গদ্যস্মৃতিগদ্য

অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায়

গল্প, গানে রাত বাড়ে। রহমান ভাইয়ের চোখ ঢুলুঢুলু করে, চোখ বুজে কথা বলতে-বলতে কখনো তিনি ঝিমুচ্ছিলেন। পরক্ষণেই হাই তুলে আবারও কথায় মুখর হচ্ছেন।

রোনাকালের মৃত্যুময় দিনরাত। তখন মানুষের পেছন-পেছন ছুটে চলত মৃত্যু। কারও সঙ্গে কারও খুব একটা দেখা হতো না। গৃহবন্দি এমনই এক সময়ে দীর্ঘদিন পর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। রহমান ভাই মানে বাউলশিল্পী ও গীতিকার আবদুর রহমান। প্রয়াত সাধক-মহাজন শাহ আবদুল করিমের প্রধান শিষ্যদের একজন তিনি। করিম আদর করে তাঁকে ডাকতেন, ‘রহমান সাধু’।

সেই ‘রহমান সাধু’ করোনাপরিস্থিতিতে দীর্ঘকাল সিলেটে আসেননি। অথচ প্রতি মাসেই দু-একবার তাঁর সিলেট আসা হতো। অনেকদিন সশরীর-সাক্ষাৎ না-হওয়ায় রহমান ভাই সে-বার সিলেট পৌঁছেই আমার অফিসে আসেন। পরিচয়ের পর থেকে এত দীর্ঘ ব্যবধানে তাঁর সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে। তাই সেদিন রহমান ভাইকে পেয়ে অনির্ধারিত এক আড্ডাও জমে গেল। ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, বাড়তে থাকে আড্ডারুদের সংখ্যাও। এ অবস্থায় সবাইকে নিয়ে অফিসের পাশের এক রেস্তোরাঁয় যাই।

সম্পর্কিত

করোনাকাল হওয়ায় রেস্তোরাঁতে কোনো ভিড় ছিল না। জনমানবহীন, শান্ত-নীরব রেস্তোরাঁ মুহূর্তেই মুখর হয় রহমান ভাইয়ের দরদি কণ্ঠে। সে-সন্ধ্যায়ই রহমান ভাই শুনিয়েছিলেন সে গান, ‘কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়’। গান শুনতে-শুনতে চমকে উঠি, কেবল আমি নই, যাঁরা শ্রোতা ছিলেন, সকলে। গান শুনতে-শুনতেই আমার চোখে ভাসছিল শৈশবে দেখা এক চড়ুইয়ের মৃতশরীর। প্রচণ্ড খরতপ্ত এক দুপুরে ছটফট করতে-করতে মরে-যাওয়া সেই চড়ুইয়ের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক চড়ুই। আমার হঠাৎ করেই মনে হলো, দাঁড়িয়ে থাকা সেই চড়ুইয়ের যন্ত্রণার উত্তরাধিকার হয়েই যেন-বা রহমান ভাই গাইলেন এ গান :

যেতে চাইলে কেমনে রাখব আমি কুলবধূ
তুমি ছেড়ে গেলে আমার কায়া থাকবে শুধু
অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায় ॥

সেদিনের অনির্ধারিত সেই গানের জলসার পুরো ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে রেখেছিলাম। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ গান আপলোড দিই। পরিচিতজনদের অনেকে তখন গানটি শুনে রহমান ভাইয়ের রচনাশৈলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন, কণ্ঠের তো বটেই। ধীরে ধীরে এ-শ্রোতা ও-শ্রোতা আর এ-শিল্পী ও-শিল্পী হয়ে গানটি ছড়ায়। ফেসবুক থেকে ইউটিউবে, অনেকের মুখে মুখেও গানটি ছড়াতে শুরু করে। তবে আমার মতো অনেকেই মজে যান গানের একটি লাইনে, ‘অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায়’। এমন থমকে দেওয়া অভিনব উপমা সচরাচর এখনকার গানে খুব একটা মেলে না। এই এক পঙ্ক্তিতেই রহমান ভাই তাঁর জাত চিনিয়ে দিলেন যেন!

ঠিক কী কারণে জানি না রহমান ভাই নিজেই সে-সন্ধ্যায় গানটি গাওয়ার জন্য বাছাই করেছিলেন। একে তো বহুদিন পর দেখা, এর মধ্যে পেছনে ফেলে আসা করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে অন্য অনেকের মতো আমাদেরও তো নাই হয়ে যাওয়ার অনেকটা সম্ভাবনা ছিল! সেই বিচ্ছেদ-ভাবনা থেকেই কি তবে রহমান ভাই এমন গান কণ্ঠে ধরেছিলেন সে সন্ধ্যায়? জানি না, জানার চেষ্টাও করিনি। তবে সে-সন্ধ্যায় আমাদের অনেককেই এ গান ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছে, মগজে তৈরি করেছে ঘোরগ্রস্ততা।
সে-সন্ধ্যার বেশ পরে এক কাজে রহমান ভাইয়ের জেলা হবিগঞ্জে গিয়েছিলাম। কাজের ফাঁকে ছুটে যাই তাঁর বাড়িতে, এক রাত ছিলামও সেখানে। অঘুমা সে রাতে রহমান ভাই তাঁর অতিথিশালায় বসে যাপিত জীবনের নানা গল্প শুনিয়েছিলেন। বাইরে নিশুতি পাখিরা ডাকছিল। কখনো রহমান ভাই তাঁর মুর্শিদ শাহ আবদুল করিমের স্মৃতি, কখনো তাঁর নিজ গ্রাম আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা থেকে কীভাবে ঘাটুগানের উৎপত্তি— সেসব বলছিলেন। আবার কখনো কখনো শুনাচ্ছিলেন তাঁর গ্রামের দোর্দ-প্রতাপশালী তেরোজন জমিদারের উত্থান-পতনের গল্প। বর্ণাঢ্য অতীতের সাক্ষী হিসেবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকা গ্রামের তেরোজন জমিদারের নিঃসঙ্গ জমিদারবাড়ির অট্টালিকার গল্প বলতে-বলতে রহমান ভাইও বিষণ্ন হয়েছিলেন।

গল্প, গানে রাত বাড়ে। রহমান ভাইয়ের চোখ ঢুলুঢুলু করে, চোখ বুজে কথা বলতে-বলতে কখনো তিনি ঝিমুচ্ছিলেন। পরক্ষণেই হাই তুলে আবারও কথায় মুখর হচ্ছেন। এভাবে সময়ের অলিগলি পেরিয়ে রহমান ভাই একটানা কথা বলেই চলছিলেন। ফজরের আজানের বেশ কিছুটা আগে, অদ্ভুত এক মায়াময় সময়ে আমার অনুরোধে রহমান ভাই ধরলেন সেই

গান :
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায়
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায়।

তোমায় নিয়ে দিবানিশি সুখে থাকব বলে
মা-বাপ ছাড়িলাম আরও ছাই দিলাম কূলে
তোমায় নিয়ে অভাগিনী সুখে থাকব বলে
মা-বাপ ছাড়িলাম আরও ছাই দিলাম কূলে
থাকিও না আমায় ভুলে, ধরি পায়
থাকিও না আমায় ভুলে, ধরি পায়
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায়।

যেতে চাইলে কেমনে রাখব আমি কুলবধূ
তুমি ছেড়ে গেলে আমার কায়া থাকবে শুধু
যেতে চাইলে কেমনে রাখব আমি কুলবধূ
তুমি ছেড়ে গেলে আমার কায়া থাকবে শুধু
অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায়
অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায়
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায়
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়।

তুমি বিনে আমারে আর কে দিবে সান্ত¦না
এ জীবনে সইলাম কত লোকেরও গঞ্জনা
তুমি বিনে আমারে আর কে দিবে সান্ত¦না
এ জীবনে সইলাম কত লোকেরও গঞ্জনা
আবদুর রহমান কিছু চায় না দুনিয়ায়
আবদুর রহমান কিছু চায় না দুনিয়ায়
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায়
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়।
কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়।
না আসিলে অভাগীরে প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু
প্রাণে মারিবায় রে বন্ধু, প্রাণে মারিবায়।

রহমান ভাইয়ের গান শেষ হওয়ার মিনিট দশেক পরেই পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে। গ্রামের রাস্তার ঠিক পাশেই ছিল রহমান ভাইয়ের অতিথিশালা, তাই ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাওয়া মুসল্লিদের চলাচলের শব্দও ঘর থেকে অনায়াসে পাওয়া যাচ্ছিল। অতিথিশালার ভেতরে আলো জ্বলতে দেখেই সম্ভবত কোনো কোনো মুসল্লি বলে যাচ্ছিলেন, ‘রহমান চাচা, সজাগ না কিতা বা?’ পরে কিছু সময়ে জন্য আমরাও ঘরের বাইরে বেরোই। চরাচরজুড়ে নেমে এসেছে ভোরের পেলবতাময় অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা।

গ্রামীণ রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে পুনরায় রহমান ভাইয়ের অতিথিশালায় ফিরে আসি। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কোন পরিপ্রেক্ষিতে কবে তিনি লিখেছিলেন ‘কথা দিয়া যাও রে বন্ধু আসিবায়’ গানটি। রহমান ভাই জানান, আনুমানিক উনিশ শ নব্বই সালের দিকে এ গানটি তিনি রচনা করেছেন। তখন বাউলশিল্পী ও গুরুভাই রোহী ঠাকুরসহ (প্রয়াত) তিনি সিলেট শহরের কুয়ারপাড় এলাকায় মঈন নামের একজন সংগীতানুরাগীর বাসায় ভাড়াটিয়া থাকতেন। সংসারবাসনা ত্যাগ করে অনেকটা ঘরছাড়া হয়ে বিচ্ছেদের মধ্যে বসবাস করছিলেন। সে-সময়ে তাঁর অন্তরের ভাবনা-চিন্তা থেকেই গানটির জন্ম হয়।

রহমান ভাই জানান, কুয়ারপাড় এলাকার যে বাসায় তিনি থাকতেন, সেটা নিরিবিলি ছিল। দিনের বেলাও সেখানে শান্ত পরিবেশ থাকত। এক রাতে তাঁর মধ্যে এ গানের ভাবনা জন্ম নেয়। পরে টানা তিন থেকে চারদিন সময় নিয়ে তিনি এ গানটি রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম গানের সংকলন ‘ভাটির সুর’ বইয়েও গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে এ বই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার উৎস প্রকাশন থেকে।

গানের মূল ভাবার্থও রহমান ভাই আমাকে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যে প্রেম, বন্ধুর সঙ্গে যে প্রেম, অর্থাৎ একটা বন্ধু আছেন আমার ভেতরে। একদিন হয়তো আমি চলে যাব, তবে তখন একটা আধ্যাত্মিক প্রেম ঠিকই থেকে যায়। এটা যেন বন্ধু মনে রাখে, এ আশাতেই গানটা লেখা। যদি বন্ধু আমাকে মনে না রাখে, তাহলে তো দুর্দশা দূর হবে না। বন্ধু যদি ভালো না বাসে, তার যদি মায়া না পাই, তাহলে তো আমার মরণেও শান্তি নাই। আমি তো হলাম জীবাত্মা, বন্ধু হলো পরমাত্মা। জীবাত্মা নিয়ে যদিও আমি মারা যাই, এরপরও জীবাত্মার একটা অংশ থাকে, তখন ওই অংশটি বন্ধুর দেখা পাওয়ার জন্য উতলা হয়। সেই নিগূঢ় সময়ে যেন তারে পাই, প্রাণপাখি যাওয়ার সময়কালে যেন বন্ধুকে পাই, এ আশাতেই গানটি লেখা।’

ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে যখন সূর্যের আলো অতিথিশালার দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল, তখন আমরা ঘুমোতে যাই। ঘণ্টাদুয়েক ঘুমোনোর পর নাশতা সেরে রহমান ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে রওয়ানা দিই। কিন্তু সে বাড়ি, অতিথিশালায় কাটানো সে রাত আমার পিছু ছাড়ে না। আমার প্রায়ই মনে পড়ে সে রাতের কথা, বারবার বুকের গহনে নাড়া দিয়ে যায় সেই পঙ্ক্তি, ‘অমাবস্যা লাগবে রে বন্ধু পূর্ণিমায়’।

আবদুর রহমান যেন এক চিত্রকর। জলরঙে এঁকেছেন আত্মা-পরমাত্মার দৃশ্যকাব্য। সে কাব্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মন কেমন করা সব পঙ্ক্তি। ঘোর লেগে আছে সে গানে, সেই কণ্ঠে। অনিঃশেষ এ সুর, এর যেন কোনো শেষ নেই।

আপনার মতামত জানান

সুমনকুমার দাশ

সুমনকুমার দাশ; ১৯৮২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামে জন্ম। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। লোকায়ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সত্তরেরও অধিক। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাউল-ফকির: পরিচিতি ও গান, বাংলাদেশের ধামাইল গান, বাউলকোষ, বাউলসাধনা লালন সাঁই ও অন্যান্য, লোকভাবন, লোকগান লোকসংস্কৃতি, বেদে-সংগীত, আমাদের শান্তিনিকেতন উল্লেখযোগ্য। তাঁর সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে বেরোচ্ছে গানের কাগজ দইয়ল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।