এইসব দিনে পাতা ভেঙে ঘুম আসে। ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস একপাতা আরেকপাতার সাথে বেয়াই বেয়াই হন।
প্রথম যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মতো গরম পড়েছে। সেজন্য এপ্রিল ইজ দ্যা ক্রুয়েলেস্ট।
রোদটা একটু কমতে মা প্রদীপ ধুতে তেঁতুল নিয়ে পুকুরে গেছেন। রান্না শেষ করে। বাবা গেছেন শ্মশান ধুতে ঝাড়ু হাতে বাঁশঝাড়ের তলার দিকে। চৈত্র মাসের শেষের দিক। ঠাম্মা আর দাদুর কাছে সংক্রান্তির দিনে ভোগ লাগাতে হবে। সংক্রান্তি নয়তো মাসপয়লা। নববর্ষ নয়। নইলে সন।
যখন আমাদের সংসারে বাজেমালের দোকান ছিল, তখন ছিল সন। সনের কারণ হলো দোকানে কাস্টমারদেরকে মিষ্টি খাওয়ানো হত। নতুন লালখাতা খোলা হত। পুরোহিত জেঠু এসে বেলপাতা ফুল দিয়ে সকালে গণেশ পূজা করতেন। হালখাতায় আর নতুন লোকনাথ পঞ্জিকায় চন্দন আর সিঁদুরের পাঁচটা ফোঁটা দিতেন। ঘর থেকে আগের দিন প্লেট গ্লাস, কাঁসার পূজার থালাবাসন আর টেবিল নিয়ে যাওয়া হত। তারপর কাস্টমারেরা মিষ্টি খাওয়া শেষে আমরা দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেতাম। তারপর রাতের সময় সিরা ভর্তি মিষ্টি আর নিমকির গামলাগুলো রিকশা করে বাড়িতে নিয়ে আসা হতো। বাবা সবসময় পেছন পেছন আসতেন। কর্মচারীরা সহসাই মধ্যপথে গল্প আড্ডায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়াটা জেলে ভরে বাবার হাতে চাবি দিয়ে দেওয়া গেলে স্বস্তি পেতেন । আমি বড় হতেই অন্য অভিসন্ধি আঁটছি যদিও।
তারপরের দিন ঠাম্মা নয়তো মা হাঁটিপাড়ার সব ঘরে মিষ্টি দিয়ে আসতেন।
এখনের সময়টা অনেক বেশি চিন্তার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অকাতরে মিষ্টি দেবো তো কেন দেব।
এখন অবশ্য আমাদের দোকানও নেই।
ছোটবেলায় ক্লাস ফাইবে থাকতে কল্যাণ ট্রাস্টের বৃত্তি পরীক্ষা, খন্দকার ট্রাস্টের বৃত্তি পরীক্ষার সিট দোকানের পাশের স্কুলে পড়ত। তারপর আনন্দ নিকেতন থেকে শুক্র শনিবারের গানের ক্লাস করে আসার রাস্তায়ও দোকান পড়ত। দোকানের পাশ দিয়ে গেলে বুকে বল পেতাম, বা ভেতরে ঢুকে পড়া উচিত।
আমি দেখেছি জগতে যত প্রশ্ন, নতুন এবং পুরাতন, এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক, বাবা আজীবন সব আহরণ এবং পেশ করা থেকে বিরত থেকেছেন। বরং
“কিছু খাবি?”
অনুরাগ স্টলের বরং মিষ্টি আনাই। সিরাটাও খেয়ে ফেলা যায়। সিরা পেটের জন্য ভালো নাকি। আমি পেছনের গুদামে লুকিয়ে লাল মিষ্টিটা অশেষ কাকু অথবা দীপক কাকু বা নৃপেন কাকু, বা গজার কাকু বা উৎপল কাকুকে দিয়ে দিতাম, যখন যাঁরা যাঁরা দোকানে থেকেছিলেন।
ছোটবেলায় বড়দের একটা চল ছিল ছোটদের দুধ খাওয়ার বা নন্টু টিপার। প্রায় প্রত্যেক কাকু মামা আমার সুতির গোল জামা উল্টে দুধ খেয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছেন। তাঁদের মঙ্গল হোক। এরকমই নিয়ম। আমি তো মা ছিলাম। মায়ের একটা কর্তব্য থাকে। চাই একই ক্লাসের মামা কাকা বাবা হোক, চাই নিচু ক্লাসের। একদিন কর্মচারী নৃপেন কাকুও বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে যাওয়ার সময় দুধ খেল। কী করার। জগতে এক জীবের অন্য প্রাণের প্রতি কর্তব্য আছে।
ছোটবেলা এক আশ্চর্য মাটির তাল। কার হাতে জানিনা।
আমরা সেলুনে যে চুল কাটতে যেতাম, সেই আয়না থেকেও দোকান দেখা যেত। আমি শেষ পর্যন্ত জড়োসড়ো হয়ে আয়নায় দোকান দেখতে থাকতাম। সেখানে ক্যাশে নাহ বাবা বসে আছেন অন্তত। সঙ্গে ভাই থাকলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ভাই একটা সময় সঙ্গ ছাড়া হয়ে নতুন বন্ধুদের দলে চলে গেছিল। এবং সে স্কুল থেকে ফেরার পথে চুল কেটে আসত। চুল কেটে আসার সময় দোকানে বম্বে পটেটো চিপস বা কাঁচের বোতলে প্রাণ আমের জ্যুস খেতাম। একদিন গ্লিটার মেহেদি আর আলতা আর টিপ নিয়ে ফিরলাম৷ পাশের বাড়ির এক দিদা বলল, নাও, এতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে। বটেই, রিষ্টিনাশা, মরে যাও। দোকানটা আমার কাছে আলিবাবার ট্রেজারের মত ছিল। আমি যেন আচারের বা চিপসের লটের ভেতর ঢুকে কোথাও হারিয়ে যেতে পারব, যেমন হারিয়ে যাওয়া যেত শীতের রোদে দেওয়া লেপ কম্বলের ভেতর। তবে লট পেড়ে বাড়ি আনা যাবেনা ততটা। আবহমান কাল ধরে, যেন এইসকল কাঁচের আচারের বয়ামগুলো দোকানের দেয়ালে ঠাঁয় বসে আছে। চিপসের বস্তাগুলো নধর দেহে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ অবধিও দাঁড়িয়ে থাকবে। রাতের পয়তাল্লিশ ওয়াটের হলুদ লাইটের তলে, সকালের ধূপকাঠির গন্ধ আর ওঁ ধ্বনির মাঝে, চালার বৃষ্টির শব্দয়।
বিপরীত পাশে শুঁটকির বাজার আর মাছের আড়ৎ। বাবা-কাকুরা দোকান থেকে বাড়ি ফিরলে শরীর থেকে একটা শুঁটকি, মাছ আর বাজারজাত ঝামেলা মিশ্রিত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। আমি এই গন্ধ পছন্দ করি ভাবলে। বাবা বলতেন ‘এসব সাম্রাজ্য আমার বাবার হাতে গড়া। এখনো বিপদে পড়লে হিন্দু-মোসলমান মাইমলরা লাঠি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে।” যেন, ছোটলোক বটে কিন্তু অনুগত ভদ্র এবং ভালো। আমি সমস্ত যত বর্ণবাদ শিখে শিখে বড় হয়েছিলাম।
মা পুকুর থেকে ফিরে এলে মাকে বললাম, মা সন্ধ্যার নিদ্রা আমি দিই? মা ক্লান্ত আর একই সাথে দেবতাগণের তরে আনুগত্যের দ্বিধায় পড়ে তখন। কারণ আমি কখনোই বিশ্বাসযোগ্য ছিলাম না।
ছোটবেলায় একবার শুনলাম ঊমা পিসি গুরু খাওয়ানোর দীক্ষা নিয়েছেন৷ এই মন্ত্র জানা থাকলে নাকি দুই হাত এমন শুদ্ধ যে সমস্ত গুরুকে রেঁধে খাওয়ানো যায়। এমনকি ঈশ্বর বাবনের কিংবা ভিক্ষুকের রূপ নিয়ে এলে তাঁকেও। কোনো গুরু নিজে রেঁধে খেতে চাইলে তাঁকে কুটে বেটে রান্নায় সহায়তা করা যায়। আমার মনে হতো, এই যদি রাতের অন্ধকার ধরে কল্কি অবতার সাদা ঘোড়ায় চড়ে আসেন, এসে উঠানে থামেন? তখন ঊমা পিসিকে ডাকতে হবে।
আর কোনো গুরুদেব যদি রান্না ঘরে একা রাঁধেন ঊমা পিসির সঙ্গে, তখন তো ঊমা পিসি তাঁকে শর্ষে জিরা বেটে দিতে থাকবেন। বাটতে বাটতে ঊমা পিসির কোমড় দুলতে থাকবে। তখন যদি গুরুদেব কিসসার মতো পিসির কোমড়ে চিমটি কেটে বসেন?
মায়ের ক্লান্তি দেখে দয়া করে ভগবানের ঘরে ঢুকলেও দুই মিনিটে কাজ লিপটে কাপড় পরে চলে আসি আমি। মাও কুপিত কিনা, সেই ভগবানকে নিয়ে শঙ্কায় আর দুশ্চিন্তায় থাকেন। তবু মায়ের ইহজাগতিক সহজাত ক্লান্তি জিতে গিয়ে আমাকে ভগবানের ঘরে ঢুকতে অনুমতি দেয়। মা বললেন, দিবায় নিদ্রা? দ্যাও তাহলে।
আমি ঢুকে পড়ে দরজা লাগিয়ে দিই। দুই মিনিটের মাথায় দরজা খুলে চলে আসি।
মাঝের ঘরের টেবিলে এনে ঠাকুরের প্রসাদ রাখি। মা আমার দিকে তাকান। মাও সত্য জানেন, আর আমিও জানি মায়ের সত্য জানার কথা। আমরা আমৃত্যু কারোর চোখের দিকে কেউ তাকাবো না।
ক্লান্তি যেহেতু জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ক্ষণে প্রায়শই জিতে যায়, মা আমাকে বলেন, কী গো এতো তাড়াতাড়ি খাইয়ে চলে এলে? খাওয়া শেষ উনাদের?
হ্যাঁ, প্রসাদের প্লেট মাঝের ঘরে রেখে এসেছি।