আগাছা
১.
আমাদের বাড়িটার চারপাশে শুধু আগাছা! বজ্জাতগুলো লাই পেয়ে রাক্ষস হয়ে গেছে। কাল রাতে দেখি পূর্ণিমার চাঁদটাও লোপাট, সারা উঠানজুড়ে শীতের মরা পাতা। দিন আসে দিন যায় মাগীর পুতেরা দেশটা গিলে খায়। আমাদের হাত-পা-নখের নিচে কালি, বুকে পিত্তশূলের আজাব, পেটে আলসার। তবু হাসি-কাঁদি, বউ লয়ে ঘুমাই, শিশুর গালে চুমু খাই। মাগীর পুতেরা পেপসি-ফান্টার মতো চোষে চোষে খায় আমাদের রক্ত-মাংস-মজ্জা।
২.
রোজ রোজ কোদাল কাঁধে দুই ভাই ফিরে আসি। ভোর ভোর কোদাল কাঁধে বেড়িয়ে পড়ি। বাবার কবরের পাশে গোর খুদি ধর্ষিতা মা-বোনের। আমাদের অঙ্গে ধুলা, বঙ্গে ধুলা তবু ভাতের থালা আগলে বসে থাকেন মা, পানির গেলাস হাতে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকে বউ। ফিশারির মাছ পোলট্রির মুরগিতে বিষ!
বতুয়া শাক, কলমি ফুলের বড়া, ছোট মাছের ঝোল আর গাভীর দুধ দেখি না কতকাল ? তাবাদে মরার ওপর খরার ঘা ইউক্রেন যুদ্ধ।
আমাদের অঙ্গে ধূলা, বঙ্গে ধূলা তবু ভাতের থালা আগলে বসে থাকেন মা, পানির গেলাস হাতে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকে বউ। ফিশারির মাছ পলট্রির মুরগীতে বিষ!
৩.
পান-বিড়ি নিয়ে বারান্দায় বসি। বিদ্যুতের বাতির নিচে জোনাক পোকা, ঝিঁঝিঁ পোকা থাকে না, ডাকে না। তাই গালাগালি, গলাগলি, হাসাহাসি করি সিদ্ধি টানি দুই ভাই। ঘরের পিছে খেওলার হাওর, সারারাত ডাহুক ডাকে বিলে। কপাটের আড়ালে বসে থাকে বউ, সস্তা সেলুয়ার-কামিজে আগলে রাখে অদমের ক্ষেত-খলা। ফলতে পারে কালিজিরা-ইরি কিংবা হাইব্রিড ধান, আগাছাও হইতে পারে বেশুমার…। দাদায় কইতো,‘মা গুণে ঝি, গাই গুণে ঘি।’ আমি শুধু বতক ধানের সুবাস পাই।
৪.
ঘরের পিছের সড়ক দিয়ে সারাদিন হাওরে ট্রলি যায় ভটভট…খটখট। বাতাসে বোরো ধানের সুবাস পাই। দিন আসে দিন যায় রাতের কোনো শেষ নাই…। পান-তামাক-বিড়ি নিয়ে বারান্দায় বসি সিদ্ধি টানি দুই ভাই। উঠানের বাল্বটা পেরেশান চোখে সারারাত জেগে থাকে, আমাদের দেউড়ির পিছে বসে থাকে শিয়াল। যে কোনোদিন সে হয়ে যেতে পারে বাঘ। এই পোড়া কপালের দেশে… ভাই তুই কোনোরকম বেঁচে থাক।
মধুনী বিলে শালুক ফুল নাই
১.
আজ ঢাকার তাপমাত্রা তেতাল্লিশ ডিগ্রি এবং দূষিত বাতাসের জন্য পৃথিবীতে প্রথম। মাঝে মাঝে করাচি-দিল্লী সামনে চলে আসে। এদিকে জিন্দাবাজার আর চৌহাট্টার উপর দিয়ে কয়েকবার ঘুরে গেছে এতিম এতিম চেহারার কিছু মেঘ!
ধূলিঝড়ে গাছ পড়ে ঢাকা-সিলেট মাহাসড়ক তিন ঘণ্টার জন্য অচল। মাত্র এক ঘণ্টার আগুনে ছাইভস্ম হয়ে গেছে গরিবদের প্রিয় বঙ্গবাজার! কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। মনিরা…তোমার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে না।
২.
দীর্ঘ খরা আর দাবদাহে দেশটা সাপ-বিচ্ছু-পঙ্গপালে ভরে গেছে। পথে বেরুলে ছোট-বড় হরেক রকম রাক্ষসের অতৎপরতা চোখে পড়ে। আমাদের সিঁদুরে গাছের সব আমে পোকা। মাটিতে রস নাই বলে কাঁঠালের বদলে গাছে গাছে
ঝুলছে বাঁদরের মাথা। তবু আমাদের গ্রামের কেউ অবাক হয় না।
মনিরা…তোমার জন্য আমার খুব বেশি কষ্ট লাগে না।
৩.
লাল দাদির শসা গাছে একটাও শসা নাই, কবির চাচার ডাবের কড়ি, সুপারির ফুল সব ঝরে গেছে ইটভাটার ধোঁয়ায়। যেখানে তোমার জন্য আমি উঁচা উঁচা বিন্না ঘাসে লুকিয়ে থাকতাম, সেই মধুনী বিলে বিন্নার ঝোপ নাই, শালুক ফুল নাই, একটাও ডাহুক পাখি ডাকে না। পাঙাস মাছের হাজার হাজার মুখ, সারাদিন কপকপ করে খাবার খায়। বাতাসে বিষ্ঠার গন্ধ তবু কেউ নাক কুঁচকায় না।
মণিরা…তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হয় না।
৪.
এক কেজি চালের দাম সত্তর-আশি থেকে ক্ষেত্র বিশেষ দেড়শ টাকা। এক কেজি করলা নব্বুই টাকা, হাঁসের ডিমের হালি রমরমা আশি টাকা। ভাত-মাছ-আনাজের স্বাদ বিষ বিষ লাগে। মন্দির-মসজিদে ভিড়, টিভি চ্যানেলে চ্যানেলে রাজনৈতিক পেশাকারদের নাচন-কুদন। ধর্ম ও রাজনীতির মকতবে আমরা সবাই গুরু-শিষ্য। তাই আমরা সকলেই সবুর করে বসে আছি। আমাদের জীবনের সব সত্য ও সুন্দর হারিয়ে যাচ্ছে, কিশোর-কিশোরীর হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, চোখে-মুখে অনাচার ক্লান্ত নর-নারী। তাদের চোখের নিচে কালো কালো পাপ। তারা জিম করে, মাসল চিনে, নর-নারীর শরীরের গ্রামার বোঝে কিন্তু মোকাম বাজার চিনে না।
মনিরা…তোমার জন্য আমার খুব বেশি আক্ষেপ হয় না।