দূর বহুদূর
তুমি ছিলে ঘুম, আমি জেগে; তখন রাত বারোটা বেজে সাত—শিশির পড়ে, আমি খোলা জানালাটা বন্ধ করে দেই। পৃথিবীতে শুয়ে থাকা তোমার কপালে রাখি হাত, তারপর, ধীরে এক বাদাড়ের ঘরে পৌঁছে যাই—এক নিমিষেই। ঘন অন্ধকারে বাড়ে নিরবতা, পেইন্টিং ঝুলে রয় দেয়ালে, ঘুমোও, যা যেভাবে থাকে থাক পড়ে—স্পর্শের কোনো কারণ নেই। অকারণে ছোঁয়া গেলে যাক ছুঁয়ে ভুলে বা বেখেয়ালে। তারপর, অন্ধকার নিরবতা কেটে যাবে—এক নিমিষেই। সময় তো নেই খুব, যথাকালে রপ্ত করে নিব জীবনের চাল, এই রাত নৈঃশব্দ্য শেষ হলে কাল ভোরে জানি জাগবেই। জেগে দেখো, নেই কেউ; আমি আছি ওপাড়ে ঝুলে আছে অনন্ত মহাকাল। (তারপর, দ্বিধাহীন হয়ে পথ পৌঁছাবো—এক নিমিষেই।)। কোথায় কে জানে, কোনো এক অজানাতেই বেজে ওঠে প্রার্থনার সুর, পৃথিবীর ঘরে ঢুকে গেছে যেই সুবাসিত ফুল, তার ঘ্রান পাই না কোথাও। ঘ্রান ছাড়া দুরুদুরু বুকের বাজনা শুনেছিলাম—শুনছে বিধাতাও, তুমি শুধু ঘুমে ঘুমে হেঁটে গেছ দূর বহুদূর। কত কথা কথকতা যথাতথা হয় না বলা; হয়ে থাকি চুপ, মহাশূন্যে স্বর্গের ছবি আঁকি আর নিরিবিলি সেখানেই করি বাস; সেখানেও ফোটে ফুল, ওঠে চাঁদ—মনে হয় এটা আমাদেরই আকাশ।
দুপুরে
এই দুপুর থেমে আছে—এই রোদ এই মোহগ্রস্ত ঘুম জেগে আছে। চেয়ে আছে বনভূমি, পাখি, শুকনো পাতার খোলা রাস্তা। আর নগরীতে, দোতলা বাসে, লেগুনায় ঝুলে ঝুলে পড়ে যাচ্ছে জীবন। তাকে ধরে রাখা যায় না, লাগাম ছেঁড়া ঘোরার মতন। কৃত্রিম দালান, ধুলোময় ভূমির শহরের দিকে তাকিয়ে কেবল জাগতিক স্বপ্ন লালন করা যায়, তাকে বেঁচে থাকা বলে না। ওই স্বপ্নের মাঝে বেঁচে থাকি দুপুরে, পর্দা ভেদ করে দুপুর ঢুকে পড়ে শরীরে, পশমে পশমে। দুপুরের তন্দ্রাতে ডুবে থাকি তেমন মগ্নতায়, প্রথম যেবার প্রেমিকার বুকের ভিতর আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই তন্দ্রা বড় মন্ত্র পড়া, সেই তন্দ্রা ভালো লাগে। একদিন দুপুরে, এলোমেলো পথ ধরে বহুদূর, বহুদূরে খুঁজে যাবো থেমে যাওয়া। সেইখানে থেমে যাবো আমি আর আকাশ, শুকনো পাতার রাস্তায় আমি দাঁড়িয়ে দেখবো তোমাকে; লিখব দুটি লাইন কবিতার।
পাহাড়ি, আমি একহাজার বছরের দুপুর বিক্রি করে ফিরে যেতে চাই তোমাদের গাঁয়ে। তোমাদের শীতলসবুজ নদীটির ডাক, শীতগ্রস্ত ভোরে মেঘেদের মিছিল আর বাতাসের শব্দ আমাকে অসহায় করে রাখে এইখানে। এইখানে নেই কোনো ভোর, নেই আকাশ, আকাশের মেঘ। এইখানে নদী বলতে কেবল বিলাসবহুল সেতুটি। এইখানে কোনো শীতকাল নেই, শিশির নেই। দুপুরের গায়ে রোজ লেপ্টে থাকে নিঃসঙ্গ অলসতা। বাড়ে জন্মভূমির টান। মনে পড়ে পিতার কথা। তোমাদের দুপুরে পিতা আমাদের ঘরের ভিতর ঘুমিয়ে রাখতেন। আর পিতার চোখ ফাঁকি রেখে আমরা ঘুড়ি ওড়াতাম আকাশে, তোমাকে ঢেকে রাখা আকাশে। এখন তাই ভাবি, যদি ঘুড়ি ভেবে কেউ ছুঁড়ে দেয় তবে আমি উড়ে আসবো তোমার কোলে, বেলা ফুরোবার আগেই।
কোনো আত্মীয় নেই দুপুরের। গাছ ও ঘাসেতে, লালজবা ফুলে ফুলে, চড়ুইয়ের বাসার কিনারে দুপুর নিঃসঙ্গ ভ্রমণে। ঘুমে ঘুমে, তন্দ্রাতে, বুকশেলফে, টেবিলে-টুবিলে রসিক রবীন্দ্রনাথ আর তার সাথে পড়ে থাকে আলস্য দুপুর। তাই, দুপুরকে প্রতিদিন মনে পড়ে, পশ্চিমে দোলে যাওয়া আলোটাকে অসহায়ে ডুবে যেতে দেখি। দুপুর কি দেখে না আমারে?
সময়
যেভাবে ভুলে গেছি মাতালের রাত, ভুলে গেছি পৃথিবীর প্রথম দুপুর—যেদিন জন্ম আমার। যেভাবে ভুলে যাওয়া হয় পূর্নিমা রাত, রজনীগন্ধায় ভেসে আসার ঘ্রান, শব্দের ভাজে গীটারের সুর। শরতের দুপুরে ছিড়ে যাওয়া ঘুড়ির সুতো, সে হারিয়ে গেছে আকাশে। জানি, একদিন ভুলে যাব মরে যাওয়ার এই আকাল সময়। মিশে যাবে ঘুড়িদের দেশে। পড়ে রইব আমি আর আমার দেহখানা। আর আমি ছুটছি এক পাগলা ঘোড়ার মত অন্তহীন, ছুটছি কেবলই মৃত্যুর দিকে। ওহে মৃত্যু! কতটা দ্বিধার অবসানে পৌঁছাবে আমাদের ঘরে। জীবনের তৃপ্তি মেটে না তবুও। যখন চারিপাশ অজস্র শব্দদের ভিড় হতো বুকের উঠানে। সবুজাভ, গোলাপী রঙিন প্রেমের বীজ বোনা হয় যেখানে। অইসব প্রেম। তবু, তবুও মুক্তি মেলেনি অসীম দোটানার ভিড়ে। আর কেউ জানে না, তুমি জানো, আমি জানি। আমি ছাড়া, তুমি ছাড়া, আর কেউ জানে না।
এইখানে ঘেমে গেছে শহরের মলাট
মেঘ ছাড়া আকাশ দেখতে বড় বিচ্ছিরি লাগে। আকাশ, যার রঙ তোমার কাছে নীল মনে হতো। আলো আর আকাশের কোনো রঙ নেই, বিভ্রমে ভেসে থাকে চোখে। খাতার ভিতর মেঘের রঙ মাখতে মাখতে এঁকে ফেলো পাহাড়। মেঘ আঁকতে জানো না তাই, পৃথিবীতে পাহাড় ধসে পড়ে। মানুষ মরে যায়। এইভাবে একদিন মরে গিয়েছিল আমার জন্মভুমি। বাঁকা বাঁকা পাথরের নদীতে ভেসে গেছে মেঘভাঙা জল। একদিন সে নদীতে বৈঠা ছাড়া একটি খাকি কাগজে বানানো নৌকা ভেসে এসেছিলো। ভেজা নৌকাটির ভিতর মাউন্টেইনপেনে লেখা ছিলÑ ‘আমি তোমার মা, আমাকে কোনোদিন খুঁজে পাবে না।’ তখনও জানি না, মায়ের নাম পাহাড়। তুমি কেমন করে জেনে গেলে আমার আগে? বৃষ্টি শেষে পৃথিবী বিষণ্ন হয়ে পড়ে, রক্তজবা ফুটতে থাকে। এই ধুমকেতু জানালায় ছবি এঁকে দেয়। কোনো কোনো দুপুরে পৃথিবী অবশ হয়ে পড়ে। আকাশভাঙা ডাক। মুক্ত ওই নীল ক্যানভাসটা ঢেকে রাখে মেঘ। তখন পৃথিবীর রঙ মেঘময়। পৃথিবীর জ্বর হয়। সে ভাবতো, এমন জ্বরাক্রান্ত পৃথিবী অচিরেই মরে যাবে। পৃথিবীর মৃত্যুর দিকে চেয়ে চেয়ে বাড়তে থাকে তার বয়েস। প্রিয় কৃষ্ণচুড়া, বলেছিলে বর্ষাকাল তোমার ভালো লাগে না। কাঁদামাটি শরীর পুড়ে খায়। ঈশ্বরের কান্না তোমার ভালো লাগে না। সাগর-সমুদ্র ভালো লাগে না। তোমার একমাত্র প্রেমিক ছিল সাঙ্গু। সাঙ্গু নদী। তার শরীরে লেবুপাতার ঘ্রান। সাপের মত গড়ন আর ঘামাচির মত পাথর লেপ্টে থাকে শরীরে।
এই দেখো, এইখানে ঘেমে গেছে শহরের মলাট। রোদ পুড়ে গলে গেছে আমাদের প্রান। এইখানে ভোর আসে বৃষ্টির উদয়ে। লেবুপাতা, আহা আমাদের স্মৃতির সিনেমা। এইখানে বৃষ্টি এলে ছয়বার বদলায় আকাশের রঙ। জামপাতা দিয়ে তুমি আকাশ আঁকতে পারো, বেগুনি আঁকাশ। নীল গোলাপ কিংবা বাদামি অন্ধকার। হাত দিয়ে মুছে দাও মেঘেদের ঘুম।
মৃত্যু
সন্ধ্যা আসার আগে পুর্বদিক থেকে বাতাশ এসে লাগে গায়ে। বৈশাখে বাতাশ ভালো লাগে। ভালো লাগে উৎসব। এই উৎসবের মৌসুমে একদিন হঠাৎ আমি একা হয়ে পড়লাম। মস্তিষ্কের সব শিল্প নিমিষে নিঃশব্দ হয়ে পড়ল। আমি হাঁটু গেঁড়ে একা একা কাঁদতে লাগলাম।
বয়স যখন ছয় কি সাত, তখন আমার খালাম্মা মারা যান। গঞ্জের এক চাঁদের গাড়িতে করে দূরের ক্লিনিক থেকে কারা খালাম্মার মৃতলাশ এনেছিলেন মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে সেদিন খালু তার স্ত্রীর লাশ দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন উঠোনে। লাশের সামনে বসে আমার মা বিলাপ করছেন সুরে সুরে।
খালাম্মার চেহারা কি রকম ছিল এখন আমার একটুও মনে পড়ে না। কেবল একটা স্মৃতি ঝাপসা হয়ে চোখে আসে। পাথরের গুটি দিয়ে তিনি পাঁচগুটি ভালো খেলতেন। চার আঙ্গুলের উপর পাঁচগুটি রেখে উল্টো ভাজে সবগুলো ধরতেন তিনি। তার স্মৃতি বলতে, একদিন বিকেলে আমার বড়বোনের সঙ্গে খালাম্মার পাঁচগুটি খেলার দৃশ্যটেই মনে পড়ে।
খালাম্মার মৃত্যুতে যখন সবাই কাঁদছিল, সেদিন অবুঝ আমিও কান্না করেছি। সেদিন মৃত্যু বলতে কি বোঝায়, আমি বুঝতাম না। কেবল মায়ের বিলাপ দেখে তাল মিলিয়েছি কান্নার স্বরে।
এরপর কেটে গেল দেড় যুগেরও বেশি। এই ক্ষুদ্র বিস্তর জীবনে আমি আর একবারও কাঁদিনি কারও মৃত্যুতে। বুকের ভেতর ধকধক করা আওয়াজই ছিল সর্বোচ্চ বেদনা।
অথচ বাতাশের সঙ্গে আজ যার জন্য কেঁদেছি, সে আমার কেউ না
একরাতের আড্ডায় গানের সূরে মাতাল করে দেয়া বোহেমিয়ান এক গায়ক।
তোমার জানালার ফাঁকে তাকিয়ে আছে অভিশপ্ত শহর
নিঃসঙ্গ হয়ে যাও, রাত বারোটায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গুণে নাও জীবনের বাকিটা সময়। দেখো, তোমার জানালার ফাঁকে তাকিয়ে আছে অভিশপ্ত শহর। এক এক করে নিভে যাবে দাম্পত্য বেডরুমের সব বাতি। দূর থেকে ভেসে আসা অপরিচিত আওয়াজ তোমার নিঃসঙ্গতা দূর করে দিতে চাইলে Í শোনো না।
শৈশবে নিঃসঙ্গ হলে বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির উঠোনে মারবেল খেলতে, নারিকেলের মালা দিয়ে খেলতে মালাঠোলা। কাপড় দলা করে মানুষ বানানোর যে শিল্প তুমি জানতে, তা দিয়ে খেলতে পুতুল। পুতলের বিয়ে হতো, পুতুল তোমার মেয়ে। বিয়ের দিন বড় নারিকেলের মালাটা পাতিল বানিয়ে রান্না করতে ভাত। ভাত ছিল বালু। কাঠালের পাতা তোমার বিয়ের কার্ড। একটু একটু বড় হতে হতে তুমি ছন্দ মিলিয়ে লিখছো কবিতা। কবিতার মতো করে প্রেমপত্র পাঠিয়েছো যাকে, সে কি বেঁচে আছে?
ঘড়ির সময় এখনও রাতে, ঘুমিয়ে পড়ো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে খবরের পাতায় তার মৃত্যুর শিরোনাম
জ্যৈষ্ঠের রোদে পোড়ে না শরীর
গড়িয়ে পড়ে জ্যৈষ্ঠের রোদ। সমকালীন খবর থেকে জানা যায় আগামী ছয়দিন টানা রোদ জ্বলবে পৃথিবীতে এমনকিÑ স্বর্গের সুখী বাসিন্দারও গলে গলে পৃথিবীতে আসতে পারে বলে জানা যায়। রেডিওতে খবরটি শোনার পর ঈষৎ মনে পড়ে যায় হারানো একটি মুখ। যার দিকে তাকিয়ে থেকেও নরক থেকে দেখা যায়Ñভোগ করা যায় স্বর্গের রূপ। আর জ্বলন্ত আগুন নিমিষেই নিভে যায় চোখের ভিতর। পোড়া গা শুকিয়ে শীতল হয় শরীর। কখনও কি আর তাকে দেখা যাবে পুড়ে যাবার আগে? গোলাপের দিকে তাকালে বড্ড মায়া লাগে, জন্মপূর্বে তাকে কেউ জানায়নি পুড়ে যাবার যন্ত্রণা, ছিঁড়ে যাবার আক্ষেপ। বিষাক্ত কাঁটা বুকে নিয়ে ফুটে ওঠে সযত্নে আর তোমার প্রেমের কাঁটায় বিঁধে রাখো তারে পকেটে, ভ্যানিটি ব্যাগে। রাস্তায় মিছিল বিপ্লবীদেরÑবন কেটে বিদ্যুৎ চাই না। সংসদে হাসে মন্ত্রী। বাড়ির বামদুয়ারে বসে পান খায় মা। সভা করতে সেদিন বিদেশী মন্ত্রী এখানে এসে জ্যাম করে রেখেছিল সারা শহর। এইসব তবুও পোড়ায় না শরীর, যেমন পোড়ায় না জ্যৈষ্ঠ্যের রোদ। তবুও পুড়ে, পরান পুড়ে। তার চোখের ভিতর ডুবে ডুবে শীতল হওয়া যায়।