কৃষ্ণচূড়া
যখন তোমার সঙ্গে হয়েছে দেখা
পৃথিবীর সব নিয়র পড়েছে ঘাসে
বহু বহু দিন চলে গেছে আমাদের
এখনো শেফালি ঝরে রেডিয়োর পাশে—
আমাদের ছিল মক্তবে যাতায়াত
পথে মুমূর্ষু সন্ধ্যার ঘন ছায়া
পৃথিবীতে নেমে এসেছে পাখিরা সব
তাদের বেগনি ঠোঁটে ছিল শুধু মায়া—
তোমাকে দেখি না বহুদিন হয়ে গেল
কোরান খতম কবেই হয়েছে শেষ
মায়াবন ধরে চলে গেছে একা পথ
বিকালের নদী হয়ে গেছে নিঃশেষ—
হয়তো খেতের ধান শুয়ে জোসনায়
হয়তো বকরি ছিঁড়ে নেয় কচি পাতা
আমার এখানে অহেতু বৃষ্টি এসে
ভিজে দিয়ে গেছে ব্রত ভাঙবার কথা—
আমি চলে গেছি মাদরাসা শিশুকালে
তারপর থেকে বয়স বাড়ে নি আর
কত ট্রেন এসে চলে গেল কতদিকে
মনে পড়ে তবু আমার শান্তাহার—
আমি ভুলে গেছি মুদিদোকানের দেনা
তুমি ভুলে গেছ সেপারার শেষ সুরা
যত্নে রাখিও ভুলিয়ো না কোনো কিছু
এ জীবন যেন বিপুল কৃষ্ণচূড়া—
আমার বন্ধু
দূর দেশ থেকে এসেছে বন্ধু আজ
আমি তাকে চিনি আবার চিনি না ভাবি
বন্ধু কি তার বলে দেবে পরিচয়
আমার বন্ধু কী বেবুঝ সদালাপী—
বৃষ্টি পড়ছে তরাশে তরাশে দূরে
যের ও জবর ভিজতেছে সেপারায়
কারা যেন কথা বলতেছে একা একা
ডাকাতের মতো বিদ্যুৎ বয়ে যায়—
আমার বন্ধু কমলাবনের মতো
নিশির শিশিরে আর্দ্র জামের ফুল
মালগাড়ি বয়ে বৃষ্টি কোথায় যায়
বঁধুর অধর মরমিয়া তাম্বুল—
তুমি কোন দেশে কোন কাহিনির বাঁকে
থরে ও বিথরে সাজিয়েছ মেঘমধু
এতদিন পরে এলে তুমি একা একা
কাহিনির দেশে তুমি সাজিয়াছ বঁধু—
এখানে জজম সাকিনের ফাঁকে ফাঁকে
জমে গেছে কত দিনকার স্রোতধারা
আমার বন্ধু ফাঁকি দিয়ে চলে যায়
অধরে অধরে পিরিতের আস্কারা—
আমি তা-ও আজো তোমার কথাই বলি
মন্দির হলো শূন্য কবে যে তাই
কোন পৃথিবীর বাঁক ঘিরে তুমি আসো
দূর দেশে আমি, আমার যে ছুটি নাই—
বৃত্ত আঁকার পদ্ধতি
কতদিন হয় তোমারে দেখি না বলো
যেন পথেঘাটে মরিচা ধরেছে ক্ষীণ
নার্সিংহোমে ঝুলে আছে ক্যাথেটার
আকাশে আকাশে পুড়ে যায় গ্যাসোলিন
কারা চলে গেল মুষ্টির চাল তুলে
বাড়ি বাড়ি থেকে দূর জামে মসজিদে
ডালিমের ফুলে ফুটল না পথটুকু
তুমি ফিরে গেছ দরজার বিপরীতে—
সেপারার সুরা সব হয়ে গেল শেষ
শিশুরা ফিরছে মক্তব থেকে বাড়ি
স্যানাটোরিয়ামে ভরে গেছে ঝরাপাতা
তুমি ফিরলে না আজও তবু তাড়াতাড়ি
মানুষ কি শুধু দূরে চলে যায় একা
সাথে নিয়ে যায় কত দিন কত ক্ষণ
সারাটা জীবনব্যাপী ডেকে গেল ঘুঘু
কোথাও তবুও কাঁপল না মায়াবন—
আজও বহু লোক ভুল করে ফিরে আসে
তাদেরকে দেখে ঘরে ঘরে আধো-শোওয়া
আমি ভুলে গেছি থার্মোমিটারে পাঠ
আমি ভুলে গেছি আত্তাহিয়াতু দোয়া—
ত্রিমোহিনীর ঘাটে
যেখানে তোমাকে পাওয়া যেত একদিন
আজ সেইখানে দুপুরে হাঁসের ডাকে
থেমে গেছে সব বিকালের মায়াবন
বৃষ্টি পড়ছে আজও রেডিয়োর ফাঁকে—
তোমাকে এখন দেখি দূরদেশ থেকে
সেখানে না আছে যোগাযোগ সেতু-সাঁকো
কবেকার সেই মক্তবে ছুটি শেষ
ছেঁড়া সেপারার জজমে সাকিনে থাকো—
তখন হয়তো আসর নামাজ শেষ
তখন হয়তো মাদরাসা ফেরে শিশু
ধানের পাতারে এলোমেলো খড়কুটো
সালেহার মা-ও নিয়ে গেছে তার কিছু—
তখন হয়তো সন্ধ্যার সেই নদী
অতুলের ছোট মেয়েটার হাতখানি
তখন হয়তো তোমাকে দেখবো, আর
আমাদের বহু বছরের জানাজানি—
পাতারে মাটির গন্ধে পেকেছে হাওয়া
শস্যের ঘ্রাণে তারারা কাঁপছে জলে
তোমাকে পড়ছে মনে খুব মরমীয়া
যেন তুমি গেছ সহস্র দূরে চলে—
তোমাদের বাড়ি ধ্বলেশ্বরীর তীরে
ছোট এক গ্রাম ছায়ারেখা বরাবর
আবার আসিও ত্রিমোহিনীর ঘাটে
ছোট ভাইটাকে ঘুম পাড়ানোর পর—
দেখা
যদি কোনোদিন আমাদের হয় দেখা
হঠাৎ কখনো ধলেশ্বরীর তীরে
থার্মোমিটারে পুড়ে গেছে কত জ্বর
কেউই দেখি নি আচানক কোনো ভীড়ে—
ওই পাশে গ্রাম বেদনা-বিন্দু যেন
কেঁপে কেঁপে ওঠে দূর থেকে ছায়ারেখা
নীলাকাশ ছিল হসপিটালের মতো
চাঁদ যেন ছিল শাদা অ্যাপ্রোনে ঢাকা
যদি কোনোদিন তোমারে আবার পাই
মক্তবে যেতে ছেঁড়া সেপারার পাশে
ঘাসের উপরে ঢেকে জলপাই ফুল
আমরা হাঁটবো শিশিরে, বিপর্যাসে—
তুমি ফিরে যাবে হাঁস তাড়ানোর ছলে
আমি চলে যাবো মসজিদে একামতে
তোমাদের হাঁস আমাদের খেতে এসে
গুগলি শামুক খেয়ে যাবে ভেসে স্রোতে—
আবার কখনো যদি দেখা হয় দূরে
ততদিনে কত চলে গেছে মাস দিন
তোমার হাঁসেরা আসে নাই ফিরে আর
আমি ভুলে গেছি কত পুরাতন ঋণ—
‘কুড়ি কুড়ি’ সেই বছর পুরানা আজ
সেই মক্তবও আগের মতন নাই
আবার তোমার সাথে দেখা হয় যদি
ধলেশ্বরীর চেনা তীরে যেন পাই—