গদ্যস্মৃতিগদ্য

গোমুড়া গ্রামের নিস্তব্ধ দুপুর

স্মৃতি কথা

চৈত্রের রৌদ হাতছানি দিয়ে ডাকছে অথচ বের হব কি করে? চৈতমাস এলে (দিদিমার) পিসিমার বাড়ির কথা মনে। গোমুড়া গ্রামের নিস্তব্দ দুপুরে একটা অভিমানী তিলা ঘুঘু আর নিসংগ ডাহুকের ডাক করাতের মতো দু-ভাগ করে দিত দুপুরের প্রতিটি পদক্ষেপ আর আমাদের ঘোরাফেরা। বাঁশঝাড়ের এককোনায় ছাইয়ের গাদা থেকে সদ্য সকালের ঘুম শেষে আড়মোড়া দেওয়া গুইসাপটাও যেনো বলতো, ‘চল ওদিকে যাই, যাবি আমার সঙ্গে? তোকে মাছধরা শেখাব।’

চৌচালা মাটির ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের বুক চিরে শেওলা-মাখা শক্ত সাদা মাটির রাস্তায় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দাগ কেটে কেটে পুকুরপাড় পর্যন্ত চলে যেতাম। আর রান্নাঘর থেকে দিদিমা গলা চড়িয়ে ডাকতো এই ভর দুপুরে কোথাও যাইস না নাতি! বাগডাস আছে। কে শুনে কার কথা। এদিকে ঘরে (দিদিমার)পিসিমার স্নানের প্রস্তুতি চলছে আসন (পূজা) দেবেন বলে। প্রতিদিন দুপুরে কড়া রোদে বিড়ি ফুকে,স্যান্ডেলের তলায় চেপে স্নান করতে রওনা হতেন পুরকুর পাড়। আর দিদিমা,তার পিশতুতু বোনকে নিয়ে রান্নাঘরে। কেউ পাটায় মশলা বাটে তো কেউ মাটির চুলায় ডাল-তরকারি চরিয়ে সুখ-দুঃখের, দরিদ্রতার আলাপে মগ্ন। আর কানপচা পুতুল? কত দুষ্টুমিই না করতাম আইবুড়ো হয়ে যাওয়া পুতুলের সঙ্গে। যার কান্ডজ্ঞান রান্নাঘরে এক কোনে পোতা লাউয়ের ডগার চেয়ে এক রত্তিও বাড়েনি। হয়তো বাড়বেও না কোনোদিন। হয়তো আজও বাড়েনি। আজ মাঝ দুপুরে যখন এইসব স্মৃতি হাতরে বেড়াই, বারান্দায় চড়ুই এর অনাকাঙ্খতি ডাকের মতো পুতুলও এসে পেছন পেছন ডাক দেয়, আর বলে-‘এই বাবু যাবি না চল, পুকুরে স্নান করি, তোকে কলার ভেলায় চড়িয়ে ধাক্কা দিব এপার থেকে ওপার যাবি। শুন,কিচ্ছু বলিসনা আমার কথা, যখন তোকে জিজ্ঞেস করবে মাসি (দিদিমা), আদরি মাসিকে বলবি কলার ভেলা পুকুরেই ছিলো, আমি চড়িনি, আমি কিচ্ছু জানি না।’

সম্পর্কিত

কইডা(চিচিঙ্গার) ক্ষেতের নিচে পাশাপাশি শুয়ে থেকে কতদুপুর দুজনে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি তার হিসেব করলে ফলাফল টেবিলের সামনে রাখা মাটির জগের হাতল উপচে পড়বে।


হঠাৎ বিদ্যুত চলে গেলে স্তব্দ হয়ে যাওয়া ফেনের ঘূর্ণির মতো আচমকা উধাও হয়ে যায় পুতুল। কানপচা পুতুল। মাঝের ঘরে ধানের গোলার আড়ালে টেনে নিয়ে কত গল্প করতে চাইতো অথচ তাকে পাগলই ভেবেছি। পুকুরে দুপুরের স্নান শেষে রৌদে শুকানোর শরীরে আমাকে কতদিকে নিয়ে যেত পুতুল! কারো ক্ষেতের পাকাটমেটো পেড়ে খেতাম তো কারো বাড়ির বেল। কইডা(চিচিঙ্গার) ক্ষেতের নিচে পাশাপাশি শুয়ে থেকে কতদুপুর দুজনে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি তার হিসেব করলে ফলাফল টেবিলের সামনে রাখা মাটির জগের হাতল উপচে পড়বে। কী সহজ-সরল-চঞ্চল সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মেয়েটি আজ এত ডালপালা গজিয়েছে যা আমাকে ছাড়িয়ে ঐ শূন্য অতল আকাশকেও স্পর্শ করে। আচ্ছা আমাকে কি পুতুলের মনে পড়ে? কিংবা বাঁশঝাড়ে ক্লান্ত যে ঘুঘুর ডাককে পেঁচার ডাক বলে হাসাহাসি করতো সেই পেঁচাকে? মুসলিম বাড়ির কলপার ঘেঁষে লাগানো ঝুমকো জবা গাছ থেকে এক লাফে একটা জবা ছিঁড়ে কানে গুজে যেই আমার হাত ধরে পুতুল ঘরে ঢুকতো অমনি সবার বকা পুতুলকে কাঁদিয়ে দিত। যেনো তার সমস্ত সংসার কেউ ছিন্নভিন্ন করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যে সংসারে একমাত্র খেলার সাথী আমি। ছোট্ট আমি। কালো আমি। সন্তানের মতো আমি। পিড়িতে বসে সামনে ভাতের থালা নিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতাম পুতুলের কান্নার দিকে। আমার কি সাধ্য তাকে সান্তনা দিই… আজ ব্যস্ত,রোজগারের ধান্দা মাথায় নিয়ে ভেসে বেড়ানো এই অনাত্মীয় ঢাকা শহরে যখন ক্লান্ত কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা অন্তর্জাল-তরঙ্গের ঢেউয়ে টোপাপানার মতো ভেসে চলে তখন অভিমানী দুপুরে পুতুলদের কান্নাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হয়তো চিরতরে, হয়তো ক্ষনিকের জন্য।

শেখেরটেক-৬ (২৯.০৩.২০)

আপনার মতামত জানান

অজিত দাশ

অজিত দাশ; কবি ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৯ কুমিল্লা শহরে। কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা । কাজ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রকাশিত বই- ওশোর গল্প (বেহুলাবাংলা, ২০১৮) ও প্রজ্ঞাবীজ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।