তাজমহলের ভেতর দশ টাকায় ঢুকতে পারা গর্বিত বাঙালির মতো প্রজাতি পৃথিবীতে যেন আর দ্বিতীয়টি নেই; বিদেশিদের ঢুকতে যেখানে মোটা অঙ্কের টাকা লেগে যায়, দালালচক্রের দেয়াল টপকে দক্ষিণপ্রান্তে যারা পৌঁছে যেতে পারেন, বুদ্ধি থাকলে তারা একটা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন,
—ভাই সাহাব মেহেরবানি কর কে দো টিকিট দেনা, বহুত তকলিফ হো রাহা হ্যায় ধূপ মে খাড়ে হো কর।
সুবিধার জন্য বাঙালির মতো খাঁটি বৈষ্ণব, খাঁটি শাক্ত, খাঁটি বাউল, খাঁটি মুসলমান, খাঁটি হিন্দুস্তানি আর হয় না; আর যদি গায়ের চামড়াটা সাদাটে হতো তবে জগতে খাঁটি ইংরেজ তো এরাই একমাত্র! গিরগিটির রং এত বদলায় না—বাঙালি যতটা বদলে যেতে পারে মুহূর্তে। স্রষ্টার এ বিস্ময়কর সৃষ্টিলীলা দেখে দেখে মাশাল্লাহ্ বলে প্রায়ই চেঁচিয়ে ওঠেন আখতার সাহেব! সেদিনও তেমনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন যখন তাজমহলে প্রবেশ-টিকিট পাঁচশো টাকার বদলে দশ টাকায় কাটতে পেরেছিলেন এবং বাঙালি হিসেবে জন্মাবার প্রয়োজনীয়তা ও সার্থকতা নিদারুণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন; যখন তিনি আমলকি বনের ছায়া ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন প্রখর রোদের উত্তাপ হতে রক্ষা পেতে—দেখতে পেলেন গাছে-গাছে থোকা-থোকা ধরে আছে প্রকাণ্ড সব আমলকি, একেকটার সাইজ প্রায় টেবিলটেনিস বলের মতো!
দুনিয়ায় এতবড় আমলকি তিনি কোথাও দেখেননি, যদিও তার দেখা দুনিয়ার সাইজ খুব বেশি বড় নয় কিন্তু এটাও ঠিক যে, দুনিয়াটা আসলে নিতান্তই ছোট আর এতবড় সাইজের আমলকি ঠিক কী কারণে তিনি দেশে দেখতে পাননি এ-ও এক রহস্য বলে মনে হলো তার কাছে। তাজমহল আর কী দেখবেন, আমলকি বন দেখেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, বাংলাদেশের আমলকি তখন টিকটিকির ডিমের সমান মনে হতে লাগলো।
আমলকি বনে আখতার সাহেবের দীর্ঘ বিচরণ দেখতে পেয়ে দূর থেকে ছুটে এল এক ঝাড়ুদার, ঝরে পড়া আমলকি কুড়াচ্ছিল সে এতক্ষণ; এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ‘গাছে বা গাছের তলায় ঝরে পড়া কোনো আমলকিতেই হাত দেবার অনুমতি নেই কারো।’ তাতে কী! ঝাড়ুদারের তো অনুমতি লাগবে না, আখতার সাহেবের দিকে তাকিয়ে কানের এপাশ হতে ওপাশে অর্ধচন্দ্রের অপূর্ব এক লাজুক হাসি দিয়ে পকেটে হাত ঘুরিয়ে বের করে আনলো গোটা দশেক তাজা আমলকি। আখতার সাহেব কিছু বলার আগেই বলে উঠলো,
—দস রূপেয়া সাহাবজী, পেড় সে তোড়কর লায়া আপকে লিয়ে, গিরা হুয়া ফল হাম নেহি দেতে।
দশ টাকার একটি নোট দ্রুত বের করে অধিকতর আনন্দ আস্বাদনের লক্ষ্যে ফ্রেশ আমলকির পরিপুষ্ট নধর শরীরে কামড় বসাতেই দাঁতের ফাঁক গলে চিক্ করে যে রস বেরুলো তাতে, আহা! কী অপরূপ স্বাদ!—বলে চিৎকার করে উঠলেন আখতার সাহেব। এ কোন বেহেশতের বাগিচায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি রসালো আমলকি চিবুচ্ছেন! এমন স্বাদ, মাংস, সুবাস, এমন কচকচে পরিপুষ্টতা, যেন মর্ত্যে এসে স্বর্গের কোনো দেবতাই তা আস্বাদন করছেন!
—এই, তোমাকে গতমাসে নিউমার্কেট থেকে না এ সাইজের আমলকিগুলো কিনে দিয়েছিলাম বাবা! তখনতো এভাবে খেতে দেখিনি আর এখানে এমন অভুক্তের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমলকি খাচ্ছো! তুমি না?
আখতার সাহেব মেয়ের কথায় দমার পাত্র নন। দুটো আমলকি শেষ করার পরই মুখ দিয়ে কথা বেরুলো। নিনাকে বললেন,
—শোন, নিউমার্কেটে যা পাওয়া যায় তা এ জিনিস নয়, এটা এখানেই খেতে হয়, স্বর্গ থেকে নেমে আসা মানুষ যেমন আর স্বর্গীয় থাকে না মর্ত্যের প্রবণতা তাকে খর্ব করে, কাবু করে, তেমনি এ বাগানে যে আমলকি খেলাম তা স্বর্গে থাকতে থাকতেই খেয়ে নিতে হয়, বাজারে যেতে যেতে তার গুণাগুণ ও স্বাদ বাজারের মতো হয়ে যাবে।
নিবিড় তখন মায়ের সাথে সোজা তাজমহলের ওপর। রোদ এতটাই তেতে উঠেছে, মেঝেতে পা রাখা কঠিন; বাচ্চা হরিণের মতো লাফাতে লাফাতে তাজমহলের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটছে সে। ফারজানা আপা মানে আখতার সাহেবের সহধর্মিনী, নিবিড়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে ছায়া দেখে বসে পড়ছেন একটু পর পর, আর দূর থেকে আখতার সাহেবের আমলকি বনে গাছতলার তামাশা দেখছেন।
নিবিড় তখন মায়ের সাথে সোজা তাজমহলের ওপর। রোদ এতটাই তেতে উঠেছে, মেঝেতে পা রাখা কঠিন; বাচ্চা হরিণের মতো লাফাতে লাফাতে তাজমহলের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটছে সে। ফারজানা আপা মানে আখতার সাহেবের সহধর্মিনী, নিবিড়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে ছায়া দেখে বসে পড়ছেন একটু পর পর, আর দূর থেকে আখতার সাহেবের আমলকি বনে গাছতলার তামাশা দেখছেন। তিনি ভাল করেই জানেন আখতার সাহেবের তামাশা কেবল শুরু হয়েছে, শেষটা যে কী হতে পারে তা ভেবে আর সময় নষ্ট করলেন না, দূর থেকেই নিনাকে ইশারা করলেন বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে; মুখে আঙুল চেপে দেখালেন যেন কোনো কথা না বলে চুপ করেই থাকে।
—নিনা, তোমার মা’কে বলো ঠিকমতো তাজমহল দর্শন করতে, আমার সম্পর্কে তোমাকে কোনো পরামর্শ না দিয়ে।
আচ্ছা বাবা, এখানেও তোমরা এসব করবে? তুমিতো মায়ের সাথেই ওপরে উঠতে পারতে। একসাথে কতদিন কোথাও ঘুরতে যাওনি, এখানে আমলকি না চিবিয়ে মায়ের কাছে যাও না।
—এখানে আমলকি না চিবুলে তো ওখানে গিয়ে তোর মায়ের কথাই চিবুতে হবে, তখন?
আখতার সাহেবের শিশুতোষ বড় বড় দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে নিনা এতটাই হেসে উঠলো যে দূর থেকে সেই ঝাড়ুদার আবার দৌড়ে এসে নিনাকে মুঠোভর্তি আমলকি দিয়ে আরো দশ টাকার ইঙ্গিত করলো।
মেয়ের পকেটে আমলকিগুলো ভরে ঝাড়ুদারকে আরো দশ টাকা দিয়ে এবার তাজমহলের দিকে পা বাড়ালেন আখতার সাহেব। নিনা তখনো হাসছে, এ হাসির অপেক্ষাই করছিল সে এতক্ষণ, বাবাকে ছেড়ে তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, তার সঙ্গ ও স্পর্শ নিনার চিরকালের বাসনা। মায়ের ভেতরও সে বন্ধন দেখতে পেয়েছে নিনা, মাঝে মাঝে সামান্য ঈর্ষা হয়, মা এমন জীবনসঙ্গী কী করে পেল! এ ঈর্ষা তখন থেকেই যখন সে একটু একটু বুঝতে শুরু করেছে সম্পর্ক আসলে কী, কেমন তার রঙ, কোন তরঙ্গে ও অনুষঙ্গে টিকে থাকে তা! কিংবা টিকে থাকাই যে আসল কাজ নয়, তার বাইরে সুদূরতর মেলবন্ধনের একাঙ্ক হিসেব সে বুঝতে চায় কিন্তু পারে না; তার যে বাবার মতো একজন নেই, যে তাকে ভেতর থেকে আরো জাগিয়ে তুলতে পারে, নতুন করে সাজাতে পারে।
নিনার মা নিনাকে যতদিন সাজিয়েছিলেন, চুলের ফিতা বেঁধে দিয়েছিলেন, শাড়িতে কুচি করে দিয়েছিলেন ততদিন নিনা বুঝতে পারেনি যে, বাবাই তাকে প্রকৃত সজ্জা দিয়েছেন; অপূর্ব ক্ষমতা আখতার সাহেবের, নিনাকে অন্তর্জীবনের সে সাজ তিনি চেনাতে পেরেছেন এবং এটাই যে তাকে আরো দুর্বল করেছে পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত সব সক্ষমতা ও আত্মশক্তির ভেতরও। সে যে কী, সেই গহীন কথাটি, নিনা জানে যে তার বাবা টের পায় তা, কিন্তু এটুকু দূরত্ব না থাকলে যে নিনা তার বাপের ছায়ায় হারাতেই থাকবে ক্রমাগত, এও সে বুঝতে পারে।
ফারজানা আপাও বোঝেন, কিংবা বোঝেন না; সব বুঝতে যেয়ে কী হতে কী হয়ে যাবে, তখন? মেয়েকে নিয়ে স্বামীর কাছে তার নানান অনুযোগ; কোনো মেয়ের জন্য এই সমাজে এত অনুভূতিশীলতা, এত আত্মনিবিড়তা ভালো নয়। কে বোঝে কার কথা, আখতার সাহেব নিজেই নিজেকে বুঝতে চান না, মেয়েটাকে শেষমেষ একা করেই ছাড়বেন। পিতার সান্নিধ্য মেয়েরা চিরকালই খুঁজে বেড়ায়। ফারজানা আপা ভাল করে জানেন সে মেয়েদের কথা যারা পিতা অন্তঃপ্রাণ; তাদের পরিবেদনার কথা, যারা ভেতরে ভেতরে দীর্ঘ অসুখি জীবন কাটান এক পর্যায়ে।
কেন? পিতাকে খুঁজে বেড়ায় তারা সবখানে, পিতার মতো প্রেমিক, পিতার মতো বন্ধু, পিতার মতো স্বামী, পিতাহি পরমন্তপঃ হয়ে ওঠে সেইসব অনুভব! কী হবে, তার মেয়ের যদি এমন হয়! আখতার সাহেব এসব কথার কোনো উত্তর দেন না, কেবল ফারজানা আপাকে শান্ত হতে বলেন, আর বলেন মেয়েকে ছেড়ে দিতে মেয়ের হাতে। কে কবে ঠিক করতে পেরেছে কারও গন্তব্য ও ভবিষ্যত! আখতার সাহেবের এসব কথা নিনার মা যে বোঝেন না তা নয় কিন্তু মায়ের মন, দুনিয়ায় কোনো মা-ই চান না তার মেয়ে খুব বেশি সূক্ষ্মবোধসম্পন্ন হোক, তাতে যে দার্শনিকতার ভিত গড়ে উঠবে ভেতরে সংসারধর্ম করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাপারটা কি এমন? কী জানি! আখতার সাহেবতো এভাবে মনে করেন না। তবু, ফারজানা আপা, নিনার মায়ের মন বলে কথা…
আজহার ফরহাদ-এর আরও গল্প
● ক্রমাগত চুম্বনের খেরোখাতা ● কথাগাড়ি ও তার গন্তব্য
দুই.
একবার নাথবৈরাগীর হাটে, মানে আখতার সাহেবের গ্রামের বাড়ি, যখন তিনি সবেমাত্র নামাজ পড়া শুরু করেন, রোজা রাখতে গিয়ে ভুল করে পানি গিলে ফেলতেন প্রায়শ; যখন তারাবির নামাজ পড়তে পড়তে হঠাৎ আকাশের তারা গুণতে শুরু করেন মসজিদে—অপলক দাঁড়িয়ে থেকে ভুলে যান রুকু ও সেজদার কথা, বন্ধু বিল্লাল যদি না হাত ধরে টান দিত তাহলে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতেন রাতভর—ছাদখোলা মসজিদের বারান্দায়। এমন সব কাণ্ডকীর্তির স্বভাবধর্ম ছিল তার, কিন্তু কেউ কিছু বলতে চাইত না সহজে তার সম্পর্কে, যদিও বা বলতো—উল্টো বহুগুণেই প্রশংসা করতো। আত্মভোলা আখতার সাহেব ছোটবেলা হতেই মানুষের প্রিয়, লোকে তাকে চান্দু বলে ডাকতো, আকাশের চাঁদ তারা খুঁজে বেড়াতেন কি না।
এই চান্দু আর তার বন্ধু বিল্লাল, এসএসসি পরীক্ষার সময় যার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বেলাল আহমেদ; আসলে এ নামটি আখতার সাহেবই ঠিক করে দিয়েছিলেন। বন্ধুকে বলেছিলেন বিল্লালটা আমার জন্য রেখে দে, আমি ডাকবো; কিন্তু এ নামে লোকে ডাকতে থাকলে তুই চিরকাল বিল্লালই রয়ে যাবি বড় হতে পারবি না। আসলে বেলাল আহমেদ ওরফে বিল্লাল, আখতার সাহেবের ছায়াসঙ্গী ছিলেন, বন্ধু বলতে বিল্লালই ছিলো তার সবচেয়ে কাছের। আমলকি বাগান পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিল্লালের কথাই মনে হতে লাগলো এখন। যদি বন্ধু আজকে এখানে থাকতো তাহলে ভ্রমণের আনন্দ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।
কেন? এর কারণ অবশ্য অনেক পুরনো। নাথবৈরাগীর হাটে তখন খুব বড় বড় আমলকি ও পেয়ারার বাগান ছিল। হিন্দু জমিদারদের পুরনো সেসব বাগান; দেশভাগের পরও, সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাবার পরও সেসব বাগানের বেশকিছু অংশ তখনও টিকে ছিল বিশেষ এক কারণে। এক বিরাট মঠ ও আশ্রমকে কেন্দ্র করেই ছিল বাগানগুলি। মানুষ ভয়ে ভয়ে সেখানে খুব একটা যেতো না। লোককথা আছে এ নিয়ে, শ্যামাসুন্দরীর থান ও গয়ানাথের মঠ মিলে বেশ বড় এ আশ্রমটি আসলে রহস্য ও অলৌকিকতার আকরস্থল।
প্রথম যখন বিল্লালকে নিয়ে আখতার সাহেব মানে চান্দু সেখানে ঢুকে পড়ে তখনকার কথা বলা যাক। গয়ানাথের শিষ্য কায়ানাথ গোঁসাই খপ করে দুই বন্ধুর ঘাড়ে ধরে একেবারে মঠতলায় নিয়ে যান। দুজনের পিলে চমকে যাবার উপক্রম, এই বুঝি প্রাণ গেল! না, কিছু হয়নি। কায়ানাথ গোঁসাই এদের ধরে এনে খুব করে পায়েস ও ফলাহার খাইয়ে দিলেন। ভরপেট আহার করার পর ওদের সাথে নানান গল্প করলেন, একটু সহজ ও স্বাভাবিক হবার পর যখন ওরা মন খুলে কথা বলতে শুরু করলো তখন কায়ানাথ গোঁসাই বিল্লালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তোর যা করার করে নে বাবা, মনের যা খুশি, বেশিদিন পৃথিবীতে থেকে কাজ নেই, আগামীকাল তোর দিব্যজন্ম হবে! পুণ্যগর্ভ পাবি! চান্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন আবার, বন্ধুকে দেখে রাখিস বাবা, ওকে একলা কোথাও যেতে দিস না।
গয়ানাথের আশ্রম হতে ফিরে আসার পরই আখতার সাহেব মানে চান্দুর মন বড় উতলা হয়ে পড়লো। এরপর প্রায়ই বন্ধুকে নিয়ে সেখানে যাওয়া শুরু করেন। সেসব গল্প বিস্তর আলাপ করা যাবে, কিন্তু মূলে যে কথা সে বিল্লাল মানে বেলাল আহমেদ, একসময় একটা বইয়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি, যদিও তার বাবার আগেই একটা ছোট পুরাতন বইয়ের ব্যবসা ছিল, সেটাকেই বড় করে শুরু করেন তিনি। সে দোকানে আখতার সাহেবের সময় কাটতো অনেক। আসলে তিনি পাহারা দিতেন বন্ধুকে, কায়ানাথের সে কথার সত্যতা বুঝতে চাইতেন।
সত্যি সত্যিই বিল্লাল মারা গেল একদিন, ক্যান্সারে! তাকে আর রক্ষা করা গেল না। তখন কায়ানাথ গোঁসাইও বেঁচে নেই, আশ্রম ও মঠেরও প্রায় ভগ্নদশা; আমলকি ও পেয়ারার বনে মড়ক লেগেছে বসতির, শূন্যতার দৃশ্যপট যেন চিতায় তুলে দিয়েছে আস্ত এক জনপদের অস্তিত্বকে। বন্ধু বেলাল আহমেদ, মারা যাবার আগে কেবল একটি কথাই বলে যেতে পেরেছিলেন তাকে,
—শুনেছি তাজমহলে শাহজাহান এক বিরাট আমলকির বন সৃষ্টি করেছেন। দুনিয়ার সেরা সেই ফল একদিন খেতে যাব তোকে নিয়ে। আচ্ছা, সেখানে কি এমন মঠ ও আশ্রম আছে? আমার খুব ইচ্ছা সেখানে গিয়ে ঘুম দেবার।
ধুর বোকা! তাজমহলের ভেতর এসব কোথায় পাবি?
—না, কায়ানাথ গোঁসাইতো বললেন যে ওখানে অনেক আশ্রম ছিল সাধুদের। আর সাধুরা আমলকির বন সৃষ্টি করেন সেসব স্থানে। তবে উনি একটা কথা বলেছেন যে, দুনিয়ায় সবচেয়ে সেরা আমলকি হলো তাজমহলের। সে আমলকি খেলে নাকি দেহে-মনে কোনো রোগবালাই থাকে না।
বাসনার মৃত্যু হয় না সহজে! বাসনা মরলেই কেবল আত্মার মরণ হয়।
বন্ধু বেলালের কথায় আখতার সাহেবের মনে হতে থাকে এখনই তাকে নিয়ে যদি চলে যেতে পারতেন সেখানে। কিন্তু তার আগেইতো বন্ধু চলে গেলো অনন্তের পানে। তার সে অতৃপ্ত বাসনার জন্য কি তাকে আবার ফিরে আসতে হবে! জানা নেই। কায়ানাথ গোঁসাইয়ের কথায় রহস্য আর রহস্য! কে জানে? কিন্তু তাঁর একটা কথায় আখতার সাহেবের প্রবল আস্থা জন্মেছে, সে হলো,
—বাবা, বাসনার মৃত্যু হয় না সহজে! বাসনা মরলেই কেবল আত্মার মরণ হয়।
তিন.
এতক্ষণে আখতার সাহেব তাজমহলের ওপরে চলে এসেছেন। নিবিড় মকবরা দর্শনে ব্যস্ত, আখতার সাহেবের সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই, ফারজানা আপা তখনো মেঝেতে বসে বাতাস খাচ্ছেন, বাতাস ঠিক নয় উত্তরে যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাসের মর্ম অনুভব করছেন। একফোঁটা বাতাস না থাকলেও বাতাসের মর্ম অনুভব কীভাবে করা যায়, তা আখতার সাহেবের মতো মানুষের সাথে সংসার করলে অসম্ভব কিছু নয়। এবার তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে বসেই সে মর্মহাওয়া খেতে খেতে যমুনাতীরের ছোট ছোট শিশুদের স্নান করার দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
ফারজানা আপার সাথে আখতার সাহেবের প্রথম দেখা আসলে এমনই ছিল। কেমন? আখতার সাহেবের তখন বয়স ছয় কি সাত হবে। বাড়ির পাশে শীতলক্ষ্যা নদীতে একবার যমুনাতীরের ন্যাংটো শিশুদের মতোই তাকে দেখেছিলেন নদীতে ডুব দিতে, সে কথা ফারজানা আপা অনেকদিন গোপন রেখেছিলেন। যেদিন বলেছিলেন সেদিন আখতার সাহেব লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে এবারও দেখতে পেলেন আখতার সাহেব আজও লজ্জায় লাল হয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে আছেন।
—আচ্ছা, তুমি এখনো লজ্জা পাও ? তোমার এত বয়স হলো তবু এ লজ্জা কাটে না?
কাটবে কী করে, তুমিই যে সেই মেয়ে, সেটা আমি যখন জানলাম তখন থেকে সেদিনের কথা ভুলতে পারিনি।
—কেন?
তুমিতো আমার বউ নও ফারজানা, তুমি আমার আত্মার অনুষঙ্গ। যখন অন্ধকারে পথ দেখতে পাই না তখন তোমার আলোকোজ্বল মুখ দেখতে পাই, সেই আমাকে পথ দেখিয়ে দেয়।
আমি ডুব দিয়ে উঠেই দেখতে পেয়েছিলাম যে একটি মেয়ে আমাকে দেখছিল এতক্ষণ ধরে, সে ছিল এক লজ্জার আর তাকেই যে বিয়ে করে সে লজ্জাকে জীবনভর আলিঙ্গন করতে হবে এর মত পরম লজ্জার ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি আছে দুনিয়ায়?
—নিজের বউয়ের কাছে কোনো লজ্জা থাকতে নেই। এসব মানায় না।
তুমিতো আমার বউ নও ফারজানা, তুমি আমার আত্মার অনুষঙ্গ। যখন অন্ধকারে পথ দেখতে পাই না তখন তোমার আলোকোজ্বল মুখ দেখতে পাই, সেই আমাকে পথ দেখিয়ে দেয়।
—তো তোমার গুরু দেখান কী, আমিই যদি দেখিয়ে দিই?
আমার গুরু, তোমার নানা কমরেড রুস্তম আলী ওরফে লালুচাঁন ফকিরের প্রতিচ্ছায়া হলে তুমি। তোমাকে দেখলে তাঁকেই যেন দেখতে পাই।
ফারজানা আপা বেশ অস্বস্তিতে পড়েন এসব কথা শুনে। কোথায় তাজমহল দেখতে এসেছেন আর এখানে বসে বসে তার স্বামীর আজব সব কথাবার্তা শুনছেন। লোকটা আসলে তার নানার চেয়েও বড় পাগল। নানাসাহেব তো তাকে আরেকটা পাগল ধরিয়ে দিয়েছেন আজীবনের জন্য কিন্তু নিনার জন্য কি তিনি কাউকে খুঁজে বের করতে পারবেন?
আখতার সাহেব ফারজানা আপার উদ্বেগের কথা বুঝতে পারলেন কি না জানা গেল না। নারীর অন্তর্লোকের গভীর গভীরতর সে উদ্বেগের কথা কেউ জানতে পারে না, পরমস্রষ্টাও সেখানে এসে একসময় শূন্যে দিলেন উড়া…।