গল্প

ক্রমাগত চুম্বনের খেরোখাতা

গাছের তলায় যে শানবাধানো বেদি তার ওপর ফুল ছড়িয়ে দিলেন আখতার সাহেব, তার দেখাদেখি বাকিরাও। বকুল পড়িমরি ঘর হতে বেরিয়ে এসেছিল, ফুলতো আনেনি, এদিক-সেদিক খুঁজেপেতে কিছু জবা আর বুনোটগর পেয়ে গেল, সেসবেই কাজ হয়ে গেল তার।

এক.
কুল তখনো নাশতা খাওয়া শেষ করেনি, যখন মিছিল ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ছেলেমেয়েগুলো প্রভাতফেরিতে। আজকাল প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে হেঁটে যাবার কথা শুনলেই মনে হতে থাকে এরা কারা? বা কোথা হতে এসেছে, কোন ধরনের মানুষ কিংবা এই যে যেখানে যাচ্ছে সেখানে গিয়ে কী পায়! এমন আজব প্রশ্ন বকুলের মনেও যে জাগেনি তা নয়, জেগে উঠতে না উঠতেই আখতার সাহেবের খপ্পরে পড়ে সে অবস্থাতেই প্রশ্নগুলোর অকালমৃত্যু ঘটেছে।

ভোরে উঠেই পাউরুটির ভেতর মাখন ডলতে ডলতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সে, আর যখন অদ্ভুত মানুষগুলো কী এক আজব গান গাইতে গাইতে কেমন এক পরাবাস্তব ও নষ্টালজিক সুরে শহিদ মিনারের দিকে এগুচ্ছে; ফুটবলের মতো গোল হয়ে থাকা গালভর্তি পাউরুটি নিয়ে এক দৌড়েই নিচে নেমে আসলো সে। মিছিলের শেষতম সঙ্গী হয়ে ধীরে ধীরে ভোরের কুয়াশায় সামনের দিকে হারিয়ে গেল শেষে।

সম্পর্কিত

বেশ কিছুদিন আগে আখতার সাহেব বকুলকে বলেছিলেন তার সাথে প্রভাতফেরিতে যেতে, বলেছিলেন এক অচেনা ও আজব শহিদ মিনারে নিয়ে যাবেন তাকে, আরও বলেছিলেন সেখানে জীবন্ত মানুষ দণ্ডায়মান যার পায়ে তারা ফুল দেবেন। কেমন অদ্ভুত সব কথা আখতার সাহেবের! বকুল না গেলে তো মিস করবেই তারওপর আখতার সাহেবের সাথে কোথাও যাওয়ার মানে হলো নতুন কোনও অভিজ্ঞতা আর তামাশার ‘ডেইট অব বার্থ’।

মিছিল ততক্ষণে শিমুলতলার দিকে যেদিকে রেলপথ দুইদিকে ভাগ হয়ে গেছে তার মাঝখানে সোজা জলা ও জঙ্গলের দিকে নেমে গেল। বকুল তখন একেবারে সামনে, আখতার সাহেবের সাথে হাঁটছে। মুখের খাবার ততক্ষণে শেষ এবং হাতে করে যে পানির বোতল নিয়ে এসেছিল তাতে চুমুক দিতে দিতে আখতার সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো—

এইদিকে আবার শহিদ মিনার কোথায় পাইলেন?

—যেতে থাক। কথা বাড়াস না।

না মানে এইটাতো জঙ্গলের রাস্তা, এতগুলা মানুষ নিয়া জঙ্গলে যাইতেছেন?

আখতার সাহেব একবার বকুলের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালেন। পেছনে তার গোটা পনের-বিশেক মানুষ, কারো কোনো আগ্রহ নেই বকুলের প্রশ্নে বা আখতার সাহেবের উত্তরে, সবাই যেন ভূতগ্রস্তের মত সামনে চলেছে। তিনি যেতেই থাকলেন, যতক্ষণ না শালবনের ভেতর একটা বড় মাঠ এসে সামনে পড়লো। মাঠের মাঝখানে এক শিমুল গাছ, ভাল করে দেখলে মনে হতে পারে একটা পাকুড় গাছও কিংবা তমাল গাছ বলেও ঠাহর হতে পারে। আসলে এ তিন গাছেরই মিশ্ররূপ, কোনটার ওপর কোনটা ভর করে বেঁচে আছে তা বোঝা কঠিন।


গাছের তলায় যে শানবাধানো বেদি তার ওপর ফুল ছড়িয়ে দিলেন আখতার সাহেব, তার দেখাদেখি বাকিরাও। বকুল পড়িমরি ঘর হতে বেরিয়ে এসেছিল, ফুলতো আনেনি, এদিক-সেদিক খুঁজেপেতে কিছু জবা আর বুনোটগর পেয়ে গেল, সেসবেই কাজ হয়ে গেল তার। আখতার সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করে বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাহ্! দারুণ বুদ্ধি তোর! ভাল করেছিস।


মিছিল এসে এই শিমুল, তমাল বা পাকুড় গাছের সামনে দাঁড়ায়। একটা বেদি আছে পাকা করা, জায়গায় জায়গায় যা ফেটে আছে, বেরিয়ে এসেছে ইঁট, আছে কিছু গর্ত, দেখে মনে হয় ইঁদুর ও সাপের আনাগোনাও থাকতে পারে। বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সব, আখতার সাহেব এ কোন জায়গায় নিয়ে এলেন তাদের আর এমন অদ্ভুত অজানা গাছ, দেখে সে বিস্মিত!

গাছের তলায় যে শানবাধানো বেদি তার ওপর ফুল ছড়িয়ে দিলেন আখতার সাহেব, তার দেখাদেখি বাকিরাও। বকুল পড়িমরি ঘর হতে বেরিয়ে এসেছিল, ফুলতো আনেনি, এদিক-সেদিক খুঁজেপেতে কিছু জবা আর বুনোটগর পেয়ে গেল, সেসবেই কাজ হয়ে গেল তার। আখতার সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করে বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাহ্! দারুণ বুদ্ধি তোর! ভাল করেছিস।

আখতার সাহেবের প্রশংসায় বকুল বেশ খুশি হলো। এমনিতে মানুষ তার প্রশংসা করে না, কিন্তু যখন কেউ করে বিশেষ করে আখতার সাহেব তখন মনে হতে থাকে যে বেঁচে থাকাটা তার জন্য অনেক আনন্দের, হয়তো এ কাজগুলো করার জন্যই সে বেঁচে আছে বা তাকে স্রষ্টা পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে এইগুলো করতেই।

আখতার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, তাই না?

থতমত খেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বকুল বলে উঠলো, ওমা আপনে কেমন কইরা জানলেন আমার মনের কথা!

—তোর মনের কথা আমি না জানলে জানবেটা কে?

তাই বইলা এত অবিকল ধরতে পারলেন?

—কেন আমি কি বলেছি সে কথা যা তুই ভাবছিলি?

ও মা, বললেন না যে, ‘তাই না?’

—হা বলেছি, তুই যে পকেট থেকে পুরনো শুকনো গোলাপটি বের করে এখানে দিয়েছিস তা দেখেই তো বললাম।

ও আচ্ছা, আমি ভাবছিলাম আপনি আমার ভাবনার কথা ধইরা ফেলছেন।
গোলাপ ফুলটাতো আপনিই আমারে দিছিলেন যেদিন আপনার সাথে প্রথম দেখা হয়, আর বলছিলেন রাইখা দিতে ততদিন যতদিন না কোনো উপযুক্ত স্থানে তা অর্পণ করা যায়।

—তো, এটা তোর সে উপযুক্ত স্থান?

তাইতো, সবাই যেইভাবে ফুল দিল তা দেইখাতো মনে হইলো আমার, এমন যায়গাইতো উপযুক্ত আপনার সেই ফুলের জন্য।

—যাক তাও ভাল, আমি মরে গেলে আমার কবরের জন্য অপেক্ষা না করে এখানেই দিয়ে দিয়েছিস—হেসে বললেন আখতার সাহেব।

ওমা, এমন কথা কইলেন কেন! আপনার সমাধিতে এই পুরানা শুকনা গোলাপ? আমিই তো আছি, আমারেই না হয় বিসর্জন দিব।

বকুলের এমন আজব কথা শুনে আখতার সাহেব কেমন উদাস হয়ে গেলেন, চোখ ছলছলে। বকুলের সাথে বেশিদিনের যোগাযোগ নয়, মাত্র কিছুদিনের সাক্ষাত। এরই মাঝে নিবিড় এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বকুলের বাবা নেই। আখতার সাহেবের পাল্লায় পড়ে অনেক কিছু জেনেছে, বই পড়েছে আজব সব বিষয়ের; যত না জেনেছে-পড়েছে তার চেয়ে বেশি দেখতে শিখেছে; কেমন করে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যে সম্পর্ক আসলে অজানালোকের পরশপাথরের মত। আখতার সাহেব যার স্পর্শ দিয়েছেন তাকে।

কিন্তু সেই মানুষ কোথায়? যাদের পায়ে আপনার ফুল দেবার কথা? বকুলের জিজ্ঞাসা।

আখতার সাহেব অনেকক্ষণ চুপ থেকে এরপর বললেন, এ গাছ বা মিশ্র গাছগুলো, যেখানে আমরা বসে আছি, সেখানে এককালের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রুস্তম আলী জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেছিলেন। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি এ গাছতলাতেই থাকতেন। এখানে একটি ছাউনি ঘর ছিল। তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা ছিল বলে এখানেই তিনি লুকিয়ে থাকতেন। তখন এ জায়গাটা ছিল আরও গভীর অরণ্য। এভাবে লুকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার ভেতরে উদাসী এক সত্তার জন্ম ঘটে। কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে যেতে লাগলেন। লোকে তাকে সাধুজ্ঞান করে নাম দিয়েছিল লালুচাঁন মাস্তান। তাঁর ডাকনাম ছিল লালু। তো, একসময় তিনি স্থায়ীভাবেই তার সঙ্গীদের নিয়ে এ গাছতলায় বাস করতে লাগলেন। যদিও তার অন্যান্য কমরেড সঙ্গীরা অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লালুচাঁন ফকিরের আর যাওয়া হয়নি, এখানেই কাটিয়েছিলেন একাত্তর সাল পর্যন্ত।

—একাত্তরের পরে? কোথায় গেলেন তিনি তখন? প্রভাতফেরিতে আসা একজন প্রশ্ন করলেন।

না, তাকে মেরে ফেলা হয় তখনই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও অর্থদানের। যুদ্ধ যখন মধ্যবর্তী তখন কোনো এক সময় খুব বাজেভাবেই খুন করা হয়। তার শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নানান জায়গায় পুঁতে রাখা হয় বলে লোকমত আছে। যুদ্ধের পর যদিও এসব খুঁজে পাবার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তার ভক্তদের নিষেধ ছিল বলে তা করা যায়নি। এই অদ্ভুত গাছটিই যেন তার মূর্তিমান কায়া ও শোকবিধুর শহিদ মিনার। গাছটি হতে একটু পেছনের দিকে এগুলেই কয়েকটি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এসব তার ভক্তবৃন্দ ও অনুসারীদের আশ্রমঘর। আজ এখানে মৌনবাস, চল্লিশ দিন তারা এ মৌনবাস সেরে চল্লিসার পর মেলা বা ওরসের আয়োজন করে প্রতিবছর। তখন হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। কথাগুলো বলতে বলতে আখতার সাহেব নিজেই সে দিকে হাঁটা ধরলেন।

এই যে বকুল, সিদ্ধ হওয়া আর সিদ্ধিপান এক করে দেখিস না, অনুকরণ করে যদি খেতে চাস তবে গাঁজাখোরের মর্যাদা পাবি, পবিত্রজ্ঞানে মাসুম হয়ে বাঁশিতে হাত না দিলে পাপ হয় রে।

 

দুই.
শান্ত ও স্তব্ধ শালজঙ্গলের আলো-ঝলমল সকালে পাখির কিচিরমিচির আর ঝরাপাতার খসখস শব্দে পায়ে পা বাড়িয়ে আশ্রমঘরের দুয়ারগুলোর দিকে চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মনে হলো আখতার সাহেব। বড় ঘরটির দিকে যেতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন সালামত মাস্তান ওরফে কিনু পাগলা, এ পাগলই লালুচাঁন ফকিরের আস্তানা ও সমাধির প্রধান সেবক। আখতার সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মৌনবাসের দিনসকল, তাই বেশি কথা না বলে আশ্রমঘরটির বারান্দায় বসলেন। হোগলামতন আসনে বসে তারা কিছুক্ষণ তামুকসেবন করলেন যদিও আখতার সাহেবের তামুক বা সিদ্ধিসেবনের নেশা তেমন নেই তবু এখানে এলে মাঝে মাঝে তার সেবা নিতেই হয়, নইলে সাধুসঙ্গের আদব রক্ষা পায় না।

বকুল ও তার সাথে অন্যান্য সঙ্গীদের কয়েকজন তখন সামনেই বসে বসে এসব দেখছিল, কলকে বা সাধুদের ভাষায় বাঁশিতে কয়েক টান দিয়ে বকুলের পাশে বসে থাকা মতিয়ারের হাতে তা দেবার পর বকুল একটু দূরে সরে গিয়ে সিদ্ধিসেবনের নিয়ম বা কায়দাটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলো।

এই যে বকুল, সিদ্ধ হওয়া আর সিদ্ধিপান এক করে দেখিস না, অনুকরণ করে যদি খেতে চাস তবে গাঁজাখোরের মর্যাদা পাবি, পবিত্রজ্ঞানে মাসুম হয়ে বাঁশিতে হাত না দিলে পাপ হয় রে।

—এ আবার কেমন পাপ!

ওই যে, একাগ্রচিত্তের চিত্তনাশা আত্মভোলা মন, সহজে যা সই হয় না, ধরা দেয় না। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। ভাবে ধরা দেবেন তিনি সে দয়াময় আলেক সাঁই কিন্তু আসলে তা নিজেরই মন, সে মনচোরারে ধরাই আসল কাজ; সিদ্ধিসেবন বাহানামাত্র।

—তবে যে সাধুরা তা সেবন করেন মামা।

করেতো, আবার করেও না। যে কারণে করে থাকে ঠিক সে কারণেই করে না।

—কেমন উলটপালট কথা হইয়া গেলো না? করে আবার করে না!

এমনই, এটা ধর ওই চাপকলের মত, তাতে পানি না আসলে তখন উল্টো কিছু পানি ঢেলে চেপে চেপেই টেনে আনতে হয়। এ হলো গভীরের সূক্ষ্মজলকে বাইরের স্থুলজলের স্পর্শশক্তি দিয়ে টেনে আনা। এ স্থুলতা হলো কফির পেয়ালায় পুরু ফেনা বা ফোমের মত, যার তলায় আসল কফি কিন্তু ফেনা না থাকলে কফির ভেতর থেকে মানসকফির স্বাদটুকু চুম্বকের মত টেনে আনবে কে?

আখতার সাহেবের এমন সব আজব কথাবার্তায় কিনু পাগলা মৌনবাস ভেঙে হাসতে থাকেন।

—আপনি যেইখানে থাকেন সেইখানে আর চুপ থাকা যায় আখতার ভাই? আপনার কাছে নীরব থাকা আর সরব থাকা কোনো কিছুরই কোনো বিশেষ মাহাত্ম্য নাই। আপনি চলেন শিশুর মতন বেখেয়ালে, দিলপরিষ্কার মানুষ। কন আপনে কথা কন, অনুমতি দিলাম, আমরা শুইনা আনন্দ পাই।

কিনু পাগলার কথায় অন্যরাও সায় দেয়, দূরে থেকে আরো কিছু ভক্ত কাছে এসে আশ্রমঘরের সামনে এসে বসে। রোদ তখন আরো তেতে উঠেছে, একটা বিরাট বড়ই গাছের ঝিরিঝিরি আলোয় আর অচেনা নানান পাখিদের ডাকে মৌনবাসের রহস্য আরো ধিকিয়ে ওঠে, তারওপর আখতার সাহেবের আলাপ-সালাপ।


আজহার ফরহাদ-এর আরও গল্প
কথাগাড়ি ও তার গন্তব্য                       ● নিবিড় এক আনোখা তামাশাময় গল্প


তিন.
ভোরবেলা যখন ঘর হতে বেরিয়েছিলেন তখন ফারজানা আপার মানে আখতার সাহেবের স্ত্রী, তার কপালে চুমু খেয়ে এসেছিলেন। যদিও, ফারজানা আপা ঘুমে অচেতন তবু, সে অচেতন অবস্থা থেকেও যে তিনি টের পান তার স্বামীর চুম্বনস্পর্শ সেটা তার মুখের হাসি দেখেই বোঝা গিয়েছিল, যে হাসিই ছিল আসলে তার সকালবেলার নাশতা। আলাপে আলাপে মশগুল যে তিনি এখন, এই হলো তার প্রধান রহস্য যা এখানে কেউ জানে না কেবল প্রয়াত কমরেড রুস্তম আলী ওরফে লালুচাঁন পাগলা ছাড়া।

ফারজানা আপার সাথে আখতার সাহেবের পরিচয় লালুচাঁন পাগলের মাধ্যমেই। কমরেড রুস্তম আলী ছিলেন ফারজানা আপার নানা, যাঁর কোলেপিঠে তিনি মানুষ হয়েছিলেন, সবচেয়ে আদরের নাতনীকে তিনিই আখতার সাহেবের সাথে যুক্ত করেছিলেন, সে অবশ্য ফকিরি ধরবার আগেই, যখন তার ঘনঘন জঙ্গলে আসা হতো এবং ঘোরগ্রস্ত এক উদাসীন দিব্যপুরুষে পরিণত হবার শুরুর দিকের কথা। আখতার সাহেব ছিলেন তাঁরই কমরেড শিষ্য, যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন এবং কাছে কাছে রাখতেন।

তো এই কাছের প্রিয় শিষ্য শেষপর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ছাড়ে নাই, যদিও কমরেড রুস্তম আলী তাকে সবসময় জঙ্গলে থাকতে দিতেন না, সমাজ পরিত্যাগ না করার শপথও আখতার সাহেবের কাছ থেকে তিনি আদায় করে ছেড়েছেন। রাজনৈতিক গুরুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার নাতনীকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছিলেন দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে।

ফারজানা আপা তখন পুরোদমে স্কুলমাস্টার আর আখতার সাহেব কলেজে পড়ান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে বাংলাসহিত্য থেকে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসও পড়াতেন তিনি। তখনকার কোনও এক সময় তাদের বিয়ে হয়, বিয়ে হওয়া মানে একটা আনুষ্ঠানিকতামাত্র, বিয়ের পর থেকে দু’জনই যে যার মত ব্যস্তসমস্ত জীবন তাদের, সাথে সংসারধর্ম, বাচ্চা-কাচ্চা, কখন কোথায় কেমন করে সব হতে থাকলো তা কেউ জানে না, তারাও না!

বনে তখন মৌনবাসের মজমা। এত মানুষ এসেছে কিন্তু কারোই আলাপ-সালাপের বাড় নেই। যে যার মত নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, কেবল আখতার সাহেব গভীর ঘুমে সচেতন, একাই তিনি ঘুমাচ্ছেন, আসলে জেগে আছেন না তার ঘরে ফেলে আসা স্ত্রীর কপালে সেই ভোরবেলার চুম্বনরেখার অভিব্যক্তি খুঁজছেন, বোঝা গেল না।

আচ্ছা, এসব আলাপ কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকছে তার শেষ নেই! যেখানে আখতার সাহেব বসেছিলেন সেখানেই আবার ফিরে যাওয়া যাক। অনেক মানুষ দূরদুরান্ত থেকে সমাধিস্থলে, আসলে যা শহিদ মিনার, মানে যেখানে লালুচাঁন ফকিরকে খুন করা হয়, সে শিমুল বা তমাল বা পাকুড় গাছের নিচে, যেখান থেকে খণ্ডিত লাশগুলোকে এ জঙ্গলের ভেতরই নানান স্থানে পুঁতে রেখেছিল বিশ্বাসঘাতকেরা, অনেক পরে জানা গেল তা ছিল পাঁচ জায়গায়।

সে পাঁচটি স্থান খুঁজে পাওয়ার পর পাঁচটিতেই গড়ে উঠেছে পাঁচ সমাধিস্থল বা দরগা; স্থানীয়রা বলে লালুচাঁন পাঁচপীরের দরগা। এই হলো এতক্ষণের আলাপ-সালাপের শানে নজুল, আখতার সাহেব যেসব কথা তার সাথে আসা সঙ্গীদের শোনালেন। বকুলও শুনলো আগ্রহভরে আরো অনেক কাহিনী যা আসলে মিথের মত, তা খুঁটিয়ে খুটিয়ে শুনতে লাগলো। ধীরে ধীরে মানুষের সমাগম বেড়ে গেল, বেলা বেড়ে দুপুর তখন বারোটা, একটু ঘুম ঘুম ভাব এলে দীর্ঘ আলাপে ক্লান্ত আখতার সাহেব বালিশে কান পেতে শুয়ে পড়লেন গভীর নিদ্রায়। বনে তখন মৌনবাসের মজমা। এত মানুষ এসেছে কিন্তু কারোই আলাপ-সালাপের বাড় নেই। যে যার মত নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, কেবল আখতার সাহেব গভীর ঘুমে সচেতন, একাই তিনি ঘুমাচ্ছেন, আসলে জেগে আছেন না তার ঘরে ফেলে আসা স্ত্রীর কপালে সেই ভোরবেলার চুম্বনরেখার অভিব্যক্তি খুঁজছেন, বোঝা গেল না।

চার.
ফারজানা আপা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার নানার মৌনবাসে যোগ দেবার। নিনা মানে ফারজানা আপার মেয়ে রেডি হয়ে বসে আছে, তার ভাই নিবিড়ও। একটা সিএনজিতে করে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে বাকিপথ পায়ে হেঁটেই যাবে তারা, সঙ্গে মোবারক আছে, দরগা হতে পাঠানো এক সেবক, সেই তাদের নিয়ে যায় প্রতিবছর।

হাতের চুড়িগুলো পাল্টে কানে দু’টি উজ্জল মুক্তার দুল পরে যখন রওয়ানা দেবেন ঠিক তখনই তার কপালে দেখতে পান গাঢ় সিঁদুরলেপা গোলাকার বিন্দু, যেভাবে সিঁদুরের টিপ আগোছালোভাবে দেয়া থাকে। আয়নায় ভালো করে দেখতে গিয়ে তার মনে হলো হঠাৎ ঘুমের ভেতর সে স্বপ্নের কথা; নানা কমরেড রুস্তম আলী, জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ও প্রাণের মানুষ, এখানেই চুমু দিয়েছিলেন।

কিন্তু ফারজানা আপা কী করে জানবেন যে আসলে এ চুম্বন আখতার সাহেবেরই, যিনি শিমুলতলার জঙ্গলে আশ্রমঘরের ভেতর গভীর ঘুমে সচেতন হয়ে ক্রমাগত এখনো তার কপালে চুম্বন এঁকেই যাচ্ছেন, আর ফারজানা আপা কিছুতেই সে দাগ মুছতে পারছেন না, ক্রমাগত মুছেই যাচ্ছেন; আরো আরো গভীর হতে গভীর হচ্ছে সেই দাগ যেন আস্ত এক কৌটা সিঁদুর উবুড় করে ধরে আছে কেউ!

নিনা আর তার ভাই মাকে ডাকছে ক্রমাগত, ওরা জানে মায়ের কোথাও যাবার সময় এমন দেরি হয়ে যায়, ওরা আরো জানে মা তাদের কোথাও বেরুতে গেলে বিশেষ করে তার নানার সমাধিতে যাবার সময় ঠিক করতে পারে না কী পরবে, কী ধরবে, কী করবে—তবু তারা ডেকেই চলেছে, ওরা জানে মা এই ডাক শুনতে না পেলে আরো দেরি করতে থাকবে।

কিন্তু ফারজানা আপা কিছুতেই কপালের দাগ মুছতে পারছেন না; আখতার সাহেব যে ঘুমিয়ে আছেন, ঘুমের ভেতর ক্রমাগত দাগ কেটেই যাচ্ছেন। কে তাকে ডেকে তুলবে? তার এই কিমাশ্চর্যম ঘুম ও স্বপ্ন হতে ডেকে তুলবার শক্তি যার আছে সেই ফারজানা আপা যদি জানতে পারতেন সে কথা!

আপনার মতামত জানান

আজহার ফরহাদ

আজহার ফরহাদ; ভাবুক, শিল্পী ও কবি। জন্ম ১০ অক্টোবর, কুমিল্লায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।