প্রবন্ধ

রফিক আজাদের কবিতা: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক ‘সত্য’ ইতিহাস

কবি রফিক আজাদ : ৮৩তম জয়ন্তী আয়োজন

রফিক আজাদ বাংলাদেশের কাব্যধারায় একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। রাষ্ট্রের সঙ্গে নানা তৎপরতায় সক্রিয় রফিক আজাদের কবিতায় শৈল্পিক সৌকর্যের অন্তরালে গভীরভাবে ধরা পড়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক ‘সত্য’ ইতিহাস। জাতীয়তাবাদী গালগল্পের ভেতর চাপাপড়া সত্যকে তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছেন আঁকাড়া শব্দের চাবুকে। ষাটের দশকে যে রফিক আজাদ নাগরিক ক্লেদ, অবক্ষয়, বিবমিষা ও বৈকল্যকে কবিতার অন্তর্প্রদেশে স্থাপন করে হয়ে উঠেছিলেন বোদলেয়ারীয় নেতিবাদী চেতনার ধারক, স্বাধীনতা-উত্তর তিনিই আবির্ভূত হয়েছেন একজন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায়। বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা সম্পর্কে এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদের বক্তব্য হচ্ছে, ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণের সাহস বুদ্ধিজীবীর থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, স্বাধীনতার আগে ও পরে, অতিমাত্রায় রাষ্ট্রনির্ভর ও শাসকশ্রেণির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের শোষণ ও অনিয়মকে যে সকল কবি-সাহিত্যিকরা বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জোগান দেন, রাখাল রাহার ভাষায় তারা হলেন ‘কালচারাল লিটারারি দালাল’। রাখাল রাহার এই অভিধাটি ধার করে বলা যায় রফিক আজাদ অন্তত একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত এই ‘কালচারাল লিটারারি দালাল’দের বিপরীত ভূমিকা রেখেছেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিতকালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে এর মতো আপসহীন কাব্য এবং একাব্যের অন্তর্গত ‘ভাত দে হারামজাদা’র মতো কবিতা লেখার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলেও সে সাহস অব্যাহত ছিল। সত্তর-আশির দশকে কবিদের একাংশ যখন রাজনৈতিক মঞ্চে আত্মহুতি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, রফিক আজাদ তখনও রাষ্ট্রের সঙ্গে সার্বক্ষণিক মোকাবেলায় উচ্চকণ্ঠ। দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি একজন বুদ্ধিজীবীর যে দায়, রফিক আজাদ অন্তত আশির দশক পর্যন্ত তা পালন করেছেন। ফলে তাঁর কবিতার ভেতর যে ইতিহাস ধরা পড়ে, দরবারি ইতিহাসে তা আর কল্কি পায়নি।

অঙ্কন : আর করিম

রফিক আজাদ অনবরত রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন, দাঁড়িয়েছেন ক্ষমতার বিপরীতে, কিন্তু তিনি নৈরাজ্যবাদী নন। মিশেল ফুকো আধুনিক রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন মানুষের মনের উপর রাষ্ট্রিক খবরদারির জন্য। তাঁর সর্বেক্ষণবাদ (প্যান-অপটিসিজম) তত্ত্বের মূলভিত্তিই হলো পুঁজিরাষ্ট্রনাগরিকদের যেভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চায় তা জেল-নজরদারির চেয়েও ভয়াবহ। তিনি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান- বিদ্যালয়, সামরিক বাহিনী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালকে ‘প্যান-অপটিসিজম’ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখেছেন। রফিক আজাদ মিশেল ফুকোর এই উত্তরআধুনিক চিন্তা দ্বারাও প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেননি। তিনি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের পক্ষে একজন লিবারেল, গণতান্ত্রিক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক। তাঁর স্বদেশপ্রীতি এবং স্বদেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা প্রবল, যে কারণে ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সামরিক বুটে পদানত রাষ্ট্রের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। রফিক আজাদের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মারণাস্ত্রের অবনমন, জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্যনিরোধ সবকিছুর মূলে রয়েছে তাঁর কল্যাণকামী মানবতাবাদী সংবেদনশীল হৃদয়। রফিক আজাদের কবি-চৈতন্যের এই কল্যাণকামী চেতনা ক্রম-রূপান্তরের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।


শুধু রফিক আজাদ নন ষাটের অপরাপর কবিদের মধ্যেও এই নাস্তিচেতনার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো সমালোচক ষাটের কবিদের সমাজ-বিশ্লিষ্টতার জন্য সামরিক শাসনের একনায়কতান্ত্রিক নিষ্পেষণকেই দায়ি করেছেন। এমনকি রফিক আজাদও ষাটের নৈরাশ্য-প্রবণতাকে শৈল্পিক দ্রোহ হিসেবে গণ্য করেছেন।


 

অসম্ভবের পায়ে

ষাটের দশকের কবিদের সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ হলো তাঁরা সমাজ ও রাজীনতি-বিমুখ। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে “শৈল্পিক ফ্যাশন” হিসেবে তারা উচ্ছৃঙ্খলতার ভেতর আমোদ অনুসন্ধান করেছেন । শুধু রফিক আজাদ নন ষাটের অপরাপর কবিদের মধ্যেও এই নাস্তিচেতনার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো সমালোচক ষাটের কবিদের সমাজ-বিশ্লিষ্টতার জন্য সামরিক শাসনের একনায়কতান্ত্রিক নিষ্পেষণকেই দায়ি করেছেন। এমনকি রফিক আজাদও ষাটের নৈরাশ্য-প্রবণতাকে শৈল্পিক দ্রোহ হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সামরিক শাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি ভেঙ্গে এই তরুণ কবিকুল স্পষ্টসুরে রাজনৈতিক বক্তব্য উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হলেও ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভ থেকে আত্মপীড়ণে নিমগ্ন থেকেছেন । সময়ের জগদ্দল ভারকে বিস্মৃত হতে আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পের বারান্দায়। রাজনীতি থেকে পলায়নপরতার রাজনীতি হিসেবেই ষাটের কবিতা তাৎপর্যপূর্ণ ।

রফিক আজাদের প্রথম কাব্য অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩) ষাটের কাব্য-প্রবণতাকে সর্বাঙ্গীণভাবে আত্মস্থ করে রচিত। পঞ্চাশের কাব্যপ্রবাহে দেশজতার প্রবল প্রতাপ ষাটের কবিরা অস্বীকার করে নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র কাব্যস্রোত। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ বোধ দ্বারা পরিস্নাত তিরিশের আধুনিক কবিদের উত্তরাধিকার লালন করে ষাটের কবিরা শিল্পকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন সমকালীন ঘটনাস্রোত থেকে। দেশের কোন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পটভ‚মিতে কবিরা হয়ে ওঠেন বাস্তবতাবিমুখ, তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আপাত রাজনীতিহীনতার মধ্যকার গভীর রাজনীতি।

নগরের সর্বময় নাস্তির পটভ‚মিতে সংবেদনশীল কবি নিপতিত হন উদ্ধারহীন সময়ের অতলগহŸরে। আইয়ুবী সামরিক শাসনের অবরুদ্ধতায় এই সৃষ্টি সম্ভাবনাহীন সময় থেকে কবি পালিয়ে যেতে চান। কিন্তু তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে কবির মধ্যে জাগ্রত হয় নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গতার অনুভব। অতীন্দ্রিয় ঈশ্বরে সমর্পিত মানুষ শেষ পর্যন্ত আশাবাদী। কিন্তু নিৎসে কথিত ঈশ্বরের মৃত্যু দর্শনে বিশ্বাসী আধুনিক মানুষ রফিক আজাদের শেষ আশ্রয়টুকুও নেই। ডাঙাহীন ভাসমান জীবনের অনুভব তাঁকে নিক্ষেপ করে নিরস্তিত্বচেতনায়। সামরিক শাসনের অবরুদ্ধতা কবির ব্যক্তিগত অস্তিত্বহীনতার মধ্যে প্রকাশিত।


পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কেন্দ্রকরে বাঙালি-মানসে অর্থনৈতিক মুক্তির যে আশা সঞ্চারিত হয়েছিল তা দেশবিভাগের অব্যবহিত কালপর্বেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে পুলিশি আক্রমণ, ষাটের সামরিক শাসনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা দমন প্রভৃতি কারণে রফিক আজাদের স্বদেশ ও সমকালকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিনষ্টির মধ্যে অবলোকন করেছেন। তাঁর কবিতায় রাতের আরাধনা মূলত অন্ধকারাচ্ছন্ন স্বদেশের প্রতিভাস। সর্বময় নাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে কবির স্বদেশ হয়ে ওঠেছে নরক-সদৃশ।


রফিক আজাদের অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান তাঁর অনুজপ্রতিম কবি সম্পর্কে বলেছেন “রফিক আজাদ মূলত অসুস্থমনস্ক কবি”। রফিক আজাদের এই অসুস্থমনস্কতার জন্য সমকালীন রাষ্ট্রীয় অবরুদ্ধতাই দায়ী। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে কেন্দ্রকরে বাঙালি-মানসে অর্থনৈতিক মুক্তির যে আশা সঞ্চারিত হয়েছিল তা দেশবিভাগের অব্যবহিত কালপর্বেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে পুলিশি আক্রমণ, ষাটের সামরিক শাসনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা দমন প্রভৃতি কারণে রফিক আজাদের স্বদেশ ও সমকালকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিনষ্টির মধ্যে অবলোকন করেছেন। তাঁর কবিতায় রাতের আরাধনা মূলত অন্ধকারাচ্ছন্ন স্বদেশের প্রতিভাস। সর্বময় নাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে কবির স্বদেশ হয়ে ওঠেছে নরক-সদৃশ। নরক-সদৃশ স্বদেশে কবির অন্তহীন অবদমন তাঁকে অসুস্থমনস্ক করে তুলেছে:

চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।
রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালোবাসাবাসি;
এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাক্সক্ষার খেই।
(নগর ধ্বংসের আগে,অসম্ভবের পায়ে)

অসম্ভবের পায়ে কাব্যে রফিক আজাদ স্বদেশকে অনুভব করেছেন আত্মগত অভিজ্ঞতার আলোকে। সমকালীন মাঠের
আন্দোলন তাঁকে অনুপ্রাণিত করতে পারে ভিন্নভাবে, কিন্তু কাব্যে তা পুরোপুরি অচ্ছুৎ। হয়তো চল্লিশ ও পঞ্চাশের
দশকের তীব্রদেশজতার ছাপ থেকে নতুন কাব্যস্রোত নির্মাণই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য।

 

সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে

ষাটের দশকে সমাজ রাজনীতিবিমুখ আত্মবিবরবাসী কবি রফিক আজাদ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পটভ‚মিতে ক্রমেই হয়ে ওঠেন সমাজ, রাজনীতি-সংলগ্ন এবং সামষ্টিকবোধে উদ্ভাসিত। প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ পর্বে পাকিস্তানি শাসকবর্গের শোষণ নিপীড়নের কোনো প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করেনি, বরং আত্মগত নৈরাশ্য ও নৈঃসঙ্গ্যের ভেতর দিয়ে তাঁর স্বদেশ নরক-সদৃশ। সমাজ, স্বদেশ ও সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জ থেকে কবি খুব বেশিদিন নির্লিপ্ত থাকতে পারেননি, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে (১৯৭৪) থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রীক অব্যবস্থাপনায় অসহিষ্ণু, সামাজিক অনাচারে সংক্ষুব্ধ। শুধু রফিক আজাদ নন, সত্তরের দশকের অধিকাংশ কবিই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সরব। স্বাধীন দেশে নব-সঞ্চারিত আশাবাদ কবিকে সমাজসংলগ্ন করে তুলেছে। ষাটের দশকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ রফিক আজাদ এবার সমষ্টির মাঝে নিজের মুক্তি চান। কবিতাকে তিনি আর কেবল শিল্পের কাছে নয় বরং কবিতাকে তিনি নিয়ে যেতে চান মানুষের কাছে। এ মানুষ মোটেও একক মানুষের নৈঃসঙ্গ্য উদ্যাপন নয়, কবি এখন ‘নিযুত রফিক আজাদের’ কাছে দায়বদ্ধ। নগর থেকে গ্রামের সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্ঘবদ্ধতা এবং তাদের জীবনীশক্তির সম্মিলিত প্রকাশ এ পর্বের স্বদেশভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

রফিক আজাদও তাঁর কাব্যে পালন করেছেন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা।রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’। রফিক আজাদ ‘ভাত দে হারামজাদা’ বাক্যটি এক দেয়াল লিখন থেকে নিয়েছেন । সমকালীন বাংলাদেশে খাদ্য সংকট এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে মানুষের প্রধান দাবি ছিল ভাতের দাবি:

দু’বেলা দুমুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবি,
অনেকে অনেক-কিছুচেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায় :
বাড়ি, গাড়ি টাকাকড়ি – কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর
ভাত চাই এই চাওয়া সরাসরি – ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই – মাটির শানকি-ভর্তি ভাত চাই:
দু’বেলা দু’মুঠো হ’লে ছেড়ে দেবো অন্যসব দাবি।

(ভাত দে হারামজাদা, সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে)

মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া কেবল ভ‚খণ্ডগত স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই। ১৯৪৭ এর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্রকরে বাঙালি অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করেছিল, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যনীতি বাঙালির স্বপ্নাকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। ১৯৭১ এ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন মানচিত্র লাভ করলেও অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদে কাতর কবির সংক্ষুব্ধ উচ্চারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ভিন্ন আর সকল প্রকার স্বাধীনতা অর্থহীন। ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় প্রকৃতি (nature) এবং সংস্কৃতি (culture) সম্পর্কিত মীমাংসা রয়েছে। প্রকৃতিস্তরে অবস্থিত মানুষের প্রাথমিক দাবি ক্ষুধার নিবৃত্তি। পেটের ক্ষুধা নিবৃতির পরই আসে যৌনতাপ্রসঙ্গ। প্রকৃতিবাদের (Naturalism মূল কথা মানুষ ক্ষুধা ও যৌনতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ক্ষুধা যৌনতার সুস্থ পরিতৃপ্তির পরেই আসে দেশ-স্বাধীনতা-মানচিত্র-জাতীয়তাবাদ প্রভৃতিবোধ। কাব্যে উল্লিখিত ক্ষুধার্তব্যক্তি অস্তিত্বের প্রান্তিক সীমায় উপনিত, যার পেটে ক্ষুধাই তীব্র। প্রকৃতিস্তরে অপূর্ণ ব্যক্তির নিকট সংস্কৃতি স্তরের স্বাধীনতাবোধ অর্থহীন বিলাসিতা
মাত্র।

চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া

প্রথম দুই কাব্যগ্রন্থের প্রখর উত্তাপ অনেকটা প্রশমিত হয়ে রফিক আজাদের কবিচৈতন্য শান্ত-স্থির-কোমল রূপ লাভ করেছে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭) কাব্যে। ষাটের দশকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত আশাবাদ ১৯৭১ এর স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতার দিকে ক্রম অগ্রসরমান। প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ কালপর্বে ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে বন্দি কবি হতাশা অতিক্রম করার কোনো অবলম্বন পাননি। মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে সমষ্টি-সংলগ্নতা কিভাবে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনে সহযোগিতা করে। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যে কবির আশাবাদের সঙ্গে যুক্ত তাঁর নৈঃসঙ্গ্য-অতিক্রমী সামষ্টিকবোধ। সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে পেরিয়ে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যে সন্তুষ্টিবোধও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। কবির এই সন্তুষ্টিবোধ এবং আশাবাদ জাতীয়তাবাদী চিন্তার ফসল।

এ কাব্যের কবির স্বাদেশিকতা-বোধ মীমাংসিত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী।ষাটের দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রবল সম্ভাবনা থাকলে রফিক আজাদসহ অন্যান্য তরুণ কবিরা ছিলেন সমকালীন রাজনীতি-সংগ্রাম থেকে বিমুখ। সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে কাব্যে ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অপেক্ষা অস্তিত্বের প্রান্তিক সীমায় উপনীত ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে অধিকতর মনোযোগী। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রীতি স্থির বিশ্বাসে অটল। মুক্তিযোদ্ধা-কবি রফিক আজাদ আমৃত্যু ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই অব্যাহত রাখলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি অগাধনিষ্ঠা এবং স্বদেশের প্রতি সুগভীর প্রীতি আমৃত্যু লালন করেছেন।


চুনিয়া কবির কল্পনায় নির্মিত স্বর্গরাজ্য, প্রাচীন গ্রিসের ‘চিরশান্তি’র রাজ্য আর্কেডিয়ার সঙ্গে যেটি তুল্য। কবিকল্পিত চুনিয়ার বাস্তবতা না থাকলেও কবির আকাঙ্ক্ষিত স্বদেশের রূপরেখা আছে। কবি চুনিয়ারূপী এমন একটি স্বদেশ কামনা করেন যেখানে নেই হিংস্রতা, যুদ্ধের ভয়াবহতা যার শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে না।


কবির স্বদেশভাবনা চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যে বিশ্ববোধে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং এ কাব্যের নাম-কবিতায় ঘোষিত হয়েছে কবির কাঙ্ক্ষিত স্বদেশের ইশতেহার। চুনিয়া কবির কল্পনায় নির্মিত স্বর্গরাজ্য, প্রাচীন গ্রিসের ‘চিরশান্তি’র রাজ্য আর্কেডিয়ার সঙ্গে যেটি তুল্য। কবিকল্পিত চুনিয়ার বাস্তবতা না থাকলেও কবির আকাঙ্ক্ষিত স্বদেশের রূপরেখা আছে। কবি চুনিয়ারূপী এমন একটি স্বদেশ কামনা করেন যেখানে নেই হিংস্রতা, যুদ্ধের ভয়াবহতা যার শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে না। কবি তার আদর্শ রাষ্ট্রেকামনা করেন মানুষের সহাবস্থান, বিশেষত পক্ষপাত দেখাতে চান নারী ও শিশুর প্রতি। মারণাস্ত্র সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বৌদ্ধ স্বভাবের চুনিয়া বাস্তবে অসম্ভব এক ইউটোপীয় প্রকল্প। ইউটোপীয় কল্পনার ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয় আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা। সমাজ স্বদেশের অগ্রগতির জন্য আদর্শ ধারণা নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। ১৫১৬ সালে টমাস মুর Utopia গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেখানে সাম্য- সহিষ্ণুতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রতিচিত্র তুলে ধরেন। মার্কসবাদের শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কল্পনাও এক ধরনের ইউটোপীয় চিন্তা। রফিক আজাদের ইউটোপীয় কল্পনা মার্কসবাদী নয়, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতেই তা বিচার্য। কবিতায় তিনি তাঁর আদর্শ স্বদেশের কথা বলেন বটে কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠিত হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা প্রদান করেন না। কবি তাঁর কাম্য স্বদেশের প্রতিচিত্র নির্মাণ করেছেন এভাব:

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্র সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।…
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভ‚মি।
চুনিয়া কখনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে ওঠে কি?…
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়—শান্তি ভালোবাসে,

(চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চুনিয়ার শান্ত স্নিগ্ধ কোমলরূপ সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২) থেকেই প্রশমিত হতে থাকে। সামরিক শাসনের অবরুদ্ধতায় সন্তপ্ত কবির চৈতন্য পুনরায় নিপতিত হয় হতাশায়। তবে এই হতাশার চরিত্র ষাটের হতাশা-উদ্যাপন থেকে ভিন্ন। ষাটের দশকের হতাশা কবিকে করেছিল নিঃসঙ্গ, কিন্তু এ পর্বে তিনি সংক্ষুদ্ধ। একনায়কতন্ত্রের অবরুদ্ধতা, জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় জরদারি এবং নয়া উদারনীতিবাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কবির সার্বক্ষণিক সংগ্রাম তাঁর কবিতাকে দিয়েছে রাজনৈতিক মাত্রা।

কবি রফিক আজাদ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ – ১২ মার্চ ২০১৬) । ছবি : সংগৃহীত

রফিক আজাদের কবিতা যে ক্রমশ স্বদেশ-সংলগ্ন হয়েছে তাঁর কাব্য-ভাষার দিকে মনোযোগ দিলেই তা স্পষ্ট হয়েওঠে। কবির কাজ প্রাত্যহিক ভাষার ভেতর দিয়েই অতীন্দ্রিয় বোধের সঞ্চার করা। অর্থাৎ কবির বাছাইকৃত শব্দে অপরিচয়জনিত সংকট থাকবে না, কিন্তু কবির সৃষ্টিশীল প্রতিভা-জারিত হয়ে পরিচিত ভাষা পাঠকের সামনে হাজির করবে ‘অপরিচিত’ গভীর অনুভব। এখানেই সংবাদপত্রের সঙ্গে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব। রফিক আজাদের কবিতা ক্রমশ হয়ে পড়ে বক্তব্য-প্রধান সংবাদপত্রের দিকে হেলে পড়ার ঝোঁক যার প্রবল। রফিক আজাদ তাঁর এই বক্তব্যপ্রধান কবিতাকে বলেছেন ‘প্রবন্ধপদ্য’। প্রবন্ধের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য সে তার বক্তব্য-বিষয়কে আড়ালহীন সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে বিপরীতে কবিতার ধর্মই কথাকে আড়াল করা। ফলে তাঁর কাব্যের অতিকথন কবিতাশৈলীকে কিছুটা ক্ষুণ্ন করেছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস হিসেবে রফিক আজাদের কবিতা গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি সময়ের কথাকে আড়ালহীন বক্তব্যে অনর্গল বলে গেছেন:

 

ধাবমান সবুজ জীপের পিছে অর্থহীন মার্সিডিস্ বেঞ্জ,
বিদেশী ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ অর্থনীতি–
রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা চলে যাচ্ছে
ব্যক্তিমালিকের হাতে, শূন্য প্রায় ব্যাংকের ভল্ট,
মুদ্রাস্ফীতি, বাজারে আগুন
অসম বাণিজ্যে মেতে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের চর,
বাজার দখল করে বহুজাতিক সংস্থার হাত,
অনিবার্য ব্রেনড্রেন, মধ্যপ্রাচ্যমুখী মানব সম্পদ,
ভণ্ডামির স্বর্ণযুগ :
দারিদ্র্য জরিপ করে গুনে নেয় বিদেশী টাকার থলি
গবেষণা-ব্যবসায়ী পণ্ডিতে দল;

(যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ, ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস)

শুধু রফিক আজাদের কবিতা নন, সত্তরের দশকের প্রায় অধিকাংশ কবিতার বৈশিষ্ট্য এই বক্তব্যধর্মিতা। মুক্তিযুদ্ধের মত বৃহৎ ঘটনা কবিদের সমাজ-স্বদেশ- সমকাল-সংলগ্ন করেছিল। এই সংলগ্নতা বুর্জোয়া নন্দনতত্তে¡র শিল্পের জন্য শিল্প কিংবা কলাকৈবল্যবাদের ভেতর দিয়ে সম্ভব নয়। রফিক আজাদ তাঁর দ্বিতীয় কাব্য থেকেই রাষ্ট্রের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলায় সক্রিয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবেলা করতে কবিকে বক্তব্য হাজির করতে হয়েছে, অনর্গল বলে যেতে হয়েছে তাঁর দাবি-দাওয়া অভিযোগ-অভিমান। ফলে কবিতা বক্তব্যপ্রধান হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। সত্তরের দশকের রফিক আজাদের কবিতা বর্ণনাধর্মী, উচ্চকন্ঠ এবং রাজনীতিঘেষা। সময়ের প্রতাপশালী ভাষার প্রভাবেই তাঁর কবিতা এই বৈশিষ্ট্যকে আত্মীকৃত করেছে। এ পর্বের কবিতাগুলোতে বাক্য এক লাইনে শেষ না হয়ে ক্রমাগত পরের লাইনে গড়িয়ে পড়ে, কথা বলা যেন শেষই হয় না। তিরিশের কবিতার যে প্রধান ধর্ম, শব্দ থেকে কবিতার অর্থের বিচ্যুতি ঘটানো, এ পর্বের কবিতায় তা পুরোপুরি অনুপস্থিত। পরিচিত আবহ থেকে আহৃত শব্দ, অলংকার, ছন্দ কবিতার বক্তব্যকেই প্রধান করে তুলেছে, কাব্যিক শৈলী সেখানে থেকে গেছে গৌণ। তবুও গভীর অভিনিবেশে তাঁর কাব্যই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক ‘সত্য’ ইতিহাস।

 

গ্রন্থপঞ্জি

দিলারা হাফিজ ও পিয়াস মজিদ (সম্পাদক) (২০১৯)
মুখোমুখি রফিক আজাদ, চিত্রা প্রকাশনী, ঢাকা

মিন্টু হক (সম্পাদক) (২০১৭)
কাশবন, ‘অমেয় আলোর রফিক আজাদ’, বর্ষ ৪,
সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি, ঢাকা

রফিক আজাদ (২০১৬)
কবিতাসমগ্র, অনন্যা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা

আপনার মতামত জানান

বিল্লাল হোসেন

বিল্লাল হোসেন। জন্ম ১৩ মার্চ ১৯৯৮, টাংগাইল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে 'শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি'তে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।