আখতার সাহেবের মন খারাপ হয় না কখনো। হয় তার শরীর, তাও আবার মেপে মেপে। যখন বাজারে যাবেন এবং কোনো রিকশা খুঁজে পাবেন না, হেঁটে হেঁটে যেটুকু পথ তা পাড়ি দেবার পর যখন দুপুরে রোদ তেতে উঠবে, কিংবা বাতাস থাকবে না একটুও বিকেলবেলায়, শরীরটা বিগড়ে বসবে। আখতার সাহেব বলেন শরীরের মন খারাপ, তার নিজের নয়। তো শরীরের এই মন কোথায় থাকে তাকে জিজ্ঞাসা করলেই বলেন, এই যে এইখানে; হাত-পায়ের আঙুলগুলো দেখিয়ে হাসতে থাকেন।
কিংবা, যখন মসজিদের পাশ দিয়ে গলির ভেতর চলে যেতে যেতে অনিল ঘোষের মিষ্টির দোকান, সেখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে লোকেরা মিষ্টি কেনে; আখতার সাহেবের লাইন ধরতে হয় না যদিও, তবু, এতগুলো লোকের লাইন ডিঙিয়ে দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে খেতে বসবেন এ ভাবনায় তার হাত-পায়ের আঙুলগুলো বা শরীরের যে মন তা বিগড়ে যায়। অনিল ঘোষের মিষ্টিঘরে বসে খাওয়ার সুযোগ নেই, সবাই লাইন ধরে কেনে। আখতার সাহেব প্রায়ই সেখানে একটা যায়গা বের করে মিষ্টি খান, আসলে তিনি গল্প করেন, অনিল ঘোষের ছেলে সুনীল ঘোষের সঙ্গে, যে তার ছেলেবেলার বন্ধু, খেলার সাথী, প্রাণের বান্ধব।
তো, আসল কথা হলো তার মন খারাপ হবার সুযোগ নেই তাই নানান বানানো গল্প তিনি বলেন এবং নিজেকে পরিহাসপ্রিয় করে তোলেন যাতে অন্যেরা তাকে নিয়ে সিরিয়াস না হয়, কিন্তু মানুষ আসলে আখতার সাহবকে নিয়ে খুব সিরিয়াস। এই যেমন বাজার থেকে ফিরবার পথে তার হাতের ব্যাগটা ছিঁড়ে যায়, সবজিগুলো পড়ে যায়, গড়িয়ে যায় নর্দমার ধারে, কুড়িয়ে তোলার লোকের অভাব হয় না, নতুন ব্যাগও জোগাড় হয়ে যায় মুহূর্তেই; এমনভাবে আফসোস করতে থাকে যে আখতার সাহেব নিজেই বুঝি পড়ে গেলেন।
তাঁর বলা গল্প বা তামাশার মতোই লোকেরা তাকে নিয়ে বেশ উৎসাহী এবং তার আশেপাশে সবসময় দু’একজন লোকের সঙ্গ লেগেই থাকে। ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত আখতার সাহেবের সঙ্গীর অভাব হয় না, কেবল অভাব একটিই, জুতসই সঙ্গী একটাও নেই, সবই তামাশার দর্শক-শ্রোতামাত্র।
বাজারে যান তিনি আসলে ঘুরতে, মানুষ দেখতে, ঘটনাচক্র কিংবা নিজেই ঘটনা হয়ে যেতে। সবচেয়ে উপভোগ করেন ঠিক বাড়ন্ত দুপুরবেলায়, তখন লোকজন কিছুটা কমে আসে, কোনো কোনো দোকানের শাটার নামানো থাকে কিংবা বেচাকেনা কম–তখন তিনি খুঁজতে বেরোন যে বিশেষ মানুষটিকে তাকে সবাই চেনে বিষু পাগলা নামে। একটা কুকুর নিয়ে সবসময় সে ঘোরে, আসলে বসেই থাকে এক জায়গায়, অনিল ঘোষের মিষ্টির দোকানের ঠিক পেছনে, যেখানে দুধ-মিষ্টি-ছানার পচে যাওয়া পরিত্যক্ত পানি জমে থাকে, মিষ্টির দোকানের আশপাশে এমন মিষ্টি-মিষ্টি দুর্গন্ধ সবসময়ই পাওয়া যায় যা না থাকলে মিষ্টির কারবার সার্থক হয়ে ওঠে না। বিষু সেখানেই বেশিরভাগ সময় বসে থাকে। আখতার সাহেব আজ এ সময় মানে দুপুর যখন গড়িয়ে পড়েছে, বিষু যখন এসময় একটু এদিক ওদিক ঘোরে, তাকে দেখতে পায়।
আচ্ছা বিষু, মিষ্টির দোকানের পেছনে ড্রেনের পাশটায় সারাক্ষণ বসে থাকিস কেন?
–ওই যায়গায় কেউ খাড়ায় না গন্ধে, আমারে ডিস্টার্ব করব কেডা?
তাহলে আবার এখন ঘোরাঘুরি করছিস কেন?
–এহনতো বাজার পাতলা, মানুষ কম, আরাম করি আর কি! বিষু হাসে।
হেঁটে হেঁটে আরাম করা! ভাল আইডিয়া।
–আপনেও তো করেন।
আখতার সাহেবও হাসেন। বিষুর কথায় তার শরীরের মন ভাল হয়ে যায়, হাত-পায়ের আঙুলগুলোও চাঙা হয়ে ওঠে। বিষুর সাথে হাঁটতে থাকেন তিনি। বিষু কুকুরটাকে কোলে নিয়ে আখতার সাহেবের সাথে আলাপ করতে করতে কোথায় যে চলে যায় তা আখতার সাহেব নিজেও টের পান না। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা হেঁটে চলেন। ততক্ষণে বাজার পেরিয়ে কিছুদূরের যে পাঙ্খা খাল, যা আসলে কোনও এক সময় নদীই ছিল, তখন নাম ছিল পান খা, বরজ-বরজ পানের নৌকা ঘাটে এসে ভিড়তো, ব্যাপারীরা সে পান নদীতে ধুয়েও নিত; ওরা বিশ্বাস করতো যে এ নদীতে পান ধুয়ে নিলে সে পান বিক্রি হত বেশি। এসব গল্প কিন্তু বিষু পাগলার কাছেই শোনা।
পান খা নদী এখন ছোট এক পাঙ্খা খাল হয়ে বয়ে চলেছে, সে পানও নেই সে নদীও নেই, নামটিও বিকৃত হয়েছে। খালের ধারে একটা বড় বাবলা গাছের পাশে এক ছাউনিঘর। বিষু আর আখতার সাহেব বসে বসে কত আলাপ আর তরজমা–বেলা পড়ে গিয়ে সন্ধ্যা, হয়তো রাতেও ঠেকবে গিয়ে, কথার শেষ নেই। আখতার সাহেব মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই বিষুর সাথে ঘুরে বেড়ান। কোথায় কোথায় যে চলে যান তা নিজেও ঠিক করতে পারেন না। তাদের সেখানে নিয়ে যায় যেখানে আলাপ যেতে চায়–একে তিনি বলেন কথাগাড়ি ও তার গন্তব্য।
আজ বাবলা গাছের পাশে যে ছাউনিঘরটিতে তিনি বিষু পাগলার পাশে বসে গল্প বা তার ভাষায় তামাশার আলাপ করছেন তার ঠিক পাশ দিয়ে যে পান খা নদী কোনো এক কালে বয়ে গিয়েছিল ফল্গুধারায়, এখন যেটা পাঙ্খা খাল, সেখানে বিষুর মা ঝাঁপ দিয়েছিল। খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছাউনিঘরটিতেই ছিল তাদের বসতভিটা। নদীতে ভেঙেছে কতবার। বিষুর মায়ের আত্মহত্যার কারণ বিষু নিজেও জানে না। তার বাপ সে শোকেই মরেছে কয়েকবছর পরে। বিষু একাই থেকেছে এতকাল। এখন তার সঙ্গী কেবল এই কুকুর।
বাবলা গাছের ছায়ায় সন্ধ্যার আবছা আলো গুলে যেতে যেতে মাঝে মাঝে যখন চমক দেয়, সে দিকে তাকিয়ে থেকে গুনগুন করে গান গাইতে থাকেন আখতার সাহেব, বিষুও তাল ঠুকতে থাকে জিহ্বায়। কেমন করে যে সন্ধ্যাটা কেটে যায়। রাত হয়ে আসে। তার মন আনন্দে ভরে ওঠে, যদিও আসলে তার মন খারাপ হয় না কোনোদিন। হাত পায়ের আঙুলগুলো চনমনে হয় ওঠে। বিষুর দিকে তাকিয়ে দেখতে পান সেখানে বিষু নয় আখতার সাহেব নিজেই বসে আছেন। খুব খেয়াল করে দেখেন যে একেবারেই তার নিজের চেহারা, একটা কুকুর কোলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে।
এবার বোধহয় আখতার সাহেব ভয় পেলেন; কিন্তু না তিনি বিষুর শরীরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। নিজের নিথর দেহটি ফেলে রেখে চলতে শুরু করলেন ঘরের দিকে। দূর থেকে আবারো দেখে নিলেন বাবলাগাছের পাশে ছাউনিঘরের দিকে। তার ফেলে আসা নিথর পুরনো শরীর তেমনি বসে আছে, যেন গল্প শুনছে বিষুর কাছে, যে বিষুর ভেতর তিনি ঢুকে পড়েছেন একটু আগে এবং বয়ে চলেছেন ঘরের দিকে। বিষুময় আখতার সাহবে আজ রাতভর তামাশা করবেন, তার সঙ্গী হবেন কারা তাও বলে দিতে হবে?
ফারজানা আপা, আখতার সাহেবের স্ত্রী একটা বেলীফুলের মালা খোঁপায় জুড়েছেন। আখতার সাহেব সে খোঁপায় গুজে দেবেন জ্বলজ্বলে রাতের তারার মত তার তামাশাভরা গল্প। দরজায় শব্দ হতেই নিনা, আখতার সাহেবের মেয়ে এসে যখন খুলে দেয়, বাবার বদলে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে বাবারই মতন, কিছু মনে করে না। সে জানে আজ কোনো এক নতুন চরিত্র এসে ভর করেছে আখতার সাহেবের শরীরে। কেবল তার খোঁপাটি দেখিয়ে বলে–বাবা, মা বেঁধে দিয়েছে, আর বলেছে বেলীফুলের সুবাস চলে যাবার আগেই যেন তোমার চরিত্রের ভুত শরীর থেকে নামে, নইলে।
নইলে, কী? আখতার সাহেবের অবাক জিজ্ঞাসা।
–মা পিটিয়ে নামাবে সে ভুত।
আখতার সাহেব এবার ভয়ই পেলেন। বিষুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার স্ত্রী আজ তাকে পেটালে বিষু সহজে তাকে তার ভেতর থেকে বের হতে দেবে না। আখতার সাহেব জানেন, ফারজানা আপা, মানে তার স্ত্রীর হাতের মার খেলে ভুত যাবে তো দূরের কথা কোনোদিন ছাড়ার কথাও চিন্তা করবে না।
কিছু না বলেই ছুটতে শুরু করলেন তিনি। বাবলা গাছের পাশে যে ঘরখানা, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাঙ্খা খাল, একদিন যা নদী ছিল, যে নদীতে বিষুর মা ঝাঁপ দিয়েছিল, যেখানে নিজেকে ফেলে রেখে বিষুতে ভর করে চলে এসেছিলেন ঘরে রাতভর গল্প রচনা করবেন বলে; দেখতে পেলেন তার সে ফেলে রাখা দেহখানা হাওয়া। কে কাকে ভর করলো, কে কীসে ঢুকে পড়লো, এসব কিছুই আর আখতার সাহেবের মনে রইল না কেবল একটাই দুঃশ্চিন্তা, তার ফেলে রাখা তিনি কোথায় এখন?
–আর কোথায়, আমার কাছে?
ফারজানা আপা স্বামীর পেছন পেছন চলে এসেছে এতদূর। আখতার সাহেবের ফেলে রাখা পুরনো নিথর শরীর ততক্ষণে সচল হয়ে আখতার সাহেবকেই ফের ধারণ করে নেয়। ফারজানা আপার শক্তি এতটাই যে খণ্ড খণ্ড ঘটনাচক্র ফের অখণ্ড হতে সময় লাগে না।
আচ্ছা, তাহলে ব্যাপারটা কী ঘটলো? আখতার সাহেবের বিস্মিত চোখ।
–কী?
মানে, আমার ভেতর যে আমি ঢুকে পড়লাম, কিন্তু সে আমি আবার বিষু।
–বিষু তোমার চরিত্র, তুমিই নির্মাণ করেছো। বাবলা গাছ আর তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা সে নদী এসব তোমারই তামাশামাত্র।
আখতার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তুমি কী করে জানলে?
–তোমাকে টেবিলে ভাত বেড়ে দিয়ে আমি স্কুলের খাতা দেখছিলাম। এর ভেতরই এতকিছু। আচ্ছা, গল্প বলবে ভাল কথা কিন্তু এভাবে চরিত্র হয়ে কোনো গল্পকার ঘুরে বেড়ায়?
আখতার সাহেব কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলেন না যে এসব কেবল চরিত্র নয় নির্জলা সত্য। ফারজানা আপার সাথে সে বাবলা গাছ আর তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোনো এককালের সে পান খা নদী, যেখানে বিষুর মা ঝাঁপ দিয়েছিল, যেখানে বসে বিষু আর তিনি একে অন্যে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন, এসব কিছুকে পেছনে ফেলে রেখে ফিরে আসেন ঘরে। আসলে তিনি তার বাসার ছাদেই বসে আছেন, নিনা ছাদ থেকে কাপড় আনতে যাবার সময় বাবাকে দেখতে পেয়ে তার মাকে ডেকে আনে। এরপর যা ঘটেছে তা আখতার সাহেবের গল্পের মানে তামাশার এখতিয়ারের বাইরে।
এতটাই বাইরে, ফারজানা আপা যে কখন তাকে বুকে চেপে ধরেন আর বলে ওঠেন, এই সব চরিত্র এমনকি তুমি নিজেও আসলে আমারই চরিত্রসমষ্টি।
আখতার সাহেব ঘুমিয়ে পড়েন, কিংবা এইমাত্রই জেগে উঠলেন, এতক্ষণ গভীর ঘুমেই ছিলেন হয়তো।