- মেঘালয়ের কাছাকাছি সীমান্তঘেঁষা একটি স্কুলে শিক্ষকতাকালীন ছুটির দিনগুলোতে চলে যেতেন সীমান্তের ওপারে, চুঙ্গা বেয়ে। মিশেছেন চোরাকারবার করে জীবনযাপন করা মানুষের সঙ্গে। দেখেছেন পাহাড়ি মানুষের জীবন। সেখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান দিয়ে এই সময়ের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর নির্মাণ করেছেন এই গল্প, আচিক মান্দি। পাঁচ পর্বের এই গল্পের প্রথম পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। - সম্পাদক
১. প্রত্যাশা সাংমা
খাসিয়া মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই আমি ফ্রিজ হয়ে যাই! বুকটা ধক করে ওঠে। এই মডং বাজারে আরো কতবার এসেছি। ডান দিকে, অনেক উঁচু থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আসা চিলাই নদীটা যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। অগভীর কিন্তু তার চওড়া বুকে শেওলা-ধরা অসংখ্য বড় বড় পাথর। প্রাচীন-গন্ধি এইসব পাথর আর খাসিয়া মেয়েদের মতো একহারা গড়নের কিছু সরলবর্গীয় গাছ, ফাঁকে ফাঁকে ছোটে-চলা স্বচ্ছ পানির থৈ থৈ, উপরে নীল পর্বতের ছায়া ছায়া লীলার মাঝে পৃথিবীর সব রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বুঝি আমার জন্য সে সারা বছর অপেক্ষায় থাকে। তাই কয়েক বছর পরপর আমাকে এখানে ছোটে আসতে হয়। কাঁটাতার ঘেরা ভারতের পানি যে চুঙ্গাগুলো দিয়ে বাংলাদেশে আসে সেইগুলা আমার পথ। তাই এখানে প্রায় সবকজন পাহাড়ি আমার মুখ চেনা। কিন্তু এর আগে স্বর্গের এই দেবীকে আমি দেখলাম না কেন?
পাহাড়ি মেয়েটার চোখ থেকে আমি নজর সরাতে পারছি না। বিস্ময়কর ভালো লাগায় আমার দেহ-মনে একটু একটু কাঁপন ধরে যাচ্ছে! আকাশের মতো ছড়িয়ে থাকা বিশাল বট গাছের ছায়ায় তার লকলকে লম্বা দেহটা শুকতারার মতো জ্বলছে। মেয়েটার কোমর এত চিকন যে, জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে গেলে বুঝি মট করে ভেঙে যাবে। তার সামনে খাঁচা খাঁচা পানের স্তুপ। যখন বিকালের লাল রোদে চিলাই নদীর বুকে ঈশ্বর হাসবেন। পাখিরা গাছের কুটর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে পড়বে কীটপতঙ্গ খাওয়ার লোভে, ঠিক সেই সময় চোরের মতো উঁকিঝুকি দিতে দিতে বাঙালিরা আসবে খাসিয়া পান-সুপারি, বাঙ-গাঁজা আর মদের চালান নিতে।
খাসিয়া মেয়েরা একজন-দুইজন করে পান-সুপারি, কমলা-সাতকড়া নিয়ে পাহাড়ের চিপাচাপা বেয়ে নেমে আসছে। তাই বলতে গেলে বাজারটা এখনো পতিত। মাথার উপর ঝলমলে দুপুর। কোথাও কোনো হাঁক-ডাক নাই। সিসাং পাহাড়ের দিক থেকে বাজ পাখির ডাক ভেসে আসছে। তিন দিক থেকেই মেঘালয়ের পর্বত খাসিয়াদের ছোট ছোট পুঞ্জি, বাজার, গীর্জাকে আগলে রেখেছে। স্তব্দ, উজ্জ্বল দুপুর আর কেমন জানি শান্তি শান্তি আবছায়ায়, ছোট ছোট টং দোকানে, গ্লাসের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। আদিবাসীরা একটু একটু করে নিঃশব্দে পান করছে।
খাসিয়া-বাজারগুলোতে যদি পাঁচটা থাকে চায়ের টং তবে পঁচিশের বেশি হবে মদের দোকান। শুধু মদের দোকান না সব রকম ব্যবসা চালায় মেয়েরা। কেউ কারো বিষয়ে নাক গলায় না। তারা মাতৃতান্ত্রীক পরিবারের মুক্তমনা স্বাধীন মানুষ। সংসার, চাষবাস, ব্যবসা মেয়েদেরকেই দেখতে হয়। তারাই জমি-বাড়ির মালিক। হর্তকর্তা। তাদের কাছে গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমরা কে বা কারা? তারা বলবে, আচিক মান্দি। অর্থাৎ পাহাড়ের মানুষ। আশা করি এইটুকুতেই বোঝাতে পারছি তাদের সহজ-সরল-সুন্দর আর প্রাকৃতিক জীবনের কিছু কিছু উপাখ্যান।
এইসব এক পলকের ভাবনা। আমার আচ্ছন্ন চেতনার মাঝে একটা সবুজ ঘাগরা, হলুদ-লালে মাখামাখি শরীরের উপর গোলাপী রঙের গোলগলা গেঞ্জি, আগুনের মতো ঝলকাচ্ছে। আদম যেমন ইভের প্রথম দর্শনে তাঁর অভিশপ্ত জীবনের সব ক্লান্তি-কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন, তেমনি আমিও। প্রথম শব্দে সৃষ্টি হয়েছিল মহাবিশ্ব। আর আজকের এই নীরব বিস্ফোরণে আমার বুকে মাথা তুলে দাঁড়ালো প্রেম।
এখন কী করব? আমি কী তার পায়ে লুটিয়ে পড়ব? নাকি তাকে খুশি করবার জন্য তার পাশে চুপ করে বসে থাকবো? গলাটা শুকিয়ে কাঠ। উত্তাপে শরীরটা পুড়ছে। আমি কিছুই শুনছি না, বুঝছি না, ভাবছি না। মায়ের গর্ভ থেকে নেমে আসা শিশুর মতো হঠাৎ আমি এক অসহায় জীব!
জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে একটু দূর থেকে আমি তাকে কেন্দ্র করে অর্ধ-বৃত্তাকারে হাঁটতে থাকি। সে বুঝি আমার জীবনের নিউক্লিয়াস। তাই অবিরাম হাঁটি। ধীরে ধীরে হাঁটি। প্রতিটা পদক্ষেপে সামনের ওই ঝর্নার মতো অপূর্ব ফিলিংস! হাওয়ায় ভাসতে থাকা পালকের মতো আমি তাকে চোখ থেকে একটুও সরাই না। সে-ও তাই। একটু বাঁকা আর চিকন চোখ দুটো থেকে একটা তরল, উজ্জ্বল আগুন ধীরে ধীরে আমার আত্মায় এসে ঢুকছে। প্রতি মুহূর্তে আমি বদলে যাচ্ছি। বেড়ে উঠছি। ইজ্জতে, স্বাধীনতায়, ভালোবাসায় ভেসে যাচ্ছি ওই পর্বত শিখরের দিকে।
পৃথিবী সৃষ্টির পর সূর্যের প্রথম চুম্বনে ভূমণ্ডল যেমন পবিত্র হয়ে গেছিল, সেই মতো তার মুগ্ধতাগুলো, লজ্জা-দ্বীধাহীন মুচকি হাসিগুলো আমাকে মুহূর্তে মুহূর্তে পবিত্র থেকে পবিত্রতমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে!
সিন্ধু সভ্যাতার সময় আমরা ভুটাং পাহাড়ে ছিলাম মায়ের পেটের ভাই-বোন। ফারাওদের রাজত্বে ছিলাম মা-ছেলে। পলাশির প্রান্তরে আমি মীরমদন, তুমি সিরাজের প্রিয় সাকি আলেয়া। আর-জনমের পাপে আমি সমতলে জন্মেছি। আমাকে ক্ষমা করো প্রত্যাশা সাংমা। আমার সাংমা দেবী।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোলতে দোলতে অনুমানে তার নামটা আমি তালাশ করি। কী হতে পারে তার নাম? খাসিয়া মেয়েদের যেমন হয় অবশ্যই তেমনি প্রত্যাশা সাংমা কিংবা এ্যলিজা মারাক? তার নাম যাই হোক আমি তাকে প্রত্যাশা বলেই ডাকবো। প্রত্যাশা! প্রত্যাশা সাংমা কিংবা আমার আশা আরেং! তোমার নামটার মাঝে লুকিয়ে আছে দারুণ রুচি আর পরিচ্ছন্নতা বোধ! কে রেখেছিল তোমার নাম? তাকে আমার আদাব-সালাম।
সাংমা রাণী, তুমি যেই হও, আমি তোমার অচেনা নই। সিন্ধু সভ্যাতার সময় আমরা ভুটাং পাহাড়ে ছিলাম মায়ের পেটের ভাই-বোন। ফারাওদের রাজত্বে ছিলাম মা-ছেলে। পলাশির প্রান্তরে আমি মীরমদন, তুমি সিরাজের প্রিয় সাকি আলেয়া। আর-জনমের পাপে আমি সমতলে জন্মেছি। আমাকে ক্ষমা করো প্রত্যাশা সাংমা। আমার সাংমা দেবী। তুমি বিশ্বাস করো, আমি আর দশটা বাঙালের মতো কুমতলবে কাঁটাতারের ওপাশ থেকে আসিনি। তোমাদের পান-সুপারির বাগান, গোয়ালের গরু রাতে যারা চুরি করে নিয়ে যায়, আমি তাদের দলের লোক নই। জন্ম থেকে আমি তোমাকে তালাশ করছি।
বাড়ি, মা-বাবা, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ কিছুই আমাকে ধরে রাখতে পারতো না। আমি প্রতি বছর একবার বাড়ি থেকে পালাই। কেন পালাই নিজেই জানি না। রোজ রোজ ঘুম থেকে উঠে একই বাড়ি, উঠান, মানুষ, মুখ এবং শুধু পাপ! পাপ! বিশ্বাস কর সাংমা দেবী, এইসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমি পালাই। এটাকে বলতে পারো জীবন থেকে পালানো। অবাস্তব মানুষ বলে আমার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে পারো। তবু আমি অক্ষম। মানুষ একটা চলমান আর্বজনা ও অশান্তির উৎস। পরজনমে আমি ঈগল হয়ে জন্মাতে চাই। থাকব অনেক উঁচুতে, বৃক্ষের সর্ব্বোচ্চ ডালে। আধাবোজা চোখে দেখব দুনিয়াটা। কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না, কোনো দরকারে আমার কাছে কেউ আসবে না। যা ইচ্ছা তা খেতে পারব, যেদিকে ইচ্ছা যেতে পারব। এবং বুড়ো হয়ে গেলে, উঁচু ডালে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে হঠাৎ করে মরে পড়ে যাব। মাংসাশি পশু ও পিঁপড়ারা এসে আমার শেষকৃত্য সাঙ্গ করবে।
প্রত্যাশা, তোমার মনে নাই? আইয়ামে যাহিলিয়া যুগে আমরা ছিলাম মরুবাসী বেদুঈন। রাত হলে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে আমি ইমরুল কায়েসের কবিতা সুর করে গাইতাম। তুমি ছাগলের গরম দুধ আমাকে খেতে দিয়ে আগুন-ঘিরে নাচতে।
বসন্ত এলে প্রতিবার ঘরের টাকা চুরি করে আমি পালিয়েছি। মহেশখালী দ্বীপে ছিলাম লবণ চাষীর কামলা। খুলনাতে গিয়ে চাখানার টি-বয়। তোমাদের চেরাপুঞ্জির পাশে, চেলার বাজারে একবার আমি তিন মাস ছিলাম। পুলিশ কিংবা বিএসএফ কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাতো না। আমার ছোটখাটো ফর্সা শরীর, বোঁচা বোঁচা নাকের নিচে পাতলা গোঁফ, মাথার লম্বা-সরল চুল আর বিড়িটানার ভঙ্গি দেখে তোমার দেশের যে কেউ আমাকে প্রত্যাশা সাংমার জাত ভাই বলে ভাবত।
তোমাদের পাহাড়গুলো সেই তাম্রযুগ থেকে আমার হাতের রেখার মতো চেনা। সিমং রাজার শাসন কালে আমি চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে জন্মেছিলাম। দেখোনা আমার গোঁফে এখনো মেঘালয়ের মেঘ জমে আছে।
আমি সব সময় ভ্রমণ থেকে ফিরে এসেছি অক্টোবর-নভেম্বরে। আমাদের সমাজে কলাপাতা-সনদ ছাড়া দাম নাই। প্রকৃত অশিক্ষিতরা আমাকে মূর্খ বলে গালি দিবে। তাই সাধে-অসাধে স্কুল-কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা দেবার জন্য সফর থেকে ফিরে আসতে হতো। পরীক্ষা হয়ে গেলে আবার পালাবার জন্য টাকার তক্কে তক্কে থাকতাম। কেন ক্লাসে যাবো? আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন সাবান-শ্যাম্পুর ফ্যাক্টরি। তারা শুধু বাহিরটা ঝলমলে করে দেয়। এই জন্য তারা একটা খোঁয়াড়ের মধ্যে ছেলেমেয়েদেরকে বছরের পর বছর আটকে রাখে। শিক্ষার্থীর জীবনে অন্ধত্ব পুরোপুরি কায়েম হয়ে গেলে অন্ধকার ভরা পৃথিবীর দিকে তারা ঠেলে দেয়। তাই আমরা মানুষ না হয়ে শতকরা নিরানব্বইজন দানব হই। একাই গোটা বিশ্বটা গিলে ফেলতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এবার পালিয়ে এলাম তোমাদের পাহাড়ে। আমি শহর-নগর এড়িয়ে, আরণ্যক জনপথ ধরে হাঁটি। পৃথিবীর শহরগুলোতে লেজকাটা শিয়ালের মতো শেকড়-কাটা মানুষের ভিড়। এইসব ছিন্নমূল মানুষগুলো কৃত্রিম হতে হতে এখন পোড়া মবিল। তাই মৌলিক কিছু পাওয়ার জন্য আমি সবসময় তৃণমূলে সফর করি।
সাংমা দেবী, আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমাকে বোঝতে চেষ্টা করুন। জীবনটা খুব ছোট্ট একটা সফর। পৃথিবীর এই ভ্রমণ আমার কাছে একটা অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। তাই আমি রুটি বানানো থেকে হালচাষ সব পাড়ি। জুম চাষের মৌসুমে আমরা দুজন জুমঘরে চলে যাবো। তোমাদের মতো আমাদেরও রিচ রূপকথা আছে। জুমঘরে আগুনের সামনে বসে আমি তোমাকে ঠাকুমার ঝুলি থেকে কিচ্ছা শুনাবো। ঝরনার পাশে পাথরে শোয়ে, তোমার কানে কানে আমি লাইলি-মজুনর গল্প বলব। প্রিয়তমা সাংমা, তোমার চোখের আলোতে, হৃদয়ের উত্তাপে, গোসল করে আমি সেই পবিত্র পুরুষ যার জন্য বিধাতা তোমাকে লটকি ফুলের দেশে পাঠিয়েছেন। তুমি এই অদমের মিনতি শোন, প্রথম দর্শনে আদম যেমন ইভকে চারপাশ থেকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন, দেখো মেয়ে, আমিও তোমাকে সেইভাবে দেখছি। জামার বোতাম খুলে দেখো, আমার বুকে লঙ্কা দ্বীপের ঘাস। শুনবে? আমিও তোমাদের মতো করে খাসিয়া-বাংলা বলতে পারি। এইযে শোন, আমি তর লাগি মনে মনে ডাকসে, প্রত্যাশা, প্রত্যাশা সাংমা…, তর লাগি আমার মন খাইছে, বেশি বেশি খাইছে।
হাতের সিগারেট হাতেই ছাই হচ্ছে দেখে সে আমাকে ইশারায় ডাকে! ডাকতেই থাকে। আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম? অন্তত পাঁচবারের বার তার ইশারা আমার চোখে পড়ে। পঞ্চাত্মা কেঁপে ওঠে। আমি কী গড়িয়ে গড়িয়ে তার পাশে গিয়েছিলাম, না বসে বসে? আমার মাথা এত ঘুরছে কেন? কেন আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? হায় আমি বুঝি হামা দিয়ে দিয়ে অনেক দেরিতে তার কাছে গেলাম। সে খুব মধুর গলায় বললে, ব।
আমি না বসে তার চোখে চোখ রেখে, কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিসাই, ব না। বসো। বলো বসো।
তবু সে বলে, তুই বাঙাল আছিস, ব।
আমি তার মুখোমুখি একটা পাথরে বসি। এখনো তার নজর আমার নজরে গাঁথা। আমি তার সবটুকু দিব্যি দেখতে পারছি। হলুদের মধ্যে লাল পোজ দেওয়া ছোট ছোট স্তন দুইটার মাঝখানে আত্মাটা আবেগে কাঁপছে। সে-ও আমাকে হৃদয়ের গভীর থেকে দেখছে। কিছু একটা তালাশ করছে। অবচেতনে আমরা পরস্পরের হৃদয়ে হৃদয় মাখি, আত্মায় আত্মার পরশ লই, শরীরের গন্ধ শোঁকে শোঁকে জানাজানি করি। রাতে জোনাকি যেমন উড়ে উড়ে আলো ছড়ায় তেমনি আমরাও মননে-মগজে আলো বিনিময় করি। এবং সে আরেকবার হাসে। বরফে ঢাকা পর্বতের চূড়ার মতো উজ্জ্বল আর পবিত্র হাসি দিয়ে সে বলে, আমি আচিক মান্দি, তুই বাঙাল, আমার লাগি আইসে, তুই ব।
অবুঝ, আনপড় ইভকে আদম যেভাবে প্রেমের ভাষা শিখিয়ে ছিলেন তেমনি আমিও তাকে বুঝাই, তুই না, তুমি। বলো, তুমি, তুমি…।
সে হাসে। প্রেম-কাম-লোভের না, পাহাড়ি মানুষের সহজ হাসি। ঝরনার পানির মতো স্বচ্ছ তার মন। অহঙ্কার কিংবা ঘৃণাহীন তার সহজ হৃদয়। হলুদের উপর পাহাড়ের লটকি ফুলের পাপড়ির মতো লালিম তার শরীরের আভা। সতেজ আর লকলকে দেহ থেকে জস্টিমধুর মতো একটা সুঘ্রাণ বেরুচ্ছে। গোলগলা গেঞ্জির নিচে গাঘরাজাতীয় আদিবাসী পোশাকে সে স্বর্গের হুরী। খাসিয়া বাংলা বলে ময়না পাখির মতো থেমে থেমে, ভেঙে ভেঙে। অনভ্যস্থ আর আজব বাংলা ভাষা তার কণ্ঠে যেন কমলা ফুলের সুবাস ছড়ায়। সে রানীর মতো লম্বা আর চিকন ঘাড় তুলে আবার বলে, তুই বাঙাল, আমার লাগি আইসে, তে ব। আমি পান বেইচা লই।