প্রবন্ধ

ঈদ উৎসব কেন সর্বজনীন নয়

আমরা প্রায়ই বিভিন্ন লেখা বা রিপোর্টে সর্বজনীন ঈদ উৎসব বাক্যটি দেখতে পাই। কিন্তু এর অর্থগত ভাবনাকে বুঝতে চেষ্টা করি না। শব্দটিকে সংখ্যাতথ্যে বিচার করা যাবে না। অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস ভূমি হলেই তাদের কোনো উৎসবকে সর্বজনীন শব্দবন্ধনে ঋদ্ধ করা যাবে না। আবার সর্বজনীনের স্থলে সার্বজনীন বললেও ঈদ উৎসব বাঙ্গাল অঞ্চলে প্রবীণ অর্থবোধক হয়ে ওঠে না।

একটি বিষয়কে সার্বজনীন অর্থে মূল্যায়ন করতে হলে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য আবেদন উপস্থিত থাকতে হবে। ঈদ উল ফিতর এলে এর প্রধান আবেদন ধনী ব্যাক্তিদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র মানুষকে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এটা কেবল মুসলমানরাই করেন। অন্যধর্মের ব্যাক্তিরা এটা করেন না। আবার ঈদ উল আযহা উৎসবের অন্যতম আবেদন হলো অর্থসম্পন্ন ব্যাক্তি কুরবানী দিবেন। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গরু কুরবানীই সর্বাধিকভাবে প্রচলিত। আমাদের অঞ্চলে ঈদ উল আযহার দেশীয় নাম বকরাঈদ নামে প্রচলিত। এই অঞ্চলে কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই বকরাঈদ শব্দটি প্রচলিত হলো তা গবেষণার বিষয় বটে। এ অঞ্চল এক সময় পৌত্তলিকদের আভাসভূমি ছিলো। গরু জবেহ করা পৌত্তলিক ধর্মে পাপ বলে গণ্য হয়। তাহলে আদি যুগে মুসলমান সুফিরা কীভাবে এ অঞ্চলে অন্য ধর্মের মানুষের মান্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা ভেবে দেখা যেতে পারে। গরুর বদলে ছাগল যার আরবী নাম বকর যা বাংলায় বকরী বলা হয়। হয়তো তারা অন্য ধর্মের প্রতি সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে ছাগলদ্বারা কুরবানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আদায় করে নিতেন। আমি পূর্বেই বলেছি, এটি একটি গবেষণার বিষয়। আমরা সুফীচিন্তকদের তরিকা বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবো তারা কীভাবে অন্যের মনোজগৎ পাঠ করতেন এবং কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন। আবার এটাও সত্য গৌড়গোবিন্দ্রের অত্যাচার ও মুসলামানদের প্রতি তার অসহিষ্ণু আচরণই বাংলায় মুসলমানদের আভাসভূমি গড়ার প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিলো। কথিত আছে, হযরত বোরহান উদ্দীনের ছেলের আকিকা উৎসব উদযাপন করতে গিয়ে তিনি গরু জবেহ করেছিলেন। সেই সূত্র ধরে অত্যাচারি রাজা গৌড়গোবিন্দ্র বোরহান উদ্দিনের হাত কেটে দিয়েছিলেন ও তার সন্তানকে হত্যা করেছিলেন। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি নালিশ জানিয়েছিলেন দিল্লীর সুলতানের কাছে। এসব কাহিনী আমাদের লোক সাহিত্য ও বাউল গানের মধ্যে আজও জিইয়ে আছে।
বাউল দূর্বীন শাহর একটি গানে এ ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়।
বোরহান উদ্দীর পুত্র হত্য়া
পাইয়া বাবায় নিমন্ত্রণ
তিনশ ষাট আউলিয়া নিয়া
সিলেট করলেন আগমন।
অন্যায়ের করে অবসান
উড়াইলেন নিশান দ্বীনি …
হযরত বাবা শাহজালাল
মজররদে ইয়ামনি।।
বকরি বা ছাগল থেকে গরু কুরবানীর উত্তরণ ও পরবর্তীতে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। ঈদের সর্বজনীনতা ধর্মীয় আচরণ থেকে আসতে হবে। শুধু শব্দ ব্যবাহর করলেই বিষয়টি সকলের হয়ে ওঠবে না। ফিতরা দেয়া এবং কুরবানী এ দুটো দুই ঈদের প্রধান বিষয়। আরো যেসব আচার অনুষ্ঠান রয়েছে সেসব কর্মসূচীকে সকলের করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সকলের বলতে অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সম্পৃক্ততা ও তাদের জন্য পরিসর তৈরী করা জরুরী। এসব যদি স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে হয়, অকৃত্রিম আবেদন সৃষ্টি করতে পারে তাহলে ন্যুনতম সর্বজনীন হবে বলে আমাদের ধারণা।

বৃটেনে ইষ্ট লন্ডন মসজিদ এক সময় ঈদ উৎসবকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করেছিলো। কিছু সাংস্কৃতিক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিলো। যদিও বর্তমানে তেমন কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না।
ইষ্ট লন্ডন মসজিদের সামনের চত্বরে ঈদের জামাত শেষে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ গান বাজনা নিয়ে ঈদ উদযাপন করতেন। ছিলো নানান ধরণের খেলা প্রতিযোগিতা। এটা তো অনেক আগের ঘটনা। যদি এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো তাহলে এতোদিনে আরো নতুন নতুন কর্মসূচী যুগ হতো। সর্বজনের দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড উপেক্ষিত হয়।

উৎসব হলো মেলবন্ধনের মতো। নানান মতের নানান পথের মানুষ এতে সম্পৃক্ত হয়। অন্যদের মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি সনাতন ধর্মের মানুষদের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দীর্ঘদিন আমরা এটা লক্ষ্য করেছি। বাঙালি সনাতন ধর্মের মানুষ এবাদত শব্দ ব্যবহার করেন না। আবার বাঙালি মুসলমান পূজা শব্দ ব্যবহার করেন না। ইন্ডিয়ার সনাতনধর্মের মানুষ এবাদত, খোদা এসব শব্দ ব্যবাহার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। জল ও পানির সঙ্ঘাত বাঙালি সনাতনধর্মের ও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিবেদ তৈরী করে। কিন্তু অবাঙালির মধ্যে এ বিবেদ নেই। তাহলে সমস্যাটা বাঙালি জনগোষ্ঠীর, ধর্মের নয়।
আজ থেকে একশ বছর আগেও বাঙালি মুসলমান ধুতি পড়তেন। এতে ধর্মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ধুতিকে বাঙালি মুসলমান ধর্মের পোশাক বানিয়ে ফেলেছেন। ইসলামী পোশাক বলে কিছু আছে? ইসলাম তো বলেনি তুমি ঐ পোশাক পরিধান করতে পারবে না। ইসলাম পোশক পরার ক্ষেত্রে একটি প্রিন্সিপোল তুলে ধরেছে। বলে দিয়েছে সতর বা শরীর কীভাবে ঢাকতে হবে। সেটা বলে নাই ওমুক বা তমুক পোশাক পরা যাবে না।
মুসলসান ও হিন্দু উভয়েই ইউরোপিয়ান পোশাক পরে নামাজ বা পূজা করেন। তাতে কোনো দোষ দেখেন না। তখন তারা বলেন না, খ্রিষ্টানদের পোশাক পরিধান করে নামাজ বা পূজা করা যাবে না। বাঙালি জীবনে এসব সাংঘর্ষিক আচার-বিচার দেখা যায়। এই সামান্য বিষয় আমাদের দূরত্ব তৈরী করে। একই ভূমির মানুষ হয়ে চিন্তারক্ষেত্রে ভিন্ন জগতে বাস করি। এসব বিরোধকে কাজে লাগান রাজনীতিবিদরা কিন্তু তা সমাধানে এগিয়ে না এসে দূর থেকে বাণী দেন সম্প্রীতি বজায় রাখার। আচার অনুষ্ঠানে ভিন্নতা রেখে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় না। এর জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান সার্বজনীনতা কিংবা সর্বজনের হয়ে ওঠে না।

উল্লেখ্য, পশ্চিমা বিশ্বে পোশাক অনেক দূরত্ব কমিয়ে আনলেও প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ দূর করতে পারেনি। তবে আইনের শাসন থাকার কারণে বর্ণবাদ আচরণের জন্য বর্ণবাদীদের অনেক কঠিন শাস্তির মুখোমুখী হতে হয়। এর জন্য পৃথিবীতে এখনও বৃটেন গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিলনকেন্দ্র এই বৃটেন। মাল্টিকালচারের প্রকৃত রূপ এখানে দেখা যায়।

পবিত্র ঈদুল ফিতর মানুষের জন্য যে বাণী নিয়ে আসে আর সুফল সবাই ভুগ করতে পারে না। ফিতরার সম্পদ বা অর্থ থেকে কেবল গরীব মুসলমানই উপকৃত হন। অন্য ধর্মের মানুষ যদি এ থেকে উপকৃত না হয় তাহলে এ উৎসব কী করে অন্যের বলে গণ্য হবে। সকলের জন্য সামাজিক কর্মসূচী ঈদের পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের সেদিকে গুরুত্ব দেয়া বাঞ্চনীয়।
ঈদ সার্বজনীন ও সর্বজনীন হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পাক। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

আপনার মতামত জানান

আহমদ ময়েজ

আহমদ ময়েজ; কবি ও চিন্তক। জন্ম- ১৯৬৮ সাল (সরকারি হিসাব অনুযায়ী) সুনামগঞ্জের সৈয়দপুর গ্রামে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপন করেন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে। তারপর দীর্ঘদিন বাউল সঙ্গ। লেখালেখির শুরু হয় ছড়ার মাধ্যমে। ছড়া, কবিতা, গদ্য ও সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। প্রকাশিত বই ‘একমুঠো রোদ্দুর’, ‘কেউ করো না মানা’ এবং বিমূর্ত চরণে রাখি কালের ক্ষমা। সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ভূমিজ। বর্তমানে বিলেতের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

দুঃখিত, কপি করা যাবে না।