তোমাকে কোনোদিন তেলরঙে এঁকে ক্যানভাসে বন্দি করে দেয়ালের পলেস্তরার নিচে সেলাই করে রাখি। তোমার পদমূলে যে-অন্ধকার জ্বলে সেইখানে এঁকে রাখি একটা চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ, সোডিয়াম আলো হে, জন্মান্ধ আলোর ছুরি।
আমার প্রতিটি রোমক‚পে প্রবল ঈর্ষা বৃশ্চিক রাত্রি হয়ে থাকে। তোমার আলো কেবল ত্বকের রং পালটে দিতে পারে, আর কিছু পারে না। তোমার অক্ষমতার শাস্তি লিখে ক্ষয় করি একটা বলপয়েন্ট, দুশো একান্নটা কিবোর্ড, একটা অরিত্র আর তিনটে খসখসে ব্রাশ। তারপর ঈর্ষার করাতে শান দিয়ে দিয়ে হিংসা বানাই। সেই করাত হাতে বের হয়ে খুঁজে বেড়াই তিনটা ধূর্ত হরিণ, দুটো মায়াবী শুয়োর আর একটা পোড়া-লাল ডাবলডেকার বাস, যে-বাসে চড়ে চিরদিন হারিয়ে যায় আমার রক্তলগ্ন প্রেম।
তুমি একটা দন্তরহিত হাতি, তুমি কিছুই পার না। কেবল দেখতে পার বুদ্ধের লোয়ার সিক্স দাঁতের মাথায় একটা পিঁপড়া বসে থাকে চিন্তাশূন্য। শীর্ণ শুঁড় নাড়িয়ে খেলে মায়া। আর বুদ্ধ ধ্যান ভেঙে সন্ত্রস্ত্র, হাঁ হয়ে দিশেহারা। বোধিধ্রæমের একটি পাতার কাছে সাহায্য চায়। পাতা কাঁপে হাওয়ায়। পাতা জানে হাওয়ার দাঁত নাই, বুদ্ধ জানে না। পিঁপড়া জানে তোমারও দাঁত নাই, তাই ভাবে তোমাকে হত্যা করে সে অজস্র মৃত্যুর শোধ নেবে। কিন্তু সে ভাবে না, স্বজাতির মৃত্যুর জন্যে মূলত তার দাঁত দায়ী নয়। যেমন করে পত্রপল্লব হত্যার দাঁতের দায় সিদ্ধার্থ গৌতমের উপর বর্তায় না।
থেমে থেমে শুকায় বটের ঝুরি আর মূল। রাত বেড়ে ধীরে ধীরে বুনো আচার অধীর। এই যে ভ‚পালী বেজে চলে। এই যে কিশোরীর কণ্ঠে ঠুমরি, ঢেউয়ের ওঠানামা নামহীন নদীনদে, এই যে লিথি বয়ে যায় ওপারের মরুতে, কেউ নাই। আমার লেখা কাগজের পর কাগজ। কাগজগুলিকে আগুন গ্রহণ করে, সে করে না, কেউ করে না। ধারণে সক্ষম নয় বলে ওগুলি চিঠি নয়। এই যে নদীর শরীরে জলের ওঠানামা, এই রাত আর লিথিকে চেনে না। আমার সঙ্গে সমাপ্তির আর দেখা হয় না। নদীর ভাষা জেনেছিল কালকেতু রাত। জেনে যায় বড় হওয়ার ব্যঘাত। দূরাগত সুর।
ওখানে হয়তো গান আছে নীল, আছে দিনের বিপরীতে বাড়ন্ত রাত্রি। আর সোডিয়াম আলোয় পুড়ে যায় আমার চোখের পাতা, পুড়ে যায় তার চোখের পাতা। আর প্রতীক্ষায় থাকি চিরদিন চিরদিন, তার সঙ্গে দেখা হবে কোনোদিন, সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। আমরা সেই সমুদ্রের ধারের কাঠের তৈরি আকাশছোঁয়া একটি ওয়াচিং টাওয়ারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকি, দাঁড়িয়ে থাকি অন্তত একটি জীবন। আমরা পরস্পর নিজেদের স্পর্শ করি না ঠিক, কিন্তু স্পর্শেও প্রতীক্ষা থাকে রাতুল।
যা ঘটে তার ঠিক উলটা দিকে তাকিয়ে থাকে শুয়োর। দেখে সেই উলটা দিকের বিপরীতের দৃশ্য ও দ্রষ্টব্য। শুয়োরের বুকে দড়ির দাগ। দড়ি ছিড়েই আসে বোঝা যায়। শুয়োরের গ্রীবা নাই, তাই গ্রীবায় নিস্তব্ধতা নাই, নিস্তব্ধতা নাই বলে দড়ি দেয়া যায় না। এই দড়িছেঁড়া শুয়োর বন ঘেঁটে দিয়ে এসে শহরের পঞ্চরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘেঁটে দেয় শহরের নাক ও নকশা। শুয়োর দেখে কালো পিচ গায়ে বেঢপ রাস্তাটা দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে জিপার খুলে মুতে দেয় পাশখোলা খাসজমিতে। রিকশা, ট্রাক, বাস, পথচারি, কুঁ কুঁ অ্যাম্বুলেন্স ঝুলে আছে রাস্তার দাঁতে, জিভে, শিশ্নে আর কানে, ছিটকে পড়ে রাস্তার গা থেকে, নাকের ডগা থেকে, আঙুল থেকে, নাভীর গর্ত থেকে, দাঁড়ির ঘাস থেকে, জেব্রাক্রসিং থেকে অদূরে বটের ছায়ায়।
বটের ঝুরিতে রোদ লেগে খিল খিল হেসে যায় হারামি পিঁপড়ের পাল। সারি সারি বজ্জাত ঠোঁটে তাদের বটফলের মধু আর মোম। শুয়োর এবার পিঁপড়ে হাতি ও বুদ্ধের দাঁত শিকার করবে ভেবে ঘোঁত ঘোঁত ওঙ্কারে তেড়ে গিয়ে বটতলায়, এক লহমায় চেটে খায় বটের ছায়া। রাস্তাটা দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছিন্ন করে যায় আকাশের করতল, বুদ্ধের বাসনা, খোরমার বন, গোলাপি সমুদ্র আর তার ধন্বন্তরি তরঙ্গ।