- বছর দেড়েক মেঘলায়ঘেঁষা সুনামগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন শেখ লুৎফর । সীমান্ত পেরুলেই ভারতের মডং-রেঙ্গা-চেলার বাজার। ছুটির দিনে প্রায়ই চলে যেতেন চোঙ্গা বেয়ে। মিশেছেন পাহাড়ি জনপদের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন বড়গল্প ‘আচিক মান্দি’। পাঁচ পর্বের গল্পটির শেষ পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। -সম্পাদক
৫. বাংলাদেশ বাংলাদেশ
সূর্যটা লাউবা পাহাড়ের গা বেয়ে নিচের দিকে আড়াল খোঁজছে। কমলা রং পৃথিবীটা ধীরে ধীরে প্রজাপতির পাখার মতো লাল—কালো, সাদা—হলুদ, কালচে—সবুজ…, তারপর ঝুপঝুপ অন্ধকার নামবে। সত্য—মিথ্যা, পাপ—ছোয়াব, সুন্দর—অসুন্দর নিয়ে তালগোল পাকানো আমাদের জীবন। তাই জীবনের সব সত্য সুন্দর না। সভ্যতার বিচারে কিছু কিছু অশ্লীল, অসুন্দর সত্যকে আমরা ভাষা দিয়ে কিছুটা মার্জিত করে নিয়েছি। ফলে পেট—পিঠ, শত্রু—মিত্র, প্রেম—কাম—ভালোবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য জটিল শব্দ আমাদের পিঠের দিকে সবসময় বর্শা তাক করে রাখে।
আমরা এখন ডিজিটালাইজড। ভারত সরকার অনেক আগেই পাহাড়ে শিক্ষা—চিকিৎসা, বিদ্যুৎ এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে। তাই আমার প্রিয়তমা প্রত্যাশা দেবী একটা ঘোরের মাঝে আমাকে জঙ্গলের দিকে টানছে আর বলছে, জঙ্গল ফকফক, জঙ্গল ফকফক…।
তারা আজ কেন বলবে, জঙ্গলে নিয়ে তোমাকে আমি নিচে ফেলে এই এই করব?
প্রত্যাশা আমাকে টানছেই। পাটকাঠির মতো শরীরে শক্তি দেখে আমি স্তম্ভিত! তার নাক—মুখ হয়ে উঠেছে পাকা টমেটোর মতো লাল। নিঃশ্বাসে আগুন! একটা ঘোরের মাঝে, বিকারের মাঝে সে এখন বকছে, ও…ও…মজা পাইছে…।
এইসবে আমার মন ভরে না। মুখ ভার করে বুঝি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন মা। মায়ের পেট থেকে মা—মাটির বুকে এসে চোখ খুলতেই প্রথমে দেখেছিলাম জননীর ক্লান্ত—বিধ্বস্ত মুখ। তাঁর পেরেশান কণ্ঠ সবার আগে আমার কানে মধুবর্ষণ করেছিল, আমার সোনা—মানিকরে আমার বুকে দ্যাও…।
কেমন জানি কষ্ট কষ্ট লাগে। আমি থমকে দাঁড়াই। কাঁটাতারের ওপাশে একটু একটু করে অন্ধকার নামছে। জড়াজড়ি করা আলো আর অন্ধকারের মধ্যে আমার সোনার বাংলা মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোদিন তাঁর দুঃখী সন্তানেরা পেট ভরে খেতে পারেনি, নিজের ঘরে শান্তিতে একটু ঘুমাতে পরেনি, চোর—ডাকাত—খুনি—লুচ্চা আর দেশী—বিদেশী লুটেরারা…।
প্রিয়তমা প্রত্যাশা, তুমি আমার আত্মা। তাই তোমার সাথে আমি মিথ্যা বলতে পারি না। আজ থেকে সাতশ বছর আগে ইবনে বতুতা বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। ‘ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা’ বইয়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন : ‘টানা তেতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে বাংলাদেশে পৌঁছলাম। সবুজ ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্যসব জিনিসও এত বেশি সস্তায় পাওয়া যায় সে দেশে, এরকম আর কোথাও দেখিনি। তবে দেশটির আর সবকিছু হতাশাব্যঞ্জক। খুরাসানের লোকেরা দেশটিকে বলে, ‘এ হেল ফুল অব গুড থিংস।’
শোন প্রত্যাশা, অনেকদিন হয় মায়ের বুক থেকে পালিয়ে এসে বনে বনে ঘুরছি। কতদিন কারো সাথে বাংলায় একটু কথা হয় না। তোমার মুখে খাসিয়া—বাংলা শোনে প্রাণটা আমার হাহাকার করছে।
আমি শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রত্যাশা অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়। কামনায় সে নাগিনীর মতো ফোঁসছে। এখন তাকে বাধা দিলে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো সময় তার চিরল চিরল চোখ দুটোতে দপকরে আগুন জ্বলে ওঠবে! একে তো পরদেশ, তার ওপর মেঘালয়ের খাসিয়া! পুলিশ, বিএসএফ কেউ তাদেরকে সহজে ঘাঁটায় না। এরা ক্ষেপে গেলে দাবানলের মতো এগিয়ে আসে। তাই তারা এই ডিজিটাল যামানাতেও অনেকখানি স্বাধীন মানুষ।
চতুর্থ পর্ব পড়ুন ↓
আমি চটপট হাত জোড় করে বলি, আমার সাংমা দেবী, একটা মিনতি আছে।
সে আমার বিনয় দেখে হেসে ওঠে, আমার লাগির কও।
আমি হৃদয় থেকে মিনতি করি, প্রিয়তমা সাংমা রাণী, তুমি আমার সাথে বলো, বাংলাদেশ…।
সাংমা হেসে হেসে বলে, বাংলাখানো?
আমি বুক উজার করে আবার বলি, বাংলাদেশ…।
সে আবার বলে, বাংলাখানো।
হতাশায় আমার মনটা ভেঙে পড়তে চায়। এই পাহাড়ি মেয়েটা তার সহজ অভ্যাস থেকে বেরুতে পারছে না। আমার বুকে ধকধক করে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার পলল বুক, সালাম—রফিক, মতিউরসহ লক্ষ লক্ষ শহীদের উজ্জ্বল মুখ! তাই আমি তার চোখে চোখ রেখে গৌরবের গলায় উচ্চারণ করি, বাংলাদেশ…।
সে বাংলা…বাংলা…করে থেমে গিয়ে আমাকে আবার টানতে শুরু করে।
এইটাই রীতি। সে আমাকে টেনে টেনে নিয়ে যাবে পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে। তারপর আমার উপর উঠে ‘মন খাইছে’র পারীক্ষা চালাবে। যার সাথে জীবন কাটাবে তাকে পরখ করে নিবে না? যতটুকু জানি, ওরা চার—পাঁচ মিনিটেই ঢলে পড়ে। একটু পরে আবার শুরু করবে। এইভাবে কম পক্ষে তিন—চারবার।
প্রত্যাশার মুখে বাংলা বাংলা শব্দটা শোনবার পর, একজন স্বপ্নবাজ বলিষ্ঠ প্রেমিক হিসাবে আমি তাকে তিড়িংবিড়িং করা ছাগল ছানার মতো বুকের সাথে ঝাপটে ধরি। একটু শক্ত শক্ত মিষ্টি শরীরটা আমার দেহে মিশে গেছে। লম্বা লম্বা কয়টা চুমো খাই। সে হাঁসফাঁস করে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার আমাকে দখল করতে চায়। আমাকে নিচে ফেলে এখানেই কী শুরু করবে?
নীরবে লড়াই চলে। পুষ্প—পতঙ্গের রাগ—অনুরাগ। আমি প্রত্যাশাকে ছাড়ি না। ডালিম ডালিম বুক দুটো পিষ্ট হচ্ছে আমার বুকে। তার চুল—গাল—কপালে চুমোর বন্যা বয়ে দিয়ে আবার মিনতি করি, প্রিয়তমা প্রত্যাশা, তুমি যা চাও সব পাবে। শুধু তার আগে তোমাকে আমার সাথে পস্ট করে বলতে হবে, বাংলাদেশ…বাংলাদেশ…।
মেঘালয়ের পর্বত ঘেরা চিলাই নদীর খাড়– পানিতে দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশ! বাংলাদেশ…বলে একাই পাগলের মতো চিৎকার পারছিলাম। কয়েক বারের পর দেখি আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যাশাও চিৎকার দিচ্ছে, বাংলাদেশ! বাংলাদেশ…।
আপনার মতামত জানান