নাগরিক পঙক্তিমালা
কোমর অবধি ঢেকে আছে নাগরিক আগাছায়
রাষ্ট্রীয় দিনলিপি, মৌলিক চাহিদার খাতায়—
এমনকি কোনও কোনও যুবতির স্তন;
লজ্জা ঢাকার জন্য আমাদের কারুরই এখন
গণতান্ত্রিক ধর্ষণ কিংবা পোশাকে আপত্তি নেই!
অভ্যস্ত চোখের সামনে চশমা ধরে তাকালেই
দেখি— স্বদেশ নয় অখণ্ড স্বর্গ, সোনালি ঝলমল
উন্নয়ন পথে একমাত্র দোষী— অপোন্যান্ট দল।
শুনেছিলাম কাকের মাংস খায়না কাকে
জনৈক কবি রেগে বললেন— কে বলেছে তোমাকে
কেবল মানুষেরাই হয় পাচাটা, হুজুগে, অস্থির,
আর কবির প্রশংসা সয় না কখনো অন্য আরেক কবির।
ক্রোধভরে একমুখ ঘৃণার থুতু আকাশে ছিটাই
ঈশ্বর কোথায়? সেখানে কেবল মেঘের বোঝাই
বেদ নয়, গীতা নয়, নয় তথাগত পুরাণ
একমাত্র সেই লোক ভগবানের সমান;
সেই স্বয়ং ভগবান, এখনো জন্ম হয়নি যার—
আজন্ম মুখে মুখে যাকে করে এসেছো প্রচার
যতো আদিম বৈশ্বিক মানুষ, আজ ধিক তোমারে ধিক
সভ্যতার শিকল পরে হয়েছো যারা রাষ্ট্রের নাগরিক।
জার্নি বাই বাস
সকাল আটটার বাসে রোজ আমাদের দেখা হতো।
টুকটাক কথাও হতো— বাস কখন আসবে?
নাইওরপুল, শেখঘাট, টিলাগড়, ঈদগাহ
দুপুরের চৌহাট্টায় এতো জ্যামের কারণ কী?
বাসে যেতে যেতে আমাদের চোখে পড়তো—
রাস্তায় পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো স্কুল।
ব্যানারে ব্যানারে স্লোগান লেখা—
“স্বল্প খরচে মানসম্মত শিক্ষা।”
প্রতিটা অর্ডিনারি বাচ্চার পিঠে দেখতাম
বয়সের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ওজনের বই।
ওদের দেখে তখন খুব করুণা হতো।
এইসব বইয়ের বোঝা পিঠে চাপিয়ে দিয়েই
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনদিন শিক্ষার নামে
আমাদের মেরুদণ্ডহীন করে দিচ্ছে।
তখনো আমরা কেউ কারুর নাম জানতাম না।
সেও জানতো না আমি কী করি, কোথায় যাই!
শুধু চোখাচোখি দেখায় হেসে উঠতো—
সমদূরবর্তী দুটি পরিচিত মুখ।
ধীরেধীরে জানলাম— আমরা সহপাঠী।
আমি জানলাম তার নাম অজন্তা,
সে জানলো আমার নাম সোহাগ।
শুধুই সোহাগ? আগে পরে কিছু নেই?
পুরোনাম— হোসাইন সোহাগ, মুসলিম।
হয়তো তার সামনে তখন সোমনাথ বিহার
আর আমার ভাগে বাবরি মসজিদ।
এরপর আরও যতোবার সেই বাসে আমাদের
দেখা হয়েছে, চোখাচোখি দেখায় হেসে উঠেছে—
একজন হিন্দু অথবা একজন মুসলিম।
কখনো অজন্তা সোহাগের দেখা হতো না!
আ পোয়েম এগাইনস্ট টেররিজম
“চুমুর জন্য বৈধতা চাই, চুমুকে বৈধ করা হোক।”
গত তিনদিনব্যাপী এই শিরোনামে—
যারা রাজপথে স্লোগান করেছিলো,
বৈধভাবে ভালোবাসার দাবি তুলেছিলো
আমি তাদেরই একজন।
ওদের সাথে আমাকেও আটক করা হলো।
আমার অপরাধ লিখা হলো—
কেন আমি কবিতা লিখি এবং
যুবতীরা কাছে এলে ঠোঁটে চুমু খাই
যেহেতু আমি রক্তে-মাংসে প্রেমিক,
আমার রক্তে-মাংসে প্রেম;
আমি লিখেছিলাম— চুমু খেলে
রমণীর স্তন দুগ্ধস্ফীত হয়।
কিন্তু, আমি কোথাও লিখিনি—
সুন্দরবন বাঁচাও, “Save Sundarban”
তনু হত্যার বিচার চাই, “Justice for Tonu”
“Terrorism has no nationality or religion”
মিহির, আমার খুব কাছের বন্ধু
ওসব লিখেছিলো বলে হাত খুইয়েছে!
আজ শেলে বসেই খবর পেলাম—
“শিববাড়ির আতিয়া মহলে জঙ্গি আস্তানা
পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত ছয়
আহতাবস্থা আশংকাজনক
খুব বেশি রক্ত প্রয়োজন;
আমার শহরের বাসিন্দা আবু কয়সর—
তিনি আর নেই!
অপর পাতায় অপুদের কথাও লিখা ছিলো।”
হয়তো পরশু আমার নামটাও কাগজে আসবে,
যতোটা সম্ভব চোখ বুজে এড়িয়ে যেও।
রিপোর্ট
ক’টা গুলির শব্দ, ধুঁয়ার রেশ কেটে যাবার পর—
সংবাদ প্রতিনিধিরা রিপোর্ট লিখতে এলেন;
ততক্ষণে দুটো ভ্যান কারাগারে ফিরে গেছে!
রাস্তার উপর তখন জুতার সমাবেশ—
ছেঁড়া টি-শার্ট, ওড়না, প্লেকার্ড, ফেস্টুন;
টিপাই-ফারাক্কা, রামপাল, তনুর লাশ
হলরোম, স্লোগান, রক্তের স্রোত
এদের সবাই অধিকার নিয়ে নর্দমায় মিশে গেছে।
বিলম্ব না করে প্রতিনিধিরা হাসপাতালে ছুটে গেলেন;
মৃত্যুর দু’মিনিট আগে ইমার্জেন্সি বেডে যখন
সদ্য অন্ধ গুলিবিদ্ধ বালক চিৎকার করে উঠলো—
আপনারা কে? পুলিশ না মানুষ?
প্রতিনিধিরা আর কোনও রিপোর্টই লিখলেন না।
মৃত্যু এবং কতোগুলো চোখ
৩ আগস্ট ২০১৬, রাত— ১০:১৫
থার্ড ফ্লোর। ওয়ার্ড ০৫, P— 03।
দুটো চোখ চিরতরে মুদে গেলো;
সেই চোখের পাশে কাঁদছিলো—
আরোও ক’টা অপলক চোখ,
চোখের ঘুমে জেগে উঠা চোখ!
প্রাণের বিচ্ছেদ উদ্বেগ উৎকন্ঠায়
ক’টা আর্তনাদ হলো, বড়সড়—
তবুও চোখের ঘুম ভাঙ্গলো না।
একটা ডেথসার্টিফিকেট এসে—
পাকাপোক্ত প্রমাণ রেখে গেলো
মেয়েটিকে মা বলে ডাকার মতো
বাবা আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই।