সাক্ষাৎকার

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহবুব মুহম্মদ

আসাদ চৌধুরী! কবি হিশেবে যে বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন; একজন সমাজচিন্তক ও বিশ্লেষক কিংবা পণ্ডিত হিশেবে ততোটুকু পাননি। হয়তো সেটা গ্রহণেও তিনি এতোটা আগ্রহী নয়। এমনও কখনো কখনো মনে হয়, তার পাণ্ডিত্য কবিত্বের শক্তিকে কিছুটা হলেও অবদমিত করেছে। যতোটা আবেগ নিঃসরণ হয়েছে তার কবিতায় তারচেয়ে ঢের বেশি হয়েছে গ্রামীণ লৌকিক দর্শন ও লোকায়িত সংস্কৃতি বর্ণনায়। হ্যা, আবেগ ছিলো। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে আবেগ নিয়ে মেঘের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াননি। তার মধ্যে আবেগের কৃত্রিমতা নয়; ছিলো এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেটা তার কবিতা, প্রবন্ধ বা চিন্তায়।
কবি আসাদ চৌধুরী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সংকটের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছিলেন, সেই যাত্রা তার চিন্তা ও প্রজ্ঞাকে করে তুলেছিল আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কবি হিশেবে আসাদ চৌধুরী যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে অনেক বেশি সমাজচিন্তক হিশেবে। অন্তত দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে। তার কিছু প্রমাণ হয়তো আমরা এই সাক্ষাৎকারেই পাবো।

যাই হোক, কবি আসাদ চৌধুরী কিছুদিন আগে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের একটি সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে । সম্মেলনের পূর্বে কবি ও গবেষক সৈয়দ মবনুর শাহী ঈদগাহের বাসায় আসাদ চৌধীরীর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। যেখানে ধর্ম, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নগরায়ন, সিলেটের আঞ্চলিক সাহিত্য ও বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। আলাপচারিতার সময় যেহেতু দীর্ঘ ছিলো তাই সেখানে কোনো বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অনেক সময় কবি নিজ থেকে কথা বলে গেছেন। এই দীর্ঘ আলোচনায় প্রথম থেকেই কবি সৈয়দ মবনু, প্রাবন্ধিক মীর ফায়সাল আলী, শৈলীর সাবেক সভাপতি হেলাল হামাম ও সাধারণ সম্পাদক ফিদা হাসান উপস্থিত ছিলেন। শেষের দিকে কবি নৃপেন্দলাল দাশ ও গল্পকার সেলিম আওয়ালের উপস্থিতি আলাপচারিতাকে আরো বেশি প্রাঞ্জল করে তুলেছিলো।

আসাদ চৌধুরী রুমে ডুকেই বললেন: সিলেটের আবহাওয়া এখনো তুলনামূলক অনেক ভালো। গাছপালা প্রচুর আছে। ঢাকায় তো সদরঘাটে বুড়িগঙ্গায় ওজু করতে গিয়ে বিপদে পরেছিলাম সেদিন। এতো নোংরা পানি! বিশ্বাস করা যায়, এইতো কয়েক বছর আগেও বুড়িগঙ্গার পানি কতো পরিষ্কার ছিলো!

আমি বললাম: আমাদের নগরায়ন হয়েছে খুব দ্রুত তবে অপরিকল্পিত!
সঙ্গে সঙ্গে আসাদ চৌধুরী বলে উঠলেন: অপরিকল্পিত তো বটেই । বাংলাদেশের বিকাশক্ষেত্রে আমাদের অপরিকল্পনার ছাপ রয়েছে। আমাদের চিন্তার মধ্যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে। আমরা জাম্প দিয়েছি, যেমন বাঙালি মুসলমান যে জাম্প ১৭৫৭ সালে দেয়ার কথা ছিল সেটা ১৯৪৭ সালে দিয়েছে। তখন কিন্তু বাঙালি মুসলমান বেশ ভালো চাকুরি পেতো, তবে বাঙালি মুসলমান বলা উচিত না এদের বেশির ভাগই ছিলো উর্দু ভাষী।

জিজ্ঞাস করলাম: ১৯৪৭ সালে বা তার পূর্বে যারা মুর্শিদাবাদ বা বাইরের অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিলেন, পরবর্তীতে দেখা গেলো ঢাকাতে তাদেরই প্রভাব বেশি ছিলো? যেমন আনিসুজ্জামান, গোলাম মুরশিদের কথা বলা যায়। শিল্প সাহিত্যে যাদের প্রভাব স্থানীয়দের চেয়ে বেশি ছিলো।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শাহী ঈদগাহ সৈয়দপুর হাউসে কবি আসাদ চৌধুরী, সৈয়দ মবনু, মীর ফয়সল আলী, মাহবুব মুহম্মদ, হেলাল হামাম ও ফিদা হাসানের আড্ডায় উপমহাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক আলাপ হয়। ছবি : সাইয়্যিদ মুজাদ্দিদ/দ্য দ্রাবিড়

আমার দিকে চেয়ে বললেন: এখানে তো তিন হাজার কথা বলতে হয়। তোমাদের সিলেটেও কি অরিজিনাল সিলেটিদের প্রতাপ বেশি ছিলো? শিলঙে যারা ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করে এসেছে তাদের প্রতাপ এখানে বেশি ছিলো। তারা এখানে ভালো করেছে। আসো কাম টু দ্যা পয়েন্টে, ভাষা আন্দোলন কেন সিলেটে হলো? আমি এই কথা কালকেও বলেছি। আজকেও বলছি। সবসময় বলছি। সিলেটে কেন ভাষা আন্দোলন হলো এই নিয়ে গবেষণা হওয়ার কথা। বদরুদ্দীন উমরের (ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন রাজনীতি) বই পড়ে দেখেন । সমস্ত বইতে যেটা আছে সেটা নওবেলাল আর সৈনিক। নওবেলাল বের করতেন শাহেদ আলী সাহেব। সিলেটের লোক আর সৈনিক বের করতেন মাহমুদ আলী সাহেব তিনিও সিলেটের লোক। সৈনিক আর নওবেলাল ছাড়া জাস্ট চিন্তা করেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বদরুদ্দীন উমর বইটা (ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন রাজনীতি) লিখতে পারতেন? সম্ভব না। ডকুমেন্ট নাই তো। এই দুটি পত্রিকা ছাড়া কোনো লিখিত ডকুমেন্ট নাই। আমি এজন্য সবাইকে লিখতে বলি। লিখলে ডকুমেন্টটা থাকলো। ডকুমেন্টের প্রয়োজন আছে। এখানে আমার ভুল হতে পারে, তবুও বলি যারা হিন্দু কংগ্রেস বা কংগ্রেস পার্টি করতেন ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা লেখা হয় নাই কিন্তু। নওবেলালও না সৈনিকেও না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। কে লিখবে! আমি অনন্ত দেবকে বলেছিলাম, দাদা তুমি লিখো। যা পারো লিখো। সিলেটে আসলে সিলেটি কথা শুনা যায় না। তুলনামুলকভাবে কম। কিন্তু শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জে সিলেটি কথা ছাড়া আর কোনো কথা চলে না। ইংরেজি, সিলেটি আর হিন্দি। ঐখানে বাংলাতে কেউ কথা বলে না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো বাংলার জন্য সেখানে এগারোজন নিহত হয়েছেন।

আমি বললাম: হ্যা, আসামে।

এখানে আমার ভুল হতে পারে, তবুও বলি যারা হিন্দু কংগ্রেস বা কংগ্রেস পার্টি করতেন ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা লেখা হয় নাই কিন্তু। নওবেলালও না সৈনিকেও না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। কে লিখবে! আমি অনন্ত দেবকে বলেছিলাম, দাদা তুমি লিখো। যা পারো লিখো। আসাদ চৌধুরী

 

চোখ বড় করে তাকিয়ে বললেন: আসামে কি? শিলচরে! ২জন নিহত হয়েছেন করিমগঞ্জে। এই দুজন মারা গেছেন মাস্তানদের হাতে। কংগ্রেসের মাস্তানরা পিঠিয়ে মেরেছে। এবং এই ১৩জনই হিন্দু। একজনও মুসলমান না। য়ার বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনে যারা মারা গেছেন তাদের সবাই মুসলমান। একজনও হিন্দু না। অদ্ভুত লাগে না ব্যাপারটা? অংকটা জঠিল, সোজা অংক না কিন্তু। এখানে (সিলেটে) ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসেই ভাষা আন্দোলনের মিটিং হয়েছে।

আমি যুক্ত করে বললাম: ঐটা তো সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে হলো, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ করলো।

: না এটা হয়েছে পরে। ১১মার্চ হলো ঢাকায় আর সিলেটে হয়েছে সম্ভবত ফেব্রুয়ারিতে।

: সৈয়দ মুজতবা আলী তো ভাষার উপর প্রবন্ধপাঠও করেছিলেন।

: হ্যা, সেটা পরে। একবছর পরে। ১৯৪৭ সালে এখানে (সিলেটে) সম্ভবত মতিনউদ্দিন সাহেবের বাসাতে প্রথম মিটিং হয়েছে। ঢাকাতে এই মিটিংটা হয়েছে ডিসেম্ভর মাসে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার না! ঢাকাতে হরতাল হলো ১১ মার্চ, এখানে(সিলেটে) হরতাল হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে।
এই সময়ে সৈয়দ মবনু কবি আসাদ চৌধুরীর জন্য লেবু ও রুহ আফজার শরবত নিয়ে আসলেন।

আসাদ চৌধুরী সৈয়দ মবনুর দিকে চেয়ে: আমি কাল থেকে মবনুকে (সৈয়দ মবনু) বলছি, এগুলো নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান করার জন্য। মবনু আবার খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল আমি তো অরগেনাইজার না। আমি বলি, অরগেনাইজার হোন আর না হোন একজনকে এগিয়ে নিতে হবে।

সৈয়দ মবনু বললেন: সমস্যা হলো বেশিভাগ সময় আমরা পলিটিক্যাল জায়গা থেকে কাজ করি নিজের নাম প্রচারের জন্য। আমরা মৌলিক কাজ করি না। তাই আমি এই কাজগুলো থেকে একটু সরে থাকতে চাই। যাওয়ার মধ্যে শুধু কেন্দ্রীয় মুসলিস সাহিত্য সংসদে যাই আর শৈলীতে। শৈলীতে আমাদের কাজ হলো গবেষণা করা। মানুষ এখন নগর, মহানগর, রাজধানীমুখি। মানুষকে যদি আমরা গ্রামমুখি করতে পারি, কৃষিমুখি করতে পারি, মানুষকে আবার যদি আমরা আত্মামুখি করতে পারি। তাহলে মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ সবাই প্রতিযোগিতা করছে সামনে যাওয়ার জন্য। যে মানুষ কালকে মারা যাবে সেও একদিনের জন্য হলেও প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবে। সেও একটা প্রতিযোগিতায় আছে। এই প্রতিযোগিতায় সবাই দৌড়াচ্ছে। সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পারা যাবে না। এজন্য নিজেকে চিনতে হবে প্রথমে। নিজেকে না চিনলে কোনো প্রতিযোগিতায় দীর্ঘক্ষণ ঠিকে থাকা সম্ভব নয়। অর্থাৎ আমরা চাই মানুষ তার নিজেকে জানুক। ৭১ পরবর্তী একটা চিন্তার বিপ্লবের প্রয়োজন ছিলো। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ এখন দালাল। সবাই যদি দালালি ছেড়ে এই দেশকে কিভাবে উন্নত করা যায় এ বিষয়ে চিন্তা বা গবেষণা করতো তাহলে আমরা আরো এগিয়ে যেতাম। কিন্তু এটা হয়নি।
আমরা কেউ এম্বেসির দালাল, কেউ রাজনৈতিক দলের দালাল, কেউ অন্যদেশের দালালি করছে। এখানে মৌলিক গবেষণার চেয়ে দালালির পরিমাণ বেশি।

জবাবে আসাদ চৌধুরী বললেন: হ্যা, অবশ্যই। ভাবেন। ভাবার দরকার আছে। টমাস মান বলেছিলেন, ‘বর্তমান পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি।’ ট্রাম্পের কথাই ধরেন, হি ইজ নট অ্যা পলেটিশিয়ান। অথচ পৃথিবীর সবচাইতে বড় রাজনৈতিক অবস্থানে তিনি! ইটস নট অ্যা মেটার অব জোক। সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, দুই বছর ট্যাক্স দেয় নাই। সবাই জানে। তিনিও গর্ব করে বলেছেন দেইনি ট্যাক্স! তারপরও সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়। কাজেই রাজনীতি যে কতটা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত সেটা বুঝা যাচ্ছে। আজকে আওয়ামীলীগ, আওয়ামীলীগ আর আওয়ামীলীগ! শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামীলীগটা কী? বিএনপি, বিএনপি আর বিএনপি। খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপিটা কী? খালেদা জিয়া কি কোনো রাজনীতি দিতে পেরেছেন? নিজস্ব রাজনীতি? হাসিনা তার বাবার আওয়ামীলীগের লিগেসিটা বহন করে নিচ্ছে, যতটা পারে। আওয়ামীলীগের লিগেসিটা কী? সমাজতন্ত্র তো তার মুখে আর নাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চারটি শর্তের মধ্যে একটি ছিলো সমাজতন্ত্র, এটি আর নেই!

সৈয়দ মবনুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন: আপনার চিন্তার সঙ্গে আরেকটি চিন্তা যুক্ত করতে বলি।
বাংলাদেশ যে হয়েছে তার সবটা আওয়ামীলীগের চিন্তায় হয়নি। কিছুটা শেখ মুজিবের অসম্ভব সংগঠন ক্ষমতা ও সেই সময়ে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এবং সেখানে এতো আপোষহীন ছিলেন যে লোকজন তাঁর উপর আস্থা রাখতে পেরেছিলো। তার চাইতে হিন্দু মুসলমানের মিলিত চিন্তা দু’জন মানুষ অনেক বেশি করেছিলেন। একজন চিত্তরঞ্জন দাস। বেঙ্গল প্যাক্ট করলেন ১৯২৩ সালের আগে। বেঙ্গল প্যাক্টটা কী? এখানে বলা হলো ১০০ ভাগের ৬০ ভাগ চাকরি মুসলমানদের দিতে হবে।

মীর ফয়সাল তখন এই কথার সঙ্গে যুক্ত করে বললেন: আন্টিল এন্ড আনলেস
ফিফটি ফিফটি।

সৈয়দপুর হাউজে আলাপকালে কবি আসাদ চৌধুরীর ছবিটি তুলেছেন সাইয়্যিদ মুজাদ্দিদ।

আসাদ চৌধুরী বিরতি না নিয়েই বললেন: না। ৬০ভাগ দিতেই হবে। এটা তাঁর পরিষ্কার কথা। আমি হুবুহু উদ্ধৃতি দিতে পারব না আমার স্মৃতিশক্তি খুবই খারাপ। তিনি বলেছেন, আমাদের পক্ষে একা ব্রিটিশদের হঠানো সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা না আসবে। এবং মুসলমানরা শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, অর্থবিত্তে এতো পিছনে পড়ে আছে যে তাদেরকে টেনে তুলতেই হবে। এটা কিন্তু আর বিশ্বাস থেকে বলা। একই কাজ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক করেছেন। কৃষকদের যদি ঋণ সালিশি থেকে মুক্ত করা না যায়, জমিদারি প্রথা থেকে যদি বাঁচানো না যায় তবে সামগ্রীক উন্নতি সম্ভব নয়। কমরেড জ্যোতিবসু পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেটা বড় কথা না। উনি সামগ্রীকভাবে একটা ঘটনা, একটা পেবম্যনন। উনি তাঁর আত্মজীবনীতে আফসোস করে বলেছেন, ‘আমরা পার্টির ডিশিসান অনুযায়ী শেরে বাংলাকে সমর্থন করতে পারলাম না। আমার খুব খারাপ লাগছিলো।’ প্রি-প্রাইমারি এডুকেশন! চিন্তা করা যায় কমিউনিস্ট পার্টি এটা সাপোর্ট করছে না!
কাজেই দলের দ্বারা আচ্ছন্ন হই বা যাই হই, মানুষ ইন্ডিভিজুয়ালি নিজের চিন্তাভাবনাকে বিকশিত করতে হবে। চিন্তা হচ্ছে মারাত্মক অস্ত্র। চিন্তাকে মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখে। আল্লাহর রাসুল হেরা গুহায় কি করেছেন? জাস্ট গোটা মানব জাতির জন্য চিন্তা করেছেন। হাউ টু সেইভ দেম। কিভাবে মানুষকে মুক্তি দেয়া যায়। অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রথমত, আধ্যাত্মিক মুক্তি, আত্মার মুক্তি, ঈমানের মুক্তি, সামাজিকভাবে মানুষ কীভাবে বসবাস করবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন। তার আগের কার্যক্রম কী? হিলফুল ফুজুল করেছেন। বিদেশিরা আসছে মক্কা শরীফে, তারা যেন অসুবিধার মধ্যে না পড়ে। মেয়েদের যাতে অসুবিধা না হয়। ছেলেদের যাতে অসুবিধা না হয়। তাদের উপকার করা। এই কাজগুলো করেছেন। এর পর যেটা করেছেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা আমাদের প্রধান প্রধান নবীদের ক্ষেত্রে দেখা যাবে- হযরত ইব্রাহিম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত (ঈসা.) এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে ইসলাম প্রচার করেছেন, ধর্ম প্রচার করেছেন। এই অভিজ্ঞতাকে নিয়ে তিনি (মুহাম্মাদ সা.) যখন ইসলামটা দিলেন তখন কিন্তু এই বিশ্বাসগুলোর উপর থেকে দিয়েছেন। আমার একটা কবিতা যেটা কখনও উল্লেখ করি না-
‘কী আলোক জ্বেলে গেলে
অন্ধকার হেরার গুহায়
সেই আলোক ছড়িয়ে পড়ে
ধরার তাবৎ জায়গায়।’
আমার ইচ্ছে থাকা সত্তেও আমি হেরা গুহা পর্যন্ত যেতে পারিনি। নিচে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম। শারীরিক সামর্থ্য ছিলো না। আমার কি লোভ ছিলো চিন্তা করা যায়! এই একটি জায়গায় নবীজী দিনের পর দিন বসে চিন্তা করেছেন। যথেষ্ট বয়স হয়ে যাওয়ার পরও বিবি খাদিজার মতো নারী রাসুলের জন্য সেখানে খাবার নিয়ে যেতেন।
(এই সময় আসাদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফোন চলে আসে। মিনিট দুয়েক কথা বলেন ফোনে। )

ফোন রেখে দিয়ে আসাদ চৌধুরী সৈয়দ মবনুকে জিজ্ঞাসা করলেন: আচ্ছা, আপনি আল ইসলাহ সম্পাদনা করেছেন কয় সংখ্যা?

উত্তরে সৈয়দ মবনু বলেন: ৬ সংখ্যা করেছি।

আসাদ চৌধুরী একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন: মাত্র! এটা কি দ্বিমাসিক?

সৈয়দ মবনু বললেন: বছরে সাধারণত ৪টা বের হয়। কিন্তু ঐবছরের শেষের দিকে সংসদে মারামারি হয়ে গেল। ককটেল ফাটনো হলো ।

আসাদ চৌধুরী: এখানে!

সৈয়দ মবনু: হ্যা, মুসলিম সাহিত্য সংসদে।

আসাদ চৌধুরী বললেন: আমাকে কেউ বলেনি! বলে কি!

সৈয়দ মবনু বললেন: হ্যা। এই সংঘর্ষ নিয়ে আমি একটি বইও লিখেছিলাম তখন। (এই সময় আসাদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফোন চলে আসে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন। বেশ মজা করে নিজের স্বাস্থের কথা জানাচ্ছেন ওপর প্রান্তের ব্যক্তিকে। প্রায় মিনিট আড়াই কথা বলেন ফোনে।)

মীর ফয়সাল আগ্রহ নিয়ে বললেন: জ্বি, বাঙালি নিয়ে কথা বলছিলেন।

আগের আলোচনায় চলে এসে আসাদ চৌধুরী আবার বলতে শুরু করলেন: বাংলাদেশ যখন হয় তখন বিভিন্ন ফেক্টর কাজ করছিলো। শুধু আওয়ামী লীগ, চীন পন্থী, মস্কো পন্থী শুধু এগুলো না। অনেকগুলো ফেক্টর কাজ করেছে। তার মধ্যে সবচে বড় ফেক্টর হলো পাকিস্তান। একটার পর একটা অন্যায় করেছে। একেবারে সহজ অংক! পাকিস্তান যদি গণহত্যা না করতো তাহলে কিন্তু আলাদা হওয়ার ইচ্ছা হতো না। এদেশের মানুষ পাকিস্থান চেয়েছে; লাহোর পাকিস্থান চায়নি। করাচির পাকিস্থান চায়নি। একমাত্র মুসলিমলীগ বেঙ্গল রেজিমে জিতেছে আর কোথাও জিতে নাই। ফ্রন্টেয়ারে খান আবদুল গফফার খান, পাঞ্জাবে খিজির হায়াত খান, বেলুচিস্থান, করাচি ও সিন্ধেও অন্যরা। একমাত্র বেঙ্গলে মুসলিমলীগ জিতেছে। পাকিস্থান আন্দোলন মুসলিমলীগ করেছে কিন্তু এটাও হয়েছে ঢাকায়। ১৯৪২ এ লাহোর রেজ্যুলেশনটাও হয় শেরে বাংলার মুখ দিয়ে। সেই মুসলিমলীগ থেকে শেরে বাংলাকে বের করে দিলেন জিন্নাহ। মুসলমানদের সবচে বড় দোষ, এই শেরে বাংলা বলি, মাওলানা ভাসানী বলি, সোহওয়ার্দী বলি এরা তিনজন একসঙ্গে বসে কাজ করার ক্ষমতা কোনোদিন রাখেনি। ইন্ডিভুজুয়ালি ট্যালেন্টেড কিন্তু কমিউনিটি ওয়ার্ক ছিলো না তাদের।

(চলবে)

আপনার মতামত জানান

মাহবুব মুহম্মদ

মাহবুব মুহম্মদ; কবি ও প্রাবন্ধিক। ১৯৯১ সালের ৩০ ডিসেম্বর, সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার রুগনপুর গ্রামে জন্ম। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।