একটা সময় ছিলো খ্যাতনামা গায়করা রাজাদের দরবারে খেয়াল গাইতেন, সাধারণ শ্রোতারা এসব বুঝতেন না বা তারা শোনা থেকে বঞ্চিত হতেন। এজন্য দেখা গেছে খেয়াল বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরম্পরায় দীক্ষিত শিল্পী ও শ্রোতা সংখ্যায় খুব অল্প, অন্যদের তুলনায়। তবে বোদ্ধা।
কিন্তু শিল্পীর সংসারের চাকা এই অল্পে ঘোরানো সম্ভব নয়। অনেকের মতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্মান অক্ষুন্ন রেখে দিনের পর দিন সাধনা করা মূলত অস্তিত্বের সাথে লড়াই করা। শুনেছিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পীরা আধুনিক গান, লাইট মিউজিক বা ফিল্মি গান করতেন না। জানিনা এ শ্রেণিবৈষম্য কেন ছিলো। কিন্তু ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান খেয়াল ঠুমরির পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক চাওয়া একজন ফিল্মি গায়ক ছিলেন। আর তাঁর পরের প্রজন্মের পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, ওস্তাদ রশিদ খানসহ রাগসঙ্গীতে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা এসে এ বৈষম্য থেকে সঙ্গীতকে রক্ষা করেছেন। খেয়াল গানের পাশাপাশি আধুনিক, সেমিক্ল্যাসিক, ফোক, ঠুমরি, গাজালসহ সবধরণের গান গেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যেকোনো গানই শ্রেণিতে নিচু নয়। সবই গান।
এ বৈষম্য তৈরি হওয়ার পেছনে কিছু সূক্ষ্ম কারণও আছে। যেমন ধরুন, একজন গায়ককে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য তাকে যখন খাসভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সম্বোধন করা হয়, তখন অন্যান্য শিল্পীদের কাছে তিনি ভগবান হয়ে ওঠেন। তার কাছে অন্য শিল্পীরা তখন খুব নিম্নশ্রেণির মনে হয়। ফলে এ ধারার সঙ্গীতে তালিম নিতে মানুষ ভয় পায়। ভাবে আসলেই কি এটা সবার জন্য, না ভগবানের বিশেষ দয়াপ্রাপ্তদের জন্য! কিন্তু এক্ষেত্রে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর এক বক্তব্য আমাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি প্রথমেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নামকরণে আপত্তি জানিয়েছেন, সম্বোধন করেছেন রাগসঙ্গীত নামে। কারণ তিনি দেখেছেন একটা শ্রেণি রাগসঙ্গীতকে শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সম্বোধন করে এক মহিমান্বিত ধারাকে সবার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। এর দ্বারা মূলত রাগসঙ্গীত চর্চাকারীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এক সাক্ষাৎকারে তো ধমক দিয়ে বলেছেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আবার কী? এটাকে রাগসঙ্গীত বলুন। কোনো গান কি শাস্ত্রের বাহিরে আছে? একটা সময় ক্ল্যাসিকাল বা রাগাশ্রয়ী গানে নির্দিষ্ট কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট বাজতো, ধীরে ধীরে যখন পশ্চিমের সাথে মিলিত হলো, তখন দেখা গেলো রাগসঙ্গীতকে যে পাত্রেই রাখা হোক; পাত্রটা যদি কানুন মেনে তৈরি হয়, তাহলে তা শ্রবণযোগ্যই হবে। তার প্রমাণ আগের প্রজন্মের পণ্ডিত রবি শঙ্কর, তারপরে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত আচার্য্য জয়ন্ত বোস, আর এখন তো সিম্ফনি অরকেস্ট্রাতে প্রায় নিয়মিতই কাজ করছেন উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী শ্রীমতী কৌশিকী চক্রবর্তী।
সময় বদলায়, সাথে চাহিদার ধরণও। এতো বদলানোর মাঝে সঙ্গীতের সংস্কার, রাগসঙ্গীতকে সময়ের সৌন্দর্যে রাঙানো এবং সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিলো। তার চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে এবং থাকবেও। মূলত সঙ্গীত হচ্ছে ‘প্রকৃতির সৌন্দর্যের শ্রুতি গ্রাহ্যতা’। এখন মানুষের কাছে সহজে পৌঁছানো যায়, কিন্তু সকল পৌঁছানো সাফল্যের নয়। এই সময়ে সঙ্গীতে সাফল্যের কথা ভাবার আগে ভাবতে হবে আমি সময়ের দাবি মেনে দাঁড়িয়ে আছি কি না! যখন দাবি মেনে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসবে, তখন আপনাকে ধ্রুপদী ধারার রাগসঙ্গীতের কথা ভাবতে হবে। নইলে সময়কে ধরা মুশকিল। আর সময়কে পাকড়াও করতে না পারলে তার দাবি রক্ষা করা যায় না। তখন একঘেঁয়ে জীবন পার করে অভিশাপ দিতে হয় পৃথিবীর নানান রীতির সমাজব্যবস্থাকে।