গদ্যস্মৃতিগদ্য

আমার রফিক আজাদ

কবি রফিক আজাদ : ৮৩তম জয়ন্তী আয়োজন

কে প্রথম ভালোবেসেছি
কে প্রথম কাছে এসেছি/কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,
কিছুতেই পাই না ভেবে
কে প্রথম ভালোবেসেছি
তুমি?
না
আমি?

দু’জনের যে কেউ একজন প্রেমের এই প্রদীপখানি তুলে ধরতেই পারে জীবনপথের সরণিজুড়ে।
যে প্রেম হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে দাঁড়ায় অলক্ষে তার, সে তো চিরকালের সামগ্রী।
পদ্মপাতার মতো পত্রের ছত্রে ছত্রে আজো লুকিয়ে আছে প্রেমের জন্যে দুই কবি হৃদয়ের গভীর আর্তি, বেদনা, ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার জন্যে হাহাকার, নিত্যদিনের মান-অভিমানের তুলাদন্ড।
কে কতটা বেশি ভালোবাসে কাকে, এই চিরন্তন প্রশ্ন ও উত্তর মেঘ-বৃষ্টি-জল ছাড়া কে দেবে কাকে?
স্মরণ-বিস্মরণের পাতায়-লেখা থাকে আরও কত কি?
জানি তো, বিজ্ঞানীদের ভাষায় এক জাতীয় হরমনের অভাবেই মানুষ প্রেমে পতিত হয়। প্রকৃত অন্ধ ভালোবাসা তাই মানসিক সমস্যাই হয়ে দেখা দেয়। তবে মানুষের জীবনে যত সমস্যা আসে-যায়, তার অধিকাংশ অপ্রিয় আঁধারেই মেশে।
কিন্তু প্রেম যখন সমস্যা হয়েও দেখা দেয়, তখনো তা পরম আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবেই জগতের সকল মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে থেকেছে যুগ থেকে যুগে। সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত— প্রেম’-এর স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অজানার পথে, অনাদিকালের হৃদয়-উৎসবে।

সম্পর্কিত

আমরা দু’জনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলন মধুর লাজে

…প্রেম শুধু মিলনেই সলাজ নয়, বিরহেও তা আরক্তিম। তবে কখনো কখনো প্রেম কেবল সমস্যা নয়, তা মহামারি আকারেও দেখা দেয়।
তখন কিন্তু দু’জনের কারো নিস্তার থাকে না। তবে প্রেমের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মহান এক শক্তি। তার প্লাবনে চিত্তে বয়ে যায় আনন্দের সুরভি। সেই শক্তির তেজ এবং রমণীয়তায় সমাজ ও সংসারের সংকীর্ণ বাহুল্যতার সবকিছু ঝরে যায়।
মানুষ দিব্যি প্রেম-ভালোবাসার অমৃত সুধারস পান করে শৈল্পিকভাবে বেঁচে থেকে- তারা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। এখানেই প্রেমের অনাস্বাদিত অপূর্ব এক ঐশ্বরিক শক্তির মূল নিহিত থাকে গৌরবে-সৌরভে। একজন কবির সঙ্গে অপর কবির প্রেম, তার যতোটা না দৃশ্যত, ততোধিক, অন্তর্গত। পারস্পরিক বেদনাবোধের বাতায়ন থেকে উৎসারিত দখিনা হাওয়ার সারথি সে যে!আমার কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হয় রফিক আজাদকে দেখার আগেই পাঠক হিসেবে আমি তাঁর প্রেমে পড়েছি প্রথম। কবির প্রেমে কে না পড়ে?
যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রেমে সদা ব্যাকুল। নজরুলের প্রেমের আকুতিও আমাদের স্পর্শ করে যায় ক্ষণে ক্ষণে। জীবনানন্দ দাশ তো মরণবাণ, কেবলি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়…।

কবি রফিক আজাদ ও কবি দিলারা হাফিজ। ছবি : সংগৃহীত

চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া

তখন ১৯৭৯-১৯৮০ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষাও সাহিত্যে এম এ পাস করে, হলে থাকবার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান-এর ডিপ-ইন-এড কোর্সে।
ড. হালিমা খাতুন আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার কোর্সে গ্রন্থ সমালোচনার জন্যে আমাকে একটি বই দিলেন। কবিতার বই। ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবি রফিক আজাদ।
পত্রপত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে রফিক আজাদের কবিতা পড়েছি বটে, তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’ তখনো আলোচিত, সমালোচিত বহুলভাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত রফিক আজাদকে চিনতাম না আমি, তখনো জানিনে তাঁকে। বলা যায়, আমার কবিতা লেখা এবং প্রকাশের প্রণোদনার আকাঙ্ক্ষাই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁর কাছে।
১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থেই কবির বেশ কিছু বিখ্যাত কবিতা অন্তর্ভুক্ত আছে, যা আবৃত্তিকারদের কাছেও জনপ্রিয় বটে। সেই প্রথম গ্রন্থটি আদ্যপান্ত— পাঠ করে গ্রন্থ সমালোচনা লিখতে গিয়ে কবির কবিতার গভীরে প্রবেশ করি। নাম কবিতা ছাড়াও অন্য বেশকিছু কবিতা পাঠ করে কবির সূক্ষ্ম মনোবীণায় যেন খুঁজে পেলাম আমার আপন সুরটিকে। সারারাত জেগে অন্য কিছু নয়, শুধু বাতাসের শব্দ, যা কেবলি দীর্ঘশ্বাসময় এই হাহাকারের সঙ্গে কখন যে মন আমার একাত্ম হয়েছে নিজেরই অজান্তে—। আজ তা মনে করাও কষ্টের।
১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমির পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এ কবিতা প্রকাশের জন্যে দুটো কবিতা দিতে গিয়েছিলাম কবি ও সম্পাদক রফিক আজাদের টেবিলে। সেই প্রথম দেখা। ভালোলাগা দু’জনের।
সেখানেই প্রথম দেখি নাদিরা মজুমদার, শামীম আজাদ, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ আরও অনেককে। তারাও মূলত কবিতা দিতেই আসতো ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে। কিন্তু রফিক আজাদের তুমুল আড্ডা রেখে নড়তে পারতো না কেউ।


তাঁর বয়স, ঘর-সংসার, কোনো কিছুই জানা নেই আমার। শুধু জানি তিনি একজন বিখ্যাত কবি, মুক্তিযোদ্ধা, ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক, উপরন্তু আড্ডাপ্রিয় মানুষ। অথচ কবি হিসেবে মানুষটিকে আমার ভালো লাগতে শুর করেছে ক্রমেই। তাঁর কবিতা সম্মোহনমন্ত্রের মতো আমাকে টানে।


এভাবে কবি ও কবিতার আড্ডার জাদুতে পেয়ে বসেছিল আমাকেও। তখন আমি সরকারি কুমুদিনী কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক। চার দিন টাঙ্গাইলে থাকি, বাকি তিন দিনের জন্যে বাসে দুলতে দুলতে ঢাকায় ফিরে আসি রফিক আজাদের আড্ডার নেশায়। ইতোমধ্যে তিনি আমাকে একদিন রিকশায় পাশে বসিয়ে স্টেডিয়ামের ম্যারিয়েটা বইয়ের দোকানে নিয়ে যান। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ নামক ছন্দের বইটি কিনে আমাকে উপহার দেন। সেই সময় একমাত্র ম্যারিয়েটায় কলকাতার বইপত্র কিছু পাওয়া যেতো। ভালো কবিতা লেখালেখির জন্যে আরও কী কী বইপড়া উচিত, সেসব বিষয়ে উপদেশ দেন মাঝেমধ্যে। আমার কবিতা, কবিতার বানান নানা বিষয়ে সরস আলোচনা করেন। কিছুদিনের মধ্যে আমিও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে তাঁর আগ্রহের মাত্রাটি দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, কবি বোধ হয় আমার দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন অজান্তে। তাঁর বয়স, ঘর-সংসার, কোনো কিছুই জানা নেই আমার। শুধু জানি তিনি একজন বিখ্যাত কবি, মুক্তিযোদ্ধা, ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক, উপরন্তু আড্ডাপ্রিয় মানুষ। অথচ কবি হিসেবে মানুষটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে ক্রমেই। তাঁর কবিতা সম্মোহনমন্ত্রের মতো আমাকে টানে। যেখানে যাই, সেখানেই শুনি কবি এবং তাঁর কবিতার আলোচনা। আমার চারপাশের বাতাসে যেন কবির উষ্ণতা ভেসে বেড়ায়। প্রাণ-মন সদাই ছুটে যেতে চায় সেইখানে।
আড্ডার পরে, যথারীতি অফিসও ছুটি। বেলাশেষে একদিন একাডেমির বটতলায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, চলো তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাই।
কোথায়?
জিজ্ঞেস করতেই বললেন,
খারাপ কোনো জায়গা নয়, সাকুরা, রেস্তোরাঁ সাইটে বসবো তোমাকে নিয়ে। নির্জনে বসে কথা বলার জন্যে জায়গাটি বেশ ভালো। ভয় নেই।
আধুনিক কবি হতে হলে এতো ভয় পেলে কি চলবে?
ভাবলাম, তাইতো!
তা ছাড়া এভাবে কবির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম সেদিনই প্রথম। ভেতরটা একটু বা কেঁপেও উঠেছিল। পায়ের নিচে বাংলা একাডেমির সবুজ দুর্বাঘাস, মাথার ’পরে প্রাচীন বটের ছায়া। সেই বটবৃক্ষের পাতার ফাঁক গলিয়ে অপরাহ্ণের গোধূলি আলোয় তাঁকে অসাধারণ পৌরুষদীপ্ত মনে হলো। মনে হলো এক কবির কবিতার কথা :

প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।

… সে কি আমার বহুজনমের এক কাঙ্ক্ষিত প্রেমিক পুরুষ?

কবি রফিক আজাদ ও কবি দিলারা হাফিজ। ছবি : সংগৃহীত

ভালোবেসে সখী, নিভৃত যতনে

অন্তরের বার্তা বলে একটা কথা আছে। যাকে বলি আমরা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সেই যেন বলে দিল, এই কবিকে আমি ভালোবাসি।
কিছুতেই সে আমার সর্বনাশ করতে পারে না। আমি অনায়াসে যেতে পারি তাঁর সঙ্গে যথাতথা, যে কোনো দুর্গম স্থানেও। কাজেই ‘আমি যাবো না তোমার সঙ্গে, হে বান্ধব আমার’- এ কথা বলা আর সম্ভব হলো না।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন যেভাবে ছুটে যায় সকলে, আমার অবস্থাও তার চেয়ে কম কিছু নয়।
সামাজিক মানুষটি যখন ভর করে আমাতে, তখন ভাবি, এই কবিকে ভালোবাসা কি ঠিক হচ্ছে আমার?
তাঁর সম্পর্কে তো প্রায় কিছুই জানিনে। কোথায় তাঁর বাড়ি, কী তাঁর বংশপরিচয়, এমনকি তাঁর জেলার নামটি পর্যন্ত বলতে পারি না।
অথচ দিনে দিনে প্রেমের গভীর গিরিখাদে পড়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে একদিন তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম তাঁর নিজের কথা, আপন সংসারের খোঁজ সেদিন কিছু না বলে পরের দিন আবার সেই সাকুরায় বসে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার হলে গিয়ে পড়ো।’
বলেই সাঁই সাঁই করে উঠে বাথরুম অভিমুখে চলে গেলেন। আমি বসে আছি তো আছিই। একাকী চিঠিখানা নেড়েচেড়ে দেখলাম বার দুয়েক। হাতের লেখা দেখে চমৎকৃত হলাম। বাহ্ কী সুন্দর হস্তাক্ষর! তাঁর হাতের লেখাকেও যেন ভালোবেসে ফেললাম মুহূর্তেই।
ফিরে এসে টেবিলে বসতে না বসতেই ঘটলো সেই অঘটন। রফিক আজাদ হঠাৎই টুক করে আমার ঠোঁটে চুমু খেলেন। কমলালেবুর কোয়ার মতো পরিপুষ্ট তাঁর অধরোষ্ঠের অগ্নি-গহ্বর থেকে সুধাস্রোত দ্রুত ছুটে এল আমার আরক্তিম ঠোঁটে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি একেবারে হতবিহ্বল, লজ্জায় চোরাবালি যেন। এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
পরবর্তী তিন দিন ধরে আমি সেই চুমুর শিহরণ অনুভব করেছি বিদ্যুৎ চমকের মতো। বাথরুমে যাই, যখনই কোথাও একা হই, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত চরম এক পুলক অনুভব করি, আর মনে মনে ভাবি একটা চুমুর এতো শক্তি, এতো তেজ, অহংকারে যেন মুড়িয়ে দিল আমায়। তিন দিন তিন রাত জিনের আছরের মতো আমাকে প্রচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই শিহরণের অনুভব চেতনা।
তাহলে এর নামই কী তবে প্রেম বা ভালোবাসা? সকল সভ্যতা, জনমানব, জায়-জঙ্গল, নিন্দা-মন্দ, সমূহ কটুক্তি, সকল উজিয়ে নব আনন্দে যা বয়ে চলে স্বর্গ অভিমুখে, তাই-ই প্রেম।


বাধ্য হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরোজা আটকে মন খুলে পড়লাম জীবনের প্রথম চিঠিখানা। কবি আত্মার কুসুমের নরম পাপড়িগুলো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে সেখানে। চোখের জলের এক সরোবর সত্ত্বেও ভালোবাসার সৌরভে গৌরবে সেদিন ছোট্ট বাথরুমের জায়গাটি যেন অমল আকাশের ছোঁয়া পেল।


তখনো আমি রোকেয়া হলে সহকারী সুপার হিসেবে পার্ট-টাইম কাজ করি, বিনিময়ে থাকা ফ্রি। মেইন বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা কক্ষে থাকি। আমার রুম শেয়ার করি অঞ্জলি বণিক নামে বোটানির এক ছাত্রীর সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার লেনাদেনা সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুর মতো। আমার সব ব্যাপারেই তার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু কবির সঙ্গে আমার সম্পর্কে যে নতুন মোড় নিয়েছে, সে কথা আমি অঞ্জলিকে বলি না, প্রসঙ্গ তুললেই বড় বোনের মতো গম্ভীর হয়ে যাই।
কাজেই সেদিন হলে ফিরেই দেখি অঞ্জলি আমার জন্যে রান্না করে অপেক্ষা করছে। খাওয়া, গল্প নানাভাবে আমাকে আটকে রাখলো অনেক্ষণ, কিছুতেই একা হতে পারছি না। এদিকে পত্রখানি পাঠের জন্যে মন আকুল হয়ে উঠেছে। হলের পুকুরপাড়ে গিয়ে যে পড়বো তারও উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে সেও যাবে। কাজেই বাধ্য হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরোজা আটকে মন খুলে পড়লাম জীবনের প্রথম চিঠিখানা। কবি আত্মার কুসুমের নরম পাপড়িগুলো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে সেখানে। চোখের জলের এক সরোবর সত্ত্বেও ভালোবাসার সৌরভে গৌরবে সেদিন ছোট্ট বাথরুমের জায়গাটি যেন অমল আকাশের ছোঁয়া পেল। কবি লিখেছেন এক জায়গায় :

দিলা আমার,
তোমাকে, একমাত্র তোমাকেই আমি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া চলবে না আমার। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। আমি একটা ঝকঝকে শাদা দেয়াল নিয়ে ঘর করতে পারি। কিন্তু বাঁচতে পারি না। বাঁচার জন্যে, প্রচÊভাবে বাঁচার জন্যে, সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচার জন্যে তোমাকে প্রয়োজন। একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্যে তোমাকে প্রয়োজন। কবিতাই আমার কাছে জীবন, দৈনন্দিন ক্লেশকর আটপৌরে দুঃস্বপ্নে ভরা বা¯—বতাকে মেনে নিই মাত্র, আকর্ষিত হই না, আকাঙ্ক্ষা করি না। আকাঙ্ক্ষা আমার অমৃতের জন্যে- যে অমৃতের স্বাদ আমি তো এই প্রথম তোমার। কাছেই পেয়েছি। সব জেনে-শুনে যে তা দিতে পারে তাকে ‘অসাধারণ’ বলবো না তো কাকে বলবো বলো? তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ। ভালোবেসে আমি তোমাকে ধুলোয় নামাতে পারি না। তুমি নিজে কবি এবং নিরপেক্ষ থেকেই বলছি তুমি খুব ভালো লেখো। নিজেকে অযথা ছোট ক’রে দেখো না, দোহাই দিলা।
তোমার কষ্ট কী আমি বুঝি না। নিজে আমি কোনো কাজই করতে পারছি না, পদ্য লেখার ইচ্ছে পর্যন্ত হয় না- সর্বদাই বুকে ব্যথা- কী যে কষ্ট, ভালো লাগে না কিছুই, সর্বদাই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে দেখতে ইচ্ছে করে- শুনতে ইচ্ছে করে স্পর্শ পেতে চাই- গোপনে অন্যদের চোখ এড়িয়ে তোমার ছবিতে যে কতোবার চুমু খাই, দেখি, কী বলবো- আমার আর কিছুই ভালো লাগে না, তুমি ঠিকই বলেছ, ‘একজন মানুষের জন্যে একজন মানুষই যথেষ্ট- পৃথিবীর অন্য সব লোক ঈশ্বরের ব্যর্থ সৃষ্টি। ভালোবাসার কাছে সবই তুচ্ছ।’

তাঁর হাতে লেখা চিঠিখানা যতোবার পড়ি ততোবার মনে হয় কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গাওয়া সেই গানটির কথা ও সুর।

মরিলো, মরি, আমায় বাঁশিতে
ডেকেছে কে?
ভেবেছিলাম ঘরে রব
কোথাও যাবো না,
ঐ যে বাহিরে বাজিলো বাঁশি
বলো কী করি?

… অপরদিকে কবিপ্রেমের এই জোর আহ্বানে বৈষ্ণব পদাবলির রাধার মতো আমারও কেবলি মনে হচ্ছিল :

ঘর কৈনু বাহির,
বাহির কৈনু ঘর ॥


তুমি ফিরে এসো
দিলারা হাফিজ

ফিরতে চেয়েছি কত শত বার
পারিনি!
সবাই কি সব পারে?
পারে না!
তুমিও পারোনি—অদেখা সত্তার গভীরে ঐযে
রিমঝিম শব্দে বেজে যাচ্ছে নিত্য দুঃখভার
তাকে পারোনি ফেরাতে!

চেয়েছিলাম আমিও—-তুমি ফিরে এসো—
উপমাবিহীন এক চিকন পথ মেলে রেখেছে
তার খোলা বুক…

তুমি আসতেই পারতে নিঝুম কোনো এক
অদৃশ্য সন্ধ্যার রথে চেপে…

পথের দুধারে ছড়ানো যত আমার কষ্ট ও দুঃখের পাপড়ি
পুড়ে পুড়ে পবিত্র বিভূতি ছড়ালো
তুমি এলে না…তবু

চোখের সলিলে ডুবে গেলো খুচরো ঐ স্মৃতিদল!
দীর্ঘ হতে হতে দীর্ঘশ্বাসগুলো আমার ছুঁয়েছে আকাশ!

চিরবাঞ্ছিত তুমি—ফিরলে না…তবু আর!

২৭/১/২৫

আপনার মতামত জানান

দিলারা হাফিজ

দিলারা হাফিজ, কবি, অনুবাদক ও টিভি উপস্থাপক। ২০ নভেম্বর মানিকগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯৮ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয়। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ড ঢাকা-এর চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। ইউনেস্কোর অনুদানে পরিচালিত বিটিভি’র বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘সবার জন্যে শিক্ষা গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কবি রফিক আজাদ-এর সহধর্মিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।