গল্প

আচিক মান্দি [তৃতীয় পর্ব]

সমতলের টগরের ঘামের গন্ধ নিতে লটকি ফুল লম্বা লম্বা দম টানে। জংলি টগরের ঘাম ঝাঁঝালো বলেই পাহাড়ি লটকি ফুলের পাপড়িতে শিহরণ বয়ে যায়। তার লালচে-হলুদ শরীর থেকে ভুরভুর করে বেরুচ্ছে হালকা সুবাস। চোরা-সুঘ্রাণে আমার মাথার চুল পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।

সম্পাদকীয় নোট
  • বছর দেড়েক মেঘলায়ঘেঁষা সুনামগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন শেখ লুৎফর । সীমান্ত পেরুলেই ভারতের মডং-রেঙ্গা-চেলার বাজার। ছুটির দিনে প্রায়ই চলে যেতেন চোঙ্গা বেয়ে। মিশেছেন পাহাড়ি জনপদের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন বড়গল্প ‘আচিক মান্দি’। পাঁচ পর্বের গল্পটির তৃতীয় পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। -সম্পাদক

৩. লিজা সাংমা ও ঈগল উপাখ্যান

প্রত্যাশা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে। একটুখানি মুচকি হাসি দিয়ে জানতে চায়, ক্যামনে আসে বন্ডু?
আমি নিজের অজান্তে ফিসফিসাই, চামে আসে বন্ডু!
তার মিষ্টি আর সুরেলা হাসিতে আমিও যোগ দেই। হাসতে হাসতেই পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনি ক্যামনে আসে বন্ডু?
ঘাগরায় ময়ূরীর পেখম মেলে প্রত্যাশা গেয়ে ওঠে, ও…ও…অখলাইন।
মানে সে ফুর্তিতে আছে।

সম্পর্কিত

আমরা পাশাপাশি হেঁটে একটা ঝাপখোলা দোকানে ঢুকি। চার-পাঁচজন পাহাড়ির হাতে গ্লাস, আঙুলের ফাঁকে জয়হিন্দ বিড়ি পুড়ছে। তাদের চোখ কৌতুহল শূন্য এবং আত্মমগ্ন। বিশ-ত্রিশ বছর আগেও পাহাড়ের ছায়া ঘন হলে দুই-একটা হরিণ জঙ্গলের পাশে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকত। আজ হরিণ, খরগোশ, অজগর নাই। ঘরে বানানো মাঠাও মদের সাথে অজগরের মাংস এখন শুধু স্মৃতি।

আগে সে বসে। ইশারায় আমাকেও বসতে বলে। তার চোখে বন-পোড়া-আগুন, জুম চাষের মৌসুমী হাওয়া। আমার নির্ভার লাগে। অজানাকে জানতে চাওয়া মানুষের জন্মগত চরিত্র। তাই পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহে, একমাত্র মানুষেরা প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন জীবন উপভোগ করছে।

খাঁটি পর্যটকের মতো কৌতুহল আর বিনয়ী প্রেমিকের মতো আনুগত্যে আমি তার পাশে অনড় বসে থাকি। সমতলের টগরের ঘামের গন্ধ নিতে লটকি ফুল লম্বা লম্বা দম টানে। জংলি টগরের ঘাম ঝাঁঝালো বলেই পাহাড়ি লটকি ফুলের পাপড়িতে শিহরণ বয়ে যায়। তার লালচে-হলুদ শরীর থেকে ভুরভুর করে বেরুচ্ছে হালকা সুবাস। চোরা-সুঘ্রাণে আমার মাথার চুল পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। আমি চারপাশে নজর বুলাই: পাহাড়িরা গ্লাস হাতে তাদের মাঝেই ডুবে আছে। একটু দূরে চিলাই নদীর বুকে ঝলমল করছে মিষ্টি বিকাল।

সে আমার চোখে চোখ রেখে যেন কিছু বলতে চায়। তবে কি সে পাহাড়ের ‘মন খাইছে’র কথা বলবে? শোনাবে কি বিখ্যাত সেই গল্পটা? একাত্তরে ফোরকান মিয়া নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ভারতের সীমান্ত-ঘেঁষা বাংলাদেশের ঝুমপাহাড়ে ছিল তাঁদের ক্যাম্প। ওপাড়েই লংত্রাই পাহাড়। বাংলা-ভারত সীমান্ত বলতে মাঝখানে একটা খাল। প্রত্যাশার ঠাকুমা তখন ষোলতে পড়েছে। দেখতে অবিকল তার মতো। পানির জন্য কলসি নিয়ে দিনে তিন-চারবার খালে আসে। ক্যাম্পে থাকলে ফোরকান ঝুমপাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে লিজার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকত। কোনো কথা কিংবা ইশারা না দিয়ে সে শুধু পাহাড়ের নিঃসঙ্গ ঈগলের গলা নকল করে ডাকতো, কু…ও…ও…।

একদিন-দুইদিন। তিন নম্বর দিন তোমার ঠাকুমা লিজা দেখে, টিলার মাথায় মানুষটা নাই। সে ফোরকানের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সারা হৃদয় দিয়ে ডেকে ওঠে, ও…ও মানুখান ক্যা?

শেষ রাতে অপারেশন থেকে ফিরে এসে ফোরকান ঘুমে ঢলে পড়ে ছিলেন। এখন দুপুর গড়ায়। খালপাড় থেকে ডাক আসছেই, ও…ও… ওখান মানু কই?
ফোরকান ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। তারপর জঙ্গল ফকফক। পাহাড়ের জঙ্গলে ফোরকানের বুক ভেসে যায় লিজার ঘামের মিষ্টি গন্ধে!


দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন ↓

আচিক মান্দি [দ্বিতীয় পর্ব]


জঙ্গল ফকফকের পর তিন মাস ফোরকানের কোনো দেখা নাই। লিজা দিনের বেশিরভাগ সময় খালপাড়েই কাটায়। কোনো আমোদ নাই, জঙ্গল ফকফক নাই, চোখ দিয়ে খালি টপটপ পানি পরে। মাঝে মাঝে ঝুমপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে গাই হরিণির মতো আর্তনাদ করে, ওখান মানু ক্যা…? ও…ও… মানু রে…, তর লাগির আমি আর সাদি করবে না। সবসমর থাকবে। ত্যা ওখান ভগমান দ্যাখবে।

অক্টোবর মাসে সামনা-সামনি এক লড়াইয়ে ফোরকানের ডান পা হাঁটুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি-খাওয়া পা নিয়ে সহযোদ্ধাদের কাঁধে চড়ে সে চলে আসে এপাড়ের পাহাড়ে। ভর্তি হয় মেঘালয়ের ‘ইকোওয়ান মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টার হাসপাতল’ এ। বিছানায় শোয়ে শোয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপন করে। তিন মাস পর হাসপাতাল থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে আসে ঝুমপাহাড়ে। লিজা খালপাড়ে চামড় গাছের নিচে তখনও বসে আছে। আগের রূপ-রঙ নাই। একটা অসার ভঙ্গিতে ঝুমপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বিলাপ করে, ও…ও… ওখান মানু ক্যা? তর লাগির খুব দুঃক পাইছে।

ফোরকান লিজার হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে লংত্রাই পাহাড়ে চলে আসে। পরনের সবুজ শার্ট-প্যান্ট খুলে পরে নেয় আদিবাসীর গেঞ্জি-হাফপ্যান্ট। খাসিয়া হয়ে তোমার ঠাকুমার হাত ধরে গীর্জায় গিয়ে ওঠে। আমার প্রিয়তমা প্রত্যাশা, ওইযে দেখো, লংত্রাই পাহাড়ের উপত্যাকায় ফোরকান বস্তি। তার বংশদরের সংখ্যা এখন অনেক। তাদের খাসিয়া দেহ, চকচকে ঘি রঙ চামড়া কিন্তু খাড়া খাড়া নাক আর ভাসা ভাসা চোখ দেখলে ফোরকানের কথা মনে পড়বে।

প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক গলায় দোকানিকে বলে, মাঠাও…।
দোকানি ষোল থেকে বিশের ঘরে জ্বলজ্বল করছে। মুখটা চওড়ায় পানপাতা সাইজ, নাকটা হাঁসের মতো হলেও হলুদ চামড়া দিয়ে ঘি ঝরছে। এবং তার চিকন কোমরে যৌবনের ঠমক…।

মেঘালয়ের আদিবাসী সমাজে মন খাওয়াটা পাপের কিছু না। বিয়ে ছাড়া যদি মা হয়ে যায় তাতেও অসুবিধা নাই। সমাজ এইসব দেখে না। মেয়েরাই সংসারে, সমাজে কর্তা। সন্তানটা তার পরিচয়ে বড় হবে।

বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ নিয়ে আমাদের সামনে মাঠাও আসে, সাথে দুইটা গ্লাস, প্লাস্টিকের বাটিতে ডালের ছোট ছোট বড়া। দরকার ছাড়া দোকানে কেউ কথা বলছে না। সবাই গ্লাস হাতে, কানে কিংবা আঙুলে বিড়ি। তাদের কাঁধ বেয়ে পেটের পাশে নেমে এসেছে কাপড়ের ব্যাগ। গোলগলা গেঞ্জির নিচে ঢোলা হাফপ্যান্ট। ব্যাগ থেকে বগলের নিচ দিয়ে উঁকি মারছে ধারালো দা-এর হাতল। তারা পান-সুপারি, কমলা বাগানে কাজ করে। ফাঁকে ফাঁকে দম নিতে দোকানে আসে। এরা ঝর্ণার পানির মতো ঠাণ্ডা এবং ভেতরে ভেতরে সরস।

বসার সময় প্রত্যাশার কাঁধ আমারটার সাথে লেগে গেছিল। এখন হাত উঠা-নামা করতে গিয়ে আমাদের কনুই দুইটা পরস্পরকে ছুঁয়ে ফেলছে। চুমো খাচ্ছে! এবং এর মধ্যেই সে পানির ওয়ার্ডর দিয়েছে, বিলও দিবে। এখানে এইটাই নিয়ম। এইভাবে সে আমার উপর কর্তৃত্ব ফলাবে। কারণ প্রত্যাশা ঘরে-বাইরে কর্তা।

আমরা একটু একটু পান করছি। রসের জোয়ারে চারপাশের প্রতিটা শব্দ-গন্ধ ও দৃশ্য মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। হাতে একটা দামি রত্ন থাকলে নিজেকে যেমন আলোকিত, উদ্ভাসিত ইত্যাদি ইত্যাদি লাগে তেমনি আমি ভেতরে ভেতরে ফুর্তিতে আছি। আমি পর্যটক। ইবনে বতুতা, সৈয়দ মুজতবা আলী এবং হালযামানার মঈনুস সুলতানের বংশদর। আমরা দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে কী দেখি? প্রকৃতি আর মানুষ। বিচিত্র খাবারের স্বাদ নিয়ে জীবন ধন্য করি। কিন্তু জীবন ও সভ্যতাকে অনুধাবন করার জন্য আমি মানুষকে দেখতে চাই একদম শেকড় থেকে।

প্রত্যাশা, তুমি শুনে খুশি হবে যে, বাড়তি আবেগ আমার নাই। আবেগ মানুষকে অন্ধ ও পঙ্গু করে। আমাদের নিজের জীবনটাই তো নিজের না। তা না হলে আমি আত্মহত্যা করতে চাইলে আইন কেন বাধা দেয়? কারণ আমরা সভ্যতার দাস। তাই একজন নারীর মাঝে মুখ ডুবিয়ে আমরা সারাজীবন গু-মুতে গড়াগড়ি খাই, কামড়াকামড়ি করি।

আমার প্রিয়তমা, তোমরা নিজেদেরকে ‘আচিক মান্দি’ বা পাহাড়ের মানুষ বলে গৌরব কর। তাই পর্বতের আড়ালে, বিশাল বৃক্ষ আর মেঘের ছায়ার নিচে তোমরা এখনো একটুখানি স্বাধীন মানুষ। তোমাকে স্যালুট দেবী।

আমরা সপ্তমবার গ্লাস ভরে নেই। সে তার বাঁ উরুটা একটু এলিয়ে দিতেই আমার উরুর চামড়া-হাড়-মাংসে অনেক বর্তা বয়ে যায়। একটু লম্বাটে গড়নের চিকন চোখ দুইটা তার জ্বলছে। বড়া নেবার জন্য বাটিতে হাত দিলে লেগে যাচ্ছে আঙুলে আঙুল। তার গরম নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে আমার প্রশ্বাসে। ভেঙে পড়ার মতো এইসব মুহূর্তে মন জানতে চায়, আসলে প্রেম কী? কেন আমরা স্বর্গীয় আনন্দে, গোলাপের পাপড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে উলঙ্গ হই?

আপনার মতামত জানান

শেখ লুৎফর

শেখ লুৎফর; কথাসাহিত্যিক। ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহরে গফরগাঁওয়ে জন্ম। পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত গল্পের বই: ‘উল্টারথে’ [২০০৮], ‘ভাতবউ’ [২০১৩] ‘অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি’, [২০১৭]। উপন্যাস: ‘আত্মজীবনের দিবারাত্রী’ [২০১১], ‘রাজকুমারী’ [২০১৯]।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।