কবিতা

তোমার চোখের দিকে তাকালে এবং আরও একটি কবিতা

তোমার চোখের দিকে তাকালে

তোমার চোখের দিকে তাকালে দেখতে পাই স্বচ্ছ জলের নীচে কবেকার পুরোনো শ্যাওলা নড়ছে। নুড়িপাথরে হামা দিয়ে কোথাও, কোনো গন্তব্যে এগিয়ে গেল একটি রঙিন কাঁকড়া। পিচ্ছিল পাথরেরা যেন তাদের বংশপ্রদীপ নিয়ে বসে আছে। চোখ সরিয়ে নিই। কয়েক পা পিছিয়ে যে আয়ত দেওয়াল সময়েরও অতীত, তার কাছাকাছি চলে আসি। হয়তো-বা এমন স্থির বায়ুর জগতে কিছুটা মনোরম শব্দ তুলে বসার আসনে বসেও পড়ি। বসার আসনে পুরনো একটি চাদর। তার গায়ে প্রকাণ্ড হিংস্র ফুলের মতো ছাপ। সুতোর বুনোট কঠিন। আমি ক্লান্ত মানুষের মতো নিঃশ্বাস ফেলি। এইসব দেহকে শূন্য করে বেরিয়ে আসা নিঃশ্বাস এই উড্ডীন, আমুদে ছাতার মতো এই একটি দিনের আলোয় নিতান্ত শিশুর মতো মিশে যায়। কখনো তুমি হাসো। যেন ঠিক বুঝতেই পারলেই না, কী এমন বিদ্যুতের রেখা আমার শরীরকে ফুঁড়ে দিয়ে পাতালে মিলিয়ে গেল। আপাতদৃষ্টে সবই তো শান্ত। প্রত্যহের মতোই গোছানো, অভিনবত্বহীন। সেই এক দুই বৃদ্ধার মতো দরজার অবস্থান। লোহার জালের ওপারে মুক্ত শৃঙ্খলার মধ্যে পাখি, লম্বাটে ধরনের গাছ। সেই মুহূর্তে কেউ কেউ হয়তো পৃথিবীকে শাসন করার জন্য অনাঘ্রাত বরফে পা রাখছে, কেউ কেউ হয়তো মুখোমুখি ব্যক্তিটির সামনে কী বলবে তা বুঝতে না পেরে আনত হয়ে আছে। এই তো, এই তো পৃথিবী। প্রত্যহের মতোই গোছানো, অভিনবত্বহীন চাদরে প্রকান্ড হিংস্র ফুলের ছাপ। আমি ভাবি এরা যেন সব উপবিষ্ট মানুষকেই কিছু একটা বলতে চায়। হতে পারে তাদের মুখের ভাষা চিরদিনের মতো মুছে দিয়েছে কেউ। সযত্নে জিভটুকু তুলে প্রাণভিক্ষে দেওয়া হয়েছে। ঠেলে দেওয়া হয়েছে এক যুগ থেকে অন্য যুগে। মৌটুসি পাখির মতো তুমি বলে ওঠো ‘শোনো না, একটু বসো। আমি এখুনি আসছি। চা তো নিশ্চয়ই খাবে? একটু অপেক্ষা কর লক্ষীটি!’ আমি দেখি তুমি সেই যে কোটি কোটি বছরের অনাঘ্রাত তুষার, তা ভেঙে কোথাও চলে যাচ্ছ। তুষারে চেনা জিনিসের মতো পায়ের ছাপ পড়ছে তোমার। আমি এক ঘোলা অচৈতন্যের মধ্যে বসে থাকি। হয়তো সেই কাঁকড়ার মতো হামা দিই, শ্যাওলার মতো নড়ি, ভাসি। পিচ্ছিল পাথরেরা তাদের বংশপ্রদীপ নিয়ে বসে আছে। তাদের ঝুলো চিবুকের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করি ‘বড়োটির বয়েস কত হল? অবিকল যেন আপনারই ছাদ পেয়েছে।‘ কী দিন, কী দিন এইসব! জালের ওপারে মুক্ত শৃঙ্খলার পাখি, লম্বা লম্বা দোহারা চেহারার গাছ। এদের আড়ালে গিয়ে কেউ কাঁদে, এদের মধ্যে কেউ শুয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। ধরো, ঠিক সেই ঘটনার আগে ওদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তোমারই মতো কেউ। সেই লতাবল্লরী ঠিক তোমারই মতো বুঝতে পারেনি কোন এমন বিদ্যুতরেখা তাদের শরীর ফুঁড়ে পাতালে মিলিয়ে গেল। আপাতদৃষ্টে সবই তো শান্ত। শেয়ালের আত্মা তখনো কোথাও নেই

সম্পর্কিত

চিঠি

আমি যে জগতে ভাল আছি, সেই জগতে এখন সেদ্ধ ডিম দিয়ে চটকে ভাত মাখার নরম গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে মাথার ওপরে যে অগাধ আকাশ, তাতে ছড়ানো জালের মতো মেঘ, একফাঁকে চাঁদ। চাঁদে কলঙ্কের ছাপ আছে, শুকিয়ে যাওয়া রক্তও আছে। আমি যে জগতে ভাল আছি, সে জগতে একটি শিশুর কান্না ধূপের ধোঁয়ার মতো লতিয়ে লতিয়ে উঠে হাজির বাতাসে ভেঙে মিশে যাচ্ছে। পিঠে ডোরাকাটা দাগ নিয়ে একটি নিজের মধ্যে মগ্ন মানুষ অপরিচিত কোনো স্থাপত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে বার্নারের সামনে। আমি যে জগতে ভাল আছি, সে জগতে এখন বিষণ্ণ আলো জ্বলছে। আর কয়েক ঘণ্টা পরে আমি যে জগতে ভাল আছি, সে জগত অন্ধকার এক সমুদ্রে ডুবে যাবে। শিশুর দেহাভ্যন্তর দিয়ে বয়ে যাবে সেই অন্ধকার সমুদ্রের জল আর একটি তৈলাক্ত পাথরে নগ্নদেহে দুটি উলঙ্গ মানুষ প্রেতের মতো চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে হৃদয় নিঙড়ে বন্য পশুর মতো সঙ্গম করবে। সঙ্গমের পর অসাড় হয়ে শুয়ে থাকবে আমি যে জগতে ভাল আছি, সেই জগত থেকে তোমার জগত হয়তো- বা কাছেই। তবে অতোটাও কাছে নয় যাতে করে তুমি সঙ্গমের মুহূর্তে যেসব আওয়াজ, শীৎকার ছিটকে ছিটকে ওঠে- তা শুনতে পার। হয়তো এই দূরত্ব সহসা এক হাওয়া এসে একটি গাছকে দুমড়ে-মুচড়ে তার মরা, শুকনো পাতাদের যতদূর উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে- ততটুকু। সশব্দে ঝলসে একপ্রস্থ বিদ্যুৎ কালো প্রেক্ষাপট ছেড়ে বেঁকেচুরে যে দূরত্বে নেমে যায়- ততটুকু। এই ধারণা আমার একদিন একাকী রাতে উচু-নীচু নির্জন একটি মাঠ পেরিয়ে আসতে আসতে হয়েছিল। মলত্যাগ শেষে জীবনে ফিরে আসার সময়ে হয়েছিল। আমি যে জগতে ভাল আছি, সে জগতে এভাবেই সব ধারণা, সব অনুমান বা উপলব্ধি ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা মেলে দেয়। আমি যে জগতে ভাল আছি, সে জগতে বাইরের ঘরে কী কাজের জন্য দেশলাই বা তেমনই কিছু কুড়িয়ে নিতে এসে দেখি, ঘরের বাতাসে সেই সাবেক চিড়িয়াখানার মতো কেমন নোনা নোনা বোঁটকা ঘ্রাণ বাইরে আকাশে তখন জাল জাল মেঘ। তার একফাঁকে চাঁদ। চাঁদে কলঙ্কের ছাপ আছে, শুকিয়ে যাওয়া রক্তও আছে

আপনার মতামত জানান

অমিতরূপ চক্রবর্তী

অমিতরূপ চক্রবর্তী; জন্ম ১৯৭৭ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। বসবাস পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে। এখানেই তাঁর শিক্ষার শুরু এবং বড়ো হয়ে ওঠা। ২০২০-তে কোলকাতা বইমেলায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল’ বেরোয়। মূলত কবিতাই লেখেন। পাশাপাশি ছোটগল্প/গদ্যের চর্চাও করেন। ভালোলাগার তালিকায় আছে বই পড়া, বেড়ানো, গান শোনা ও সিনেমা দেখার আগ্রহ। পেশায় চাকুরিজীবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।