গল্প

জুহরা পাগলি

কেউ যখন গা ঘেঁষে দাঁড়ায় কিংবা বসতে চেষ্টা করে তখন পাগলি রেগে গিয়ে খাটাসের মতো গালাগালি শুরু করে, এই খানকির পুত, তুই কি আমারে মাগি পাইছত? হইরা দাঁড়া, নাইলে বসই কাইটা রাইখা দিমু, শালার শালা বদমাইশ।

বিনোদনের জন্য তখনও কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক আবিস্কার হয়নি। বিভিন্ন বয়সের মানুষ বসে যুবতি পাগলিকে নিয়ে মজা করছে। হৃষ্টপুষ্ট দেহের যুবতি শার্ট-প্যান্ট গায়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায়, সে যাবে মোহনগঞ্জ। ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে ততই জটলা বড় হচ্ছে। আর জটলা যত বড় হচ্ছে পাগলির পাগলামি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন কথায় পাগলিকে আরও পাগলামির দিকে উসকে দিচ্ছে। কারো কারো দৃষ্টি তার কথামালার দিকে, আবার কারো কারো দৃষ্টি তার যৌবনে উতলে ওঠা দেহের দিকে। একেবারে দুই পাহাড়ের মতো উঁচু বুকের দিকে কিংবা পেন্টের ফাঁক দিয়ে উরুর দিকেও যে কারো কারো চোখ নেই তা কিন্তু নয়।
কেউ কেউ আবার গা ঘেষেও পাগলির যৌবনের স্বাদ নিতে চেষ্টা করছে। তবে সে পাগলি হলেও বুঝে সুবিধাভোগিদের চরিত্র। কেউ যখন গা ঘেঁষে দাঁড়ায় কিংবা বসতে চেষ্টা করে তখন পাগলি রেগে গিয়ে খাটাসের মতো গালাগালি শুরু করে, এই খানকির পুত, তুই কি আমারে মাগি পাইছত? হইরা দাঁড়া, নাইলে বসই কাইটা রাইখা দিমু, শালার শালা বদমাইশ। যাকে পাগলি গালি দেয় তার লজ্জা-শরম থাকলে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আর যারা উপস্থিত তাদের কেউ দ্বিতীয়বার লজ্জায় পাগলির যৌবনের দিকে চোখ তুলে দেখছে না। বিভিন্ন পেশা এবং শ্রেণীর অতি ভদ্রলোকেরা দূর থেকে পাগলির বকবক কিংবা দেহ থেকে মজা লুটছে। নিরাপদ দূরত্বে নারীরাও বাঁকা চোখে মাঝেমধ্যে পাগলিকে দেখছে। আর যখন পাগলি কোন পুরুষকে লুচ্ছা-বদমাশ গালি দিচ্ছে তখন নারীদের কেউ কেউ মুচকি হাসির টিপ্পুনি কাটছে। শুচিবায়ু রোগি স্বভাবের নারীরা স্বামীকে নিয়ে সন্দিহান, কেউ কেউ পাগলির প্রতি ক্ষুব্ধ। যারা স্বামীর উপর কর্তৃত্বশীল তারা নিজ স্বামীকে এদিকে আসতে দিচ্ছে না। আবার কোন কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হাত ধরে টানাটানিও চলছে। পাগলি তার গতিতে চলছে। মাঝেমধ্যে সে জিকিরও করছে। মাঝেমধ্যে উচ্চ আওয়াজে বলছে, দয়াল মুর্শিদ, দয়াল রাসুল, দয়াল আল্লাহ।
কেউ একজন ‘এই বগি তুই খাস কী’-এর মতো জানতে চাইলো; এই পাগলি তুই খাস কেমনে? সে সহজ উত্তর দিলো আল্লাহ খাবায়। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ হাতের লাঠি উঁচিয়ে বললো, আমরা লাঠি না হান্দাইলে খাইতে পারি না, আর তরে আল্লাহ এমনি এমনি খাবায়? পাগলি চোখ উঠিয়ে খাকি পোশাকের পুলিশ দেখে কি যেন বিড়বিড় করে বলে মুখ বন্ধ করে। পাগলি একবারে নীরব হয়ে যায়। মনে হলো পাগলি পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে। কেউ একজন যেতে যেতে পাগলিকে পাঁচ টাকা দিলো। একে একে উপস্থিত অনেকেই তাকে টাকা দিলো। কেউ দিলো বনরুটি, কেউ দিলো পানি, কেউ পান আর কেউ সিগারেট। পাগলি রুটি খায়, পান খায়, অতঃপর সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই খানকির পুলা; এইগুলা কি আমি লাঠি হান্দাইয়া খাইলাম, না আল্লাহ খাবাইলো। শালার পুতেরা খালি লাঠি হান্দানি শিখলে, তর লাঠি একদিন তরে খাইবো খানকির পুলা। আল্লাহ যেদিন ধরবো রে পুলা, হেইদিন বুঝবি আল্লাহ কারে কয়।
পাগলির কথায় পুলিশ যেন কিছুটা ভয় পায় আল্লাহকে, কিছুটা লজ্জিত হয়। সে মাথা নিচু করে স্থান ত্যাগ করে। এরই মধ্যে লম্বা বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন এসে উপস্থিত হলে সবাই পাগলির পিছু ছেড়ে ট্রেনের দিকে যেতে থাকে। পাগলি তার মালপত্র উঠিয়ে ট্রেনে ওঠে। এই পথে সে নিয়মিত চলাফেরা করে, সবাই তাকে চিনে-জানে। টিটি আর তার কাছে টিকিট চেয়ে লজ্জিত হতে চায় না।

দুই.
পাগলের আবার অতীত-বর্তমান ইতিহাসের বর্ণনা কী। পাগলি তো পাগলিই। তবু সে বকবক করে বলে, আমারও একখান ইতিহাস আছে, যেমন আছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস। যে কেউ পাগলির এমন কথায় প্রথমে চমকে ওঠে। পাগলি বলে কী, তার আর স্বাধীনতার ইতিহাস একাকার? কেউ কেউ ধমক দিয়ে বলে, এই পাগলি, বকবক বন্ধ কর। কেউ আবার মজা পায়। কারো কিছুতে পাগলের কী আসে যায়। সে বলতেই থাকে। সে যা বলে তার আগামাথা বের করতে অনেক কষ্ট হলেও তার বর্ণনাকে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে মিলাতে চাইলে অনেকটা মিলে যায়। যেমন ছোটবেলা পাগলি মা-বাবা হারিয়ে ভাই-ভাবির কাছে পরাধীন হয়ে যায়। যেমন নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা অসহায় হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে নবাব বুঝতে পারলেন তিনি পরাধীন হতে চলছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করেন, কিন্তু বিফল হলেন ষড়যন্ত্রকারী-ক্ষমতালোভীদের চক্রান্তের ফলে। মীর জাফর, উর্মিচাঁদ, ঘষেটি বেগমরা সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজকে সহযোগিতা করলো বাংলার স্বাধীনতাকে হত্যা করতে, যেমনটি পাগলিকে তার ভাই-ভাবি ষড়যন্ত্র করে তার বাপের সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং অপাত্রে বিয়ে দান করেছে। স্বামীর নির্যাতনে অতঃপর পাগল বেশে পাগলি দু’ছেলেকে ফেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘর ছাড়ে। যেমন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নির্যাতনে পাগলের মতো বেরিয়েছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন করতে। টুঙ্গিপাড়া থেকে ফরিদপুর, ঢাকা, কোলকাতা, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাগলের মতো বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ পাগলিও সারা বাংলাদেশ পাগলের মতো ঘুরে আর বলে, আমি পাগল, আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। পাকিস্তান কিংবা ভারত যেমন বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত দেয়নি, তেমনি পাগলিকে সম্পদ থেকে তার বাপ কিংবা স্বামী বঞ্চিত করেছে। তবু বাংলাদেশের মানুষ কিংবা পাগলি তৃপ্ত নিজের স্বাধীনতার জন্য। বাংলাদেশের এই ইতিহাস পাগলির হয়তো জানা, হয়তো জানা নেই। তবে সে বকবকিয়ে বলে, আমারও একখান ইতিহাস আছে, যেমন আছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস।

সম্পর্কিত

তিন.
পাগলি সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার রাত নেই, দিন নেই, সমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই, আপন নেই, পর নেই। যেখানে রাত সেখানে কাত। পাইলে খায় নাইলে নাই। শেষ আশ্রয় মাজারে মাজারে চক্কর দেওয়া। পাগলি মাজারে থাকে, মাজারে খায়। মাজারে থাকতে থাকতে পাগলির মধ্যে বেশ গানের ভাব এসে যায়। সে নেত্রকোনার শাহ সুলতানের মাজারে এক গানের আসরে শুনতে পায় কিছু গান, যেগুলো তাকে গানের দিকে টানতে থাকে। সে একা বসে থাকলে বিড়বিড় করে বলতে থাকে;

‘আমি তোমার নামের ভক্ত
পাইলে করিতাম রপ্ত
তুমি ছাড়া আর কে আছে পতিত পাবন
তৌরাত ইঞ্জিন জবুর কোরআন
হিন্দু লোকের পদ্ম-পুরাণ
একই আদমের সন্তান, একই গঠন।’

গানের সুর, তাল, লয় পাগলিকে ওলটপালট করে দিতে থাকে। সে আরও পাগল হয়, আরও কী যেনো খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে সে এক মাজার থেকে আরেক মাজারে যায়। মাজারগুলোর মাহফিলে সে নাচে, গায় আর কখনও কখনও নেশাও করে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে ধুম করে ঘুমিয়ে পড়ে। মাজারে ঘুরতে আসা অনেক যুবকের ঘুম হারাম হয় পাগলির নাচ, গান, দেহ এবং চেহরায়। কেউ তার দেহে হাত দিলেই সে খাটাসের মতো চিৎকার দিয়ে গালাগালি শুরু করে দেয়, কুত্তার বাচ্চারা, শুয়োরের বাচ্চারা, তর মা বোনের শরীরে টিপাটিপি কর গিয়া, আমার গায়ে হাত দেস ক্যান? আমি পাগল বইলা কি আমার মান-ইজ্জত নাইরে খানকির পুলা?
পাগলি মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অসহায় ভাবে। তার যাওয়ারও জায়গা নেই। সে মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকে :

‘ভব পাড়ি সারতে নারী
ডুবলো আমার দেহের তরী
কৃপা করি হও কা-ারি
ভয় পাইয়া ডাকি তোমারে।’

সে কোথায় যাবে, কাকে বলবে আশ্রয়ের জন্য? সে তো পাগল, পাগলকে আশ্রয় দিবে কে! ঘুরতে ঘুরতে একবার মদন এলাকায় শাহ সুলতানের মাজারের এক মাহফিলে তার চোখ আটকে গেলো এক সাধকের চেহারায়। সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলো কী করা যায়। অসংখ্য মানুষ সাধককে ভক্তি সালাম করছে। সে সালাম করতে গিয়ে আটকে যায় সাধকের পায়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে :

‘বাঁশির সুরে হই উদাসী
পাগলরে লও কুলে আসি
আমি কাঙ্গাল কুল নাশিনি
কাইন্দা কাইন্দা জনম যায়।’

সাধক আশ্চর্য হলেন পাগলির মুখে তাঁর নিজের গান শুনে। তিনি চোখ তুলে চাইলেন পাগলির দিকে। পাগলি দু’হাত জোড় করে কী যেন ভিক্ষা চাইলো।
সাধক সামন থেকে সরে পাশে বসার কথা বললে পাগলি পাশে অন্যান্য ভক্তদের সাথে মিশে বসলো। ধীরে ধীরে পাগলি মিশে গেলো সাধকের ভক্তদের মধ্যে। অনেকে তাকে তাড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। সাধক মাজার ছেড়ে যখন চলে যাবেন তখন পাগলিও তার সঙ্গ নিলো। কাফেলা থেকে সে দূরে দূরে কাফেলাকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে। কেউ কেউ তাকে পাগলি বলে ব্যঙ্গ করে। তবু সে চলতে থাকে, হাঁটতে থাকে। এভাবে সে মিশে যায় এই কাফেলার সাথে। ধীরে ধীরে সে শিষ্য হয়ে যায় সাধকের। সাধক তার সকল ভক্তবৃন্দকে বলে দিলেন, এটা পাগল, ওকে কেউ কষ্ট দিও না। শিষ্যরা সাধকের কথাকে আল্লাহ-রাসুলের কথা ভেবে মানতে থাকে। পাগলি সাধকের কাফেলার সাথে গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে ঘুরতে থাকে। এখন কেউ তাকে কথা বলতে ভয় পায়, এভাবেই সে সাধকের আশ্রয়ে আশ্রয়ী হয়ে যায়। পাগলি ধীরে ধীরে প্যান্ট-শার্ট ফেলে শাড়ি পড়ে। ছাড়ে গাঁজা, সিগরেট। মাঝেমধ্যে নামাজও পড়ে।

চার.
জুহরা পাগলিকে জানে না কিংবা ভালোবাসে না, নেত্রকোনা-ধর্মপাশা-সিলেট-কুমিল্লায় পির মনফরের ভক্ত-মুরিদে এমন মানুষ কমই আছে। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে যখন বলে, ‘এই পাগলি, শরিয়তের বালাই নাই, পিরের সাথে চক্কর মারস, লজ্জা করে না?’ পাগলিও এখন বেশ জ্ঞানী। সে বলে, আমি যখন পাগলের মতো অসহায় ছিলাম, মাজারে মাজারে অসহায়ের মতো চক্কর দিতাম, খাদ্য-কাপড়ের অভাবে থাকতাম, তখন তোমার শরিয়ত আর তুমি কোথায় ছিলা বাবা? যখন আশ্রয়শূন্য পথে থাকতাম, মানুষ আমাকে নিয়া টানাটানি করতো আর আমি একটু সাহায্যের আশায় হাহাকার করতাম, তখন তোমরা শরিয়ত নিয়া কোথায় ছিলা? যখন আমার ভাইরা আমার বাপের সম্পদ লুটে খাইলো, যখন আমি আমার স্বামীর সম্পদ থেকে বঞ্চিত হইলাম, তখন তোমাদের শরিয়তওলারা কোথায় ছিলা? এই মিয়া, শরিয়ত কার জন্য? তোমার না আমার? গোপনে গোপনে বেগানা মাইয়াদের সাথে লক্কর-জক্কর করতে শরিয়ত থাকে কোথায়? শরিয়ত মারাইতেছো পাগলের লগে! পাগলের কিসের শরিয়ত মিয়া?

আপনার মতামত জানান

সৈয়দ মবনু

সৈয়দ মবনু; কবি, গবেষক ও দার্শনিক। জন্ম সুনামগঞ্জের সৈয়দপুর গ্রামে ১৯৭০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি । লিখছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও গান। রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে চিন্তা, মতামত ও বিশ্লেষণের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন সৃজনমুখর ছোটকাগজ ‘নগর’। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে দয়াদর্শন, দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্য : উৎস ও ক্রমবিকাশ, মার্কস চিন্তার সহি তফসির, জুলেখা ও জলরঙ (গল্প), আত্মার অনুবাদ (কবিতা), পাতালাতার পিরমুর্শিদি (কবিতা) উল্লেখযোগ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।