সাক্ষাৎকার

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী (পর্ব ৩)

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহবুব মুহম্মদ

আসাদ চৌধুরী! কবি হিশেবে যে বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন; একজন সমাজচিন্তক ও বিশ্লেষক কিংবা পণ্ডিত হিশেবে ততোটুকু পাননি। হয়তো সেটা গ্রহণেও তিনি এতোটা আগ্রহী নয়। এমনও কখনো কখনো মনে হয়, তার পাণ্ডিত্য কবিত্বের শক্তিকে কিছুটা হলেও অবদমিত করেছে। যতোটা আবেগ নিঃসরণ হয়েছে তার কবিতায় তারচেয়ে ঢের বেশি হয়েছে গ্রামীণ লৌকিক দর্শন ও লোকায়িত সংস্কৃতি বর্ণনায়। হ্যা, আবেগ ছিলো। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে আবেগ নিয়ে মেঘের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াননি। তার মধ্যে আবেগের কৃত্রিমতা নয়; ছিলো এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেটা তার কবিতা, প্রবন্ধ বা চিন্তায়।
কবি আসাদ চৌধুরী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সংকটের মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছিলেন, সেই যাত্রা তার চিন্তা ও প্রজ্ঞাকে করে তুলেছিল আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কবি হিশেবে আসাদ চৌধুরী যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে অনেক বেশি সমাজচিন্তক হিশেবে। অন্তত দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে। তার কিছু প্রমাণ হয়তো আমরা এই সাক্ষাৎকারেই পাবো।

যাই হোক, কবি আসাদ চৌধুরী কিছুদিন আগে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের একটি সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে । সম্মেলনের পূর্বে কবি ও গবেষক সৈয়দ মবনুর শাহী ঈদগাহের বাসায় আসাদ চৌধীরীর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। যেখানে ধর্ম, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নগরায়ন, সিলেটের আঞ্চলিক সাহিত্য ও বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। আলাপচারিতার সময় যেহেতু দীর্ঘ ছিলো তাই সেখানে কোনো বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অনেক সময় কবি নিজ থেকে কথা বলে গেছেন। এই দীর্ঘ আলোচনায় প্রথম থেকেই কবি সৈয়দ মবনু, প্রাবন্ধিক মীর ফায়সাল আলী, শৈলীর সাবেক সভাপতি হেলাল হামাম ও সাধারণ সম্পাদক ফিদা হাসান উপস্থিত ছিলেন। শেষের দিকে কবি নৃপেন্দলাল দাশ ও গল্পকার সেলিম আওয়ালের উপস্থিতি আলাপচারিতাকে আরো বেশি প্রাঞ্জল করে তুলেছিলো। এই গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতার বেশ কিছু অংশ শিল্প-সাহিত্যের ওয়েবজিন দ্রাবিড়-এ ধারাবাহিক প্রকাশ হচ্ছে। তৃতীয় পর্ব পড়ার আমন্ত্রন থাকলো। – মাহবুব মুহম্মদ

মীর ফয়সাল আলী আসাদ চৌধুরীর কাছে বৌদ্ধদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। জিজ্ঞাস করলেন:
বাংলাতে বৌদ্ধদের বিলুপ্ত হতে দেখলেও হিন্দুদের বেলায় এটা আমরা দেখি না। বৌদ্ধরা কেনো বিলুপ্ত হলো? রাজনৈতিকভাবে এরা নিরিহ ছিলো বলে?
আসাদ চৌধুরী কিছুটা প্রস্তুত হয়ে বললেন: এটা বলা মুশকিল। শ্রীলঙ্কা বা বার্মার দিকে থাকিয়ে কি এটা
বলা যায়? আজকের রোহিঙ্গারা কী বলছে? আজ হিন্দু তামিলরা কী করছে? ধর্মীয়ভাবে কেউ উগ্র কি উগ্র না এগুলো বলা মুশকিল। তবে আমি বলতে পারি, তুলনামূলকভাবে বৈষ্ণবরা শান্ত। যেকোনো কারণেই হোক ওরা শান্ত। ‘মেরেছে কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দিব না।’ এটা বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করে। এদের মাথা সবসময় নত থাকে। এটাই তাদের লক্ষণ। অন্যদিকে সুফিরা প্রেমিক। তারা মনে করে, হাজার হাজার কাবার চাইতে একজন মানুষের হৃদয় অনেক বেশি উন্নত। কিন্তু এরপরও দেখা যাবে, আমাদের এখানে যে সুফিরা এসেছেন তাদের লড়াই করতে হয়েছে। শাহজালাল, শাহপরাণকে লড়াই করতে হয়েছে। খান জাহান আলীকেও লড়াই করতে হয়েছে।

আমি বললাম: এদেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সুফিই তো ননপলিটিক্যাল না।
আসাদ চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমি সেটাই বলতে চাচ্ছি। কাজেই উগ্রতা ব্যক্তিবিশেষ নির্ভর করে।
আর বাংলাদেশে যারা বৌদ্ধ হয়েছিলেন তাদের প্রায় অধিকাংশই নিম্নবর্গের হিন্দু। ইস্ট বেঙ্গলে যারা আসছে তারা মোস্টলি ব্রাহ্মণ। এখানে কিন্তু বৈশ্য বা ক্ষত্রিয়ের সংখ্যা বেশি। সেনগুপ্ত, দাসগুপ্ত, সেন মিত্র।
ভাগিরতী যখন ভারতে চলে গেলো ঐটা গঙ্গা। পদ্মা যখন আসলো তখন কিন্তু সেই সম্মান পেল না। পদ্মাস্নানে সেই মর্যাদা নাই যেটা গঙ্গাস্নানে আছে। আসলে সময় মানুষকে উগ্র করে তুলে। অনেক হিন্দু জমিদার বৌদ্ধদের মন্দির গড়ার টাকা দিয়েছেন। আবার অনেক বৌদ্ধরাজা হিন্দুদের মন্দির গড়ে দিয়েছেন, লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেছেন। ডকুমেন্ট আছে এগুলার। পরবর্তীতে এই জিনিগুলো থাকে নাই। হিন্দুরা স্ট্রং হয়ে গেলে বৌদ্ধরা টিকতে পারলো না। আস্তে আস্তে পাহাড়ি এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হলো। মুসলমানদের সঙ্গে এটা করতে পারলো না কেনো? কারণ, হিন্দু নিম্নবর্ণ থেকে যারা মুসলমান হলো এদের কোনো পিছুটান নেই।

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন ↓

একান্ত আলাপচারিতায় আসাদ চৌধুরী (পর্ব ২)

নৃপেন্দ্রলাল আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত হয়ে বললেন: সিলেটে কিন্তু এটা দেখা যায় না। এখানে
যেমন খুব নিম্নবর্ণ হিন্দু মুসলমান হয়েছেন তেমনি উচ্চবর্ণের হিন্দুও। তবে সিলেটের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মুসলমান হয়েছেন সম্পদ রক্ষার জন্য।

আলাপের এই পর্যায় এসে আসাদ চৌধুরীসহ সবাইকে দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
খাবার টেবিলে বসে নৃপেন্দ্রলাল দাশ বললেন: প্রাচীন ভারতে খাবার বিষয়ে বেশ মজার একটা কথা
আছে। কোনো খাবার গ্রহণের আগে চারটা প্রশ্নের জবাব জেনে নিতে হবে। কে তৈরি করেছে? কখন তৈরি করেছে? কিভাবে তৈরি করেছে? কী দিয়ে তৈরি করেছে? বাংলা খাবারের মধ্যে ব্যাকরণ আছে। যেমন, পুরি এসেছে পুরুষ্ট থেকে। লুচি মানে লঘিষ্ট।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। একটু রেস্ট নিয়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের দিকে রওয়ানা দেই সবাই। সন্ধ্যার দিকে শুরু হয় কেমুসাস সাহিত্য সম্মেলন। পরদিন কবি ফিরে যান ঢাকায়।

আপনার মতামত জানান

মাহবুব মুহম্মদ

মাহবুব মুহম্মদ; কবি ও প্রাবন্ধিক। ১৯৯১ সালের ৩০ ডিসেম্বর, সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার রুগনপুর গ্রামে জন্ম। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।