে যাবে৷ ট্রলারের শুধু রঙ করা বাকি। এমন সময় খবর এলো সায়েরার শরীরটা ভালো নেই। সায়েরার মা উন্মাদপ্রায়, আজই সে মেয়ে দেখতে যাবে।

নতুন ট্রলারে তাড়াহুড়ো সাতফুল সাজিয়ে মেয়েকে আনতে যায় মন্নান মিয়া। গিয়ে দেখে মেয়ের প্রসববেদনা উঠেছে৷ সায়েরার মা কান্না করতে লাগলো ‘ সদর হাসপাতালে লইয়া যাও আমার মা’রে নাইলে বাঁচতো না। এক বিহান অইছে ব্যাথা উঠছে। ‘

বৈকালিক খামখেয়ালি আবহাওয়ায় আফাল উঠেছে হাওরে৷ ঘরসমান উঁচু উঁচু ঢেউয়ে কাগজের মতো ভাসছে ট্রলার। বুনো আক্রোসে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ট্রলারে৷ হাওরের মাঝখানে প্রসূনের কান্না ভেসে আসে। আফালের ক্ষীপ্র তান্ডবকে বিদীর্ণ করে সে কান্নার আওয়াজ। নবাগতের আগমনে আর ঝড়ের তান্ডবে গলা ফাটিয়ে আজান দেয় বারেক মিয়া। সায়েরার মা বললো, ‘ নানার মুখ পাইছে ছেরাডা’। সায়েরা সেই মুখ দেখে যেতে পারলো না।

আপনার মতামত জানান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।