অনুবাদ

কাপাস কা ফুল

সম্পাদকীয় নোট
  • [উর্দু সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক আহমদ নাদিম কাসমি একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক। পাকিস্তানের খোশাব জেলার পার্বত্য গ্রাম আঙ্গায় ১৯১৬ সালের ২০ নভেম্বর তার জন্ম। পাঞ্জাব বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। উর্দু সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ফনুন’ সম্পাদনা করেন দীর্ঘ ৫০ বছর। দৈনিক ইমরোজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। প্রভাবশালী দৈনিক জং পত্রিকায় দীর্ঘদিন ‘রেওয়ান-দেওয়ান’ শিরোনামে সমকালীন বিষয়ে কলাম লিখেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৫০ টিরও বেশি। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৮ সালে লাভ করেন রাষ্ট্রপতি পদক, পাকিস্তান একাডেমি থেকে পান আজীবন সম্মাননা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজেও ভূষিত হন। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ফুল, তাহযিবই নিসওয়ান, আদাব-ই- লাতিফ, সাভেরা ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, চৌপল, সানাতা, কাপাস কা ফুল, গারসে গার তক ইত্যাদি। তার মেয়ে ড. নাহিদ কাসমি ও ছেলে নোমান কাসমি। শক্তিমান এই লেখক ২০০৬ এর ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন। গল্পটি উর্দু থেকে অনূদিত -অনুবাদক]

মূল : আহমাদ নদিম কাসমি
অনুবাদ : ফায়যুর রাহমান

মাই তাজু প্রতি রাতে অন্তত এক ঘণ্টা ঘুমাতো, কিন্তু সেই রাতের গোসা তাকে এটুকুও ঘুমোতে দেয়নি।
এই বয়সে নিঘুর্ম থাকার অনেক সমস্যা। মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরে, বারবার পানির তেষ্টা পায়।
মাই তাজু খাট থেকে নেমে কলসির দিকে পা বাড়াল। কিন্তু দু’ পা এগোতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। খাটের পায়ার সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেল। নিমিশেই সে জ্ঞান হারাল।
বাইরে তখন অদ্ভুত দৃশ্য। ভোরের আলোয় একটু একটু করে রাতের অন্ধকার গলে যাচ্ছিল। চড়ূইরা একে-অপরকে গতরাতের স্বপ্নগুলো বলছিল। কিছু পাখি ডানা ঝাপটে বাতাসে ভাসছিল। মৃদু বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা একটা ভাব ছিল। আর মসজিদে আযান দিচ্ছিল ওয়ারিস আলি।
ওয়ারিস আলির সুরেলা আযানে একটা ঘোরলাগা ভাব আছে। সেদিন এক শিখ চোরাকারবারী গ্রামবাসীকে সকৌতুকে বলছিল, আমি যদি ওয়ারিস আলির আযান আরও দু’-চারবার শোনি, তাহলে আমি আশঙ্কায় আছি কখন জানি মুসলিম হয়ে যাব।
নিস্তব্ধ গ্রামটি যখন ওয়ারিস আলির আযানের সুরে জেগে উঠছে, মাই তাজু তখন মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার সাদা চুলগুলো রক্তে লাল হয়ে আছে।
তবে এটা সত্যি, মাই তাজু আজকাল অজ্ঞান হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতি আট থেকে দশ দিনের মাথায় সকালে বিছানা থেকে উঠার সাথে সাথে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। একবার তো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিল। এমনকি কিছু পিঁপড়া তাকে মৃত ভেবে তার উপর কিলবিল করা শুরু করে দিয়েছিল। তখন প্রতিবেশী চৌধুরী ফতেহ দীনের মেয়ে রাহতান দেয়ালে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল, মাই, আজ লাচ্চি লাগবে না?
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রাহতান ভালো করে তাকাল। তখনই তার চোখে পড়ল মাই অচেতন হয়ে পড়ে। রাহতানের চিৎকার শুনে তার বাবা ও ভাই দৌড়ে এসে বেড়া ভেঙ্গে মাইয়ের চোখেমুখে পানিছিটা দিল। অনেকক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরল। তার মুখে এক চিমটি চিনি দেওয়া হল। তারপর হেকিম মনসুর আলি এসে রোগ নির্ণয় করে বললেন, ‘মাই খালি পেটে ঘুমায়।’

সম্পর্কিত

সেদিন থেকে রাহতানের একটা রুটিন হয়ে গেল, সে সন্ধ্যেবেলা একটা রুটিতে ডাল-তরকারি মিশিয়ে নিয়ে আসে। এর পর মাইয়ের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বসে বসে তার বকবক শোনে।
একদিন মাই বলল, ‘জানিস মেয়ে, আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি কখন উপর থেকে ডাক আসবে। যেদিন দেখবি সকালে তোর বাসায় লাচ্চি নিতে আসিনি, বুঝবি চলে গেছি। তারপর তুই এসে আমার খাটের নিচ থেকে ওই বাক্সটা বের করবি, ওতে আমার কাফন রাখা, আমি তোকে দেখাবো।’ মাই একটু থামল। ‘ওয়ারিস আলিকে বলবি মৌলভী আবদুল মজিদ এতে পবিত্র মাটি দিয়ে কলেমা শাহাদত লিখেছেন। আমি ভয় পাচ্ছি বারবার বের করার ফলে মাটিগুলো না ঝরে পড়ে যায়! আমার কাফনের কাপড় সম্পর্কে তুই শুধু এটুকু বুঝে নে মেয়ে, এটা সেই কাপড় যা শুধু রাজকন্যাদের জন্য বানানো হয়। শিমুল ফুলের বিশেষ তুলো দিয়ে এই কাপড় তৈরি হয়। এটা আমার অনেক কষ্টের অর্জন। আমি সারাজীবন মানুষকে গম পিশে আটা দিয়েছি, আর বিনিময়ে তাদের থেকে কাফন নিয়েছি। আচ্ছা মেয়ে, এটা কি মন্দ ব্যবসা ছিল? ছিল না, না? আমি ভয় পাচ্ছি, খদ্দরের কাফন পরে গেলে মানুষ আমাকে জান্নাতেও চাক্কি দিয়ে গম পিশায় লাগিয়ে দিবে।’
তারপর মুখটা হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করল, ‘তোকে কাফনটা দেখাই, মা?’
রাহতান ভয়ার্ত সুরে বলল, ‘না মাই, থাক, পবিত্র মাটিগুলো যদি ঝরে যায়!’
তারপর প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করল। ‘এখনো তুমি আরও বিশ বছর বাঁচবে। তোমার কপালে পাঁচটি রেখা আছে। চার পাঁচে বিশ।’

মাইয়ের হাত তৎক্ষণাৎ কপালে উঠে গেল। ‘পাঁচটা কই মেয়ে, চারটা আছে’। পঞ্চমটা তো উঠে গেছে। তুই যদি ছুরির ডগা দিয়ে টান মেরে রেখাটি মিলিয়ে দিস, আরও কিছু দিন বাঁচতে পারি। তোদের ঘরের আরও থোড়া লাচ্চিও খেতে পারি।’
মাইয়ের শুকনো মুখে এবার একটা গোলোমোলো হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে ভর করে জোরে একটা হাসি দিয়ে রাহতান কেটে পড়ার প্রস্তুতি নিল। কিন্তু ততক্ষণে মাই বাক্সটা খুলে ফেলেছে। কর্পূরের গন্ধে চারদিক ভরে গেছে। রাহতান চেষ্টা করেও কাফন আর জানাজা থেকে রেহাই পেল না। কারণ এগুলো মাইয়ের প্রিয় বিষয়।

মাই তাজু সর্বক্ষণ মৃত্যুর গল্প করে। যেন মারা যাওয়াই তার সবচে বড় প্রাপ্তি। একবার রাহতান মজা করে মাইকে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল, মাই মারা গেলে সে নিজে তার কাফন পরিয়ে দেবে। তার বাবাকে বলে মাইয়ের জন্য একটি শানদার জানাযার ব্যবস্থা করবে। এটা শুনে মাই এত খুশি হয়েছিল, মনে হয়েছিল সে নতুন জীবন পেয়েছে।
রাহাতন ভাবে, এটা কত বড় দুর্ভার্গে্যর বিষয় যে, মাই মারা গেলে তার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলার মত একটা মানুষও পৃথিবীতে নেই। অথচ কিছু মৃত্যু কত শান্তির, কিছু মৃত্যু কত নির্জন। রাহতানের ছোট ভাই যখন কূপে পড়ে মারা গেল, সেখানে কী এক আশ্চর্য মাতম ছিল শোকের। অনেক দিন ধরেই তার জন্য ফাতিহা পাঠ চলল। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত তার কবরে। অথচ সেই সময়েই করিম নাইয়ের বাচ্চাটা নিউমোনিয়ায় মারা গেল, তার জন্য শোকযাপনের কিছুই দেখা গেল না, বরং যেদিন বাচ্চাটা মারা গেল, সেদিনও করিমের ঘরের চুলাটা ঠান্ডা ছিল। তৃতীয় দিন চৌধুরী ফতেহ দীনের কাছে করিম চিঠি লিখলÑ মৃত্যুতে এমন পার্থক্য করা উচিত নয় সাহেব। মারা গেলে তো সবাই সমান হয়ে যায়। সবাই একই মাটিতে দাফন হয়। ধনীদের কবরের জন্য তো বিদেশ থেকে মাটি আনা হয় না, সবার জন্যই দেশের মাটি।

একদিন রাহতান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা মা, সত্যিই কি পৃথিবীতে তোমার কেউ নেই?’
মাই মুচকি হাসল। ‘কেন থাকবে না!’
‘আচ্ছা!’ রাহাতন অবাক হল।
মাই বলল, ‘আছে, একজন আছে।’
রাহাতন খুব খুশি হল। আজ মাই তাকে এমন একটি গোপন কথা বলছে যা গ্রামের বড়রা জানে না।
অধীর আগ্রহে রাহতান জিজ্ঞেস করল, ‘সে কোথায় থাকে?’
‘সে?’ মাই হাসতে লাগল, ‘সে এখানেও থাকে, ওখানেও থাকে। পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে সে থাকেন না। সে সীমান্তের এপাশেও থাকে, ওপাশেও থাকে। সে তো…’
রাহতান মাইকে থামিয়ে দেয়। ‘আরে বল কে সে?’
মাই একইভাবে হেসে যায়। বলে, ‘কে আবার? ঈশ্বর ছাড়া আর কে?’

রাহতান তার বাবার কাছে শুনেছে আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে গ্রামের এক পাটোয়ারী মাই তাজুকে এখানে নিয়ে এসেছে। লোকে বলে, সেকালে মাই তাজু এত সুন্দরী ছিল যে, রাজাদের যুগ হলে মাই নির্ঘাৎ রাণী হত। তার সৌন্দর্যের কথা যখন চারদিকে বলাবলি হতে লাগল, সে তখন এই গ্রাম ছেড়ে পাটোয়ারীর নিজ গ্রামে চলে গেল। যেখানে গিয়ে দেখল পাটোয়ারী বিবাহিত, তার প্রথম স্ত্রীর ঘরে দু’টি বাচ্চাও আছে।
মাই তাজুর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল পাটোয়ারী। বলেছিল সে অবিবাহিত। মাই তাজু কান্নাকাটি করে খালে ঝাঁপ দেওয়ার হুমকি দিয়ে বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাটোয়ারীকে বিয়ে করেছিল।
পাটোয়ারীর প্রথম স্ত্রী লাঠি দিয়ে দুই হাতে মাইয়ের বুকে—পীঠে মারতে শুরু করল। লাঠির প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে নোংরা কথা ছুড়ে গালাগালি করছিল। মাই তাজু ওখান থেকে পালিয়ে মরতে মরতে নিজের গ্রামে চলে যায়। মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, কিন্তু বাবা এসে হাত ধরে টান দিয়ে উঠানে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘পাটোয়ারীর আরও তিনটা বউ থাকলেও তোমাকে তার সাথে থাকতে হবে। তুমি নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছ, এটা আমাদের জন্য অনেক অসম্মানের ছিল। এখন এখানে থাকতে চাইলে তালাক দিয়ে এসো, নইলে চাকর হয়েও থাকো। আমাদের কাছে তুমি সেদিনই মারা গেছ, যেদিন সবার সামনে বেহায়ার মত বলেছ, ‘বিয়ে যদি করি, তবে পাটোয়ারীকেই করব, নইলে আজীবন কুমারী হয়ে মরব।’ আজ কেন এসেছে? যাও, আমরা বুঝে নেব আমাদের কোনো সন্তানই ছিল না।’
তার মা কান্নাকাটি করতে থাকেন। তাকে মারতে থাকেন। তবুও বাবা রাজি হননি।
ওইদিনই মাই তাজু বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসে। মধ্যরাতে গ্রামে ফিরে দেখে পাটোয়ারীর দরজায় তালা দেওয়া। সারারাত সে দরজার বাইরে বসে থাকে। সকালে লোকজন জমায়েত হয়। পঞ্চায়েত সিদ্ধান্ত নেয়, তাজু পাটোয়ারীর নিয়মিত ভাড়াটে, তাই পাটোয়ারীর বাড়িতে তার অধিকার রয়েছে। পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তে তালা ভাঙা হল। এরপর গ্রামবাসী পাটোয়ারীর জন্য কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করল। কিন্তু পাটোয়ারী আর এল না। শোনা গেল পাটোয়ারী অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে। গ্রামের দু’জন লোক তাকে খুঁজতে বের হল। যখন তারা তাকে খুেঁজ পেল, সে বলল, তার প্রথম স্ত্রীর ছয় ফুট লম্বা গুন্ডা একটা ভাই আছে, গ্রামে গেলেই ও তাকে মেরে ফেলবে।

‘আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে বলিনি যে, আমি গ্রামে যে বাড়িটায় থাকতাম, সেটা কিনে নিয়েছি এবং এটা আমার নিজস্ব সম্পত্তি। আমি এই বাড়িটি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী তাজুর নামে লিখে দিচ্ছি। আমি তাকে তালাক দেব না। আমি তাকে ভালোবাসি।’ কথাগুলো বলে কাঁদতে লাগল পাটোয়ারী।
গ্রামবাসীর দয়ায় পাটোয়ারী তাকে তালাকের পরিবর্তে একটা বাড়ি দেয়। সেও কৃতার্থ হয়ে বসে থাকে। কারণ তার পেটে একটি সন্তান ছিল। শিশুটির জন্ম হলে সে তার নাম রাখে হাসান দীন। কঠোর পরিশ্রম করে সে বড় হয়। তাজু তাকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ালেও এরপর আর সাহস হয়নি।
তাজুকে তার সৌন্দর্যের জন্য সবাই ব্যাথা দিয়েছিল। পাটোয়ারীর সাথে বিচ্ছেদের পর তার যৌবনটাই যেন অভিশাপ হয়ে গেছিল। একবার এক পরহেজগার ব্যক্তি হাসান দীনকে উচ্চশিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে তাজুকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করল। তাজু তখন হাসান দীনকে সাতটি রুটি বেঁধে দেয়। হাসান একটি কুড়াল নিয়ে পরহেজগার ব্যক্তিটির পিছনে ছুটে।
এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। হাসান দীন কয়েক বছর ঘুরে বেড়াল। তারপর যখন প্রেম করার সময় হল, তখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিল। এর পর মাই তাজুর কয়েকটা বছর একা কাটল। হাসান দীন হাওলদার হল। এর মধ্যে আরেকটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। শোনা গেল হাসান দীন বেনগাজিতে নিহত হয়েছে। তারপর মাই তাজু কলের পাথরে গম পিষতে শুরু করল, স্থানীয়রা যাকে বলে চাক্কি। তাজু গম পিষতে থাকল সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তাকে মিলের পাত্রে মাথা রেখে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়।

চৌধুরী ফতেহ দীনের মেয়ে রাহতান যদি তার আশেপাশে না থাকত, তবে ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সময় কবেই সে মারা যেত। একদিন সে রাহতানকে বলল, ‘মেয়ে, আমার যদি সামর্থ থাকত, তোর বিয়েতে আমি তোকে স্বর্ণপদক দিতাম। কিন্তু আল্লাহ আমার ছেলেকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। এখন আমি তোর জন্য সবসময় দোয়া করি তুই যেন পরিপূর্ণ জীবন যাপন করিস এবং বিয়ের পরও সেভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাস, যেভাবে তুই বাপের বাড়িতে পড়েছিস।’
একদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার হয়ে এলেও রাহতান রুটি নিয়ে না আসায় মাই তাজুর খুব রাগ হল। সে লাঠি নিয়ে ফতেহ দীনের বাড়িতে গেল। ফতেহ দীনের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল রাহতান এক বন্ধুর বিয়েতে গেছে, ফিরতে মধ্যরাত হবে। তারপর রুটি চাইলে রাহতানের মা বললেন, ‘আমি নিয়ে তোমাকে দেব, আগে পরিবারের খাওয়া শেষ হোক।’
একথা শুনে মাই তাজুর গোসা উঠে গেল। এতদিন সে নিজেকে ফতেহ দীনের পরিবারের একজন মনে করত। বলল, ‘তাহলে বিবি আমি কি ভিখিরি?’
কানে সোনার দুল ভরা বিবিও মাই তাজুর মত দরিদ্র মহিলার কথা শুনে কষ্ট পেলেন। তিনি বললেন, ‘না, ভিখিরিদের আমার ভাল লাগে না, আপনি ভিখিরি না, অভাবী!’
মাই তাজু কেঁপে উঠল। সে উঠে চলে গেল। রাহতানের মা পেছন থেকে তাকে দু’—একবার ডাকলেও সেই ডাক কানে তুলেনি। বাড়িতে এসে উঠানে পড়ে সে কাঁদতে থাকে আর মৃত্যুকে ডাকতে থাকে। যেন মৃত্যু দেয়ালের ওপাশে বসে তার কথা শুনছে।
মাঝরাতে চাঁদ হলুদ হয়ে গেলে দেয়ালের ওপাশ থেকে রাহতানের ডাক শোনা গেল। ‘মাই, জেগে আছো?’
মাই বলল, ‘আমি কখন ঘুমাই মেয়ে!’
‘এদিকে এসে দেয়াল থেকে রুটি নিয়ে যাও।’

‘না মেয়ে, আমি নেব না।’ মাইয়ের গলা ধরে এল। ‘একজন মানুষ বেঁচে থাকার জন্যই খায়, তাই না? আর কতদিন বাঁচবো, মরতে গিয়ে আমার কবর আমার পাশেই হেঁটে যায়। আমি কেন তোমার শস্য নষ্ট করব মেয়ে?’
রাহতান দেয়ালে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা বাড়িয়ে জেদের সঙ্গে বলল, ‘এটা নাও, নাও বলছি।’
‘না মেয়ে।’ মাই এখন ঢুকরে কেঁদে উঠল। ‘নিতাম, কিন্তু আজ তোর মা বললেন আমি অভাবী। গম পিষে আমার হাতে কড় পড়ে গেছে, আমাকে অন্য কিছু বলুক। না মেয়ে, রুটি লাগবে না। আমি আর কখনোই রুটি নেব না। গত সন্ধ্যায় যে রুটি দিয়েছিলে, সেটাই আমার শেষ রুটি ছিল। এই রুটিটা তোদের কুকুরের সামনে রাখ।’
তারপর রাহতান ও তার মায়ের মধ্যে সে উত্তপ্ত কথাবার্তা শুনতে পেল। রাহতান কাঁদছে। মা তাকে বকাঝকা করছে। এর পর ফতেহ দীনের কন্ঠ শোনা গেল, ‘তুমি কি ঘুমাবে, নাকি আমি গিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ব?’
তারপর সবাই চুপ হয়ে গেল। মাই তাজু উঠে বসল। তার মনে হলো রাহতান তার বিছানায় বসে কাঁদছে। মাই তাজু উঠে দেয়ালের কাছে গেল। তারপর ফতেহ দীনের ভয়ে আবার ফিরে এল।
সে কলসি থেকে পানি পান করে। অনেকক্ষণ ধরে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটি তার মুখের উপর ঘুরিয়ে রাখে। সে আজ কত গরম আর এই বাটি কতটা ঠান্ডা। মনে হচ্ছে এখন গ্রষ্মকাল। সে তুলো কাঠের মত শক্ত হয়ে গেছে। তার সেই তুলোর কথা ভাবছে। ‘এখন আমি তাকে দেব। কিন্তু ইনশাআল্লাহ, এর কোনো প্রয়োজন হবে না। আল্লাহ, আমাকে এই চাদরের পরিবর্তে কাফন পরিয়ে দিন।’

মাই কলসির কাছ থেকে উঠে খাটের কাছে এল। কিছুক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস। ঈশ্বর তাকে চিরকাল আশীর্বাদ করেন। ‘এই চাচির ঘরে এত সুন্দর মেয়ের জন্ম হলো কিভাবে! তার জন্ম হওয়া উচিত ছিল আমার ঘরে।’ সে তার হাসান দীনের কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকে। তারপর চোখের জল মুছে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ে। যেন বাতাসের সাথে চলছে। ফতেহ দীনের কুকুরটি একটি বিড়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিড়ালটি দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে তার সামন দিয়ে বেরিয়ে আসে। একটি বাড়িতে একটি মোরগ ডেকে ওঠে। তারপর কাকগুলি মারামারি শুরু করে।
হঠাৎ সব মুরগি চুপ হয়ে যায়। যেন একসাথে তাদের গলা চেপে ধরা হয়েছে। সারা গ্রামের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শুরু করে। অতঃপর পূব দিক থেকে একটা আওয়াজ আসে, যে আওয়াজ প্রায় প্রতি রাতেই আসত। চোরাকারবারীদের তাড়াচ্ছে সীমান্তরক্ষীরা। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়তে চোখ বন্ধ করল।
‘একজন প্রবীণ মহিলা আমাকে অভাবী বলে ডাকলেন! গম পিষে হাতের চামড়া হাড় হয়ে গেছে, আর আমাকে ডাকে অভাবী! কেয়ামতের দিন আমি তাকে ধরব, সে আমাকে অপবাদ দিয়েছে।’
সে উঠে পানি খেয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর যখন জেগে উঠল, তখন তার গলা জুতার চামড়ার মত শুকিয়ে গেছে। সে পানি খেতে উঠে দুই পা এগোতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তার মাথা খাটে লাগল। সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
মাই তাজুর জ্ঞান ফিরলে সে প্রথমেই যে জিনিসটি বুঝতে পরল, সেটি হচ্ছে নামাজ শেষ হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ উঠে সে দেয়ালের দিকে দৌড়ে গেল। চারদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। মহিলারা চিৎকার করছে। শিশুরা চিৎকার করছে। সূর্য যেন ধোঁয়া ঢেলে দিচ্ছে। দূরে ক্রমাগত গর্জন আর বিস্ফোরণ হচ্ছে। লোকজন রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে।
মাই কেঁদে উঠল, ‘রাহতান, রাহতান!’
রাহতান ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তার সোনামুখটি বিষন্ন, চোখগুলো বিবর্ণ, কন্ঠে ভয়, কান্না ও কম্পন। ‘জলদি বের হও মা, গ্রাম থেকে বের হও। লাহোরের দিকে ছুটে চল। আমরাও লাহোর যাচ্ছি, তুমিও লাহোর চল। ভারতীয় সেনাবাহিনী এসেছে।’
বলেই সে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।
‘ভারতীয় সেনাবাহিনী এসেছে! এখানে, আমাদের গ্রামে কেন এসছে! সীমান্ত তো তিন মাইল দূরে। এই বাহিনী আমাদের গ্রামে কেন এসেছে, মা?’ মাই বিস্ময়ে কেঁদে ফেলল। ‘ওরা ভুল করে আসেনি তো! ফতেহ দীন ভাই কোথায়? তাকে পাঠাও, সে ওদের বুঝিয়ে বলুক এটা পাকিস্তান।’
কিন্তু রাহতানের কোনো জবাব এল না।

চারদিকে হৈচৈ বাড়ছিল। পূবদিকের একটি বাড়ি জ্বলছিল। ঠ্রা ঠ্রা করে কয়েকটা গুলি এসে তার ঘরের দরজার উপরের অংশে পড়ে বেড়া থেকে মাটির বড় বড় কয়েকটা টুকরা মেঝেতে ফেলে দেয়। কয়েকটা গুলি বাতাসে শিস বাজাতে বাজাতে ওদিকে চলে যায়। ফতেহ দীনের উঠানের পাশ থেকে একটা কাক পাগলের মত উড়ে এসে হঠাৎ বাতাসে গড়িয়ে পাথরের মত মাই তাজুর কলসির পাশে পড়ে যায়।
তারপর আরেকটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়। মাই তাজু একটু আগে যে দেয়াল থেকে নেমে এসেছিল, সেই দেয়ালের দিকে আবার দৌড় দেয়। কেউ যেন চৌধুরী ফতেহ দীনের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে দরজাটি ভেঙে পড়ল। হঠাৎ গুলির মুহুর্মুহু শব্দের সাথে অনেকগুলো চিৎকারের আওয়াজ কানে এল। মাই তাজু এদের মধ্যে রাহতানের চিৎকারটা পরিস্কার চিনতে পারল।
‘রাহতান, রাহতান’ সে চিৎকার দিয়ে উঠল।


লাঠি দিয়ে ঠেলে দরজার খিড়কি খুলে সে বাইরের গলিতে বেরিয়ে এল। গলিতে শিহাবুদ্দিন, নুরুদ্দিন, মুহম্মদ বশির, হায়দার খানসহ আরও বহু মানুষের লাশ পড়ে আছে। চৌধুরী ফতেহ দীনের ধ্বসে পড়া দরজার কাছে মৌলভী আবদুল মজিদ মৃত পড়ে আছেন। তার মুখের অর্ধেকটা অংশ উড়ে গেছে।


লাঠি দিয়ে ঠেলে দরজার খিড়কি খুলে সে বাইরের গলিতে বেরিয়ে এল। গলিতে শিহাবুদ্দিন, নুরুদ্দিন, মুহম্মদ বশির, হায়দার খানসহ আরও বহু মানুষের লাশ পড়ে আছে। চৌধুরী ফতেহ দীনের ধ্বসে পড়া দরজার কাছে মৌলভী আবদুল মজিদ মৃত পড়ে আছেন। তার মুখের অর্ধেকটা অংশ উড়ে গেছে। মৌলভী সাহেবের নুরানী দাড়ি দেখে মাই তাকে চিনতে পারল।
চৌধুরী ফতেহ দীনের উঠানে ফতেহ দীন এবং তার ছেলেরা মৃত পড়ে আছেন। ফতেহ দীনের স্ত্রীর কানভর্তি সোনার দুল গায়েব হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে ধ্বংশযজ্ঞ চলছিল। আর বাইরে রাহতান সৈনিকদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভয়ে নিজের থেকে চৌদ্দ পনেরো বছরের ছোট বাচ্চাদের মত চিৎকার করছিল। হঠাৎ এক সৈনিক এসে তার ঘাড় ধরে সজোরে ধাক্কা দিল। হুমড়ি খেয়ে সে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার জামাটা ফেটে গেল। সে উলঙ্গ হয়ে গেল। লজ্জা ঢাকতে সে বেলের মত বসে পড়ল। কিন্তু আরেকজন সৈনিক এসে তার জামার বাকি অংশটা ঝাপটে ধরে হাসতে হাসতে নিজের জুতা মুছতে লাগল। তখনই মাই তাজু এল। সে রাহতানের উপর পড়ে গিয়ে এক অদ্ভূত আওয়াজে বলে উঠল, ‘আল্লাহ তোর পর্দা রক্ষা করুন মেয়ে, আল্লাহ তোর ইজ্জত রক্ষা করুন।’
এক সৈনিক এসে মাই তাজুর সাদা চুল ধরে তাকে রাহতানের কাছ থেকে টেনে নিতে চাইলে তার হাত রক্তে ভিজে গেল। মাই রাহতানকে ঢেকে রেখে বলল, ‘এই মেয়েটি যদি তোমাদের কারও বোন বা মেয়ে হত, তবে কি তোমরা তার সঙ্গে এমনটা করতে? এই মেয়ে তো…’
‘এটা দিয়ে তুমি কী করবে?’ একজন সৈনিক এসে মাই তাজুর পাঁজরে জোরে গুতা মারে, ‘যাও এখান থেকে, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের মধ্যেই আমাদের লাহোরে পৌঁছতে হবে’।
মাই একদিকে গড়িয়ে পড়ল। যেন সে ন্যাকড়ার পুতুল।
তারপর রাহতানের দিকে সবার হাত এগিয়ে গেল। যে আর চিৎকার করছে না। এখন যে নগ্ন দাড়িয়ে আছে। যেন জামাকাপড় পরে আছে। তার চেহারাটা মাই তাজুর কাফনের ডিব্বার মত হয়ে গেছে। চোখগুলো এতটাই বড় বড় হয়ে গেছে যে, দেখে মনে হচ্ছে কখনোই এই চোখের পাতা ছিল না।
জ্ঞান ফেরার পর মাই তাজু দেখল তার পাশে ওয়ারিস আলি মুয়াজ্জিন দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে এদিক—সেদিক তাকাল। লাশগুলোর মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ‘রাহতান কোথায়?’ সে চেঁচিয়ে উঠল। মনে হল তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওয়ারিস আলি মাথা নিচু করে একপাশে সরে দাঁড়াল। ‘আমার রাহতান কোথায়?’ সে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ওয়ারিস আলির দিকে দুই কদম এগিয়ে গেল। যেন তাকে এখনই মেরে ফেলবে। ‘সে কোথায়?’

সে ওয়ারিস আলির কাছে এসে হতবাক হয়ে গেল। ওয়ারিস আলির মুখ রক্তাক্ত। তার হাতের মাংস একদিকে ঝুলে আছে। কথা বলতে বলতে মাই দেখল, ওয়ারিস আলির ঠোঁটও কেটে গেছে। মুখেও রক্ত। ‘কে কোথায় আছে মাই, কেউ জানে না। এখান থেকে এখনই চলে যাও। ভারতীয় সেনারা এখান থেকে চলে গেলেও তাদের লোকেরা গ্রামটি ঘিরে ফেলেছে। তুমি আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে লাহোর চলে যেতে পারলে চলে যাও। ওখানে মারা গেলে কেউ তোমার জানাজাটা পড়বে। এখন যাও, আমাকে কাজ করতে দাও।’
মাই বলল, ‘দেখ ছেলে, আমি পানি আনছি, তুই কুলি করে অন্তত মুখটা ধুয়ে ফেল। তুই একজন মুয়াজ্জিন, মুখে এত রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস! ব্যাটা, রক্ত তো হারাম!’
‘আমি সব করব।’ ওয়ারিস আলি চিৎকার দিল। তারপর এদিক—সেদিক তাকিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আল্লাহর দোহাই মাই, এখান থেকে চলে যাও। আমি এত মানুষকে মরতে দেখেছি যে, এখন তুমি মরলে মনে হবে সারা পৃথিবীটা মরে গেছে। আল্লাহর দোহাই, চলে যাও।’
‘আগে বল আমার রাহতান কোথায় গেল?’ মাই জেদের সঙ্গে বলল।
ওয়ারিস আলি জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে নেই, তাকে নগ্ন করে তুলে নেওয়া হয়েছিল?
হ্যাঁ, মাই মাথা নাড়ল। তার রক্তাক্ত এক গোছা চুল দড়ির মত মুখে ঝুলে রইল।
‘তাহলে জিজ্ঞেস করছ কেন সে কোথায় গেল!’

মাই নিজের বুকে সজোরে আঘাত করল। যেমন আঘাতে একটু আগে চৌধুরী ফতেহ দীনের দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সে ধপ করে বসে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। ওয়ারিস আলি তার মুখ চেপে ধরল। ‘কেউ শুনে ফেললে এসে যাবে’। সে বলল। তারপর অনেক কষ্টে তাকে টেনে তুলল। ‘তুমি আমার অবস্থাটা দেখ, আমি শুধু খোদার কুদরত ও আমার ঈমানের শক্তিতে বেঁচে আছি। অন্যথায় আমার মধ্যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি গলি থেকে লাশগুলো টেনে টেনে একটা গর্তে ফেলেছি। এখন আমাকে সেখানে ফতেহ দীন, লাল দীন, নুরুদ্দিন ও মাসি জান্নাতের লাশ নিয়ে যেতে হবে। তারপর আমি তাদের মাটি দিয়ে দাফন করব, এর পর মৃত্যুবরণ করব। মাই, জানাজা ছাড়া মরো না। লাহোরে চলে যাও। ভারতীয় সৈন্যরা এদিকে আসছে। তুমি মাঠের দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে যাও, আমার হাতে সময় খুব কম। দেখো, আমার জুতাও রক্তে ভরে গেছে।’
বিধ্বস্ত দরজা পার হতে হতে মাই আবারও থেমে গেল। ‘ওয়ারিস ব্যাটা। তুই লাহোরে যা, আমি দাফন করব। আমি বেঁচে থাকলে প্রতিদিন বড়জোর কারো একটি রুটি হারাম হবে। কিন্তু তুই মারা গেলে তোর সাথে আযানও মরে যাবে।’
‘না মা’, ওয়ারিস আলি দ্রুত বলল, ‘আজানও কবে মরে গেছে। আল্লাহর দোহাই এখন যাও।’

গলিতে পা দিয়েই সে আবার মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেলে, তোর কী মনে হয়, ওরা রাহতানকে মেরে ফেলেনি তো?’ ওয়ারিস আলি আকাশের দিকে আঙুল তুলে। এর পর চৌধুরী ফতেহ দীনের লাশের দিকে ঝঁুকে পড়ে।
মাই তাজু কুঁজো হয়ে গলির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তার এক হাতে লাঠি, অন্য হাতটা পিঠে। সে এমনভাবে নুয়ে নুয়ে হাঁটছে, যেন খড়ের গাদায় সুই হাঁটছে। মাই তাজু গ্রামের শেষ গলি থেকে বের হয়ে যখন মাঠে নামতে যাচ্ছে, এমন সময় চারদিক থেকে গুলি আসতে লাগল। সে গড়িয়ে একটা খাদে পড়ল। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘হায়, ওরা ওয়ারিস আলিকে মারবে না তো! আচ্ছা, একজন মানুষকে মারতে কি এত গুলি লাগে!’

খাদ থেকে সে আখ ক্ষেতে অনেক মানুষকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছে। এমনকি সে দেখেছে আখ যেখানে ভাঙা হয়, সেখান থেকে রসের স্রোত শেকড়ের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। তখনই রাহতানের কথা তার মনে পড়ে। সে খাদ থেকে উঠে দাঁড়ায়। একটি গুলি তার মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়ে পিছনের একটি গাছের গায়ে লাগে। পুরো গাছটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। সে আবার খাদে শুয়ে পড়ে। তার মনে হয়, সে মারা গেছে। কবরে শুয়ে আছে।
তারপর হঠাৎ তার কাফনের কথা মনে পড়ল। সে দ্রুতবেগে খাদ থেকে উঠে গলির দিকে ছুটে চলল, যেন তার ভেতরে একটা মেশিন চলতে শুরু করেছে। এই প্রথমবার তার মনে পড়ল সে খালি হাতে লাহোর চলে যাচ্ছিল। সে ভুল করে তার উপার্জন বাড়িতে রেখে যাচ্ছিল। তার কাফন তো ওই বাক্সে রাখা ছিল। মানুষ জীবনকে এতটাই ভালোবাসে যে, বাঁচার জন্য দৌড়াতে গিয়ে নিজের কাফনের কথাই ভুলে যায়! অথচ কত কষ্টে সে এই কাফন তৈরি করেছিল। আর তাতে কত কষ্টে পাক মাটি দিয়ে কালেমা শাহাদত লিখিয়েছিল। একটি ভাল কাফন ও শানদার জানাযার জন্য সে এখনো বেঁচে ছিল।
সে এখন এত দ্রুতবেগে হাঁটছে যে, যৌবনেও সে এভাবে হাঁটত না। তার পায়ের বেরামও যেন একেবারে সেরে গেছে। লাঠিকে ভর না দিয়ে লাঠি তরবারির মতো উঁচিয়ে ধরে সে চলতে লাগল। রাহতনের বাড়ির সামনে গিয়ে তার পা থেমে গেল। সে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত দরজা দিয়ে উঁকি দিল। ওয়ারিস আলি সব লাশ গুটিয়ে নিয়েছে। কেবল রাহতানের ছেঁড়া জামার একটা অংশ দমকা হাওয়ায় ঝাঁকুনি দিয়ে পুরো উঠানে অস্থির আত্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নিজের বুকটা চিরে ফেলতে মন চাইছে মাই তাজুর। কিন্তু সাথে সাথে ওয়ারিস আলির কথা মনে পড়ল। যে বলেছিল….। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাফনের কথা মনে পড়ল তার। তার রুমের দরজাটা খোলা ছিল। কলসির পাশে মৃত কাকটি শুয়ে ছিল। তার খাটটি আগের মতই ছিল। খাটের নিচের বাক্সটা খোলা থাকলেও তাতে কাফনটা সেভাবেই ছিল। বাক্সটা খুলে মাই শুধু কাফনটা হাতে নিল। সে মাথার চাদরের নিচে কাফনটা লুকিয়ে যখন বেরিয়ে এল, চৌধুরী ফতেহ দীনের কুকুরটি ছুটে এসে তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। তার আচরণ দেখে মনে হল এখন সে হাসতে না পারলেও অন্য সময় হলে খুব হাসত। ‘যাও, চলে যাও’ মাই তাকে ধমক দিল, ‘আমার নামাজের কাপড় নষ্ট করো না।’

কুকুরটা উঠে দাঁড়াল। মাই তাজু অন্য গলি দিয়ে ঘুরে গেল। দেখল কুকুরটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের পুতুলে মত দাঁড়িয়ে আছে। মাই কুকুরটিকে তার দিকে ডাকল। কিন্তু সে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে একটি দেয়ালের ছায়ায় গিয়ে বসে পড়ল। ‘আহা বেচারা’, মাইয়ের মনে অপরাধবোধ জেগে উঠল। কিন্তু এমন সময় শক্তিশালী দু’টি বিস্ফোরণ ঘটল যে, মাই তাজুর পায়ের নীচের মাটি ধ্বসে পড়ল। সে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে আবার খাদে পড়ে গেল। মাটি কাঁপছিল। বাতাসে সিংহের মতো একসাথে অনেকগুলো গর্জন আসছিল। বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে গর্জন ঘনিয়ে আসছিল।
সে বুকে কাফন জড়িয়ে খাদে হামাগুড়ি দিতে থাকে। কয়েক বছর আগে সে লাহোর সেনানিবাসে প্রদীপ উৎসব দেখতে গ্রামের অন্য মহিলাদের সাথে এই খাদের পার ধরে হেঁটে গেছিল। ওখানে কী বিপদই না ঘটেছিল। বেচারী শাহবি টাঙার চাকার নিচে পড়ে হুট করে মরে গেল। তাহলে কি রাহতানও মরে গেছে? রাহতান কি মরার উপযুক্ত ছিল? না মেয়ে, আমি তোমার হাত থেকে রুটি ফেরত দেব না। আমার সাথে কাঁদো না মেয়ে, আমার সাথে কাঁদো না।
সে শুনতে পেল সে জোরে জোরে কথা বলছে। কিন্তু তার এত উচ্চ আওয়াজ এখন কে শুনবে? ‘রাহতান, আমার প্রিয় রাহতান! হায়, সে ছিল শিমুল ফুলের অদ্ভূত তুলো। তার ফুলের রঙ অন্য ফুল থেকে কত আলাদা! রাহতান, আমার মেয়ে রাহতান!


একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইয়ের কোল থেকে নিজেকে ছাড়াল রাহতান। কাফনটা খুলে তাড়াতাড়ি নিজের শরীরে জড়িয়ে সে হাসল। যেন সে দেয়াল থেকে মাইকে রুটি দিতে এসেছে। মাই দেখল রাহাতনকে ওর কাফনে খুব সুন্দর লাগছে।


খাদ থেকে তুলো ক্ষেতে এবং সেখান থেকে আখ ক্ষেতে প্রবেশ করে মাই। বিস্ফোরণগুলো এত জোরে জোরে হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে এগুলো তার ভেতরেই হচ্ছে। বলা হয়, বুলেট যখন কাউকে আঘাত করে, তখন সেও বুলেটের মতো বিস্ফোরিত হয়। আহ, কে চিনবে আমার হাড্ডিগুড্ডি! আর কে আমার কাফন দিবে, যার গায়ে পবিত্র মাটি দিয়ে কলেমা শাহাদাত লেখা! আহ, কত ঘন এই আখ ক্ষেত! এটি চৌধুরী ফতেহ দীনের খামার। রাহতান এই ক্ষেতের আখ চুষত, আর বলত মাই, আমি বার্ধক্যকে ভয় পাই, বুড়ো হয়ে গেলে আর আখ চোষা যায় না। মাই তাজু হাসল। তার চোখে জল এসে গেল। ‘রাহতান, আমার কন্যা রাহতান!’
‘মাই’। মনে হল আওয়াজটা পাতাল থেকে এল।
মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী। তাকে আসমান কিংবা জমিন যেখানেই ফেল, তার কানটা বেজে উঠবেই।
‘মাই!’
আহ, আওয়াজটা তো আমার পাঁজর থেকে আসছে!
সে কাফনটা বুকে চেপে ধরে দম বন্ধ করে নিলো। অনুভব করল তার আঙুলগুলো হৃদপিন্ড থেকে কাফনের মধ্যে লাফিয়ে উঠছে, কামানের গোলার মতো শব্দ করছে।
মাই হাঁপিয়ে উঠল। সে একবার তাকাল। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে দিল। মনে হল কাফনটি তার হাত থেকে সরে গেছে। সে সামনে তাকাল।
‘মাই’, রাহাতন বলল, ‘তুমি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছো! দেখছ না আমি উলঙ্গ, আমাকে কিছু দাও।’
মাই জোরে জোরে হাসতে হাসতে, জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে রাহাতনকে কোলে টেনে নিল, হাসান দীনকে ছোটবেলায় যেমন দূধ কাওয়ানোর সময় কোলে নিত।
এখনও মাঠের চারপাশে বিস্ফোরণ ঘটছে। কিন্তু মাই রাহতানের কপালে চুমু খাচ্ছে। ‘আরে, আমি আমার নিজের কাফনটাকে অকেজো রেখেছি কেন!’
‘কাফন।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাইয়ের কোল থেকে নিজেকে ছাড়াল রাহতান। কাফনটা খুলে তাড়াতাড়ি নিজের শরীরে জড়িয়ে সে হাসল। যেন সে দেয়াল থেকে মাইকে রুটি দিতে এসেছে। মাই দেখল রাহাতনকে ওর কাফনে খুব সুন্দর লাগছে।
‘আহ, আমার মেয়ে! আল্লাহ তোর হেফাজত করুন, আল্লাহ তোর উজ্জত রক্ষা করুন।’
তারপর রাহতান মাইকে বলল, ওরা যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন উপর থেকে পাকিস্তানি বিমান এসেছিল। বিমান দেখে ওই লোকগুলো খালে লুকিয়ে গেল। আর আমি পালিয়ে গেলাম। আমি জানতাম আমার জন্মভূমির বিমান আমাকে চিনেছে। আমাকে কিছুই বলবে না। তারপর গ্রাম পেরিয়ে এখানে এসে সেই তখন থেকে বসে আছি। আমার মনে হচ্ছিল, আমার মাই আমাকে ডাকছে, ‘রাহতান, আমার রাহতান!’ কাফনের গায়ে জায়গায় জায়গায় রক্তের দাগ দেখা দিতে শুরু করেছে। আঁচড়ে আঁচড়ে ক্ষত হওয়া রাহতানের শরীরে কাফনটা বসে যাচ্ছিল আর পবিত্র মাটিগুলো রক্তের জন্য জায়গা করে দিচ্ছিল।
মাই বলল, লাহোর কাছেই কোথাও হবে মা। ‘রাহতান বেটি, তাহলে কথাটা কতটুকু সত্যি যে, তুই আমার জন্য শানদার জানাযা দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলি! তুই সেই প্রতিশ্রম্নতি সত্যি সত্যি পুরণ করেছিস মা। আমার কাফনে তোকে কত সুন্দর লাগছে! আমার প্রিয় মেয়ে, আমার রাহতান!’

আপনার মতামত জানান

ফায়যুর রাহমান

ফায়যুর রাহমান; প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আইনবিষয়ে; স্নাতক (সম্মান)। পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক সিলেটের ডাকে কর্মরত। প্রকাশিত বই ‘হান্টিংটনের ভূত’ (গবেষণা)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।