গল্প

জাতিস্মরত্ব

বাড়ির পিছনের ছোট ঘাটের পারে মেঠোপথ দিয়ে এইতো ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পরিচয় তো দিতে চান না। আমরা তখন ট্যা কও তো ট্যাংরা বুঝি। সেদিন ফুল তোলে এসে গনগন করে জ্বর এসেছিল।

এখন শীত করে, কিন্তু ফ্যানের শব্দ একটা সিল্ডের মতো। আমিও জন্মান্তরে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি স্পষ্টতই বিগতজন্ম দেখছিলাম আজকে একটু আগে। সাজানো নওরোজের টেবিলে টিউলিপের, টার্কিশ জলদানির সমন্বয়ে, মোমবাতির, সামানুর, ওফে মেওয়ার সমন্বয়ে……
ফিরে পাওয়া স্মৃতিশক্তির মতো হিমশীতল কুয়াশাচ্ছন্ন খানিকটা, আজকে জাতিস্মরত্ব লাভ করেছি।
হতে পারে মৃত্যুর ভয়ে বাঁচতে পাগলও হয়ে যাচ্ছি বা। যেভাবে লাল পাতার ডাঁই থেকে উঠে আসে কুয়ার কিছুমিচু।

সাকির একটা দোঁহা ছিল, “কবে পাতা ঝরবে
তুষারপাতের উপর”। আমি তো উর্দু জানতাম না। কত কিছু আগে সেজন্য বুঝতেও পারিনি। এইসকল প্রণোদন আজকে খামখেয়ালি লেফাফাদোরস্ত মনে হয়। আজকে জানলাম কী কী লিখেছিল সাকি যা জানি নি। কোনো আফসোস নেই।
সাকি যেহেতু সাকি, তাড়ি হতে আহ্বান করতে পারত আমাকে। কিন্তু করেনি ভুলক্রমেও।

সম্পর্কিত

তখন সংগ্রামের আগে পাঞ্জাবি কী আর জুনাগড়ী কী, বাঙালির কাছে সবাই পাকিস্তানি।

আপনারা আজকের তমুক জনপ্রিয় গায়ককে চিনে থাকবেন। তাঁর মা, আমি, আমার ছোট বোন রানু হাফেনারে আমরা তিনজনে পান খেতাম। শুচিও হয়তো কবে মারা গেছে। হয়তো কোথাও জন্মেও থাকতে পারে বা।
কিশোরীমোহন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ঝরা পাতা ঢাকা বিস্তৃত মাঠ।  একটা মিষ্টি, খেলে পেট পাঁকায়, তেমন তেঁতুল গাছ ছিল অশ্বত্থের মতো। নিচ থেকে রেড হুডের ন্যায় বৃহৎ, ক্ষুদ্র আমাদের আরো ক্ষুদ্র করে দেওয়া। দীর্ঘ তেঁতুল। আমরা হয়তো ভাবতাম বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ বুঝি এতো বড় হয়।
শীতে স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মুখের চামচে আলু নিয়ে দৌড়,  বস্তাদৌড়, অংক দৌড় হয়। ফিরে যাওয়ার সময় সাকি সাইকেলে পিছে করে আসতো।
স্কুলে ওঁরা সাকি’রা পড়েনি।
একবার মুকুটের মতো চাপ কলের মাথায় আমি হাতের বালাটা ফেলে এসেছিলাম। সাকী পানি নিতে গিয়ে লিখেছিল, ” আসো নি, কিন্তু কিছু একটা ফেলে গিয়েছিলে।”
এইসব কী?

আমাদের তখন উৎসবের মতো দিন ছিল।
একবার মাখন দা’র বউকে ভূতে ধরল। ঠিক দুক্কুর বেলা….। রাতে ল্যান্টন ধরে পায়খানায় গিয়ে বৌদি কল পারে শত শত মরা ইঁদুর, ধাবমান তেলাপোকা দেখতে লাগলেন। আমরা কত আনন্দ করেইনা সেদিন সকালে সাঁতার কেটে এসেছিলাম। মাখনদা তাঁর ডিসপেন্সারির খালি শিশিতে পাদ ভরে নতুন বৌদিকে বাচ্চা হবে বলে খাইয়ে দিয়েছিল। সে কী খিলখিল হাসি পরে। মাখন দা বৌদিকে অনেক সোহাগ করত। এমনকি ভূতগ্রস্ত অবস্থায়ও।
যেদিন ভূত ধরল, স্নান সেরে এসে দেখা গেল বৌদির গালে চার আঙুল চড়ের দাগ। কুল বরই পাড়তে গাছে চড়েছিল সেদিন।

একবার আমাদের খোকন দাও স্নান সেরে এসে ভেজা প্যান্ট পাল্টালো। তারপরে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাকিকে বলছিল, মা, ওঁরা ডাকছে। ওঁরা ঢিল মেরে মেরে চালও ভেঙে ফেলতে পারে। তুমি দরজা খুলবে না। সেদিন ভোর রাতে খোকন দা মারা গেছিল।
তখন পৃথিবীতে তত আলো ছিল না।

একবার আমি শিব ঠাকুর দেখলাম। দাঁড়িয়াল, জোব্বা পরা। হাতে কমণ্ডলু। জল্লারপারে তখন আমরা মামার বাড়িতে গেছিলাম। চারপাশ টাটকা ভোরের চোটে কালচে কমলা হয়ে আছে। বাড়ির পিছনের ছোট ঘাটের পারে মেঠোপথ দিয়ে এইতো ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পরিচয় তো দিতে চান না। আমরা তখন ট্যা কও তো ট্যাংরা বুঝি। সেদিন ফুল তোলে এসে গনগন করে জ্বর এসেছিল।
সাকিকে কিছুই বলা হয়নি। বস্তুত কথাও হয়নি আমাদের।

একবার শীতলি দেবীকেও দেখলাম। কতগুলো খারাপ লোকে দৌড় করাচ্ছে তাঁকে স্বাভাবিক ভাবে। সন্ধ্যায় খেলে ঘরে ফেরার সময়।
দোলের সময় মা আমাদের বের হতে দিতেন না।
বুইন্যে পাইন্যে হাত লাগবে। এগুলো ঠিক নয়।
সেদিন রাতে আশীর্বাদে একটা দুটা করে জলবসন্ত হয়।

বাড়ি থেকে পাশ ঘেঁষে হাঁটলে কিছুদূর পরে সন্ধ্যার শেষে উর্দু কাওয়ালি শোনা যেত। ভূত অমাবস্যায় পুকুরদের জলে আরো বেশি, যেনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে করে শোনা যায়।
সাকিদের এখানে এলাকাটায় জ্বিন ছিল। রাতে যারা গলা ছাড়া মস্তক ছাড়া হাঁটে। জ্বিনেরা জুনাগড়ী পাড়ার দেহরক্ষী।

আমাদের মায়েরা সাকিদের ব্যাপারটা, এঁরা ঠিক হিন্দু না মোশুলমান, ধরতে পারতেন না। হাতে মাথায় শাঁখা সিঁদুর দেয় না, আবার হিন্দি ভাষায় কথা বলে হতে পারে। হতে পারে বিহারি,  মারোয়ারীদের জ্ঞাতি ভাই।

আজকের যে তমুক জনপ্রিয় পাকিস্তানি গায়ককে চেনেন আপনারা। আমার বিয়েটা কী করে হলো বলি। তার মাকে, আমার সই, আমি নিজেও টের পাইনি, কবে কী করেছিল। একসাথে দোক্তা কিনে, গল্প করে করে পায়খানা করে দিন পার করেছি আমরা। তাকে এক জুনাগড়ী ছেলে ভাগিয়ে নিয়ে গেছিল।  মুড়ির টিনে করে। হয়তো পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেলো তখন। আজকে জানি হয়তো নয়, হ্যাঁ।

সাকি কখনোই এমনতর করত না। আমি না শুধু, কেউই না। কোথায় পালাবে? কেনই বা।
একবার দোয়া কবুলের মাসে হরেন্ড দাদাকে দিয়ে রাংতায় পেঁচিয়ে দোয়াত কলম পাঠাল। “মেরি সিয়াহী মে রোশনি ভর দো।” আমার মস্যাধার আলোকিত করে দাও।

এই জন্মে এই সবকিছুই, ফিরে তাকানো নয়, নীলচে সাদা কালো পর্দায় চোখের সামনে নিজে নিজেই চলছে যা, যত এইসব গাঁজাখোরি খামখেয়াল প্রেম, অকেজো মনে হয়। কাউকে তো পাঠাতে হতো, বরং আমাকে নয় কেন।

পুরনো রাতের যত ত্র্যহস্পর্শের কথা সংসার আশংকা করে, জুনাগড়ীরা নাকি প্রায়শ মেয়ে নিয়ে পালাচ্ছে, ইত্যাদি। একদিন উনারা, হীরেন্দ্র সিংহ রায়েরা, পুত্র সমেত, আমার শ্বশুর মশাইয়েরা, আমাদের পাড়ায় এলে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। আর আমি এইট ক্লাস। আর তিনি ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত পাস করেছিলেন। কিন্তু গণিতে ভালো। আমার থেকে কত ভালো অংক পারতেন।

শেষ কাগজের কথা বলি। একদিন- আমার শ্বশুরবাড়ি মুরাদ পুরে- নীল গুঁড়া দিয়ে কাঁচ মাজলে বেশ ঝকঝকে হয়, আমি প্রথম কিছুতেই চিনতে পারিনি। নরম সাদা গায়ের রং এমন তাম্রাভ হয়ে গেছে।
সাথে কিছু হজমি গুলিও কিনতাম। সংগ্রামের আগে কী পরে ঠাওর করতে পারি না। সাকি পেটরা নামিয়ে পাগড়ি হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিল।

নীলের গুঁড়া মোড়া কাগজে লেখা ছিল, ” মেরি সিয়াহি নীলে পরগয়ে, তোমহারা সুকুন ভি আওর উজালা হো।”

ভূতও দেখে থাকতে পারি। সংগ্রামের কালে সাকি মরেও থাকতে পারে, লোক মুখে শুনেছিলাম।
হতে পারে আমরা উদ্বাস্তুত্ব ত্যাগ করে সদ্য ভারত থেকে ঘরে ফিরেছি৷ হতে পারে একটা কঠোর সময়।
(আজকে জানি….)
তখন পৃথিবীতে তত আলো ছিল না।

আপনার মতামত জানান

দৃষ্টি দিজা

দৃষ্টি দিজা। কবি, অনুবাদক ও গল্পকার। জন্ম ১৯৯৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ। ২০২১ সালে চৈতন্য প্রকাশন থেকে বের হয় তার গল্পের বই ‘বিলুপ্তি ফেরাতে আসা রানী মাছ’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।