সাক্ষাৎকার

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী (পর্ব ৪)

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহবুব মুহম্মদ

আসাদ চৌধুরী! কবি হিশেবে যে বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন; একজন সমাজচিন্তক ও বিশ্লেষক কিংবা পণ্ডিত হিশেবে ততোটুকু পাননি। হয়তো সেটা গ্রহণেও তিনি এতোটা আগ্রহী নয়। এমনও কখনো কখনো মনে হয়, তার পাণ্ডিত্য কবিত্বের শক্তিকে কিছুটা হলেও অবদমিত করেছে। যতোটা আবেগ নিঃসরণ হয়েছে তার কবিতায় তারচেয়ে ঢের বেশি হয়েছে গ্রামীণ লৌকিক দর্শন ও লোকায়িত সংস্কৃতি বর্ণনায়। হ্যা, আবেগ ছিলো। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে আবেগ নিয়ে মেঘের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াননি। তার মধ্যে আবেগের কৃত্রিমতা নয়; ছিলো এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেটা তার কবিতা, প্রবন্ধ বা চিন্তায়।
কবি আসাদ চৌধুরী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সংকটের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছিলেন, সেই যাত্রা তার চিন্তা ও প্রজ্ঞাকে করে তুলেছিল আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কবি হিশেবে আসাদ চৌধুরী যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে অনেক বেশি সমাজচিন্তক হিশেবে। অন্তত দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে। তার কিছু প্রমাণ হয়তো আমরা এই সাক্ষাৎকারেই পাবো।

যাই হোক, কবি আসাদ চৌধুরী কিছুদিন আগে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের একটি সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে । সম্মেলনের পূর্বে কবি ও গবেষক সৈয়দ মবনুর শাহী ঈদগাহের বাসায় আসাদ চৌধীরীর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। যেখানে ধর্ম, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নগরায়ন, সিলেটের আঞ্চলিক সাহিত্য ও বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। আলাপচারিতার সময় যেহেতু দীর্ঘ ছিলো তাই সেখানে কোনো বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অনেক সময় কবি নিজ থেকে কথা বলে গেছেন। এই দীর্ঘ আলোচনায় প্রথম থেকেই কবি সৈয়দ মবনু, প্রাবন্ধিক মীর ফায়সাল আলী, শৈলীর সাবেক সভাপতি হেলাল হামাম ও সাধারণ সম্পাদক ফিদা হাসান উপস্থিত ছিলেন। শেষের দিকে কবি নৃপেন্দলাল দাশ ও গল্পকার সেলিম আওয়ালের উপস্থিতি আলাপচারিতাকে আরো বেশি প্রাঞ্জল করে তুলেছিলো। এই গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতার বেশ কিছু অংশ শিল্প-সাহিত্যের ওয়েবজিন দ্রাবিড়-এ ধারাবাহিক প্রকাশ হচ্ছে। চতুর্থ পর্ব পড়ার আমন্ত্রন থাকলো। – মাহবুব মুহম্মদ

প্রথমপর্বের আলাপচারিতার প্রায় বছরদেড়েক পর কবির সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় যাই। উদ্দেশ্য ছিলো আসাদ চৌধুরীর আরেকটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার। সকালের নাস্তা শেষ করে ফকিরাপুল থেকে কবি সাইয়্যিদ মুজাদ্দিদ ও কবি সৈয়দ ফরহাদকে নিয়ে হাজির হই কবির সাহানা নামের কল্যাণপুরের বাসায়। হাফ হাতা শার্ট আর লুঙ্গি পরে কবি আমাদের স্বাগত জানান। স্বাভাবিক নিয়মেই শুরু হয় আমাদের আলাপ। সৈয়দ মবনু আসাদ চৌধুরীকে কিছু বই পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে থাকা উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের বইটি হাতে নিয়ে বললেন, বাহ! মবনু (সৈয়দ মবনু) অনেক ভালো একটা কাজ করেছেন।
আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তোমাদের সিলেটে কিন্তু অনেক উর্দু সাহিত্যিক ছিলেন। মানিক (আবদুল হামিদ মানিক) আছে না? ও কয়েকজন কবির নাম আমাকে দিয়েছিলো। এবং কয়েকজনের কবিতাও ছিলো। মবনু যে জানে না তা না। মবনু আমার থেকে অনেক বেশি ভালো জানে। যেমন উনি বাংলাদেশের উর্দু কবিতার কথা বলেছেন। কিন্তু ১৯৭১ এর আগে ৪৭ এর পরপর তো বটেই এরও আগ থেকে বেশ কিছু অবাঙালি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং কাব্য চর্চা করেছিলেন। সংখ্যা কিন্তু কম না। বলতে গেলে এর মধ্যে অনেক নামকরা কবি আছেন। আমি জানি না মবনু এদেরকে ঐ গুরুত্বটা দিয়েছেন কিনা। তিনি হয়তো টেকনিক্যালি যারা বাঙালি তাদের কথাই বলেছেন। টেকনিক্যালি বাঙালি না কিন্তু উর্দু কবিতা লিখেছেন এবং বাংলাদেশে ছিলেন, আমি মনে করি এইগুলা আমাদের প্রপার্টি।
আমি বললাম: এই বইতে অনেকেই আছেন যারা বাঙালি না কিন্তু উর্দু কবিতা লিখেছেন।
আসাদ চৌধুরী বললেন: আমি মবনুর কথা আরেকটা ছেলেকে বলেছি। ঐ ছেলে নিজে নিজে চর্চা করে এখন গালিব অনুবাদ করছে, বাহাদুর শাহ জাফর করলো।
: জাভেদ হুসেন?
: হ্যাঁ।
: প্রথম আলোতে কাজ করেন?
আসাদ চৌধুরী বললেন: হ্যা। আমি একদিন কুমিল্লায় গেছি একটা অনুষ্ঠানে। সম্ভবত খেলা ঘরের একটা অনুষ্ঠানে। তখন আমাদের ট্রেন ছাড়তে লেইট হয়। তো যা হয়, স্টেশনে ঘুরাঘুরি করলাম, একটা হোটেলে ভাত-টাত খেলাম, ঐখানে আবার ভর্তা-টর্তা, অনেক ভাজিও দেয়। আমি আবার এইগুলো পছন্দ করি। হঠাৎ এসে এক দল ছেলেমেয়ে ঢুকছে। ওরা নাকি উর্দু কবিতা পছন্দ করে। বলে কি! আমার তো পুরা মাথা গরম। বলে কি? কুমিল্লায় এরা উর্দু কবিতা পছন্দ করে। এরপর আলাপ হলো। পরে দেখলাম এরা কুমিল্লা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে উর্দু কয়েকটি সংকলন প্রকাশ করেছে। তখন থেকেই জাভেদের পড়াশোনার চর্চা। ঢাকায় আসার পর আমরা প্রচণ্ড উৎসাহ দিয়েছি। ওর নিজেরই উৎসাহ আছে, একগাদা কাজ করে গেছে। মবনু পাকিস্তানে বসে যে কাজটা করেছিলো সেটা অসাধারণ একটা কাজ। আমি মনে করি, ঐ লেখাটা আরও একটু পড়াশোনা করে যদি লিখেন ভালো হবে।
একটু থেমে বললেন: ১৮৮৫ এ বোম্বেতে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়। সেখানে উমেশ ব্যানার্জি একটা বক্তৃতা দেন। ঠিক তার তিন বছর পর ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরে স্যার সৈয়দ আহমদ একটা বক্তৃতা দেন। বক্তৃতার নাম ছিলো ‘ওয়ান কািন্ট্রি টু নেশনস’। আবার ৮৫ দিকেই তিনজন, এরমধ্যে একজন মাত্র বাঙালি ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ। আর একজনও বাঙালি না। সৈয়দ আমির আলী এবং নবাব আমির আলী। নবাব আমির আলী পাটনা থেকে এসে কলকাতায় সেটেল হয়েছেন। এরা যে আন্দোলনটা করেছিলেন সে আন্দোলনটা হচ্ছে, মুসলিম স্বার্থ নিয়ে আন্দোলন এবং ১৮৮৫-এ এটা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। তখনই কংগ্রেস হয়। তার তিন বছর পর ১৮৮৮ সালে এই টু নেশন থিওরিটা স্যার সৈয়দ এর মুখ থেকে প্রথম বের হয়।

নবাব আমির আলী পাটনা থেকে এসে কলকাতায় সেটেল হয়েছেন। এরা যে আন্দোলনটা করেছিলেন সে আন্দোলনটা হচ্ছে, মুসলিম স্বার্থ নিয়ে আন্দোলন এবং ১৮৮৫-এ এটা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। তখনই কংগ্রেস হয়। তার তিন বছর পর ১৮৮৮ সালে এই টু নেশন থিওরিটা স্যার সৈয়দ এর মুখ থেকে প্রথম বের হয়।


আমি: আচ্ছা, তাহলে এই টু নেশন থিওরি প্রথম স্যার সৈয়দ বলেন?
আসাদ চৌধুরী: হ্যা। এবং সেটা ১৮৮৮ ডিসেম্বরেই।
আমি জানতে চাইলাম: আমরা জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধনবাড়ির জমিদারের খুব বড় একটা ভূমিকা ছিলো।
: হ্যা। নবাব আলী সাহেবের।
:কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় এবং রাজনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা আমির আলী বা লতিফের যে ভূমিকাটা দেখি ঐটা নবাব আলীর ক্ষেত্রে দেখি না।
তখন আসাদ চৌধুরী বললেন: রাজনীতি করতেই হবে, এমন কোনো কথা আছে? রাজনীতি করতে হবে
এটা কি খুব বাধ্যতামূলক ব্যাপার? রাজনীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতি তো সব কিছু না। উনি যা করেছেন তা বাঙালি মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো তার বিপুল ত্যাগ ছিলো সেখানে। এবং ১৯১১তে আবার যখন ইউনাইটেড বেঙ্গল হলো সেই সময়ও নবাব আলী যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তার কোনো কন্ট্রিবিউশন ছিলো না। মেলা কন্ট্রিবিউশন ছিলো এবং ঢাকায় যেখানে ঢাকার নবাবদের ধাপট ছিলো অসম্ভব, সেখানে ধনবাড়ির একটা লোক শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে এইখানে তার অবস্থানটা তৈরি করেছে। নট অ্যা মেটার অব জোক! এতো সহজ না ব্যাপারটা। এবং এইখানে এই নবাবদের তাড়াতে গিয়ে আবুল হাশিম- আমাদের বদরুদ্দিন উমরের বাবা, এরা যে পরিশ্রম করেছেন সেটা চিন্তা করা যায় না। মুসলিম লীগে নবাবেরা পাত্তাই পায়নি। ১৯৪৪ থেকে ৪৭ পর্যন্ত ঢাকার নবাবরা এই ঢাকায় মুসলমানদের কাছে পাত্তাই পেলো না শুধুমাত্র এদের জন্য। এইগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নবাব আলী সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যাননি। হ্যা, উনি জড়াতে চাননি। একদিকে ঠিকই আছে। মুসলিম লীগের চামচামি করার থেকে, বৃটিশ চামচামি করার থেকে উনি ধরে নিয়েছেন ইংরেজি শিখতে হবে। তার মানে এই না, বৃটিশদের চামচামি করতে হবে। যেটা স্যার সৈয়দ আহমদ করেছেন।
আমি বললাম: এটা হয়তো ঐসময়ে প্রয়োজন ছিলো।
বললেন: প্রয়োজন ছিলো কি ছিলো না সেটা মহাকাল বলে একটা ব্যাপার আছে, ইতিহাস বলে
একটা ব্যাপার আছে সেটা বলে দিবে।

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী তৃতীয় পর্ব পড়ুন ↓

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী (পর্ব ৩)

আমি আবার বললাম: বাঙালি মুসলমান এখন পর্যন্ত যতটকু অগ্রসর হয়েছে তাদের তো কিছু ভূমিকা
আছে।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন: অবশ্যই। কিছু না। অনেকটা ভূমিকা আছে। আজকে টাঙ্গাইল, তুমি হয়
তো কাদের সিদ্দিকীকে গালাগাল করবে। আমি তার চাইতে একটু বেশি গালাগাল করবো। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর ৭১ এর ভূমিকা, ইউ ক্যান্ট ইগনোর ইট। তারা প্লান করেছে আগরতলা হয়ে কুমিল্লা হয়ে দাউদকান্দি হয়ে তারপর এট্যাক করবে ঢাকা। এটা ছিলো মানিক সাহেবের পরিকল্পনা।
সেইখানে নুরুন্নবী সেকেন্ড ম্যান অব কাদের সিদ্দিকী, জ্যাকব এবং অরোরা এরা প্লান করলেন যে আমরা টাঙ্গাইল থেকে এট্যাক করবো। শত্রু ভাবতেই পারবে না যে আমরা টাঙ্গাইল দিক থেকে এট্যাক করবো।
মানিক সাহেবের পরিকল্পনা ছিলো যে ঢাকা দখল করবে। আর এদের পরিকল্পনা হচ্ছে মানুষ না মেরে, বাঙালিদের ওরা মারবে আর আমরা ওদেরকে মারবো, এইসবের মধ্যে না গিয়ে, আমরা সাডেনলি এট্যাক করবো। এখন কয়জন কাদের সিদ্দিকীকে, সবাই তো শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, যেন শেখ মুজিব বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তিরিশ লক্ষ লোক এমনই এমনই রক্ত দেয়নি তো। ব্যাপারটা এতো সহজ না। এবং যারা এখন দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক ইত্যাদি ইত্যাদি, তারাই তো মুক্তিযুদ্ধের মূল জিনিশগুলো রাখেনি। গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ, সমাজতন্ত্র তো উচ্চারণই করে না। ধর্ম নিরপেক্ষতার বালাই তো বহুদিন আগেই উঠে গেছে। মানুষকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে আবার বিএনপি জামাতমার্কা চিন্তাভাবনা করলে হবে না। একটা রাজনৈতিক দল! তাদের নেত্রী এতোবছর ধরে জেলে আছেন তারা একটা মিছিল পর্যন্ত করতে পারে না। যদি টেলিভিশন আর খবরের কাগজ না থাকতো তাহলে এই পার্টির কোনো চিহ্নই থাকতো না।

আপনার মতামত জানান

মাহবুব মুহম্মদ

মাহবুব মুহম্মদ; কবি ও প্রাবন্ধিক। ১৯৯১ সালের ৩০ ডিসেম্বর, সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার রুগনপুর গ্রামে জন্ম। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।