নয়া বাজারে একটা চাখানা আছে। লুকা নামের একটা তামাটে রঙের হাড়মোটা মানুষ সেটা চালায়। মানুষটার না আছে ঘরবাড়ি, না আছে সংসার। তো সেই লুকা বাজারের বীরেন ডাক্তারের ঘরের পেছন থেকে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। বাজারের মানুষের ভাষায়, লুকা একটা আচুদা মানুষ। দুনিয়ার কোনো আউবাউ বোঝে না। হেলিগ্যা তার না হইল টাকা, না হইল সংসার।
নয়া বাজারের মানুষ যাই বলুক, জীবন নামক রঙ্গমঞ্চে কেউ কেউ গড্ডালিকায় গা ভাসানোর কৌশল রপ্ত করতে পারে না। লুকা হয়ত সেই প্রজাতির মানুষ বলেই মরা নদীর রেখার মতো শুধু তার যৌবনের কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি আর অদ্ভুত একটা মন আছে।
বাজারের বটতলার ছাইয়ের স্তুপের পাশে দুইটা কুকুর ঘেষাঘেষি করে শুয়ে আছে। এ ছাড়া বাজারে আর কোনো প্রাণের সারা নাই। মেঘহীন আকাশটা তারায় তারায় ছেয়ে গেছে। বিদ্যুতের বাতির জন্য যুত করে দেখা না গেলেও লুকার মন্দ লাগে না। এর মাঝেই সে টের পায়, ঘুমটা হালকা হয়ে এসেছে। ঘুম মানে অবসান। জীবনের সবরকম লটখটানি থামিয়ে দেওয়া। নাই হয়ে যাওয়া। লুকা নাই হতে চায় না। এই দুনিয়ায় দেখার ও শেখার শেষ নাই। লুকা ত কবি না। সে একটা চাখানা চালায়। দুনিয়ায় চরাট করে বেড়ানো হাজার রকমের মানুষ এসে চায়ের কাপ সামনে নিয়ে নানান জাতের আলাপ জোড়ে। তখন ধুমায়িত চায়ের সৌরভে আলগা মন থেকে আদু কথাগুলা তাদের অজান্তেই বেরিয়ে আসে। অথবা গরিব লুকা, আধাবুড়া লুকাকে তারা কেউ মানুষ ভাবে না। তাই ওদের মুখে কিছুই আটকায় না। সঙ্গত কারণেই লুকা বেশিরভাগ সময় নীরব শ্রুতা। এই সংসারের মানুগুলাকে দেখতে দেখতে আর মানুষের ভিতরের মানুষগুলার ভাব-ভাষা শুনতে শুনতে সে কত শিখেছে! মানুষ বড়ো দুঃখী, কাঙাল, জন্তুর চে’ জন্তু। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নাচতে থাকা তরুণরা যখন তার চাখানায় বসে। ওরা যখন হোন্ডার চাবির রিং আঙুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে মাদরচুদ বলে খেঁকিয়ে উঠে তখন ওদের চোখের হিংসার আগুনের দিকে তাকিয়ে, লুকার ভাঙাচুরা গণরটা রাক্ষস দেখার মতো ভয়ে শিউরে উঠে। আবার যখন বুড়োরা বসে টাকা-পয়সার আলাপ করে, পরনিন্দা, পরচর্চায় মত্ত হয় তখনও লুকা নীরব থাকে। ওদের অর্থবল আর জনবল দুইটাই আছে। লুকার তো কোনোটাই নাই। তাই কোন কথা থেকে কোন কথার প্যাচে পড়ে লেজে-গোবরে হয়ে যায় তাই সে নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মাঝে যখন বুড়োরা কোনো আলাপের রসে হেসে ওঠে তখন লুকাও বোকার মতো হা হা করে হাসে।
লুকা তারাভরা আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আনে। তারপর কান পাতে ঘুমন্ত পৃথিবীর বুকে : ঝিঁঝিরা বিরামহীন ডাকছে। তাই বোধ করি লুকা ভাবে, মানুষ ঘুমিয়ে পরলেও পৃথিবীটা ঘুমায় না। উপরে তারার বাতি জ্বালিয়ে আকাশটা জেগে থাকে। নিচে জেগে থাকে লক্ষ জাতের জীব-জন্তু। মানুষও তো জন্তু! এই কথা ভাবতে গিয়ে লুকা চমকে ওঠে, জন্তুটাকে বশ মানিয়ে চলাটাই মানুষের কাজ। বশ মানানোর ক্ষমতা যার যত কম সে-ই তত বড়ো জন্তু।
পাশের মাঠ থেকে নানা জাতের কীট-পুঙ্গের ডাক আসছে। লুকা এইসব ভাবতে ভাবতে সার-বীজের ঘরের সামনের বেঞ্চে এসে বসে পড়ে। দোকানের ভিতর শুয়ে শুয়ে ফোনে কথা বলছে দোকান-মালিক বছিরের ছোট ছেলে। বছির ছিল গরিবের ছেলে। থাইল্যান্ড হয়ে পায়ে হেঁটে মালয়েশিয়া চলে গেছিল নব্বই সনে। টানা পনের বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে এসে বাড়িতে দালান তুলেছে, বাজারে দিয়েছে এই দোকান। যে বছির লুকার সিগারেটের শেষ অংশটায় একটা টান দেবার জন্য পিছন পিছন হেঁটে যেত এক মাইল, আজ সে লুকাকে চিনে না। বাজারের মানুষ বলে, লুকা একটা বাহুত্তরা আছিন, না করল লেখাপড়া, না শিখল হাল-গিরস্তি।
বাজারে যত ইয়াবাখোরের উৎপাত। টাকায় টান পড়লে ওরাই দোকানের তালা ভেঙে চুরি করে। তাই রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বছিরের ছেলের মতো অনেকেই এসে যার যার দোকানে শুয়ে থাকে। তো বছিরের অকর্মা এই ছেলেটা কিছুদিন কলেজের বারান্দা দিয়ে ঘুরাঘুরি করে এখন ঘুরছে দালালের পিছে। মনস্কাম : ইরান-তুরস্ক-গ্রীস হয়ে রাবারের ডিঙ্গি নাওয়ে চড়ে গিয়ে উঠবে ইতালি। তাই সে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে পিরিত করে বেড়াচ্ছে। সেই পিরিতির মানুষ আবার একজন না। প্রায় ডজনখানেক। তাই রোজ রাতে সবাইকে সামলাতে হয় মোবাইল ফোনে। বছিরের পোলা এখন তার এক প্রেমিকাকে বলছে, আহ্… কী বড়ো বড়ো জাম্বুরার মুন তোমার বুক! ব্রা খুলছ? মনে কর আমি অহন তোমার হেইটায়…।
লুকা সাঁ করে বসা থেকে উঠে পড়ে। মানুষের মনে কত অসুখ! ভাত-মাছ আর ভবকালের রঙ্গিলা বারুই টাকার সাথে মানুষের মনে রোজ রোজ হাজারটা জীবাণু সেঁধিয়ে পড়ছে। তাই এই রোগ জর্জর প্রাচীন পৃথিবীর প্রত্যেকেই এখন রোগী। যে বুড়াটা মাথায় টুপি দিয়ে মসজিদের দিকে দিনে পাঁচবার হাঁটে সে যৌবনে ছিল সিঁধেল চোর কিংবা ডাকাত কিংবা লুচ্চা অথবা জমি লোভি চাষা। বছর বছর পাশের জমির বাতর কেটে নিজের জমি বাড়াত। এখন ছেলেরা লায়েক হয়েছে। মাসে মাসে দেশে-বিদেশের টাকা আসে ঘরে। তাই আল্লার দিকে মনটাও নুয়ে পড়েছে।
বছিরের পুলার তাতানো স্বরে লুকার গতর কাঁপছে, কান দুইটা গরম হয়ে উঠছে। অতৃপ্ত, অবিবাহিত লুকার বয়সে ভাটি দিলেও তার হাড্ডির ভেতর সব সময় উৎপেতে অপেক্ষায় থাকে কামনার আগুন। কিন্তু সে বুকে হাঁটতে জানে না। সে মানুষের খোলসপড়া আরেকটা জন্তু না। তাই এইসব শুনলে তার গতরে কাঁপন লাগে। মনে ভয় জাগে, কবে জানি তার ভেতরের জন্তুটা রাক্ষসের মতো বেরিয়ে পড়ে!
লুকা তার স্টলের দিকে না এসে পাকা সড়ক ধরে দক্ষিণের দিকে হাঁটতে থাকে। নিজের ভুলে আজ যে আগুনে তার পা পড়েছে কিছুতেই আর ঘুম হবে না। তারচে আরেকটু হাঁটলে শরীরটা অবশ হয়ে আসবে। লুকার একবার ইচ্ছা করে স্টলে গিয়ে আয়নাতে নিজের মুখটা দেখে। সে সত্যিই কি বুড়া হয়ে গেছে? সামনের দাঁত দুইটা বাঁধিয়ে, চুলে কলপ লাগিয়ে, ক্লিন শেভ করলেই তো বয়স বিশ বছর কমে যাবে।
আর কিছু ভাবতে সাহস হয় না। মানুষ বড়ো দুর্বল। মনে একবার ভাঙন ধরলে ধ্বস নামবে। তাই লুকা হাঁটতেই থাকে। বাজারের দক্ষিণ থেকে উত্তরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। পাকা সড়কটা মরা সাপের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসলে সে টলতে টলতে এসে ঘরের দরজার তালা খুলে। হাড়ের বোঝার মতো মনে শুধু আফসোস কিম্বা শূন্যতার অঢেল ক্লান্তি। পৃথিবী বদলায়, মানুষ বদলায়। লুকা তুমি ক্যান নিজেরে বদলাইতে পার না?
চা স্টলের দুই বেঞ্চের দেড়হাত বিছানায় লুকা কুঁকড়া হয়ে শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম নাই। বুকে আক্ষেপের আগুন, জীবনডা মাটি করলাম!
একটু পরেই লুকার মনে সান্ত্বনার পাতা গজাতে শুরু করে, আমি কি দুঃখী?
লুকা পাশ ফিরে শুতে গিয়ে বেঞ্চের দেড়হাত বিছানা থেকে পরতে পরতেও অনেক দিনের অভ্যাসে ঠিক হয়ে শুতে পারে, জীবন যার যার মতো–কেউ দুধ বেইচ্যা গাঞ্জা খায়, কেউ খায় মধু। গাঞ্জাখোরের কাছে গাঞ্জাডাই মধু।
এইসব ভাবতে ভাবতে লুকা ঘুমিয়ে পড়ে।
সাত ঘণ্টা ঘুমালেও ফজরের আজানের সাথে সাথে লুকার ঘুম ভেঙে যায়, এক ঘণ্টা ঘুমালেও তাই। ফ্রেশটেশ হয়ে দোকানের পিছনের দিকের দরজা খুলে সে পা মেলে চৌকাঠে বসে। হাতে বিড়ি, মুখে ভাবনার ছাপ। দোকানের পেছনের দরজার পরেই মাঠ। সেদিক থেকে সকালের ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, শান্তির বাতাস। ফসলের বিশাল মাঠটা পেরুলেই তাদের গ্রাম। এককালে অই গ্রামটাতে তার কত বন্ধুছিল, ভাই-ভবী, বোন, চাচা-জেঠা ছিল। গ্রামের সবার সাথেই তার ছিল খাতির-মহব্বত। তাই ওরা কেউ রক্তের সম্পর্কের না হলেও তারা ছিল তার স্বজন। আজ কেউ নাই। টাকা আর সময় সবাইকে পর করে দিয়েছে। গ্রামের সবাই আগে ছিল সাধারণ চাষা। কেউ কেউ কামলা-কুলি। মাটির মমতায় বেঁচে থাকার জন্য অধিকাংশই ছিল মাটির মানুষ। নব্বইয়ের পর থেকে এলো গার্মেন্টস আর বিদেশের জোয়ার। কাঁচাটাকার সুখে সবাই ধীরে ধীরে বদলে যেতে যেতে আজ শরীর-সাস্থ্য, কাপড়চোপড়ে, জীবন যাপনে বিশ্বনাগরিক।
বিড়িটা ফেলে লুকা গ্রামটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে তাদের বাড়ির বড় রেন্ট্রি গাছটাকে খোঁজে। পায় না। শুনেছে সে তার বড়ো ভাই নাকি গাছটা কেটে সেখানে একটা নতুন দালান তুলেছে। তার চারটা ছেলে মালদ্বীপ আর মালয়েশিয়াতে। শুধু তার ভাইয়ের না,গোটা এলাকার সবার ঘরে ঘরে বিদেশ থেকে মোটা টাকা আসে। সবারই পেট ও ঘাড়ে পরত পরত চর্বি। তাই ময়লা লুঙ্গি-শার্ট পরা একহারা গড়নের ফকির টাইপ লুকাকে তারা আজ চিনতে পারে না।
একবার তার বন্ধু জহিরের ছোট বোনের নাক দিয়ে রক্তপড়া রোগ হয়। দিন-রাত খেজুরের রসের মতো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে। লুকাকে সাথে নিয়ে জহির তার বোনকে নিয়ে গেলো হাসপাতালে। রোগীকে ভর্তির পর পরীক্ষাটরীক্ষা করে ডাক্তার বললে, এখনই একব্যাগ রক্ত লাগবে। আপনারাতো তরুণ, আপনাদের রক্ত পেলে রোগী দ্রুত সেরে ওঠবে। তো পরীক্ষার পর দেখা গেলো মেয়েটার সাথে লুকার রক্ত মিলেছে। লুকা হাসিমুখে একব্যাগ রক্ত দিল। তারপর টানা দশদিন দুই বন্ধু হাসপাতালের বারান্দায় কাটাল, এই অষুধটা লাগবে, এই স্যালাইনটা নিয়ে আসেন…।
সাতদিনের দিন টাকায় টান পড়লে জহির বাড়িতে গেলো। মেয়েটা এখন অনেক সুস্থ। লুকা যখন বিছানার পাশে টুল টেনে বসে তখন তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করতেই মেয়েটার ফ্যাকাশে গাল দুটো একটু লাল হয়ে ওঠে। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া একটা সুন্দরী আর লাজুক মেয়ের গভীরকালো চোখের অস্থির মণি দুটোর দিকে তাকিয়ে ঝলমলে তারণ্যভরা লুকার বুকটা কেঁপে ওঠে। আজকুয়া ক্যামন আছ…এইরকম দুই-চার কথা বলে সে পালাতে চাইলে মেয়েটা অভিযোগকারিনীর মতো ভারী গলায় বলে, একটু বসেন না ভাইজান। লুকার লম্বাটে গড়নের ফর্সা মুখটা হঠাৎ লাল হয়ে ওঠে। তার শরীরটা শিরশির করে ভেঙে আসতে চায়। বুকের মাঝে খালি আজব এক তৃষ্ণা ছটফটায়। ইচ্ছা করে তার কপালটা একটু ছোঁয়ে দেখতে, আজকেও কি জ্বর এসেছে? এইসব কিছুই বলা হয় না, ছোঁয়ে দেখা হয় না। আসলে লুকা ভিতু। দস্যুর মতো লুটে নিতে জানে না বলেই বারবার তার পিঠটা কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে হাসপাতালের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এতক্ষণে সে উঠে বসেছে। হালকা, লম্বা আর নাজুক শরীরটা একটা পাতলা চাদরে ঢাকা। মাথার এলামেলো, বিশাল খোঁপাটা আলতু করে হলুদ আর উজ্জ্বল ঘাড়ে পড়ে আছে। ঠোঁটে আজব একটা হাসি, আপনার শরীরে বুঝি অনেক রক্ত? এই কথায় লুকা একেবারে চুপসে যায়। সে কী করে বলবে যে কোনো প্রকার বাহাদুরী করার জন্য সে রক্ত দেয়নি। লুকা কী করে বলে, তাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তো তার এত ভয়। একটা রাজকন্যাকে তার ছাগল টাইপ জীবনের সাথে কোন সাহসে সে জড়াতে চায়? লুকা মাথা নুয়ে বসে আছে দেখে সে মুখটিপে হাসে। তারপর বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে একটা ম্যাসেজ লিখতে থাকে। একটু পরেই লুকার মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে পুতপুত করে ডেকে উঠলে সে শত অপরাধীর মতো মাথা তুলে। ততক্ষণে মেয়েটা গায়ের চাদরে মুখ ঢেকে ফেলেছে।
লুকা ধীরে ধীরে বারান্দায় ফিরে আসে। তারপর মোবাইলটা বের করে ম্যাসেজটা পড়তে শুরু করে, আপনি যে আমাকে দেখেও দেখছেন না এইটা কিন্তু খারাপ। তলে তলে একজনকে পছন্দ করেন কিন্তু বলতে পারেন না, সেইটা আরো অনেক বেশি খারাপ। তাই বলছি, শুধু আপনি আমাকে না, আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ফটফট করে লুকার দুই কান গরম হয়ে ওঠে। শ্বাস পরতে থাকে ঘনঘন। একবার তার নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মনে হয়। তারপর মনে হয়, এই রাজকন্যাকে সে কোথায় রাখবে? তার বাপের ভিটায় কাত হয়ে পড়ে আছে যে ঘরটা, সেখানে ? একটা গোলাপকে সে কোন সাহসে কাদার মধ্যে ছোঁড়ে ফেলে দিতে চায় ?
সারা দুপুর-বিকাল সে আর তাকে দেখতে গেলো না। হয় হয় সন্ধ্যায় জহির ফিরে এলে গেটের দাড়োয়ানকে বিশ টাকা ঘুষ দিয়ে দুই বন্ধু গিয়ে তার বেডের পাশে বসে। মেয়েটা গম্ভীর হয়ে শোয়ে আছে। লুকার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। পরের দিনই তারা রোগীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তারপর থেকে লুকা হাওয়া। এক মাস দেখা নাই। মাঝে দুইদিন জহিরের ডাকে এসেছিল, সেই আগের লুকা আর নাই, মুখটা শুকনা শুকনা, শরীরটাও শুকিয়েছে, শেল-খাওয়া মানুষের মতো কথা বলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। পাশের রুম থেকে মেয়েটা কান পেতে ছিল, কুনুকুনু করে কীযে আলাপ হলো তারাই জানে। মাঝে একবার জহির হো হো করে হেসে উঠলে লুকাকেও একটু হাসতে শুনে সে। এতেই মেয়েটার দুরুদুর বুকের রক্ত ছল্লাৎ করে মুখে ছুটে আসে।
তিন মাস পরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। পাত্র সিঙ্গপুরে মোটা টাকা রুজি করে। অকর্মা আর হুজুগে মানুষ বলে গ্রামের সব বিয়েতেই লুকার ডাক পড়ে। জহির কিন্তু তাকে ডাকল না। বিয়ের আগের দিন মেয়েটা লুকাকে ফোন দিয়েছিল, জানেন, আপনি একটা অন্ধ মানুষ। আপনাকে ভুলতে আমার কষ্ট হবে। আপনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যান। আর কিছু না পেলে গার্মেন্টেস তো কাজ পাবেন। এখানে আপনার আপনজন বলতে কেউ নাই, এইকথা ভাবলেই আমার কষ্ট লাগে। খুব কষ্ট…
পড়তে পড়তে মনে হয় আমিই সেই লুকা। একটা বোকাচুদা মানুষ। দারুণ লাগলো লুৎফর ভাই।