- বছর দেড়েক মেঘলায়ঘেঁষা সুনামগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন শেখ লুৎফর । সীমান্ত পেরুলেই ভারতের মডং-রেঙ্গা-চেলার বাজার। ছুটির দিনে প্রায়ই চলে যেতেন চোঙ্গা বেয়ে। মিশেছেন পাহাড়ি জনপদের মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন বড়গল্প ‘আচিক মান্দি’। পাঁচ পর্বের গল্পটির চতুর্থ পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। -সম্পাদক
৪. কাপল কাপল
স্বর্গের তৃপ্তিভরা ছোট ছোট মুহূর্তগুলো গ্লাসে ঢেলে আমরা একটু একটু পান করতেই থাকি। আমাদের আত্মা পরস্পরকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে আমরা ছিলাম নীরব দর্শক—শ্রোতা। প্রিয়তমা প্রত্যাশার পুরুষ্টু উরু, চকচকে হাতের কনুই আমার উরু ও পেটের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকল। আমাদের মুখে কোনো কথা নাই। কেন থাকবে? ছাগল ছাগলের সাথে কথা বলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। মানুষ আলাপ করে মুখের ভাষা দিয়ে কিন্তু প্রেমিক—প্রেমিকারা কথা বলে আত্মা, ইঙ্গিত কিংবা গানের মতো হৃদয়ের কালাম দিয়ে।
পাহাড়ি লতাপাতার নির্যাস থেকে বানানো মাঠাও আড়কে আমার ছোট পেটটা ঢোল। ঘণ্টাখানেকের এই নৌবিহারে আমি এখন ভারেশ্বর। পৃথিবীর সমস্ত রূপ—রস, প্রেম—কাম ইত্যাদির মুখে ছাই দিয়ে আমার তলপেটটা টনটন করছে। পেশাবের তলবে ভেতরে ভেতরে আমি কাতরাচ্ছি। প্যান্টের চেইন টেনে দাঁড়িয়ে পড়ার জন্য চোখের সামনে দেখছি শুধু চিপাচাপা।
দোকান থেকে বাইরে বেরুতেই লাল—সবুজের শেষ বিকাল আমাদেরকে স্বাগত জানায়। নীল নীল পর্বতের ছায়ায় আমরা খুব কাছাকাছি, পাশাপাশি হাঁটছিলাম। বেহেশতের হুর—গেলমানরা আমাদের চলার পথে নীল অপরাজিতার পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে উড়ে এসে প্রত্যাশার সিল্কি চুল আমার চোখে—মুখে বারবার ঝাপটা মারছে। পাহাড়ি টিয়াগুলো মাথার উপর দিয়ে ছোটে যেতে যেতে আমুদে—গলায় গাইছে, ওখান মানু ভালা আসে…, ওখান মানু ভালা আসে।
এক ঝাঁক শালিক পাখায় পতপত শব্দ তুলে আওয়াজ দেয়, কাপল! কাপল!
এইসব দেখতে দেখতে আমরা বাজারের দক্ষিণ দিকে হাঁটছি। সামনেই চিলাই নদী রোদে ঝিকমিক করছে। প্রত্যাশা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে, ত্যা লওনা বন্ডু নদীখানো যায়।
আমিও তো মনে মনে নদীই খোঁজছি। নারী আর নদী, নদী আর নারী…, কোথায় কোথায় জানি মিল আছে?
প্রিয়তমা সাংমা দেবী। আমার আশার পাখি। আমি তোমার আলোভরা টানাটানা চিকন চোখে চিলাই নদীটাকে দেখছি। অনেক উপর থেকে পাথরের ঢাল বেয়ে সে ছুটে আসছে। খলখল করে ভারতের সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে আমাদের বাংলাদেশে। ওইযে দেখো, আমাকে দেখে নদীটা হৈ হৈ করে ডাকছে, বাংলায় চল… বাংলায় চল, তুমি দেশে যাবে না ভাই?
আমি হাত নেড়ে চিলাইকে টাটা দেই, যাও বোন, মাকে বলবা আমি ভালো আছি, ভূতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব নিয়ে মেঘালয়ের পাহাড়ে কাজ করছি।
বোঝেছ সাংমা দেবী, পৃথিবীর সব ভালো ছেলেরাই মাকে খুব ভালোবাসে। এবং সময়মতো এইভাবে ফাঁকি দেয়।
হাঁটার মধ্যেই প্রত্যাশা আমার একটা হাত আলতো করে ধরে। জুমচাষে অভিজ্ঞ আঙুলের একটু শক্ত শক্ত গরম স্পর্শে আমি কেঁপে উঠি। বিবি হাওয়া কী আদমের হাত আগে ধরে ছিলেন?
তৃতীয় পর্ব পড়ুন ↓
আমরা হাতে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে চিলাই নদীর খাড়– পানিতে নেমে আসি। খলখল করে পানি ছোটছে। পাশাপাশি উপুর হয়ে ঠাণ্ডা পানির হিমহিম স্রোতে আমাদের ভাঙাচুরা মুখ দেখাদেখি করি। এক দেখায় কত লক্ষ লক্ষ কাপলের মুখ দেখি, জীবন দেখি, পোড়ে যাওয়া পতঙ্গের হৃদয়ভষ্ম দেখি!
আমরা পাশাপাশি বিশাল একটা পাথরে বসি। কলকল করে নদী ছোটছে। সাংমা একটু একটু হাসছে। বেশি হাসছে তার চিরল চিরল চোখ দুটো। অপূর্ব স্বাদে আমার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। বিছানায় নেবার জন্য মেয়েদেরকে আমরা যেভাবে পটাই, প্রত্যাশা এখন আমার সাথে ঠিক তাই তাই করছে। শুধু তার ভাব—ভাষা কিংবা ইশারা—আবেগ প্রাচীন পাহাড়ের মতো কিছুটা রুক্ষ ও আদিম।
পরনের ঘাগরাটা একটু উপরে তুলে ধরতেই প্রত্যাশার পায়ের গোছার রূপ নদীর পানিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি সেই উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কী চকচকে! মাছি বসলেও পিছলে পড়বে।
একটু একটু করে উপরে উঠতে উঠতে নদীটা একদম পর্বতের হৃদয়ে চলে গেছে। উপরে, নদীর দুই পাশে ভঙ্গিল পবর্তের ঢেউ খেলানো সবুজ চূড়া। সেখানে নদীর অগভীর বুক দিয়ে হাঁটলে দেখতে পাবে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অনেক ছোট ছোট গুহা। প্রত্যাশা আমার, উলঙ্গ—মানুষ একদিন ওইখানে থেকেছে, ভালোবেসেছে, সন্তান জন্ম দিয়েছে। কিন্তু কে পিতা, কে মাতা?
কাচুমাচু ভঙ্গিতে একবার উঠে গিয়ে বিশাল একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে পেশাব করি। শেষ শিহরণে একটু হলেও সঙ্গমের সুখ পাই। চেন টানতে টানতে আবার ফিরে আসি তার পাশে। সে আগের মতোই আমার একটা হাত মুঠিতে তুলে নেয়। মোমের আগুনে জ্বলছে তার শরীরের হাড়মাস। ময়নার মতো ভাঙা ভাঙা বুলিতে সে বলে, মানুখান আমার লাগির আইসে, বইসে, দারু খাইসে, তর লাগির আমার বেশি বেশি মন খাইছে…।
এইসব বলতে বলতে কিংবা একটু টলতে টলতে সে আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। ও…ও…মানুখান আমার, ও…ও…ওখান আমার মানু…!
ও…ও…ডাকটা যত লম্বা হবে, বুঝতে হবে তার আন্তরিকতা কিংবা প্রেম—কাম ততটাই গভীর হয়েছে। তাই এইসব বলতে বলতে পাহাড়ের বাঘিনী সমতলের ছাগলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্রথমেই একটা আগ্রাসী চুম্বনে চুঁষে চুঁষে সে আমার আত্মা থেকে হৃদয়টা তুলে নেয়। আমি পূজার নৈবেদ্য। দেবীর চরণে সমর্পিত। তাই আমার গোঁফসহ ঠোঁট দুইটা কমলার কোশের মাঝে গায়েব হয়ে যায়। বুকের কাছে, বগলের নিচে নাক লাগিয়ে চতুর কুকুরির মতো আমার ঘামের গন্ধ লয়। তারপর ও…ও…করে কামার্ত হরিণীর মতো আদিম আবেগ কেঁাকায়, আমার মন বেশি বেশি খাইছে। ভগমান দ্যাখব, ওখান মানু ভালা আসে।
আমার প্রিয়তমা সাংমা। মিথ্যার উপর আমি বালির বাঁধ গড়তে চাই না। আমার বিষয়ে তোমার একটা পস্ট ধারণা থাকা উচিৎ। তুমি আচিক মান্দি, আমি ভূ—পর্যটক। তাই তোমাকে আমি ভেতর থেকে চিনি। তুমি শুধু আমার বাহির দেখেছ। কাঁটাতারের ওপাশ থেকে আসা বাঙালদের চরিত্র দিয়ে আমার জাত বিচার করে বসে আছ। কিন্তু জাতি হিসাবে আমাদের অনেক প্রেম, ত্যাগ আর গৌরব—গাঁথা আছে। কেউ কেউ বলে, বাঙালিদের রক্তের ঠিক নাই। তাই নাকি আমাদের চরিত্রের আগা—মাথা নাই। তবু আমি বড় গলায় বলছি, আমরা ভাষার জন্য একদিন পতঙ্গের মতো প্রাণ দিয়েছি। স্বাধীনতার জন্য আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তহোলি মানব ইতিহাসে সব চেয়ে বড় বিস্ময়। বাঙালরা শুধু চোর—ডাকাত—লম্পট না, জাত প্রেমিকও। এই ডিজিটাল যামানার কসমোপলিটন সিটিতে একটু মন খারাপ হলেই, আজো আমরা বিষাদমাখা গলা ছেড়ে দেই, একবার যেতে দে মা আমার ছোটগাঁয়…।
ও…ও…প্রত্যাশা, তুমি মনে রেখো, একদিন বাঙালরা নিশ্চয়ই তাদের সমস্ত হীনতা—ক্ষুদ্রতার চোরাবালি ডিঙিয়ে, তোমাদের পাহাড়ের মতো অটল ভঙ্গিতে দাঁড়াবে। সেই আনাগত দিনের বিশ্বাস থেকে বলছি, মন খাইছে—টাইছে দিয়ে আমার হৃদয় পাবে না। তুমি শুধু বাংলায় একবার বলো, তোমাকে ভালোবাসি…।